তুমি বললে আজ – পর্ব ২৮

0
576

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৮.

.
প্রায় আধা ঘন্টা সময় নিয়ে তাসফি নামক এই বজ্জাত ছেলেটাকে নিয়ে চললো তাদের আড্ডা টা। তারপর হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কথায় কথায় আমার প্রসঙ্গ উঠে আসলো। রিমি আপু আমার কথা বলতেই সবাই তাসফি ভাইয়ার দিকে বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকালো। আমি সাথে সাথে মাথাটা সরিয়ে ওনার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলাম। এতক্ষণ ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে ওদের বকবকানি শুলেও ক্যামেরার সামনে যাই নি। আমাকে যেন কেউ দেখতে না পায় সেভাবেই বসে ছিলাম। কারণ এই বজ্জাতের দলকে কোন মতোই বিশ্বাস নেই, আমার আর তাসফিকে এত কাছাকাছি দেখে কখন কি বলে উঠবে তার কোন ঠিক নেই।

আমাকে হুট করে সরে আসতে দেখে আমার দিকে তাকালেন উনি। ওনার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে কত বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছি। তবে ওনাকে পাত্তা দিলাম না আমি। ঘুমানোর ভান করে শুয়ে পরতে নিতেই রাহাতের হাসি হাসি গলা ভেসে উঠলো।

“তা তোমার পেতনী বউ কই তাসফি ভাই? ইস্ আফসোস হয় তোমার জন্য, শেষে কি না এই শাঁকচুন্নি-টাই তোমার কপালো জুটলো। মনের মতো ভাবী আনতে পারলা না।”

সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো রাহাতের আফসোসের সুরে বলা কথাটা শুনে। আর এদিকে রাগে কটমট করে উঠলাম আমি। ওনার কোলের উপরে থেকে ল্যাপটপটা আমার সামনে রেখে রাগ নিয়ে বলে উঠলাম,

“ওও ওই শয়তান, আমার পিছনে না লাগলে তোর পেটের ভাত হজম হয় না?”

“তুই আবার কই থেকে আসলি? আমরা তো ভাবীর কথা বলছিলা, তোর এত লাগছে কেন? তাসফি ভাই…. তাসফি ভাই, এই শাঁকচুন্নি তোমার বাসায় কি করে?”

“শালা হারামি… তোকে যদি কাছে পেতাম না এক্কে বারে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।”

“উফ্ রাহাত ভাইয়া তুমি থামো তো, আমাকে বলতে দাও। ওই ছেমরি, তাসফি ভাইয়া কে দেখে তো দশ হাত দূরে পালাতি, আর এখন তো দেখি ভাইয়া কে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছিস।”

রাহাত কে চুপ করিয়ে দিয়ে ফুপাতো বোন রিমা বললো কথাটা। রিমার কথায় সবাই আবারও হাসতে লাগলো। এর মাঝে রাহাতের ডাক শুনে তাসফি ভাইয়া আমার কাছে এসে পাশ ঘেঁষে বসেও গেছেন। তাদের হাসিটা বজায় রেখেই ফুপাতো ভাই সাহিল ভাইয়া বললো,

“এই থাম তোরা থাম, আমার বোনটাকে তোরা বেলুন ফোলা ফোলাচ্ছিস কেন? দেখছিস না বহুত ফুলে গেছে, যে কোন সময় বিস্ফরণ হতে পারে।”

“মাঝ রাতে আমাকে নিয়ে কি শুরু করলা তোমরা? তোমাদের সব কয়েক টাকে দেখে নিবে আ….”

এবার রাগ টাকে কন্ট্রোল করতে না পেরে খানিকটা চিৎকার করেই বলতে লাগলাম। তবুও তাদের অসহ্যকর হাসিটা শেষ হচ্ছে না করোর মুখ থেকেই।এত কথার মাঝেও তাসফি ভাইয়া চুপচাপ শুনছে আর ঠোঁট চেপে হেঁসে যাচ্ছে। আমার কথাটা শেষ হবার আগেই রিমি আপু সবাইকে চুপ করিয়ে দিতে বলে উঠলো,

“উফ্ থাম তো সবাই। ওর পিছনে লাগছিস কেন সবাই? তাসফি ভাই তুমিও চুপ করে আছো? ধমক দিতে পারবো না এই বজ্জাত গুলোরে?”

এবার মুখ খুললেন তাসফি মহাশয়। বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,

“এইতো বলছি, এই তোরা আমার বউটাকে তোদের বোন পেয়েছিস নাকি? ভাবী হয় তোদের ভাবী।”

আবারও এক দফা হাসির রোল পরে গেল। আমি কটমট চোখে তাকালাম ওনার দিকে। অভিনয় করে কথা বলতে দেখে সকলের প্রতি সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো ওনার উপর।

“নাটক করছেন কেন? আপনি তো….”

“আয় হায়, কি ভালোবাসা!”

আমার কথার মাঝে-ই রিফা বলে উঠলো। সবাই চুপ হয়ে গেলেও মিটিমিটি হাসতে লাগলো। রিফাপু আবারও বলে উঠলো,

“তুমি খুব বেইমানি করলেও তাসফি ভাই। বউকে পেয়ে এই নিষ্পাপ নিষ্পাপ ভাই বোনদের কি করে ভুলে যেতে পারলে? আগে তো খুব মনে পড়তো, তার খবর নেবার জন্য, আর এখন? তাসফি ভাই তুমি আ….”

কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল রিফাপুর, সেই সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই। রিফাপুর কথা বলার মাঝেই ভেসে এসেছিলো একটাই কথা, ‘আজ তো দেখি খুব খুশি’। সাথে সাথেই আমি ‘আহ্…’ করে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। হঠাৎ এমন ঘটনার জন্য কেউ হয়তো প্রস্তুত ছিলো না। হঠাৎ করে এসে সাকিল ভাইয়া যে রিমি আপুকে চুমু দিবে সেটা অপরিকল্পিত ছিলো সবার কাছে।
আমি লজ্জায় চিৎকার করে করে উঠে দূত ল্যাপটপটা সরিয়ে দিয়ে উঠতে লাগলাম। তাড়াহুড়ায় সরে আসতে নিলে খেয়ালও করলাম না যে খাটের কোনায় বসে ছিলাম এতক্ষণ। হুট করে উঠতে গিয়ে কারোর সাথে পা লেগে পড়তে লাগলাম, ঠিক তখনই সাথে সাথেই দু’হাতে আঁটকে জড়িয়ে ধরলেন তাসফি ভাইয়া। ধমকে উঠলেন,

“ইডিয়েট! এত লাফালাফি করা লাগে কেন?”

ভয়ে আমার হার্ট যায় যায় অবস্থা। ফ্লোরে পরে গেলে নিশ্চিত মাথা ফাটতো। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয়েে পেয়ে আমিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি ওনাকে।

“রাহাত, ভাই রে আমার। এবার আমারও বিয়ে করতেই হবে। তুইও করে ফেল, রিফা, রিমা তোরাও কর। চারদিকে রোমান্স আর রোমান্স।”

প্রায় আধা মিনিট পর সাহিল ভাইয়ার গলা শুনে চমকে গেলাম। রিমি আপুর জন্য শেষমেশ আমাকেও লজ্জায় পরতে হলো এদের সামনে। আমি সরে আসতে চাইলেও আমাকে আঁটকে রাখলেন তাসফি। আমি লজ্জায় অস্তিতে তাকাতে পারলাম না ল্যাপটপের দিকে। উনি হালকা চিৎকার করে বললেন,

“ফাজিল গুলো, যা ঘুমিয়ে পর।”

তারপরই ল্যাপটপ বন্ধ করার শব্দ হলো। আমি ছটফট করতে লাগলেও উনি কেন জানি ছাড়লেন না আমায়। সেভাবেই বুকের সাথে আঁটকে নিয়ে ল্যাপটপটা টেবিলের উপর রাখতে নিলেন হয়তো। ওনার ঠোঁট-টা আমার বা গাল ছুঁয়ে কান ছুঁয়ে গেল, কেঁপে উঠলাম কিছুটা। ল্যাপটপ রাখতে কিছুটা ঝুঁকে গেলেন উনি, যার ফলে ওনার হাত দিয়ে পিছন থেকে আমার কোমর জড়িয়ে রাখায় ব্যাথাও পেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় অস্পষ্ট সুরে অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসলো,

“উফ্ তাসফি ছাড়ো না…. লাগছে তো।”

স্থির হয়ে গেলেন উনি। নড়াচড়া বন্ধ করে সেভাবেই থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর অদ্ভুত গলায় বললেন,
“বউ…!”

“হু…”

“কি বললা?”

থমকে গেলাম আমি, কেঁপে উঠলাম আবারও। এতক্ষণে টনক নড়লো যেন। কি বলছিলাম সেই খেয়ালও ছিলো না আমার। মনে হচ্ছে কোন একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম। কি বলে ফেললাম এটা আমি, আর কিভাবেই বা বললাম? এখন ওনার সামনে থাকবো কিভাবে আমি? সরে আসতে চাইলাম কিন্তু কিন্তু এক চুলও পারলাম না। মনে হলো আগে চাইতেও আরও বেশি শক্ত করে ধরেছেন আমায়। আস্তে করে বললাম ছেড়ে দিতে, উনিও সেভাবেই বেঁধে রাখলেন আমাকে। আবারও দু’বার বললাম কিন্তু উনি কিছুই শুনতে পেলেন না মনে হয়।
হঠাৎ করে আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বিছানায় আঁটকে ধরলেন। ঝুঁকে এসে কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“কি বললা? আরেকবার বলো, আমাকে পাগল বানিয়ে যেতে চাইলে তো যেতে পারবা না।”

শিউরে উঠলাম আমি। ভয় লজ্জা একসাথে নিয়ে কাঁপা গলায় বললাম,
“ছা…ছাড়েন না, আর বব্..বলবো না। ভুল হয়ে গেছে।”

“উহুম! তখন যেটা বলেছো সেটা বলো। তারপর ভেবে দেখবো।”

“ভুল করে বলে ফেলছি, ছ..ছাড়েন না…”

“একদম না, আগে বলো।”

এবার হাল ছেড়ে দিলাম আমি। এই ছেলেটার সাথে কখনোই পেরে উঠবো না সেটা খুব ভালো ভাবেই জানি। তবুও এতক্ষণ বৃথা চেষ্টা করছিলাম। এতক্ষণে গলা শুকিয়ে কাঠ-কাঠ হয়ে উঠেছে। শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
“তত্..তাস্..ফি ছা..ছাড়ো….”

উনি সময় নিলেন না, সাথে সাথেই ঘের লাগা বলে উঠলেন,
“ভালোবাসো… আমায়?”

শিউরে উঠলাম আবারও। অজান্তেই ওনার ঘাড়ের কাছের টি-শার্ট চেপে ধরলাম, জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম। তাসফি মাথা উঠিয়ে হালকা হাসলেন।

“আমি কিন্তু আমার উত্তরটা পেয়ে গেছি রুপু। তোমার জামাই-টা কিন্তু তেমার মতো মাথামোটা না”

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে আমার নাকের সাথে নাক ঘষে বলে উঠলেন। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলাম আমি। আমার লজ্জাটাকে শতগুণে বাড়িয়ে দিতে উনি আবারও ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“তুমি বললে আজ দুজনে ভালোবাসার এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো। তোমায় ভিজিয়ে দিবো আমার ভালোবাসার বৃষ্টিতে। হারিয়ে যাবো দুজন দুজনার ভালোবাসা বাসিতে।”

.
সকালের গভীর ঘুমটা ভেঙে যেতেই তিরতির করে জ্বালা করে উঠলো পুরো শরীর। অনুভব করলাম নিজের উপর কারোর অস্তিত্ব, সাথে সাথে বুঝেও গেলাম ঠিক কি হতে পারে। মাথাটা কিঞ্চিৎ ভার এবং প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে শরীরের সাথে সাথে। আস্তে করে ওনাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বললাম ছেড়ে দিতে। উনি আঁটকে রাখার চেষ্টা করলেন না। ছেড়ে দিতেই আমি আস্তে করে উঠে বসলাম, ওনার দিকে একবার তাকিয়ে চাদরের আড়ালে নিজেকে আবৃত করে নামতে লাগলাম। পা দু’টো ফ্লোরে রাখে ভর দিতেই নড়ে গেল পুরো শরীর। অস্পষ্ট সুরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো মুখ থেকে। তাসফি সাথে সাথে বিছানা ছেড়ে উঠে আমায় জিজ্ঞেস করলেন ‘কি হয়েছে?’ আমি মাথা নাড়িয়ে ‘কিছু না’ বলে উঠার চেষ্টা করতেই আবারও একই অবস্থা হলো। সাথে মাথার চিনচিন ব্যাথাটাও হতে লাগলো। উনি বুঝে গেলেন এবার আমার অবস্থাটা। কথা ব্যায় না করে বিছানা ছেড়ে নেমে আমার সামনে দাঁড়ালেন। হুট করে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠলেন,

“গাধী কোথাকার, ঝগড়া করবার সময় খুব মুখ চলে, নিজের সমস্যার কথা বলার সময় মুখটা বন্ধ থাকে কেন?”

.
প্লেটে এক গাদা খাবার নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছি। আর আমার পাশেই রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন তাসফি ভাইয়া। তার চোখের একটাই ভাষা, সবগুলো খাবার শেষ করে তবেই উঠতে পারবো তার আগে নয়। মুখ ফুলিয়ে ইনোসেন্ট ভাব নিলেও কোন কাজ হচ্ছে না। কিন্তু উনি তো আর বুঝতে পারছেন না, আর দু’বার খাবারটা মুখে দিলেই আগের খাবারও বেরিয়ে আসবে। আবারও না বলতেই এবার ধমকে উঠলেন উনি। চোখ মুখ খিঁচে নিলাম আমি, নির্দয় মানুষ একটা।

সকালে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আবারও ঘুমিয়ে গেছিলাম সারারাত না ঘুমানোর ফলে। তাতে শরীরের ব্যাথাটা কিছুটা কমে গেলেও পুরোপুরি কমে নি, সাথে মাথার ব্যাথাটাও। ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর পর জেগে উঠলেও উনি খাবার কথা বললেন। প্রচন্ড খুদা লাগলেও খেতে ইচ্ছে করলো না, তবুও মাথা নাড়ালাম। সাথে সাথে উনি কোলে নিয়ে নিচে এসে ডাইনিং রুমে বসিয়ে দিলেন। কয়েকবার জোর পূর্বক খেলেও আর গলা দিয়ে নামতে চাইলো না।
কিন্তু ওনার ধমক শুনে অনিচ্ছার সত্বেও দু’বার মুখে দিলাম। সাথে সাথে গাঁ গুলিয়ে আসলো। কোন ভাবে চেয়ারটা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনের কাছে গেলাম। গড়গড় করে বেরিয়ে আসলো পেটে থাকা সমস্ত খাবার টুকু। তাসফি বুঝতে পেরেই উঠে এসে ঝাপটে ধরলো আমায়। উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘কি হয়েছে?’ জবাব দিতে পারলাম না আমি। বমি করার পর দূর্বলতা, শরীর ব্যাথা, মাথা ব্যাথায় কিছুটা নিস্তেজ হয়ে হেলে পড়লাম ওনার বুকে। উনি পানি দিয়ে পুরো মুখ মুছে দিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় শুয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর গ্লাসে পানি এসে মুখের সামনে ধরে খেতে বললেন। খাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম সেটা স্যালাইনের পানি ছিলো, তাই বিনাবাক্যে পুরোটাই শেষ করলাম।

.
.
(চলবে…..)

ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, আর ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here