#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#পর্ব_৫
আসলেই আমরা না জেনে বুঝে মানুষের সম্পর্কে কতো ভুল ধারনা করি।
রাহি সালাম জানিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলো। তারপর আগেরদিনের পড়া দেয়া নেয়ার পাট চুকানো শুরু হলো।
রাফি প্রথমে একটু অবাক হলো যে আগেরদিনের চঞ্চল মেয়েটার হঠাৎ কি হলো। পরে যদিও বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে সে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটার বেশি বাজলো রাফি। মা রেনু বেগমই দরজা খুলে দিলেন।
রেনু বেগম : তুমি আসছো বাপ। কতক্ষণ ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। যাও তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার দেই।
রাফি : তুৃমি এখনো জেগে আছো কেন মা? আচ্ছা আমি ৫ মিনিটে আসি।
৫ মিনিটের আগেই রাফি চলে এলো। এসে দেখে বাবা, রিমি, মা সবাই খাবার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করছে। হঠাৎই মনটা ভালো হয়ে গেলো তার। কে বলে সে অসুখী? আলহামদুলিল্লাহ সবই তো আছে তার। এতো ভালোবাসা কি সবার ভাগ্যে থাকে?
বাবার পেনশনের টাকা পাবে ২-১ দিনের মধ্যে। মাসকাবারির বাজারে দায়িত্ব রাফির তাই তাকে ফ্রি থাকতে বললেন বাবা জামান সাহেব। রাফিও মাথা নেড়ে হ্যা বললো। আরো টুকটাক কথায় তাদের খাওয়া শেষ হলো।
রুমে ফিরে আবার রাফিকে ঝেকে ধরলো একরাশ চিন্তা। মা-বাবার চোখে চিন্তা দেখতে পায় সে। মাঝে মাঝে নিজেকে ব্যার্থ মনে হয় যে কিছুই করতে পারে না সে তার পরিবারের জন্য। আবার ভাবে মুমিন তো কখনো হতাস হয় না। তবে কি সে মুমিন না?
_______________________________
এমন করেই ২ দিন কেটে গেলো। রাহি আবার আগের রুপে ফিরে এসেছে।
মাসকাবারি বাজার করতে বড় বাজার যাচ্ছিলো রাফি। হঠাৎই দেখে রাস্তার অপর পাশে রাহির মতো দেখতে কেউ। লং টপস, জিন্স, স্কার্ফ আর হাই পোনিটেলে খুব ছোট লাগছিলো রাহিকে রাফির কাছে। রাহি তখন একঝাক ছেলেমেয়ের সাথে রাস্তায় দাড়িয়ে গোলা জাতীয় কিছু খাচ্ছিলো। রাফিকে দেখে সে নিজেই এগিয়ে এলো।
রাহি: আসসালামুআলাইকুম স্যার। এখানে কি করেন আপনি?
রাফি : ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। এমনি একটু বাজারে এসেছি। তুমি এখানে কি করো? তোমার না এখন কোচিং-এ থাকার কথা?
রাহি: “যার যেখানে থাকার কথা সবসময় কি সে সেখানে থাকে?” একটু বিষন্ন স্বরে বললো কথাটা।
রাফি: মানে? ঠিক বুঝলাম না।
রাহি: অতশত বুঝে লাভ নেই। আপনি কোথায় যাচ্ছেন বলেনতো? আমিও যাবো আপনার সাথে।
রাফি: তুমি আমার সাথে গিয়ে কি করবে? আমিতো বাজার করতে যাচ্ছি।
রাহি: আমিও বাজার করতে যাবো। কখনো করা হয়নি, আজ আপনার থেকে শিখে নিবো।
রাফি একটু অপ্রস্তুত হলো। বড় বাজারের নির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকেই প্রতিমাসে বাজার করে রাফিরা। মাঝে মাঝে বাকিও নেয়। তাই সবাই খুব ভালোভাবেই চেনে তাকে। আজ হঠাৎ একটা মেয়ের সাথে দেখে কি না কি ভাবে তা নিয়েই চিন্তিত সে। কিন্তু রাহির চোখে চিন্তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে খুব উৎসাহী চোখে তাকিয়ে আছে রাফির দিকে। যেন এই মুহুর্তে বাজার করার থেকে সুন্দর কোন কাজ হতে পারে না। ওর উৎসাহ ভাটা দিতে ইচ্ছে করলো না রাফি। তাই মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা চলো”
রাহির চোখে একটা খুশির ঝলক খেলে গেলো।
মিনিটখানেক চুপচাপই হাটলো তারা। কিন্তু চুপ থাকা রাহির কর্ম না তাই সে উৎসাহী গলায় বললো,
” স্যার আপনার হাতে ওটা কি?”
রাফি: বাজারের ব্যাগ
রাহি: আমিতো বাজারের ব্যাগ আনিনি। স্কুল ব্যাগে তো আর বাজার নেয়া যায় না। আপনি আপনার ব্যাগটা আমায় দিন।
রাফি: আমার ব্যাগ তোমায় দিলে আমি বাজার নিবো কিসে করে?
রাহি: সে আমি কি জানি
রাফি: সামনের দোকান থেকে একটা ব্যাগ কিনে নিও তাহলেই হবে। অথবা বাজার করার সময় কিনো। ওখানে অনেক ব্যাগ পাওয়া যায়।
রাহি: আচ্ছা।
আর একটু হেটেই ওরা বড় বাজার পৌছে গেলো। রাহির কাছে বিষয়টা নতুন। দুপুরবেলার কাঠফাটা রোদ তারউপর মানুষ গিজগিজ করছে। মনে হচ্ছে গরমে ওর হিট স্ট্রোক হয়ে যাবে। তবুও একটুও দমলো না সে। রাফিকে যা যা কিনতে দেখলো সে নিজেও তাই তাই কিনলো। কিন্তু সমস্যা বাধলো ওতো কিছু বয়ে হাটতে পারছে না সে।
একটু করুন চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে বললো, “হাটতে পারছি না স্যার। হাত দুটো ছিড়ে গেলো”
রাফি নিজেকেই ধিক্কার দিলো। এটা তার আগেই খেয়াল করা উচিৎ ছিলো। কিন্তু কি আর করার নিজের হাতেও অনেক ব্যাগ ছিলো। পরে কি ভেবে বললো, “আচ্ছা তুমি এখানে দাড়াও আমি আসছি।”
রাহি: না আমিও বাজার করবো। আর আপনি এতোগুলা মানুষের মধ্যে আমায় রেখে চলে যাচ্ছেন স্যার?
রাফি: না না। আমি দূরে কোথাও যাচ্ছি না। ব্যাগগুলো পরিচিত দোকানে রেখে বাকি বাজার করবো। সত্যি এতো ভারি ব্যাগ নিয়ে হাটা কষ্টকর।
রাহি মুচকি হেসে বললো, ” ওকে স্যার। তাড়াতাড়ি আসবেন। ”
রাহি এক এক করে ব্যাগ গুলো নিয়ে একটা দোকানে রেখে এলো। এখন শুধু টুকটাক সবজি কিনবে। মাছের বাজারে রাহিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা বলেই মনে হলো তার। কারন গরমে উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারা ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এতেও যেন সৌন্দর্য কমেনি তার। খুব সাধারন একটা মেয়ে রাহি। কিন্তু তারপরও রাফির ইদানীং তাকে অসাধারণ লাগে।
দুজনে মিলে বাজার শেষ করে আবার আগের দোকানে এসে মালামাল বুঝে নিলো। রাফি দোকানীকে ধন্যবাদ দিতে ভুললো না।
এবার বিপত্তি বাজলো অন্য জায়গায়। রাহি এতোকিছু নিয়ে যাবে কিভাবে? রাফি রাহিকে রিকশা করে দিতে চাইলো। কিন্তু রাহি রাজি না। সে রাফির সাথেই যাবে। বাধ্য হয়েই একটা রিকশা নিলো তারা। মালামাল রেখে যেন একজনের বসার জায়গা হচ্ছে না। তবুও দুজন কোনমতে চেপে বসলো তাতে।
রাফি: চলেন মামা। সাবধানে চালাবেন তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।
রিকশা চলতে শুরু করলো। হালকা বাতাসে রাহির বেরিয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে। রাফি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো কয়েক সেকেন্ড লাল লাল চেহারা নাকের ডগায় ঘাম কামড়ে রাখা ঠোঁট আর উৎসাহী সাথে ক্লান্ত দুটো চোখ। সম্বিত ফিরে পেতেই চোখ সড়িয়ে নিলো রাফি।
রাহি: আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। আমি খুব মজা পেয়েছি বাজার করে। এরপর থেকে আমরা একসাথে বাজার করবো ঠিকআছে?
রাফি: কেন? তোমার বাসায় অন্যকেউ নেই বাজার করার জন্য?
রাহি: আছেতো স্যার কিন্তু আমি আপনার সাথে বাজার করেই মজা পেয়েছি। কি সুন্দর দামাদামি করেন আপনি।
আজ রাহি সাথে ছিলো তাই একটু কমই দামাদামি করেছিলো রাফি। যে কয় পয়শা বাঁচবে তাও অনেক।
রাফি: আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন তুমি এটা বলো যে কোচিং এর সময় তুমি রাস্তায় কি করছিলে?
রাহি: কোচিং ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে হাটতে বেড়িয়েলাম।
রাফি: তাহলে আমার সাথে যখন এলে কেউকে তো বলে আসলা না। ওরা চিন্তা করবে না?
রাহি: আমি এমনিও কেউকে বলে কয়ে কিছু করিনা স্যার। ওরা কিছুই মনে করেনি।
রাফি: ওহ
চুপ করে গেলো দুজনেই। কি বলবে কারোই মাথায় আসছে না। রাহি রাফির ব্যাক্তিত্বে অবাক হলো। ছেলে বন্ধুর অভাব নেই তার। সবাই যেন অপেক্ষা করে কখন একটু গায়ে ছোয়া দিবে। কিন্তু রাফি একদম এক কোনায় সরে আছে। আর রাহি আরামসে বসে আছে তবুও মাঝে একটু ফাঁকা আছে। রাহির মনে হচ্ছে রিকশায় একটু ঝাকি লাগলেই রাফি টুপ করে নিচে পরে যাবে। আনমনেই হেসে ফেললো সে।
রাফি: কি বেপার একা একাই হাসছো: তার টার ছিলে গেলো না তো? আমাকেও বলো আমিও হাসি।
রাহি: আমার তার আগে থেকেই ছেড়া নতুন আর কি ছিড়বে।
রাফি হাসলো। একটু সময় থেমে রাহি বললো, “আমার কোন ছোয়াছে রোগ নেই স্যার”
কথাটার মানে রাফিকে বুঝিয়ে দিতে হলো না। সে মুচকি হাসলো কিন্তু জায়গা থেকে একচুল সরলো না। রাহি: আরে মিঞা এদিকে আগান তো। আপনি নিজে পরবেন পরে পাবলিক আমারে দোষ দিবে।
রাফি: পড়বো না। রিকশায় চড়ে অভ্যাস আছে আমার।
রাহি: “কেন কতোজনের সাথে এমন করে রিকশায় চেপেছেন স্যার” কথাটা বলেই একটা চোখ মারলো রাহি।
রাফি একটু কেশে উঠে বললো, ” না মানে তা না। রিকশায় চেপে অভ্যাস আছে বুঝাতে চেয়েছি”
এবার রাহি জোরে হেসে দিলো। তারপর দুজনেই চুপচাপ। আর কোন কথা হলো না।।
রাহির বাসার সামনে যখন রিকশা থামলো তখন আবার আরেক ঝামেলা এতো জিনিস নিয়ে রাহি একা যাবে কিভাবে।
এমন সময় দারোয়ান এসে হাজির হলো তাদের সামনে।
দারোয়ান : রাহি আফা আমনে বাজার করছেন কিল্লিগা? আমারে কইলে তো আমিই করতাম। আর এই কেডা? আমনের সার না?
রাহি: আমার বাজার করতে ভালো লাগে চাচা। এখন থেকে আমিই বাজার করবো। আপনি একটু জিনিসগুলো উপরে নিতে সাহায্য করেন।
দারোয়ান বড় বড় বোঝা গুলো নিয়ে চলে গেলো। থাকলো শুধু ছোট একটা ব্যাগ আর সবজি। রাহি বললো সে নিজেই ওগুলো নিতে পারবে।
রাহি: আচ্ছা স্যার এবার যাই। রাতে দেখা হবে।
রাফি: হুম ইনশাআল্লাহ
রাহি: স্যার শোনেন!
রাফি: হ্যা বলো
রাহি: আপনি তখন লজ্জা পেয়ে যে টমেটোর মতো হয়ে গেলেননা সেটা দেখে কিন্তু আমি ছোট খাটো ক্রাশ খাইছি।
রাফি জোড়ে কেশে উঠলো। রাহিও হাসতে হাসতে চলে গেলো।
রিকশা পুনরায় চলতে শুরু করলো। এবার রাফি ঠিক করে বসলো। কিছুক্ষণ আগের সময়টার কথা মনে করে আনমনেই হাসলো সে।
রাহির মা সেলিনা চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। রাহি রোদে পুরে বাজার করেছে শুনলে ওর বাবা সেলিনা চৌধুরীকেই কথা শুনবে। দারোয়ানই তাকে জানালো যে বাজারগুলো রাহি করেছে।
রাহি এসে দেখে দারোয়ান বাজার রেখে গেছে আর সেলিনা চৌধুরী বসে আছে। রাহিকে আর তার হাতের বাজার দেখে সেলিনা চৌধুরী বললো, “তুই পাগল হয়ে গেছিস রাহি? এতো বাজার তোকে কে করতে বলছে? তোর বাবা শুনলে কি করবে তোর জানা নেই?”
রাহি: “আহ মা তুমিও না। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আরো খুশি হবে। তা না তুমি বকাবকি করছো। ” মুখটা মলিন করে বললো সে।
সেলিনা চৌধুরী : খুশি তো হয়েছিই কিন্তু এতো কষ্ট করতে তোকে কে বলেছে? তুই একা এতো বাজার কেন করেছিস?
রাহি রুমে যেতে যেতে বললো “একা করেছি কে বললো? রাফি স্যার সাথে ছিলো। যাই আমি শাওয়ার নিয়ে নেই খুব গরম লাগছে”
সেলিনা চৌধুরী অবাক হয়ে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।
চলবে……