প্রনয়-পর্বঃ 4+5

0
658

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী 🍁
পর্ব- ৪+৫
বাবা নাস্তা দিয়েছি খেতে এসো…
আমির পত্রিকা পড়ছিলেন।সেঁজুতির কথায় চিল্লিয়ে বললেন,
‘আসছি আসছি,এই নিউজ টা পড়েই আসছি।
সেঁজুতিও পাল্টা চিল্লিয়ে বলল,
— নটা বেজে গিয়েছে বাবা,আমাকে ক্লাসে যেতে হবে,,তাড়াতাড়ি এসো।
আমির ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
— ওহ হ্যা হ্যা,,আসছি।
পাশেই নিউজ পেপার টা ভাজ করে রেখে দিলো আমির।টেবিলের কাছে আসতেই
হঠাৎ ডোরবেল বাজলো।আমির মেয়ের দিক তাকালেন।
‘কে এলো এখন?হোসাইন মনে হয়।
সেঁজুতি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো দরজা খুলতে।ওপাশে কালো পোশাক পরিহিত দুজন অচেনা লোক।পরিপাটি, ফরমাল পোশাক আশাক।সাথে বড় বড় গোফ দুজনের।একজনের হাতে মস্ত বড় ব্যাগ। সেঁজুতি লোক দুটোর আপাদমস্তক দেখলো।
তন্মধ্যে একজন বললেন,
— এটা কি মিস সেজুথির বাসা?
— জি,কিন্তু আপনারা?
— অভ্র স্যার আমাদের পাঠিয়েছেন,,আপনাকে এই টাকা গুলো দেয়ার জন্যে…
হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বললেন একজন।
সেঁজুতি চিনলোনা।একটু ভাবলো।বলল
— অভ্র টা আবার কে?আর আমাকেই বা টাকা কেনো দিতে যাবে?যেহেতু আমার নাম টা ঠিক বলেছেন সেহেতু আপনারা ভুল বাসায়ও আসেননি।,তবে এটা ঠিক কিসের টাকা?
অন্য লোকটি ব্যাস্ত ভঙিয়ে বললেন,
‘ম্যাম টাকা টা ধরুন,স্যার বলে দিয়েছেন একবার ওনার দেয়া টাকা আপনি রিজেক্ট করেছেন এবার আমরা যেন এই টাকা আপনাকে দিয়ে তবেই ফিরি…
এবার সেজুথির বোধগম্য হলো এরা ঠিক কার কথা বলছে, আর এটা ঠিক কিসের টাকা!
তাও সন্দেহ কাটাতে জিজ্ঞেস করলো,
‘কদিন আগে যার ভাই হাসপাতালে ছিলেন সেই কি আপনাদের স্যার?
লোক দুটি সমস্বরে বললেন’জ্বী!
সেঁজুতি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ ওওও এবার বুঝেছি।আমার রক্তের দাম দেয়া হচ্ছে তাইনা?আপনার স্যার এর তো দেখছি খুব সাহস! আমি যেখানে ওনার মুখের ওপর বলে এলাম আমি টাকা নিচ্ছিনা।সেখানে আবার উনি আমার বাড়ি অব্ধি আপনাদের পাঠিয়ে দিলো…?
অদ্ভুত তো!শুনুন, আপনার স্যার কে বলে দেবেন,,ফের যদি আমার বাড়ির আঙিনায় উনি বা ওনার কোনও পাঠানো লোক কে দেখতে পাই আমি,তবে ঠ্যাং ভেঙে একেবারে হাতে ধরিয়ে দেবো…
বুঝেছেন?
ধমক খেয়ে বোকা বনে গেলেন দুজন। হতভম্ব হয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন,
— জ্বি জ্বি বুঝতে পেরেছি..
সেঁজুতি তুষ্ট হাসলো,
ভেরী গুড,,তো দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?নাস্তা বেড়েছি খাবেন??
লোক দুটো চোখ কপালে তুলে বললেন,
— জ্বি?? না.. না…
— তবে আর কি,আসুন।
দিরুক্তি না করে লোক দুটোর মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো সেঁজুতি।
___
প্রায় অনেক দিন পর ভার্সিটিতে এলো সেঁজুতি। ভার্সিটিতে ঢুকতেই সেঁজুতির ওপর এক প্রকার হামলে পরলো তোহা।মেয়েটা এতিম।দেখতে মারাত্মক।তবে খ্রিস্টান।এতিমখানায় মানুষ হওয়ার পর খুব ছোটবেলায় এক খ্রিস্টান পরিবার দত্তক নিয়েছে ওকে। সেখানেই মেয়ের আদরে মানুষ। সেঁজুতির একমাত্র বন্ধুই তোহা। তোহা দৌড়ে এসে হন্তদন্ত, উত্তেজিত হয়ে বলল,
— সেজুথি! কোথায় ছিলি তুই,,চারদিন ধরে না ফোন করিস আর না ধরিস… ভার্সিটিও আসিস নি।
সেঁজুতি পা ঝুলিয়ে বসলো বাদাম গাছের নিচে পাতানো বেঞ্চে।পাশে তোহাও বসলো।
— বাবার শরীর একটু বেশিই খারাপ ছিলো তো, তাই ব্যাস্ত ছিলাম বাবাকে নিয়ে।তোর কী খবর? পড়াশোনা চলছে ঠিকঠাক?
– তা চলছে।কিন্তু কেমন আছেন আংকেল এখন?তুই আমাকে একবার জানালিওনা!
—আরে তেমন কিছু হলেতো বলতাম পাগলী।এখন ভালো আছে।
— আচ্ছা এই নে
ব্যাগ থেকে কিছু নোটস বের করে সেঁজুতির ব্যাগের ওপর রাখলো তোহা।বলল,
এগুলো গত চার দিনে যা ক্লাস হয়েছে তার নোটস
তার আগের ক্লাস তো করেছিলি তাই ওগুলো নোট করিনি…
সেঁজুতি বিস্মিত কন্ঠে বলল,

— আমিতো এখনও তোর কাছে চাই-
ইনি..
আর তুই বুঝে গেলি?
তোহা হেসে বলল,
— না বোঝার কি আছে,?,বেস্ট ফ্রেন্ড কি এমনি এমনি হয়েছি নাকি!আর তাছাড়া এত ভালো স্টুডেন্ট তুই,সামান্য কারনে রেজাল্ট খারাপ হবে এটা আমি হতে দেবো?
খুশিতে কেঁদে ফেলল সেঁজুতি। নিঃশব্দে।ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা তার জন্যে নয়।
আনন্দে তোহা কে জড়িয়ে ধরলো এক হাতে।মেয়েটা বড্ড ভালো কেন?
______
ভার্সিটি বাসা থেকে বেশ কাছেই।হেটে হেটেই যাতায়াত করে সেজুথি।এতে ভাড়ার টাকাও বেঁচে যায় তার। আজও হেটে আসছিলো ফুটপাত ধরে।রাস্তার এক পাশে ময়লার স্তুপ করে রাখা।গন্ধ নাকে আসতেই সেঁজুতি ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। হঠাৎ চোখ পরলো সেদিক টায়।বাচ্চা একটা মেয়ে।পড়নে ময়লা ছেড়ে জামাকাপড়,মাথার চুল এলোমেলো,কোকড়ানো।
একটা কুকুর পলিথিনে মোড়ানো কিছু খাবার চেটে খাচ্ছিলো।,বাচ্চা মেয়েটা দৌড়ে গিয়েই কুকুর টাকে তাড়ালো।এরপর পলিথিন টা হাতে উঠিয়ে অর্ধ খাওয়া এক পিস পরোটা পেলো। একটু ছিড়ে মুখে দিতে যাবে ওমনি ওর হাত খপ করে ধরে আটকালো সেজুতি।মেয়েটি বোকা বোকা চাউনিতে তাকালো। সেঁজুতি মেয়েটির হাত ঝাকিয়ে ফেলে দিলো খাবারটুকু।মেয়েটি প্রচন্ড কষ্ট পেলো বোধ হয়। সেঁজুতি অধৈর্য হয়ে বলল,
একি করছো বাবু?? এটাতে কুকুর টা মুখ দিয়েছে.. এটা কেনো খাচ্ছো তুমি?
মেয়েটি মুখ কালো করে বলল
আমার খুউব খিদা লাগছে। কাইল রাত থেইকা কিচ্ছু খাইনাই।
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল
— এই টুকু বাচ্চা,, কাল রাত থেকে না খেয়ে আছো?তোমার বাবা মা কোথায়?
— বাপজান নাই।মায় কইছে হেয় নতুন মা নিয়া চইলা গেছে।
সেজুথি বুঝতে পারলো যে তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে।কষ্ট লাগলো তার।
‘আর তোমার মা??
মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়ালো।হাফ প্যান্টে হাত মুছে বলল,
‘মায়ের অনেক জ্বর!দুইদিন ধইরা কামে যাইতে পারেনাই।ঘরে যা ছিলো সব শ্যাষ, তাই আর কিচ্ছু খাইতে পারিনাই।
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— আচ্ছা বুঝেছি।এগুলো খেতে হবেনা।আমি তোমাকে খাবার কিনে দিচ্ছি দাড়াও..
বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে পাশের একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গেলো সেঁজুতি। হোটেলের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিলো।দুপুরের সময়। অনেক লোক,ভাত খেতে বসেছে। সেঁজুতি আর ভেতরে গেলোনা। বাইরে থেকে ভাত আর মুরগীর মাংস কিনে মেয়েটাকে নিয়ে আবারো আগের জায়গায় ফেরত এলো। রাস্তার পাশে সিমেন্টের বাধানো ছোট ছোট বেঞ্চ।সেঁজুতি একটা বেঞ্চে মেয়েটাকে বসিয়ে নিজেও বসলো পাশে।হোটেল থেকে খাবারের সাথে একটা প্লেট ও এনেছে সে।
প্যাকেট থেকে খাবার গুলো বের করে প্লেটে ঢেলে বাচ্চা মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,
— নাও খাও।
মেয়েটি সময় নিলোনা।চোখ মুখ চকচক করছে খুশিতে।খাবার পেয়েই অনেক তাড়াহুরো করে খেতে থাকলো।
কিন্তু সমস্ত খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছিলো অল্পতেই।বাচ্চা মানুষ, তার ওপর ক্ষুধার্ত। গুছিয়ে খাবেই বা কী করে?
“তুমিতো ঠিক ভাবে খেতেই পারছোনা। আমাকে দাও,আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি…
মেয়েটি মাথা নেড়ে সেঁজুতির হাতে প্লেট দিলো।কোলের ওপর থেকে কাধব্যাগ নামিয়ে পাশে রাখলো সেঁজুতি। ভাত মেখে লোকমা তুলে সযত্নে মেয়েটির সামনে ধরতেই একপ্রকার লুফে নিলো মেয়েটি।
রাস্তায় মস্ত বড় জ্যাম।সিগন্যালে আটকা পরেছে সব গাড়ি।তার মধ্যে রুদ্রর কালো গাড়িটাও আছে।গাড়ির ভেতর বসেই এতক্ষন একভাবে সেঁজুতির কর্মকান্ড দেখছিলো রুদ্র।গত এক ঘন্টা ধরে তার গাড়ি জ্যামে আটক।
বিরক্ত হয়ে গাড়ির জানালা খুলে রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে তাকিয়েছিলো।
হুট করেই তার চোখ পড়ে রাস্তার ডান পাশে সেজুথির দিকে।এবার কিন্তু একবার দেখাতেই সে চিনে ফেলেছে মেয়েটিকে।ভাবতে হয়নি।
কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে খাবার কিনে দেয়া থেকে শুরু করে খাইয়ে দেয়া দেখে রীতিমতো হা হয়ে গিয়েছে রুদ্র।এমন জীর্ন শীর্ন ময়লা পোশাক পড়া একটা বস্তির বাচ্চা মেয়ে!আজকাল কার কোনও মেয়েতো ধারেকাছেই ঘেষতে দেবেনা একে।
সেখানে এই মেয়েটা ওকে খাইয়েও দিচ্ছে..?.
অদ্ভূত না বিষয় টা?
রুদ্রর সুক্ষ্ণ বুদ্ধি মাথা চাড়া দিচ্ছে।বলছে এই মেয়েটা হয়তো সেরকম নয় যেরকম সে ভাবছে।যা দেখলো এতক্ষন নির্দ্বিধায় একে ভালো মানুষের কাতারে ফেলা যায়।তবে ওইদিন রাতে তার সাথে থাকলো কেন?এর মধ্যে কোনও গল্প আছে…??
পরমুহূর্তেই ভাবলো,
থাকলেই বা…
তার কি এসে যায়…?
তখুনি
জ্যাম ছুটে গেলো।সেজুথির দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়ির জানালার কাঁচ টা তুলে দিলো রুদ্র।
আর তার গাড়ি ছুটে চললো নিজ গন্তব্যে…
_____
ভাই??
— হুম
ফাইল চেক করতে করতে ছোট করে জবাব দিলো রুদ্র।তার জবাব বরাবরই এত টুকুন।
অভ্র দরজায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে বলল
‘কিছু বলার ছিলো তোমাকে?
— বল…
অভ্র দেখলো রুদ্র তাকাচ্ছেনা।রুদ্রর আগ্রহ পেতে একটু জোরে বলল,
‘ভাই সেই মেয়েটার ব্যাপারে।
— কোন মেয়ে??
রুদ্রর ভাবলেশহীনতায় অভ্র অবাক না হয়ে পারেনি।একদিনে ভুলে গেলো?অবশ্য হবেইতো।যার চারপাশে সব সময় মেয়ে মানুষের আনাগোনা সে কী আলাদা করে একটা মেয়েকে মনে রাখতে পারে নাকী?
— ওই মেয়েটা,, যে তোমাকে ব্লাড ডোনেট করলো।
রুদ্র ফাইলের কাগজ ওল্টাতে ওল্টাতে বলল,
— হুম, তো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিস??
অভ্র এবার মহা ঝামেলায় পরেছে তাতো আর ভাই জানেনা।মেয়েটা যে তার ইজ্জত খেয়ে ফেলল একদম। নিজের মুখে কী করে বলবে সে? মিনমিন করে বলল,
— শোনোনা ভাই,,হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট থেকে মেয়েটার এড্রেস নিয়ে আমাদের দুজন লোক কে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম।গতবার চেক নেয়নি ভেবে এবার ক্যাশ পাঠিয়েছিলাম একেবারে।
রুদ্র এবার তাকালো।
— তো??
অভ্র রুদ্রর তাকানো দেখেই ঘাবড়ালো আরো।আস্তে করে বলল,
— মেয়েটা টাকা রাখেনি ভাই,,
রুদ্রর কপালে ভাঁজ।সে অবাক হয়েছে।
রুদ্রর এমন চাউনী বুঝতে পেরে অভ্র এগিয়ে এলো কয়েক পা।উদগ্রীব হয়ে বলল
‘– হ্যা ভাই টাকা তো রাখেইনি উলটে আমাকে হুমকি দিয়েছে।
রুদ্র বুঝলোনা,
— মানে?
অভ্র থেমে থেমে বলল
— মানে, মেয়েটা বলেছে,,এরপর ওনার বাড়ির আঙিনায় যদি আমি বা আমার কোনও লোক টাকা নিয়ে হাজির হয়,তবে…
— তবে?
— তবে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে..
মুখ কাচুমাচু করল অভ্র।
রুদ্র চমকালো।ক্ষেপেও গেলো।ঝরঝরে ইংলিশে বলল,
‘ হোয়াট? আর ইউ কিডিং উইথ মি?
অভ্র ঘন ঘন মাথা নাড়লো দুদিকে।তার কী অত সাহস আছে নাকী? রুদ্রর সাথে মজা করবে। ছিঃ ছিঃ এ স্বপ্নে ভাবাও অন্যায়।
— নো নো ভাই,,সত্যি বলছি।মেয়েটা তাই বলেছে।এমনকি ওনাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে নাকী।কি মারাত্মক মেয়ে!
রাগে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো রুদ্রর।উঠে দাঁড়ালো তাৎক্ষণিক। ফাইলটা পরে গেলো ফ্লোরে।রুদ্রর সে খেয়াল নেই।হাত দুটো মুঠো বন্দি করে দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘হাউ ডেয়ার সি?? রুদ্র রওশন চৌধুরির দেয়া টাকা বারবার রিজেক্ট করছে ওই মেয়ে?
কি নাম মেয়েটার??
‘ পুরো নাম বলব? নাকী ডাক নাম?
রুদ্র তাকাতেই অভ্র চট করে বলল ‘সে..সেজুতি।
রুদ্র বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
‘বাসার এড্রেস টা আমাকে টেক্সট কর।
চলবে….
( নাইস,নেক্সট বাদ দিয়ে গঠন মূলক মন্তব্য করুন)
#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব- ৫
শাঁ শাঁ করে বাতাস বইছে। প্রকোপে হন্নের মতো উড়ছে জানলার সোনালী রংয়ের পর্দা। রুদ্রর মন,মস্তিষ্ক বড্ড অশান্ত,অবিচল।অস্থিরতায় এক ফোঁটা শান্তি নেই যেন।কেমন অন্যরকম অশান্তি এটা।এরকম কেন হচ্ছে?ফাঁকা ফাকঁা লাগছে কেন এত? রুদ্র খেয়াল করেছে রাস্তায় সেজুতিকে দেখার পর থেকেই এই অবস্থা।কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।এখানে অন্য কোনো মেয়ে হলেও কী এরকম হতো?একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে আপনজন দের মতো সাহায্য করায় তার ভীষণ ভালো লেগেছে এটা ঠিক।কাজ টা যেই করতো না কেন এরকমই ভালো লাগতো।কিন্তু এই অদ্ভূত অদ্ভূত লাগার কারন কী?মেয়েটিকে সে চেনে বলে?খুব কাছ থেকে দেখেছে বলে?মেয়েটিকে প্রথম দেখায় খারাপ বলে আখ্যায়িত করার জন্যে? নাহলে কী?কেন মনে হচ্ছে মেয়েটি খারাপ নয়!অন্য রকম।আলাদা।পুরোটাই আলাদা।
শান্তি পাচ্ছেনা রুদ্র।তার বার বার মনে হচ্ছে সেজুথী এখানে আসা বাকি মেয়েগুলোর মত নয়
তবে?? তবে ঠিক কি কারনে একটা মেয়ে নিজ ইচ্ছায় এখানে আসবে?? হোয়াই??এখানেতো ভালো মেয়েরা আসেনা।কাউকে তুলেও আনা হয়না।সব আসে টাকার লোভে,আর রুদ্রকে ছোঁয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়।সেঁজুতি কেন তাহলে?
— হোয়াট এভার,, আমি কেনো এসব নিয়ে ভাবছি..?
না আর ভাববোনা এসব থার্ড ক্লাস টাইপ মেয়ে নিয়ে।
মুখে ভাববেনা বললেও মন কী শোনে? সে অত্যন্ত বেহায়া কীনা!একই কথা বারবার তার মাথায় ঘুরেফিরে আসছে।
রুদ্র সটান শুয়ে পরলো।দুহাত মেলে দিয়ে জোরে শ্বাস নিলো।চোখ বন্ধ করলো।কাত হয়ে শুলো।নাহ! কোনো ফল সে পাচ্ছেনা।সেঁজুতির সেই স্নিগ্ধ মুখ খানা উঁকি দিচ্ছে চোখে।মেয়েটিকে খাওয়ানোর সময় এত নিষ্পাপ লাগছিলো কেন তাকে? সেকী আসলেই এত নিষ্পাপ?
রুদ্র তড়াক করে উঠে বসলো।মেজাজ তেঁতে গেছে।
— ও গড, এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?কেনো হচ্ছে কেনো?
জোরে চিল্লালো রুদ্র।টেবিলে রাখা ফুলদানি টাকে চোখে পরলো।পেলোও হাতের কাছে।রাগের মাথায় সেটাকে উঠিয়ে ছুড়ে মারলো দূড়ে।
কিছু একটা ভাঙার শব্দে দৌড়ে রুদ্রর রুমে এলো অভ্র।উদ্বিগ্ন তার চেহারা।দরজা অব্দি এসে ভেতরে রুদ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো ওখানেই।
রুদ্র বিছানার ওপর বসে আছে।হাত মুঠো বন্দী করে ডোরা সাপের মতো হিঁসহিস করছে যেন।সেকী রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে?
অভ্রর কী এখন কথা বলা উচিত?আচ্ছা ভাঙলো কী?অভ্র রুমের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে ভাঙা ফুলদানি দেখে শিওর হলো রুদ্রর মাথা গরম।ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
— ভা.. ভাই কি হয়েছে তোমার..
রুদ্রর উত্তর এলো সময় নিয়ে,
— অভ্র,,মিস সুভাকে কল কর,,,আধ ঘন্টার মধ্যে আমি হোটেল পৌছাচ্ছি,,,কাউকে পাঠিয়ে দিতে বলবি…
অভ্র যেন অবাক হলো,ইতস্তত করে বলল,
— কিন্তু ভাই,,এখন তো বিকেল।তুমিতো রাত ছাড়া সেখানে যাওনা।
রুদ্রর রাগ এমনিতেই সপ্তম আকাশ ছোঁয়া।অভ্রর কথা যেন ঘি ঢাললো। লাল চোখে তাকালো,
—ডু হোয়াট আই সে ড্যামেট…
রুদ্রর ধমকে কেপে উঠলো অভ্র।ভয়ে আটশাট হয়ে পরলো একদম।না, রুদ্রকে এর বেশি ঘাটানো বিপদজনক তার জন্যে।মারবেনা কিন্তু একটা বাজখাই ধমকে সে মরবে নির্ঘাত।
— ও…. ওকে ভাই,,
সুভার নাম্বারে ডায়াল করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো অভ্র।সুভা আর আর সি হোটেলের ম্যানেজার। রুদ্রর কোন রাতের সঙ্গী কোন মেয়ে হবে সেসব গোপনে সেই ঠিক করে।
জোরে জোরে গাড়ি ড্রাইভ করছে রুদ্র।রেহান কে ও নাইনি।ঠিক কি কারনে তার এত চটেছে মেজাজ সে নিজেই বুঝতে পারছেনা।
তবে কি অজানা কোনও প্রশ্নের উত্তরের কারনে???হয়তো.. হয়তো না।এত দ্রুত গাড়ি চালানোর কারনে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পার হলো মাত্র বিশ মিনিটে।গাড়ি এসে থামলো সেই একী হোটেল RRC এর সামনে।নির্ধারিত ৪০৪ নাম্বার রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকলো সে।
আজকেও বিছানার ওপর একটি মেয়ে সেজেগুজে বসে আছে।রুমের লাইট জ্বলছে।রুদ্র পরপর দুবার জোড়ালো শ্বাস নিলো।তাকালো মেয়েটির দিকে।একটু বাদে মেয়েটি মাথা তুলতেই ৪৪০ ভোল্টেজের শক খেলো রুদ্র।চমকে উঠলো যেন।
নিজে নিজে আওড়ালো,
— একি এটা তো সেই মেয়েটা।যার জন্যে এইটুকু সময়ে এই হাল।
রুদ্র রেগে বলল,
— হেই ইউ?? আবার এখানে কেনো এসছো ? কে এত সাহস দিয়েছে তোমাকে??
মেয়েটি ভয় পেলো।কেঁপে কেঁপে বলল,
— আ.. আমাকে তো সুভা ম্যাম ডেকেছে.. আজকের জন্যে।
রুদ্র ভালোভাবে তাকালো।খেয়াল করলো এবার।
‘কই এটাতো সেই মেয়ে নয়,এটাতো অন্য মেয়ে.. তবে যে একটু আগে সে দেখলো।কি ছিলো সেসব??
— আ..আমি কি তবে চলে যাবো স্যার??
রুদ্র নিজেকে সামলে জবাব দেয় ‘না’
দরজায় লক টেনে এগিয়ে আসে রুদ্র।হঠাৎ চোখে পরলো সেদিন রাতের দৃশ্য।ঐ মেয়েটা ঠিক এইভাবে বসে ছিলোনা? হ্যা এখানেই বসেছিলো।কেমন গুটিশুটি মেরেছিলো।কিন্তু কেন?এই মেয়েটিতো কী সহজ ভাবে বসে।সেই মেয়েটির কি হয়েছিলো তাহলে?
পরমুহূর্তে মাথাটাকে জোরে ঝাকালো রুদ্র।অসম্ভব! এই যন্ত্রনা সহ্য হচ্ছেনা তার।মেয়েটাকে এক দুবার দেখে এরকম ব্যাবহারের কোনো মানে আছে? মেয়েটা চুলোয় যাক,মরুক।তাতে তার কী এসে যায়?
রুদ্র বিছনার ওপর বসলো।মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতেই সেঁজুতির জলে ভেজা চোখ দুটো খুঁজে পেলো যেন।আচ্ছা সেরাতে মেয়েটি কাঁদছিলো কেন?
উফ! আচ্ছা জ্বালাতো!
পরপরই তার চোখে ভেসে উঠলো সেজুথির বাচ্চা মেয়েটাকে খাইয়ে দেয়ার সময় ঠোঁটের হাসিটুকুন।
— উফফ কি হচ্ছে টা কি আমার সাথে??
মাথা চেপে ধরলো রুদ্র।
— কি…কি হয়েছে স্যার??
মেয়েটার কথায় চোখ তুলে তাকালো রুদ্র।একী আবার ওই মেয়ে? একদম তার সামনে বসে আছে? তাকে এত জ্বালিয়েও হচ্ছেনা।
— আবার?? আবার তুমি?? কি চাইছো হ্যা,,কি চাইছো.?? এখনও দাঁড়িয়ে আছো??বের হও,,আই সে গেট আউট ফ্রম হেয়ার।
রুদ্র গলার সব টুকু জোর দিয়ে চেঁচালো।মেয়েটির আত্মা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।মনে মনে রুদ্রকে পাগল উপাধি দিয়ে রুম ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো সে।
রুদ্র এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো।বিড়বিড় করলো,
— কি চায় ওই মেয়ে?
________
অভ্র গালে হাত দিয়ে বসে আছে।বাম হাতে পেপার ওয়েট ঘোরাচ্ছে মন দিয়ে।এমন সময় সুভার কল দেখে ভ্রু কোঁচকালো। কানে ধরতেই সুভা ফটফটে কন্ঠে বলল,
হ.. হ্যালো স্যার,,,স্যার।
— ইয়েস মিস সুভা,বলুন..( অভ্র)
সুভ্রা হা-হুতাশ করে বলল,
— ইয়ে মানে স্যার,,বস তো মেয়ে টাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন।
অভ্র বুঝলোনা,
‘বের করে দিয়েছে মানে
‘ জ্বি স্যার মেয়েটিতো তাই বলল।স্যার নাকী খুব রাগারাগি ক
রেছে।ধমকেছে।এত জোরে কখনও ধমক খায়নি বলে মেয়েটি সেই থেকে নাকেচোখে জল দিয়ে কাদছে।
‘ নিশ্চয়ই মেয়েটি কিছু করেছে।নাহলে শুধশুধু ভাই বের করে দেবে কেন?ভাইতো নিজেই গেলো।
‘ স্যার আমিও তাই ভেবেছিলাম।কিন্তু স্টাফ রা অনেকে স্যারের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছে।আর সব থেকে বড় কথা মেয়েটি কিছু করলে স্যার আমাকে বলতেন।হুশিয়ার করতেন যেন এরকম না হয়।তাতো করলেন না।
অভ্র বিভ্রান্তিতে পরলো।রুদ্রর হয়েছেটা কী?
— ভাই কি বেড়িয়ে গেছে ওখান থেকে??
— জি। কিছুক্ষন আগেই বের হলো।
অভ্র ছোট করে বলল, ‘ ওহ ওকে।
সুভা তাৎক্ষণিক ধৈর্য হারা হয়ে বলল,
‘ স্যার আসল কথাতো বলিনি।
‘ কি কথা?
সুভা উদ্বেগ নিয়ে বলল,’ স্যার যাওয়ার সময় কড়া করে বলে দিয়েছেন,উনি না বলা অব্ধি আর কোনও মেয়ে যেন এখানে না আসে।
অভ্র বিষম খেলো যেন।কেশে উঠলো একেবারে।হতচকিত কন্ঠে বলল,
— হ্যা?অসম্ভব!কি যা তা বলছেন। মিস সুভা আই থিংক আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
সুভা প্রচন্ড কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
— না স্যার সত্যি বলছি।
অভ্রর মাথা ঘুরছে।
— ঠিক আছে আমি দেখছি..
‘ওকে স্যার।
লাইন কেটে ফোনের দিক তাকিয়ে থাকলো অভ্র।
ভাইয়ের হয়েছে টা কি?নিজেই তো মেয়ে পাঠাতে বললো,নিজেই আবার বের করে দিলো।
এখন আবার এসব কী শুনলাম? অভ্র দুহাতে তুলে বলল ইয়া খোদা! আমার ভাইয়ের ওপর যেন জীন ভূতের আছর না পরে।
পরেরদিন…..
সকাল আনুমানিক এগারোটা।সেঁজুতি বাজারে গিয়েছে অনেকক্ষন।আমির বাসার পেছনের বারান্দায় বসে ছিলেন।সেখানে অনেক গুলো ফুল গাছের টব।দু একটা সব্জিও আছে।সে কিনে এনেছিলো,আর যত্ন করে লাগিয়েছিলো সেঁজুতি। হঠাৎ ডোরবেল বাজলো।সেঁজুতি এলো বোধ হয়।হুইল চেয়ার চালিয়ে সদর দরজার দিক এগোলো আমির।দরজার নিচের দিকের সিটকিনি খুলে দিতেই হা হয়ে মেলে গেলো সেটি।ওপাশে
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকিটে চিনতে পারলেন না তিনি।তবে চেনা চেনা লাগছে অনেক।কোথাও যেন দেখেছে।খুব বেশি না ভেবে বলল,
‘আপনি?? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না,,
রুদ্র ফুল্যি এটিটিউডের সাথে জবাব দেয়।
— রুদ্র,,রুদ্র রওশন চৌধুরী..
নাম শুনেই চিনে নিলেন আমির।এই লোক কে তো কয়েবার টিভিতে দেখেছে।পত্রিকায় ও পড়েছে এর সম্পর্কে। নামি ব্যাবসায়ী।অঢেল টাকাপয়সার মালিক।এত কম বয়সী ছেলের এত সাফল্যের কথাইতো প্রতিনিয়ত নিউজ হয়।
এত বড় বিজনেস ম্যান তার বাসায় ঠিক কি জন্যে আসবে?? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না আমির।তবুও এসেছেন যখন সেতো অতিথি।আমির খানিক পাশ ঘেষে গেলেন।রুদ্রকে বললেন
— ভেতরে আসুন…রুদ্র ভেতরে ঢুলো।চারপাশে একবার চোখ বোলালো। মধ্যবিত্তের বাসা ঠিক যেমন হয় এটা ঠিক তেমনই। কোথাও কোনো বাড়তি কিছু নেই।যা দরকারী ঠিক তাই।দেয়ালে কতগুলো হ্যান্ড ক্রাফটের কাজ টাঙানো অবশ্য।
— বসুন না…
রুদ্রর চশমার গ্লাস ভেদ করে আমিরের দিকে তাকালো।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমি এখানে বসতে আসিনি.. আব,,কি যেনো নাম?সিথি…উম না সেজুতি?হ্যা সেঁজুতি। আপনার কে হয়??
আমির বিচলিত কন্ঠে বলল,

— আ.. আমার মেয়ে,,কেনো বলুন তো?কিছু হয়েছে?
— ডাকুন ওনাকে।আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই।
— ওতো এখন বাসায় নেই,,,
আপনি আমাকে বলতে পারেন..
রুদ্র চোখ ছোট করে বলল,
— বললাম না,,প্রশ্নের উত্তর ওনাকে দিতে হবে। কোথায় গিয়েছেন উনি?
— কিছু জিনিস আনতে গিয়েছে।আসলে আমার এই অবস্থা,তাই বাজার থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সব টাই মেয়েটাকে সামলাতে হয়।আপনি বসুন না,ও চলে আসবে…
রুদ্র তীব্র অহংকারে ফেটে পরে বলল,
— অপেক্ষা করতে আমি পছন্দ করিনা।আপনি বরং ওনাকে একটা কথা বলে দেবেন।
— কি কথা??
রুদ্র এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল
— এটাই যে,, তৃতীয় বার যদি রুদ্র রওশন এর পাঠানো তওফা ফেরত দেয়া হয় তার ফলাফল খুব একটা ভালো হবেনা ওনার জন্যে।
আর এক মুহুর্ত দাড়ালোনা রুদ্র।গটগট করে হেটে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।আমির নাক মুখ কুঁচকে চেয়ে রইলো সেদিকে।
— হাটুর বয়সী ছেলের কি এটিটিউড!পয়সাওয়ালা হলে যা হয় আর কি….ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নেই।
কিন্তু এমন উগ্র লোকের সাথে আমার মেয়ের কি দরকার?? আর কোন তওফার কথাই বা বলছিলেন উনি???
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here