মধ্যবিত্ত – Part 25

0
153

#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_২৫
#নুসরাত_রিতু
রাত তখন এগারোটার একটু বেশি। রিমিকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে সন্ধ্যার দিকে। মাগরিব পরে তারা রওয়ানা করেছিলো।
আয়শা রহমান সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বিয়েও হয়েছিলো বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারে। সাদের বাবার মৃত্যুর পর তাকে অনেক দুরবস্থার স্বীকার হতে হলেও তার বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে সব কিছু মোকাবিলা করেছে সে। ঘরের বউ হিসেবেও সে বুদ্ধিমতি কেউকে আশা করছে। প্রথম দেখায় রিমিকে তার কাছে চতুর না হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মনে হয়েছে। কিন্তু বাসায় তুলতেই তিনি রিমির থেকে আশাহত হয়েছেন। তাই কঠিন মুখ করে বসে আছে সে রিমির সামনে।
সন্ধ্যার ঘটনা।
রিমিকে ঘরে তুলে আয়শা রহমান এর কক্ষে বসিয়ে সে অন্যান্য অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য রান্না ঘরে গিয়েছিলেন। রিমিদের বাসায় গুটিকয়েক লোক গিয়ে মেয়ে নিয়ে আসলেও এই বাড়ি লোকজনে গিজগিজ করছে। তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না রিমিকে আগলে রাখা। সাদও তখন অন্যদের নিয়ে ব্যাস্ত।
কিছুক্ষণ পর রিমির জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে তিনি রুমে ঢুকে দেখেন রিমি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছেন আর তার পাশে বসেই সাদের এক দুঃসম্পর্কের খালা রিমিকে কথা শুনচ্ছে।
খালা বলছিলেন, “এমন বিয়া আমি জীবনে দেখিনাই। আয়শার ঢং এর শেষ নাই। মাইয়ার না আছে কোন ঢক আর না আছে টাকা পয়শা কি দেখে এই মাইয়ারে আয়শা ঘরের বউ করছে কেঠায় জানে! গায়ে এক ভরি স্বর্ন পর্যন্ত নাই। ফ্রিজ, টিভি কিচ্ছু দেয়নায়। এয়া কোন ছোটলোকের ঘরের মাইয়া আনছে আয়শা!”
সাদের আরেক ফুপু বলে উঠলেন, “আপনারা আয়শারে বিয়া দেওনের সময় কি দিছিলেন? হুদা হাতে মাইয়া তো আপনারাও পাঠাইছেন। ছোটলোক তো তাইলে আপনারাও। যদিও ঐ কথা এখন আর মনে করে লাভ নাই। আমাগো ভাইই বাইচ্চা নাই। তয় আপনার এই কথার লগে আমি একমত যে এমন ছোটলোকি বিয়া আমি খুব কমই দেখছি।
না দিছে জিনিসপত্র, না দিছে গহনা গাটি আর না খাওয়াইছে পাঁচজন লোক। আবার এমনই চালাকের চালাক শুনছি একই দিনে একই খরচে পোলারেও বিয়া করাইছে।”
খালা: দেখেন গিয়া পোলায় কোন আকাম কুকাম করছে। এজন্যই তো এতো তাড়াতাড়ি বউ ঘরে তুলছে। মাইয়া বিদায় দেওয়া পর্যন্ত তর সয় নায় বেডাগো।
রিমির দিকে তাকিয়ে ফুপু বললেন, “তা তোমার ভাবি আবার পোয়াতি না ত? তোমাগো যুগের মাইয়া পোলাগো তো কোন বিশ্বাস নাই। তোমারো কোন জায়গায় লাইন আছিলো নি?”
এই পর্যায় রিমি হুহু করে কেঁদে উঠেছে। আয়শা বেগমও আড়াল থেকে বেড়িয়ে কড়া চোখে রিমির দিলে তাকালো। তারপর খাবারের ট্রে টা রিমির সামনে দিয়ে বললো, ” সত্যি বলেছেন আপা এই যুগের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের তুলনা হয় না। এই যে আমার বউমাকেই ধরেন না। আজ পর্যন্ত কোন পর পুরুষ ওর চেহারা দেখেনি। আর আমাদেরকেই দেখেন না শাড়ি পরে বুক পিঠ কোমর বের করে ঘুরে বেড়াই। ”
সাদের ফুপু স্পষ্ট বুঝতে পারলো খোচাটা তাকেই দিয়েছেন আয়য়শা রহমান। কারন এখানে শুধু সেই শাড়ি পরে আছেন।
এবার বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর আপা তুমিও ঠিক বলছো। বউমার বাপের বাড়ির লোক সত্যি ছোটোলোক যে বউ এর সাথে কিছু দেয় নায়। এবার ভাব যারা যৌতুক চায় তারা কতোটা ছোটলোক। বউয়ের বাপ ভাই যদি ছোটলোক হয়ও তারা কিন্তু আমাদের চেয়ে ভালো। কারন তারা সেটাই করেছে যেটা নবীর সুন্নত। যেই বিয়েতে খরচ যতো কম সেই বিয়েতে রহমত তত বেশি। আর আমদের দিকেই তাকাও না আমরা এতোটাই পিশাচ যে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিয়মে চলা ব্যাক্তিকে ছোটলোক বলছি। ভাবো আমরা কতোটা ছোট লোক।”
খালা: তুই কিন্তু আমারে অপমান করতেছো আয়শা।
আয়শা: তুমি গায়ে কেনো টেনে নিচ্ছো আপা? আমিতো তোমাকে কিছু বলিনি।
আসলে তোমার রিমির থেকে শেখা উচিত এই যে কতক্ষণ ধরে তোমরা ওকে উল্টো পাল্টা বলছো দেখো ও কি সুন্দর মুখে তালা দিয়ে বসে আছে।
আমাকে যদি কেউ এমন কথা বলতো তাহলে এতোক্ষণে আমি তাকে ঘার ধরে বাসা থেকে বের করে দিতাম। কারন কবুল বলার সাথে সাথে এই বাসা তো রিমিরও তাইনা? আর রিমির বাসায় বসে পান চিবুতে চিবুতে কেউ রিমিকেই অপমান করবে এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
রিমির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কাঁদা বন্ধ করে খেয়ে নেও। আরো অনেকে দেখতে আসা বাকি। এরপর ওজু করে নামাজ পরে নিবে আটটার দিকে পার্লারের লোক আসবে।”
অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সবাই আসেন একটু নাস্তা করে নিন। রিমিও একটু একা বিশ্রাম নিক।”
ঘটনা সেখানেই শেষ হলে পারতো কিন্তু না। সেখানেই সব শেষ হয়নি। শাশুড়ীর কথা মতো কান্না বন্ধ করে হালকা নাস্তা করে নিয়েছিলো রিমি। অন্যরাও রুম থেকে বিদায় নিয়েছিলে তৎক্ষণাৎ। নামাজ শেষ করে উঠে দেখে পার্লারের লোক চলে এসেছে। হালকার মধ্যে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন তারা রিমিকে।
দশটার দিকেও প্রতিবেশীদের অনেকে আসাযাওয়া করছিলো। নতুন বউ হওয়ায় সবার সাথেই সাধ্য মতো হেসে হেসে কথা বলছিলো রিমি। এমন সময় এক প্রতিবেশী তার পনেরো ষোলো বছরের ছেলেকে নিয়ে হুট করেই ঢুকে পরে আয়শা বেগমের রুমে। স্বাভাবিক ভাবেই রিমি তখন পর্দায় ছিলো না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র জোরে বা যেখাবেই হোক তৎক্ষনাৎ বিষয়টা বুঝতে পেরে রিমি বিছানায় পরে থাকা কাথায় নিজেকে আবৃত করে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে ছেলেটি রিমিকে দেখার আগেই রিমি নিজেকে লুকাতে সক্ষম হয়।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পরে রিমি কেঁদে দেয়। পুনরায় কিছু কঠিন কথা শুনতে হয় তাকে। মহিলা রিমিকে ন্যাকা, ঢং করে, পর্দায় থেকে শয়তানি করে এমন অনেক কথা বলে রুম থেকে বিদায় নেয়।
আয়শা রহমান তখন ঘটনাস্থলে না থাকায় সে এসবের কিছুই জানতো না। কিন্তু একটু আগে যখন সবাইকে তিনি খাবার দিচ্ছিলেন তখন সেই ফুপু বললেন, “তুমি তো বললা বউ নাকি কারো সাথে দেখা করে না। কিন্তু চারতলার ভাবির ছোট ছেলেটার সাথে তো ঠিকই দেখা করলো। আমি নিজের চোখে দেখছি ছেলেটারে নিয়ে ভাবি ঘরে ঢুকছে আবার কিছুক্ষণ পর বের হইছে। আমার কথা তো শোনো না একসময় ঠিকই বুঝবা এই বউ কেমন। সবই উপর উপর নাটক ছাড়া আর কিছুই না।”
আয়শা রহমান কোন উত্তর না দেয়ায় মহিলা আর কথা বাড়াতে পারেনি। আগামীকাল সাদের ওয়ালিমা তাই অনেক আত্মীয়রাই আজ চলে এসেছেন। তাদের সামনে আর জল ঘোলা করতে চায়নি আয়শা রহমান ।
কিন্তু সবাইকে খাওয়ানো শেষে তিনি যখন রিমির কাছে এসে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন তখন রিমি পুনরায় কেঁদে ভাসিয়েছে। বার কয়েক কান্নার ফলে মুখের মেকাপ বিকৃত রুপ ধারন করেছে। সব মিলিয়ে আয়শা রহমান রিমির উপর প্রচন্ড রেগে গেলেন।
বর্তমান:
আয়শা রহমান : তুমি আমাকে বলবে তো কি হয়েছিলো তখন। কথা না বলে কান্নার তো কোন কারন দেখছি না।
রিমি:……….. ( তখনও কেঁদে যাচ্ছে)
আয়শা রহমান : এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি রিমি। তুমি কি সত্যি দেখা দিয়েছে ঐ ছেলের সামনে?
রিমি এবার কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনা বর্ননা করলো।
সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়শা রহমান। এতোদিন বাবা মা ভাই আগলে রেখেছে রিমিকে তাই মুখের উপর জবাব দেয়া সে শেখেনি। এজন্য যে যা খুশি বলে যাচ্ছে মেয়েটাকে আর ও কোন জবাবই দিতে পারছে না।
আয়শা রহমান : কান্না বন্ধ করো। এই বিষয়ে আমি পরে তোমার সাথে কথা বলবো। সাদ এসে পরবে কিছুক্ষণ এর মধ্যেই।
তুমি হাতমুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার আনছি। আজ আমি নিজ হাতে তোমায় খায়িয়ে দিবো।
__________________________
রাহিকে কিছুক্ষণ আগেই রাফির রুমে বসিয়ে গেছে রাফির কাজিনরা। রেনু বেগম যত্নে কেন কমতি রাখে নি রাহির। রিমি যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন তিনি। তাই রাহিকে নিজেরই তখন দায়িত্ব নিয়ে তার হাত পায়ে তেল মালিশ করে দিতে হয়েছে। রিমির জন্য রাহিরও খুব মন খারাপ। এখন সুস্থ আছেন রেনু বেগম। রাফিদের বাসায় আজ খুব বেশি মেহমান নেই। অনেকে বিয়ের পর পরই চলে গেছে দু একজন কাছের মানুষ এখনো আছে। রাতের খাবার সবাই একসাথেই খেয়েছে। কোন গায়রে মাহরাম না থাকায় রাহিকেও সবার সাথে খেতে দিয়েছিলেন রেনু বেগম।
কিন্তু লজ্জা আর অস্বস্তিতে রাহি তেমন কিছুই খেতে পারেনি।
ইতিমধ্যে সে লেহেঙ্গা বদলে হালকা একটা গাউন পরে নিয়েছে। আজ পুরো দিন হিজাব নিকাবে থাকতে হয়েছে তাকে। তাই মাথা ব্যাথায় সে এখন কাতর হয়ে আছে। রেনু বেগমের থেকে নিয়ে একটা মাথা ব্যাথার ঔষধ খেয়ে নিয়েছে সে রাতের খাবার খাওয়ার পরই।
এখন সে অপেক্ষা করছে রাফির জন্য। তাকে এমনই উপদেশ দিয়ে গিয়েছে সবাই। কিন্তু ক্লান্ত শরীর তার ঘুমে ঢুলঢুল করছে।
রাফি যখন রুমে ঢুকলো তখন রাত বারোটার বেশি হবে। সংকোচ এ সে অনেক সময় ছাদে বসে ছিলো। পরে ভাবলো এমন ভাবে একা একা ভেবে লাভ নেই। রাহির সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলতে হবে তাকে। তার পর রুমে আসার সময় কাজিনরা আটকে রাখলো কতক্ষণ।
সব জায়গা থেকে ছাড়া পেয়ে রুমে এসে দেখে খাটের মাঝ বরাবর গুটিশুটি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে রাহি। পরনে তার হালকা গোলাপি রং এর একটা গাউন। মাথার হিজাবটা এখনো পেঁচানো কিন্তু পিন আটকানে না তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
রাফি ওজু করেই এসেছিলো। একাই দুই রাকাআত নামাজ পরে নিলো সে। এরপর রাহির গায়ে একটা কাথা দিয়ে লাইট অফ করে খাটের একপাশে শুয়ে পরলো।
এই দিনটা নিয়ে কতোশতো পরিকল্পনা ছিলো তার। রাহিরও হয়তো ছিলে। কিন্তু সবকিছু কিভাবে ঘটে গেলো। কিছুই স্বাভাবিক না, ঠিক তাদের সম্পর্কের মতো। এসব ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে সে ঘুমের সাগরে পারি জমালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here