মন পাথরে হঠাৎ ঝড় – পর্ব 22

0
272

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২২
Tahrim Muntahana
অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। এখন যে দুপুর টিকটিক শব্দ করা যান্ত্রিক ঘড়ি নামক বস্তটা না থাকলে হয়তো বুঝাই যেতো না। ভোর সকালের প্রকৃতির রণমূর্তি রূপের রেষ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। আকাশ কালো মেঘকে আপন করে নিয়ে ঠাই দিয়েছে তার বুকে। কিছুক্ষণ পরপর ঝিরঝির বৃষ্টিতে রাস্তা আরো পিচ্ছিল করে দিচ্ছে। পরিবেশ টা সবার কাছে মনোমুগ্ধকর না হলেও দুটি প্রেমিকযুগলের কাছে অত‍্যন্ত মনোরম দৃশ‍্য ! যে দৃশ‍্যের মুগ্ধতা তাদের চোখে বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে দুজোড়া চোখ হাসছে।
রাতে ঘুম না হওয়ায় ঠান্ডা এই পরিবেশে গরম কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আদর। দুদিন তারা এখানেই থাকবে; হৃদানের আদেশ! বউয়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে বলে হৃদান প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেছে আতইয়াব। এই নিয়ে হাসির পাত্র হয়েছে সে। কিন্তু তার কি এসবে এখন লজ্জা আছে? সে তো এখন অষ্টাদশী প্রেমিকের মতো প্রেম কুড়াতে ব‍্যস্ত। প্রেমিকদের লজ্জা রাখতে নেই! আদর হু হা কিছুই করেনি। তার যে আনন্দ হচ্ছে না, তা না। ভালোবাসার মানুষটার কাছাকাছি সবাই থাকতে চায়। আদর ব‍্যতিক্রম নয়! শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিবে ঠিক তখনি আরামের ব‍্যাঘাত ঘটিয়ে ফোন টিংটিং শব্দ করে বেজে উঠে। বিরক্তিতে কপাল কুচকে আসে তার। এই সময়েই ফোনটা বাজতে হলো। অপর পাশের ফোনের মালিকের উপর বেজায় রাগ নিয়ে ধুম করে বিছানা থেকে নেমে ফোনের কাছে গিয়ে দাড়ালো। ফোনের উপর জ্বলজ্বল করছে ‘আমার ক‍্যাবলাব্রিটিশ’ নামটি। কপালের ভাজ গাঢ় হলো। একই বাড়িতে থেকে ফোন দেওয়ার কারণ আদর বুঝলো না। কিছু হলো না তো? ভেবেই ঝটপট ফোনটা রিসিব করে কানে ধরলো। হৃদান অপর পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
তিনমিনিট সময় মেইন গেটের কাছে আসো। এর একটু দেরী হলেই হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতো নরম ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটকে জড়িয়ে ধরতে বাধ‍্য হবে! দোষ কিন্তু আমার না, তোমার ঠোঁটের! আদর টা মিস না করতে চাইলে ১২:৪৬ শেষ হওয়ার পরেই এসো!
ধড়াস করে উঠলো হৃদপিন্ড। কান দিয়ে যেন উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। হৃদপিন্ডটা টিপটিপ করে না দ্রুত বেগে স্পন্দন দিচ্ছে। এভাবে কেউ বলে? ছি অশ্লীল! মনে মনে কথাটি বলে কিছু বলতে নিবে ঠুস করে ফোনটা কেটে দিলো হৃদান। ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো আদর। তিনমিনিট সময়ের কথা মনে হতেই ফোনটা নিয়ে দৌড় ছুটলো সে। ইতিমধ‍্যে নিজের ভাবনাতেই একমিনিট কাটিয়ে দিয়েছে । পড়নে তারিমের একটা ফ্রক। দৌড়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাটুর উপর ফ্রকের নিম্নাংশ বাড়ি খাচ্ছে। চুল গুলো কাঠি দিয়ে খোঁপা করা বলেই হয়তো রক্ষা। নাহলে দৌড়ের জন‍্য একটার সাথে আরেকটা জট পেঁকে যেতো। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজায় এসে একটু থামলো সে। হাত ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেলো মাত্র ২৪ সেকেন্ড আছে। আত্মা কেঁপে উঠলো আদরের। কোনোদিক না তাকিয়ে ভো দৌড় দিলো। মেইন গেটে চোখ যেতেই দেখতে পেলো ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা খুলে এক পা বাহিরে রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে ফোন টিপছে হৃদান। দৌড় থামালো একদম হৃদানের সামনে এসে। এখনো চার সেকেন্ড সময় অবশিষ্ট রয়েছে। হাসি ফুটে উঠলো আদরের ঠোঁটে। সে তো কল্পনা করেই নিয়েছে হৃদানের ওত কাছাকাছি থেকে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হৃদান তাও ছাড়ছে না তাকে। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে! আর ভাবতে পারলো না আদর। খপ করে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো হৃদান। চমকে উঠলো সে। ভয় পেয়ে গেছে! জোরে নিশ্বাস নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো পাশের মানুষটির দিকে। হৃদান বাঁকা হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদরের ভয় হলো। চুমু টুমু দিয়ে বসবে নাতো! মাঝখানে হালকা দুরত্ব।হৃদানের মনে হয় দুরত্বটা পছন্দ হলো না। নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আদরকে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি ঝুলিয়ে আদরের দিকে ঝুঁকে বলল,
বাহ! আন্ডাবাচ্চা দেখি খুব ফাস্ট! এবারের যাত্রায় বেঁচে গেলে। এরপরের সুযোগ মিস করবো না। চিকন রসালো ঠোঁটটা একদম লুফে নিবো।
আদর বিচলিত হলেও পরক্ষণেই হৃদানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি দেখে চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো তার। ফিচেল হাসলো সে। এবার ভড়কে গেলো হৃদান। সে আদরের ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখার জন‍্য এমন করছিলো। মেয়ে পাগল হলো নাকি! হৃদান কে আরো একটু ভড়কে দিতে নিজের অবস্থান থেকে উঠে একদম হৃদানের কোলে বসে পড়লো আদর। হৃদান একদম শক্ত হয়ে গেলো। এই মেয়ে আশেপাশে থাকলেই নিজেকে পাগল পাগল লাগে; এতটা কাছে, দুটো শরীরের মধ‍্যে কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই, দুজন দুজনার নিশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পাচ্ছে, হৃদান ঠিক থাকতে পারে? নিষিদ্ধ ইচ্ছারা যেন মাথায় কিলবিল করছে। একটু গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার জন‍্য মনটা আঁকুবাঁকু করছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথা। হৃদানের বিচলিত বিষ্ময়কর চাহনী দেখে আদর শব্দ করে হেসে উঠলো। হৃদান দুচোখ ভরে দেখলো প্রাণোচ্ছল হাসিটা, কান পেতে গভীর ভাবে উপভোগ করলো হাসির কলকল ধ্বনিটা! আহ হৃদয় যেন থমকে গেছে। প্রশান্তিতে ভরে গেলো বুক। কারো হাসিও এখন হৃদান চৌধুরী বুকে শান্তি দেয়! মিষ্টি হাসলো হৃদান। আদর ততক্ষণে হৃদানের কোল থেকে নেমে নিজের জায়গায় বসেছে। ভ্রু নাচিয়ে হৃদানকে বুঝালো কেমন দিলাম। হৃদান হালকা শব্দ করে হাসলো। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
হৃদান চৌধুরীর অর্ধাঙ্গীনী তো তার মতোই হওয়া চাই! যে হৃদান চৌধুরীকে টক্কর দিতে পারবে। সমান তালে ঘরে ও বাইরে দাপটের সাথে চলতে পারবে। নিজের সুদৃঢ় অবস্থান টা বজায় রেখে হয়ে উঠবে অনন‍্য। আমি নিজের জন‍্য পার্ফেক্ট আদর কে চাইনা, বাচ্চা বাচ্চা বোকা অতিরিক্ত কথা বলা আদরকেই আমার লাগবে; কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় আমি পার্ফেক্ট আদর আহমেদ কে চাই। যাকে ভাঙতে পারবে না কেউ! শত কষ্টের মাঝেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না অন‍্যের কাছে। তোমার দুর্বলতায় তুমি আমাকে হারাতে পারো! কারণ তুমি আমার দুর্বলতা আদর। যাকে হারানোর ভয় আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়, যার একটু কষ্টে আমার হৃদয় জ্বলে, পুড়ে একদম খাক হয়ে যাই। যদি তুমি দুর্বল হও; শত্ররা হৃদান চৌধুরীকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাতে বেশী সময় ও ব‍্যয় করবে না। তোমার মাঝেই হৃদান চৌধুরী প্রাণ নিহিত। পাথর হৃদয়ে যে ঝড় তুলেছো ; সেই ঝড়ের সমাপ্তি তোমাতেই!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রুতিগুলো শ্রবণ করলো আদর। হৃদানের কথার মানে বুঝতে তার একটুও সময় লাগেনি। মানুষটা তাকে সামনের জন‍্য স্ট্রং করতে চায়ছে; সে ঢের বুঝতে পারছে। সে কি দুর্বল? মন কথাটা এক ফিকেই সরিয়ে দিলো। নাহ সে দুর্বল নয়। বরং আগের থেকে এখন নিজেকে শক্তিশালী মনে হচ্ছে। হৃদানের হাতের উপর হাত রেখে আশ্বস্ত সুরে বলে উঠলো,
আমি দুর্বল নয়। যারা আমার সরলতা কে দুর্বলতা ভেবে ভুল করে তাদের জন‍্য আমি সরল ই থাকতে চাই। যখন তাদের শেষ সময়টা আসবে তখন ঠিক আদর আহমেদের হিংস্র রূপটা দেখতে পাবে। কিন্তু বেশীক্ষণ নয়! যে একবার আদর আহমেদের হিংস্র রূপ দেখবে তার পৃথিবীর বুকে নিশ্বাস ফেলার সময় যে বড্ড কম হবে!
হৃদানের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। সে মানুষ চিনতে ভুল করেনি। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আদর জানালায় হাত রেখে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে প্রকৃতির স্নিগ্ধতার সাক্ষী হচ্ছে। যার দরুন তার চোখে মুখেও মুগ্ধতা বিরাজ করছে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে তৃপ্ততার সহিত অবলোকন করছে হৃদান। দুজনের চোখেই মুগ্ধতা; একজন প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আরেকজন প্রেয়সীর মুগ্ধতায় ঘেরা মুখশ্রী দেখে মুগ্ধ!
বাগানের ঠিক মাঝখানে কৃষ্ণচূড়া গাছটি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। পাশেই রঙ বেরঙের ফুল গাছ। বাগানের কিছু অংশ ঘেরাও করে রেখেছে। তার ঠিক মাঝখানটাই একটি দোলনা। অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো দোলনায় কিছু তাজা ফুল। আহা কি সুন্দর। দোলনায় দোল খাচ্ছে তারিম। ভাবনায় অনেককিছু। চারপাশ চোখ বুলাতেই তারিমের নজরে এলো আশেপাশের দৃশ‍্য। মিষ্টি হাসলো সে। ঠিক যেমনটা তার পছন্দ ; তেমন ভাবেই হৃদান জায়গা টা সাজিয়েছে। কিছুদিন আগে হারিয়ে গেলো সে,
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে বাগানে গিয়েই চোখে পড়ে দোলনাটি যা আগে ছিলো না। খুশিতে মন নেচে উঠে। কোনো দিক না তাকিয়েই দোল খেতে থাকে সে। ভালোভাবে চারপাশ খেয়াল করলে হয়তো দেখতো একজন মায়া মায়া চোখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দোল খাওয়ার পর তার হঠাৎ করেই মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। এই বিষয়টা মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু প্রখর। পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে হৃদান কে। যে গাছের সাথে হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তারিমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এগিয়ে আসে হৃদান। একপাশে সরে বসার জায়গা করে দেয় তারিম। হৃদান বসে। মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠে,
তুমি খুশি তো হৃদু?
তারিম অবাক হয়ে তাকায়। হৃদান মুচকি হাসে। একহাত দিয়ে তারিম কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
আমি তোমার একমাত্র ভাইয়া হৃদু। আমার সেই পুতুল বোন তুমি।‍ যার একটা আবদার ও আমি কখনো ফেলি নি। তুচ্ছ কথাটাও মাথায় রেখে দিতাম।সেই ছোট্ট পুতুলটার দোলনা পছন্দ আর আমি সেই ইচ্ছেটা পূরণ করবো না?
তারিমের চোখ ছলছল করে উঠলো। বহুদিন পর কেউ এভাবে তার আবদার পূরণ করছে। যদিও তার দুই বেস্টু তার সব আবদার ই পূরণ করে কিন্তু তাদের টা তো আলাদা। তারিম বুঝলো সার্ভেন্ট কে দোলনার কথা জিজ্ঞেস করার সময় তার ভাই শুনে নিয়েছে। হৃদানের বুকে মাথা রাখলো তারিম। যত্ন সহকারে আগলে নিলো হৃদান। তার তো এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সেই পুতুল বোন টা যে হারিয়ে গিয়েছিলো সে এখন তার বুকে! উপর ওয়ালা তাকে এত বড় প্রাপ্তি দিয়েছে! হৃদান হেসে বলে উঠলো,
তোমার সকল আবদার কিন্তু আমাতেই হৃদু। সেই ছোট বেলার মতো সব আবদার আমাকেই করবে। এখন দেখোতো চারপাশটা পছন্দ হয়েছে?
তারিম চারপাশটা ভালোভাবে দেখতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। গোলাকৃতি করে চারপাশে ফুল গাছ লাগিয়েছে। ঠিক মাঝখানটাই দোলনা। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করে দেখলো হৃদানের প‍্যান্টে মাটি লেগে আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
তোমার শরীরে মাটি কেন ভাইয়া?
হৃদান হাসতে হাসতে বলল,
এই সবগুলো ফুল গাছ আমি রোপন করেছি হৃদু। খুব যত্ন করে! আমার পুতুল বোনের পছন্দের কাজ অন‍্যকেউ করবে কেন?
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তারিম। আহা সুখ! কখনো সে ভেবেছিলো তার নিজের ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে দোলনায় দোল খেতে পারবে! আজ তাই সম্ভব হচ্ছে। হৃদান তো তাকে নিজ হাতে খেতেই দেয় না। যতক্ষণ বাসায় থাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। একটু পর পর দেখে যায় কি করছে। প্রত‍্যেকদিন বাহির থেকে এটা ওটা নিয়ে আসে।‍ যেন সে ছোট বাচ্চা!
দোলনায় কেউ বসতেই তারিম নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে এলো আতইয়াব কে। বিরক্তি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। তারিমের মুখের হাসি চওড়া হলো। আতইয়াব ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,
কার ভাবনায় বসে থাকিস? কখন থেকে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছিস না। খবরদার কাউকে নিয়ে কল্পনা সাজাস না; তোর কল্পনা সহ বাস্তবেও কাট কাট করে দিবো!
তারিমের মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। আবেগি কন্ঠে বলে উঠলো,
জানেন এখানে আগে দোলনা ছিলো না। ফুল গাছ গুলোও ছিলো না।
তো?
আতইয়াবের কন্ঠে বিরক্ত। তারিম মনক্ষুণ্ন হলো না। তার মনটা আজ খুব ভালো। আবার বলে উঠলো,
এই দোলনা সহ চারপাশের ফুল গাছগুলো নিয়ে সুন্দর পরিবেশটা আমার ভাইয়া নিজের হাতে করেছে। প্রত‍্যেকদিন সকালে এসে ফুলগাছ গুলো দেখে যায়। নিজ হাতে যত্ন নেয়। শুধুমাত্র আমার জন‍্য! আপনার আর আদরের ভালোবাসা দেখে আমার খুব মনে হতো, নিজের একটা ভাই থাকলে আমাকে ঠিক এভাবেই আদর করতো! শাসন করতো! ভালোবাসতো! সব আবদার মুখ ফুটে বলার সাথে সাথেই পূরণ করতো! দেখেন উপর ওয়ালার লীলা; নিজের ভাইয়াকে ফিরে পেলাম আমি। নিজের আপনজন পেলাম। মুখ ফুটে বলার আগেই সব আবদার পূরণ হয়। পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ আমি! যার হৃদান চৌধুরীর মতো একটা ভাই আছে, আপনার মতো একজন স্বামী আছে, বোনের মতো দুজন বেস্টু আছে! খুব সুখী আমি। খুব খুব!
চোখ থেকে আনন্দঅশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। আতইয়াব চারপাশটা একপলক দেখে মুগ্ধ হলেন। হৃদান চৌধুরী নামক মানুষটা খারাপ না সে জানে; শুধু উপরের হিংস্র খোলসটার জন‍্য সবাই ভুল বুঝতো! তারিমের মাথাটা নিজের প্রশস্ত বুকে চেপে ধরলো। তারিম এই বুকটার অপেক্ষায় ছিলো যেন। আকড়ে ধরলো পিঠ! পেছন থেকে হাসির শব্দ আসতেই তারিম ছিটকে দূরে সরে গেলো। রোহানি সুবাহ ওদের দেখে হাসছে। আতইয়াব বিরক্ত হলো। বউয়ের সাথে একটু একান্তে প্রেম ও করতে পারবে না নাকি! এখন থেকে ঘরেই সব আদর পুষে নিতে হবে। বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে নিবে রোহানি বলে উঠলো,
হৃদান জিজু আমাদের যেতে বলেছে ভাইয়া। গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ফালাহ ভাইয়া আর পান্চু ভাইয়া!
আতইয়াবের মনে পড়ে গেলো সকালে বলা হৃদানের কথাটা। ঝিম মেরে গেলো মাথা। এখন কি তাকেও এসবের সাক্ষী হতে হবে! হাটা ধরলো গেটের দিকে। ওরা তিনজন ও পিছে পিছে যেতে লাগলো। ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছে না কিসের জন‍্য যাচ্ছে তারা!
শুনশান রাস্তায় গাড়ি রেখে বসে আছে হৃদান-আদর। অপেক্ষা আতইয়াবদের! গ্রামের কাঁচা রাস্তা শুরুর মাথায় গাড়ি রাখা। বর্তমানে হৃদান রা অবস্থান করছে আনন্দমহল গ্রামের শেষপ্রান্তে। হৃদানের মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর। আদর সাহস ই পাচ্ছে না কথা বলার। চুপ করেও থাকতে পারছে না। নিরব পরিবেশে নিরব সে থাকতে পারে না। দুপুর গড়িয়ে এখনো বিকেল হয়নি। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। জানালা খুলতে দেয়নি হৃদান। কাঁচের উপর বৃষ্টি ফোঁটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে আদর। হৃদান তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে, কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই জানে না সে! জানার ইচ্ছেও নেই। হৃদান তাকে জাহান্নামে নিয়ে গেলেও সে প্রস্তুত। ভালোবাসে তো! তবুও ভাবনা থেকেই যায়! আদরের উুসখুস হৃদান বুঝতে পারলো। আদরের গা ঘেসে বসতেই আদরের মাঝে কম্পন টের পেলো সে। হাসলো! কারো স্পর্শে এতটা কম্পন হয়! হয়তো হয়; যদি স্পর্শটা ভালোবাসার মানুষটার হয়। হৃদানের ও এমন নিরাবতা পছন্দ হলো না। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
আমার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার দেখছি। হালকা স্পর্শেই যেহারে কাঁপতে থাকো তুমি ; বাসর ঘরে কাঁপতে কাঁপতে তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। না হবে আদরকে আদর, না আসবে আন্ডুবাচ্চা! আমি কিন্তু মুটেও সাধুসন্নাসী না। বিয়ের পর একদম ছাড় নেই। খেয়ে দেয়ে শক্তি বাড়াও শরীরে। জড়িয়ে ধরলেই তো খুঁজে পাওয়া যাবে না; রোমান্স তো অনেক দূর। হাইরে কপাল আমার!
হতাশার শ্বাস ফেললো হৃদান। হৃদানের কথায় আদরের বুকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাটা স্বভাবের লোকটা কি জানে তার এসব কথায় তার বুকে ঝড় হয়, হৃদয় অত‍্যাধিক কাঁপতে থাকে, কান গরম হয়ে যায়! অস্পষ্ট স্বরে আদর বলে উঠলো,
অসভ‍্য ক‍্যাবলাব্রিটিশ!
হৃদানের কানে পৌঁছালো। শব্দবিহীন হাসলো! পাশে থাকা রমনীর মুখে অসভ‍্য ডাকটাও যেন অত্যন্ত মিষ্টি শুনাচ্ছে। কি প্রেমে পড়লো হৃদান চৌধুরী; গালিও মধু মধু লাগে!
আতইয়াবদের গাড়ি দেখেই হৃদান আর কথা বাড়ালো না। ছুটে চলল গ্রামের পথ ধরে; পেছনে ফেলে সারি সারি গাছ, বিশাল এরিয়া জুড়ে ধান ক্ষেত, শাক-সবজি ক্ষেত; আহা কি দৃশ‍্য। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। হৃদানের গাড়ি অনুসরন করে ছুটে চললো পেছনের গাড়ি। মাঝখানে বাঁক নিলো হৃদান। পনেরো মিনিট যেতেই চোখে পড়লো দুতালা বিশাল এক বাড়ি। যার গেটের উপর জ্বলজ্বল করছে ‘চৌধুরী মঞ্জিল’ নামটি! কারোর আর বুঝতে বাকি রইলো না তারা এখন হৃদান দের জমিদার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাটা ধরলো হৃদান। গেট খুলে দিলো দারোয়ান। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশাল বাগান। কিন্তু বাগানটাকে আদও বাগান বলা যায়! ফুল গাছ গুলো মরে শুকিয়ে গেছে। যত্ন নেয় না হয়তো। হৃদান সরাসরি সদর দরজায় চলে গেলো। ঠকঠক শব্দ করার মিনিট এক পরেই দরজা টা খুলে গেলো। হা হয়ে রইলো অপর প্রান্তের মানুষটি!
চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here