গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 19+20

0
456

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনিশ+বিশ
নিজের বাবার আর খালা’কে উল্টো করে ফুটন্ত পানির উপর ঝুলিয়ে রেখেছে ফারদিন। ফাইজা পাশের চেয়ারে এখনো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ে চেয়ে সব’টা দেখছে। কাল পার্কে ঘুরে রাতে বাসায় কাছে নামিয়ে ফারদিন চলে যেতেই এক দল লোক ও’কে তুলে নিয়ে আসে এখানে। তারপর থেকে ওর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুললো তখন এই দুজন’কে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠলো। তার পাশেই ফারদিন চেয়ারে হেলান দিয়ে গান’টা কপালের সাথে ঠেঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সব পরিবেশ কিছু বুঝতে না পেরে ফাইজা চুপ করে বসে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছে। রেজওয়ান আর কাকনের হাত পা বাঁধা আর মুখে টেপ লাগানো বলে ওরা কোনো শব্দ করতে পারছেনা। ফারদিনের দুই পাশেই দুইজন গার্ড দাড়িয়ে আছে। ফারদিন কিছুক্ষন থম মে/রে বসে থেকে শান্ত হয়ে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফাইজার সামনে এগিয়ে এসে ওর দুই গালে হাত রাখলো। ওর হাতে গান’ থাকায় ফাইজা কিছু’টা ভয় পেলো। ফারদিন বুঝতে পেরে অভয় বানী দিয়ে বললো…..
–আর ইউ ও’কে জান? কোথায় লেগেছে? কোথায় কষ্ট দিয়েছে ওরা? বলো আমাকে?
ফারদিনের চিন্তিত স্বর শুনে ফাইজা একটা ঢোক গিয়ে ফারদিনের কপালে নিজের কপাল ঠেঁকিয়ে বলে উঠলো….
–আমি জানতাম আপনি থাকতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। দেখুন আমি একদম সুস্থ আছি। ঠিক আছি।
ফাইজার কথা শুনে ফারদিন একটু হেসে ওর কপালে আদুরে স্বরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। কাল যখন শুনেছিলো ফাইজা কিডন্যাপ হয়েছে তখন ওর মনে হচ্ছিলো কেউ ও’র গলা চে’পে ধরেছিলো। দম নিতে পারছিলোনা। এইসব কে করেছে সব জেনেও ফাইজা’কে খুঁজে পেতে পেতে সারা রাত কেটে গেলো। সকালে যখন এখানে এসেছিলো তখন ফাইজা সেন্সলেস অবস্থায় ছিলো। আর ফারদিনের লোকেরা কাকন আর রেজওয়ান’কে ফারদিনের কথামতো এইভাবে রেখে দিয়েছে৷ সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে যে রেজওয়ান আর কাকন কিছু বুঝেই উঠতে পারেনি। ফাইজা’র হাত পা দুটোর বাঁধন খুলে দিয়ে ও’কে একটু জড়িয়ে ধরে ঠিক ভাবে ওড়না’টা গায়ে প্যাঁচিয়ে দিলো। তারপর ওর লোক’দের ইশারা করতেই ওরা রেজওয়ান আর কাকন’কে নামিয়ে আনলো। ওদের দুজন’কে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাত পা বেধে দিলো। ফারদিন একটা চেয়ার টেনে ওদের মুখোমুখি বসে সামনের একটা টেবিলের উপর পা তুলে বসলো। গান’টা টেবিলের সাথে লাগিয়ে ধরে আছে। রেজওয়ান আর কাকন ওর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাঁকিয়ে আছে। ফারদিন ওদের দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠলো….
–কি ভেবেছিলেন? আমার প্রথম ভালোবাসা আমার মায়ের মতো আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা’টা ও কেড়ে নিবেন। আমাকে নিঃস্ব করে দিবেন। হাউ ফানি ম্যান…..
বলেই হাহা করে হেসে দিলো। ফাইজা প্রশ্নওর চোখে তাঁকিয়ে সব’টা দেখছে। ফারদিন একটু থেমে শান্ত স্বরে ফাইজার দিকে না তাঁকিয়েই বলতে লাগলো….
–আমি যখন সাত বছরের একটা বাচ্চা। তখন চোখের সামনে প্রতিদিন বাবা-মা’কে ঝগড়া করতে দেখতাম। প্রতিদিন রাতে ড্রিংকস করে বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে ঝগড়া করে মা’কে মা/রধর করা ছিলো বাবার নিত্যদিনের রুটিন। আমি দরজার আড়াল থেকে লুঁকিয়ে দেখতাম। আর চাপা আতৎনাদ করতাম। কি, বা বুঝতাম? শুধু মায়ের কান্না দেখে বুঝতাম মা খুব কষ্টে আছে। আমার মা সব’টা মেনেও কোনো শব্দ করতো না। বাবার অফিসের যত সুন্দরী মেয়ে ছিলো তাদের সবাই’কে টাকার লোভ দেখিয়ে বাবা বাড়ি নিয়ে এসে ভোগ করতো। তাও আমার মায়ের চোখের সামনে। মা’কে রুমের এক কোনে বেঁধে রেখে মায়ের সামনেই অন্য মেয়ে’র সাথে দিনের পর দিন রাত কাটিয়েছে এই লোক’টা। পাঁচ বছর থেকেই আমাকে একা অন্য রুমে কা’টাতে হতো। কত রাত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি হিসেব নেই। টাকা পয়সার অভাব ছিলোনা। বিশাল বাড়ি সম্পত্তি কিছুর অভাব ছিলোনা। অভাব ছিলো ভালোবাসা আর শান্তির। আর এইযে এই মহিলা’টা(কাকনের দিকে ইশারা করে) ইনি আমার আপন খালা। আমার মায়ের আপন রক্তের বোন। আমি শুনেছিলাম খালা হলো দ্বিতীয় মা। কিন্তু এই মহিলা’টার থেকে জঘন্য মহিলা আমি কোনোদিন দেখি’নি। যে নিজের আপন বোনের স্বামীর সাথে পরকিয়া করে গেছে দিনের পর দিন। অন্য মেয়ের সঙ্গ পেয়ে আমার বাবা আমার মা’কে যেই নির্যাতন করতো। সেগুলো দেখে ওই সাত বছরের বাচ্চা’টা আমি’র মনে আস্তে আস্তে মেয়েদের নিয়ে ক্ষোভ ঘৃনা জমতে শুরু করেছিলো। আমি প্রতিদিন আড়ালে লুঁকিয়ে মায়ের কান্না দেখতাম। মায়ের শরীরে আঘাতের ক্ষত গুলো আমার থেকে লুঁকিয়ে রাখার জন্য মা বড় বড় পোষাক পড়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক রাত মা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতো। আমি চেয়ে চেয়ে বোবার মতো মায়ের কান্না দেখতাম। বাবা নামক মানুষ’টার থেকে কোনো দিন আমি আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কিছু পাই’নি। বরং পেয়েছি অবহেলা। যেদিন মা জানলো তার বোন তার সংসার ভাঙ্গছে সেদিন মা বড় হয়েও ছোট বোনের পা জড়িয়ে নিজের স্বামী আর সংসার ভিক্ষা চেয়েছিলো। কিন্তু ওরা আমার মা’কে ভিক্ষা দেয়’নি। বাবার সাথে তর্ক করার সময় বাবা মা’কে বেল্ট দিয়ে আ’ঘাত করে র’ক্তা’ক্ত করেছিলো। মা তারপরের দুইদিন তীব্র জ্বর আর ব্যাথায় ছটফট করেছিলো কিন্তু জঘন্য লোক’টা ফিরেও তাঁকায়’নি।
বাড়ির কাজের আন্টি মা’কে ওষুধ দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যেতো। ওই কাজের আন্টি’টাকেও আমার বাবা ভোগ করেছে বহুবার। লোক লজ্জার ভয়ে সে কোনোদিন মুখ খুলতে পারে’নি। তার চোখে আমি অসহায়ত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম৷ নভেম্বরের ১২ তারিখ আমার জীবনে কাল রাত্রী হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি’নি। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আর এই মহিলা’টা ড্রিংকস করে একসাথে আমাদের বাড়ি ফিরেছিলো। রুমে যেতেই মা ওদের দেখে প্রতিবাদ করা শুরু করে। রেগে গিয়ে এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। আমি তখন ওই রুমের বেলকনি’তে বসে বসে খেলছিলাম। চেঁচামেচি শুনে দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি ওরা তিনজন কিছু নিয়ে চেঁচামেচি করছিলো। ওই টুকু আমি বুঝিনি এতসব কিছু। এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় মা/রায় বাবা রেগে মায়ের চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে জোরে বারি মা/রতেই মায়ের মাটা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। মা চিৎকার করে নিচে পড়ে যেতে’ই এই মহিলা’টা গিয়ে মা’কে একাধারে হিল জুতো দিয়ে লা/থি মা/রা শুরু করে। মা যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। দৃশ্য’টা সহ্য করতে না পেরে জোরে চেঁচিয়ে গিয়ে মাকে ঝাপটে ধরেছিলাম। কিন্তু ওরা আমার মায়ের থেকে আমাকে টেনে ছাড়িয়ে নিলো। বার বার কান্না করতে করতে বলছিলাম” বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে। মা’কে মে/রো না। মা ম/রে যাবে। বাবা মা/কে খালামনি মা/রছে কেনো? তুমি একটু থামাও? “কিন্তু না এই নির্দয় মানুষ দুটো আমার কথা শুনলো না। বাবা আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে নিয়ে আসার সময় মা আহত অবস্থায় বাবার পা জড়িয়ে ধরেছিলো। বাবা মা’কে সেই অবস্থায় লা/থি মে/রে দূরে সরিয়ে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অব্দি দেখলাম যে এই মহিলা মায়ের তল পেটে এমন ভাবে লা/থি মে/রেছে যে মা একটা চিৎকার করে শান্ত হয়ে গেলো। আর শব্দ পাইনি মায়ের। ছটফটানি থেমে গিয়েছিলো মায়ের। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছিলো “তোর মা আর বেঁচে নেই ফারদিন। চলে গেছে দূর আকাশের তারা হয়ে” বাবা আমার হাত ধরে টেনে পাশেফ রুমে এনে আমার হাত পা এমন’কি মুখ বেঁধে দরজা আটকে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সেদিন বদ্ধ ঘরে এক অসহায় মা আর তার ছেলের চিৎকার কেউ শুনে’নি। চলে গিয়েছিলো তখনি আমার মা আমাকে ছেড়ে বহু দূরে। আমার থেকে খুব জঘন্য ভাবে আমার মা’কে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মায়ের শেষ চিৎকার আমি এখনো শুনতে পাই……
বলেই ফারদিন হাটু ভেঙে ফাইজার সামনে বসে পড়লো। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা বইছে। কথা গুলো বলতে বলতেই ফারদিন ফাইজার সামনে এসেছিলো। এইটুকু বলেই আর বলতে পারলো না। হাটু ভেঙে ফাইজার বুকে মাথা রেখে জোরে কান্না করে উঠলো। ছেলেরা এমন করে কাঁদতে পারে বুঝি?
#চলবে
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বিশ
নিজের রক্তের বোন’কে কেউ এত’টা নির্মম ভাবে মা/রতে পারে ভাবতে পারছেনা ফাইজা। নিস্তব্দ হয়ে আছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে পানি। ফারদিন আজ নিজের ভেতরের জমানো কষ্ট গুলো চোখের জলে বিসর্জন দিচ্ছে। ফারদিন’কে স্বান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা বা শব্দ ওর জানা নেই। কি স্বান্তনা দিবে এই ছেলে’টাকে? যে ছেলে কিনা সাত বছর বয়সে নিজের মা’কে চোখের সামনে খু/ন হতে দেখেছে তাও নিজের বাবা আর আপন খালার হাতে। তাকে স্বান্তনা বা বুঝানোর মতো ভাষা আদৌ আছে কিনা ফাইজার জানতে ইচ্ছে করছে। তাহলে, অন্তত ছেলে’টাকে ওই ভাষায় স্বান্তনা বানী দিতে পারতো। ফারদিন ফাইজা’র বুকে মাথা রেখে শব্দ করেই ফুঁপিয়ে কাদঁছে। যে ছেলে’টাকে প্রথম দিন থেকে হাসি খুশি দেখেছে সেই ছেলে’টার ভেতর এতটা কষ্ট জমানো ছিলো কেউ বুঝতে পারে’নি। ফাইজার চোখ থেকে জল টপটপ করে পড়ছে। ফাইজা কাঁপা কাঁপা হাত’টা ফারদিনের পিঠে রাখতেই ফারদিন কান্না থামিয়ে দিলো। নিচের দিকে তাঁকিয়ে তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছে নিয়ে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে দাড়িয়ে পড়লো। চোখের জল টুকু লুকাতে একটু দূরে সরে গিয়ে পেছন ফিরে আবারো বলা শুরু করলো..
–সেদিন আমাকে আর আমার মৃত মা’কে ওইভাবে রেখে এই লোক’টা আর এই মহিলা দুজনেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। একটা সম্পূর্ণ রাত কাঁদতে কাঁদতে আর মুখ বাঁধা থাকায় আমি কখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম জানিনা। যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে দীদার পাশে আবিস্কার করি। দীদা কাঁদতে ছিলো আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই দীদা আরো কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই আমি কান্না শুরু করে দিয়ে দীদা’কে সব বলতে থাকি। তখন জানতে পারি। সকালে কাজের আন্টি এসে মা’কে মৃ’ত অবস্থায় মেঝে’তে পায় আর আমাকে অন্য রুমে সেন্সলেস অবস্থায় পায়। আর সেই সবাই’কে ডেকে এনে দীদা’কে খবর দেয়। আরো জানতে পারি সেদিনের পর আমার টানা ত্রিশ ঘন্টা সেন্স ছিলোনা। মা’কে যে মা’র্ডার করা হয়েছে তা মা’য়ের লা’শ দেখেই বুঝে গিয়েছিলো সবাই। দীদা আমার বাবা আর খালার বিষয় কিছু জানতো না। এমন’কি এটাও জানতো না যে বাবা মা’কে কত’টা অত্যা’চার করতো। তাই পুলিশ’কে খবর দেওয়া হয়। কাজের আন্টি সেদিন সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো বলেই সবাই আমার বাবা আর খালা’র আসল চেহারা জানতে পেরেছে। পুলিশ ওদের দুজন’কেই এরেস্ট করেছিলো কিন্তু ওই যে আমাদের দেশে এখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশিরভাগ দোষী ছাড়া পেয়ে যায়। সেদিন ও ঠিক এই জঘন্য মানুষ দুটো টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলো সবার। আমার দীদা একা লড়াই করে পেরে উঠে’নি ওদের সাথে। আর আমি সে তো সাত বছরের একটা বাচ্চা ছিলাম সে কিই বা করতে পারতো বলো তো? ওরা নিজেদের দোষ আড়াল করে দিয়ে দেশ ছেড়েই পালিয়ে গেলো। মা’য়েরা দুই বোন ছিলো। আমার মা’তী ছিলো মাটির মানুষ। যার হাসি’টা ছিলো মুগ্ধ করার মতো। জানো আমার মা চোখ ধাধানো সুন্দর ছিলো কিন্তু এই লোক’টা(রেজওয়ান) আমার মায়ের কদর করতে পারলো না। এই মহিলা(কাকন) ছোট থেকেই উৎশৃঙ্খল ছিলো তাই দীদা সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে আর মায়ের নামে করে দিয়েছিলো। আর অল্প কিছু দীদার নামে ছিলো। তাই রাগে, হিংসায় প্রতিশোধ তুলতে সে আমার মা’কেই কেড়ে নিলো। অপর দিকে এই লোক’টার(রেজওয়ান) বিশাল বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি ছিলো। আবার এই লোক’টার(রেজওয়ান) যে মেয়ের নেশায় পড়ে সব করতে পারে তা এই মহিলা(কাকন) খুব ভালো করে জানতো। তাইতো এই দিক’টাই কাজে লাগালো। দুজন বিয়ে করে নিলো৷ আর সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলো। তারপর কেটে যায় বিশ বছর। আস্তে আস্তে দীদার সাহায্যে সব ভুলে যেয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখলাম। দীদার হাত ধরে বড় হয়ে উঠলাম। কিন্তু ওইযে, চোখের সামনে সব মেয়েদের নোংরা চেহারা দেখে মেয়েদের প্রতি ঘৃনা আমার মনে যে রয়ে গিয়েছিলো সেটা কিছু’তেই ভুলতে পারি। যত বড় হচ্ছিলাম তত মেয়ে শব্দ’টাকে ঘৃনা করতে শুরু করেছিলাম। আমি তো চোখের সামনে যাদের দেখেছি তারা সবাই নোংরা মেয়ে ছিলো। তাহলে আমি কি বিশ্বাস করব বলো তো যে সব মেয়েরা এক না? সেই থেকে বাবা আর মেয়ে এই দুটো শব্দ যেনো আমার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠলো। জানো স্কুল কলেজ এমন’কি ভার্সিটি লাইফে আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিলোনা। মেয়েদের থেকে সব সময় দূরে থাকতাম। মেয়েদের দিকে কখনো ঘৃনার দৃষ্টি ছাড়া অন্য দৃষ্টি’তে তাঁকাই’নি। ভার্সিটি শেষ করে দীদার বিজন্যাসে জয়েন করলাম। আমি জয়েন হওয়ার পর একজন মেয়ে’কেও অফিসে রাখি’নি। সাত বছর থেকে যেই চাপা কষ্ট আর ঘৃনা একাকিত্ব নিয়ে আমি বড় হয়েছি তা যেনো কোনো মানুষ’কে ফেস করতে না হয়। সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র ভুলি’নি। মনের কোনে ঘৃনা প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলেছে প্রতি মুহূর্ত। ওদের অনেক খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাই’নি৷ পৃথিবী’টা তো আর ছোট না যে আমি চাইলেই সবাই’কে পেয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন ওরা দেশে ফিরলো তখন বুঝেছিলাম এ দেশে ফেরার একটাই কারন ওরা জানতে পেরেছে যে আমার দূর্বল’তা তুমি। আমার থেকে হয় তোমাকে কেড়ে নিবে নয় আমাকে মে/রে ফেলবে। দেখো তাই হলো প্রথমে আমাকে এক্সিডেন্ট করালো আমি ম’রে গিয়েও বেঁচে ফিরলাম তাই তোমাকে সরানোর কাজে নেমেছিলো। কিন্তু ওরা বোধহয় ভুলে গেছে সেদিনের সাত বছরের ছেলে’টা এখন আটাশ বছরে পা রাখবে কিছুদিন পর…..
বলেই হেসে দিলো ফারদিন। ফাইজা নির্বাক চাহনী’তে তাঁকিয়ে আছে। রেজওয়ান আর কাকনের চোখে ভয় দেখতে পারছে শুধু। কি আশ্চর্য এত কিছুর পর ও এই লোক দুটোর মনে একটু অনুতাপ হচ্ছে না। ঘৃনা হচ্ছে লোক দুটোর উপর। এতটা নিকৃষ্ট পিতা আর খালা যেনো কারোর না হয়। নিজের সন্তান’কে কেউ মে/রে ফেলতে চায়। ভাবতে পারলো না ফাইজা। ছুটে গিয়ে ফারদিন’কে ঝাপটে ধরে কেঁদে দিলো হাউমাউ করে। ফারদিন ও ফাইজা’কে বুকের সাথে চে’পে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। ফাইজার কান্না থামাতে ফাইজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর দুই গালে হাত রেখে চোখের পানি টুকু মুছিয়ে দিতে দিতে একটু জোরালো কন্ঠে বললো……
–কতদিন বলেছি কাঁদবে না। তাও কাঁদতে হবে তোমার অনেক দিন বুঝি থা’প্প’ড় পড়েনা। থা’প্প’ড় খে’তে ইচ্ছে করছে জান।
এইটুকু বলে ফাইজার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো…..
–নাকি চু’মু খেতে ইচ্ছে করছে জানননন……
এই পরিস্থিতিতে কেউ এমন কথা বলতে পারে তা ভাবতেই ফাইজা এক প্রকার ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। ছেলে’টা যে নিজের কষ্ট লুকাতে মজা করছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর চোখ দুটো দেখে৷ ফাইজা কোনো শব্দ না করে ফারদিনের দুই গালে আলতো করে হাত রাখলো। ফাইজার স্পর্শ পেতেই ফারদিন মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। ফাইজা ফারদিনের গালে হাত দিয়ে ওর চোখে চোখ রাখলো। ফারদিনের চোখের কোন’টা যে রক্তের মতো লাল হয়ে আছে তা স্পষ্ট দেখতে পেলো। চোখে পানি ও টলমল করছে কিন্তু মুখে হাসি। কোন ধাতু দিয়ে গড়া এই ছেলে’টা। এত কষ্ট এত বছর ধরে কি করে সহ্য করলো? ফাইজার টলমল চোখের চাহনী’তে ফারদিনের মুখের হাসি’টা মিলিয়ে যেতে লাগলো। বুকের ভেতরের হাহা’কারের শব্দ গুলো ভেসে আসচ্ছে। ফাইজা করুন স্বরে ফারদিনের চোখে চোখ রেখেই প্রশ্ন করে উঠলো…..
–এত বছর ধরে এই ভয়ংকর কষ্ট গুলো কি করে সহ্য করেছেন?
বলতে বলতেই ওদের দুজনের চোখ বেয়ে পানির ফোটা গড়িয়ে পড়লো। ফারদিন নিজেকে সামলে নিজের গালে থাকা ফাইজার হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললো….
–তিন বছর আগে এক গোধূলি লগ্নে তুমি এসে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিলে। মা’কে হারিয়ে অতীত ভুলে বেঁচে থাকতে শিখেছিলাম। কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকা’টা সম্ভব হয়ে উঠবে না……
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here