হৃদয়ের সুখ আপনি – পর্ব 20

0
306

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২০
#Nishi_khatun
এদিকে দাইয়ানের জন্য অপেক্ষায় কয়েক ঘন্টার এই বিষাক্ত রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে ফজরের আজানের মিষ্টি ধ্বনি ভেসে আসছে। ঠিক সে সময় বাড়ির কলপার থেকে পানি তোলার আওয়াজ আসছিল। বোঝা যাচ্ছে কেউ এই ভোর বেলা ইচ্ছাকৃত ভাবে ওখনে গোছল করছে। কারো গোছলের সময় তার সামনে যেয়ে তাকে তো লজ্জায় ফেলেদিতে পারি না।
কিন্তু মাথায় এটা ডুকছে না রুমের পাশে বাথরুম গোছল খানা আছে তবুও কেনো কলপারে গোছল করছে? এটা কী শুধু মাত্র লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে?
কিছুসময় পর দাইয়ান রিমশা’র রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর রুমে রাখা জায়নামাজটচ বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে। এরপর রিমশা’র দিকে না তাকিয়ে সোজা বিছানাতে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
দাইয়ানের এমন কান্ডে রিমশা হতভম্ব!
এটা কি হলো? তাদের মাঝে কোন কিছুই হয়নি।
তাহলে উনি এভাবে ভোরে গোছল কেনো করেছে?
এখন বাড়ির কেউ যদি বুঝতে পারে তখন সে মুখ দেখাবে কি করে? আর জামাই তার আগে বাড়ির লোকদের গোছলের বেপারে অবগত করে তাকে লজ্জায় ফেলেদিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।
এখন যাই হোক রিমশা কে নামাজ পড়তে হবে!
তাই সে চুপচাপ রুমের বাহিরে বেড়িয়ে আসে।
বারান্দাতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে নিজেকে একটু সিক্ত করছিল। এরপর সে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করবে।
তখন কোথায় থেকে একটা মেয়ে হুট করে এসে রিমশা’র পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি আমাদের নতুন ভাবী তাই না?”
রিমশা মাথা দু দিকে নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই মেয়েটা বলে,
“আমি ঝর্ণা। এবাড়ির কাজের মহিলার মেয়ে। আপনি আমার সাথে একটু আসেন তো ভাবী।”
বলে রিমশা’র হাত ধরে তাকে টেনে বাড়ির উঠানের পাশে থাকা কলপারে এনে দাঁড় করিয়ে রাখে। ঝর্ণা দ্রুত বালতি তে পানি ভর্তি করে দিয়ে বলে,”ভাবী বাড়ির বাকিরা জেগে যাবার আগে আপনি দ্রুত গোছল করেন। নয়তো সবাই জেগে গেলে তখন লজ্জায় পড়বেন। ”
রিমশা এবার ঝর্ণার দিকে ভালোভাবে দৃষ্টিপাত করে। একটু খেয়াল করে দেখে মেয়েটার বয়স হয়ত ১৫/১৬ বছর হবে।
এই কিশোরী মেয়ে এতো পাকনামি শিখলো কি করে? নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে,”তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে কি বলছো তা তুমি জানো?”
ঝর্ণা বলে,”কেন জানবো না? প্রতিটা নতুন বউ কে সাত সকালে গোছল করতে হয় এটা সবার জানা। এখানে বাচ্চা আর বুড়ির কি আছে? প্লিজ ভাবী তাড়াতাড়ি করেন নয়তো নামাজের ওয়াক্ত ফুরিয়ে যাবে।”
রিমশা আর কোন কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গোছল করবে তখন ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি গোছলখানা থেকে বেড়িয়ে কি পড়বো?”
ঝর্না দ্রুত নিজের রুম থেকে একটা সুন্দর শাড়ি নিয়ে এসে রিমশা’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,” কিছুদিন আগে আমি আর ইলমা আপা এগুলো নতুন বানিয়েছি। ইলমা আপার ব্লাউজ পেটিকোট আপনার ঠিকঠাক হবে।”
রিমশা আর কথা না বাড়িয়ে সে সব কিছু নিয়ে কলপার থেকে চেঞ্জ করতে চেঞ্জির রুমে চলে যায়। সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অজু করে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। রুমে এসে নামাজ আদায় করে চুপচাপ কিছু সময় দাইয়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
এই মানুষটা এখন থেকে একান্ত তার। ঘুমন্ত মানুষটার দিকে সারাজীবন এভাবে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। সত্যি ঘুমন্ত মানুষের সৌন্দর্য অন্যরকম হয়। আমার শ্যামবর্ণের সুপুরুষ, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, বাশির মতো লম্বা নাক! এই নাকের আগাই সব সময় রাগ আর গম্ভীরতা বিরাজ করে। তবুও উনি আমার।
এভাবে কিছু সময় তাকে দেখে তৃষ্ণার্ত নয়নের তৃষ্ণা মিটিয়ে আমি রুমের বাহিরে বেড়িয়ে আসছিলাম। তখন ঝর্ণার সাথে আরেকটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
মেয়েটা এসে বলে,”ভাবী আমি আপনার একমাত্র ননদী।
চলেন আপনাকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
এরপর ইলমা বাড়ির সকলের সাথে রিমশা’র পরিচয় করিয়ে দেয়। রিমশা তখন একটা বিষয় খেয়াল করে বাড়ির বড় বউ রাইসার চেহারে বিষণ্ণতায় ঘেরা। ভাবীর চেহারা দেখে যে কেউ তার মনের খবর বলতে পারবে। তবে ভাবীব এমন বিষণ্ণতার কারণ কি আমার জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল।
বাড়ির সব মহিলা রান্নাঘরে ছিলাম। ঠিক এমন সময় বাড়ির সদর দরজাতে দাইয়ানের নামে হাক-ডাক শুরু হয়ে যায়।
তখন বাড়ির পাহারাদার সদরদরজা খুলে দিতেই বাহিরের অনেক লোকজন বাড়ির ভেতরে হুরমুর করে প্রবেশ করে।
তারা চিৎকার করে দাইয়ান কে ডাকতে থাকে। তখন আমার বড় ভাসুর দিরহাম ভাই দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এসে বলে,’তোমাদের সমস্যা কী? আমাদের বাড়িতে এসে এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচানোর মানে কি?”
একজন ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলল-, “দু দিন আগে পারার মোড়ে মেয়েদের সাথে বেয়াদবি করার জন্য যে লোকটাকে মারধোর করে তাকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল আজ সকালে রুপসী খালপাড়র তার লাশ পাওয়া গেছে।”
দিরহাম বলে,” আমি আজকে যদি আপনাকে খুন করার কথা বলি! আর কালকে আপনি মারা যান তাহলে তার দোষ আমার? তাছাড়া কাল রাতে আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বউ রেখে কেউ তো বাহিরে খুন করতে যাবে না?”
ভীরের মধ্যে থেকে অনেকেই তখন বলাবলি শুরু করে আর হ্যা কাল রাতে না শুনলাম ঐপাশের গ্রামের কোন মেয়ের সাথে কাহিনী করে বিয়ে করেছে। বাসরঘর বাদ দিয়ে কি কেউ খুন করতে যাবে?
তারপর ও সবাই দাইয়ান কে দেখতে চায়। তখন দিরহাম দাইয়ান কে ডাক দিতে শুরু করে। কিছু সময়পর দাইয়ান রুম থেকে বেড়িয়ে এসে হাই তুলে বলে,”ভাই রাতে বিয়ে করতে না করতে সাত সকালে বউভাতের দাওয়াতে এতো মানুষ কে ডাকার কি দরকার ছিলো? দু দিন পরেও তো বউভাতের অনুষ্ঠান করতে পারতে। ”
দিরহাম বলে,”এরা তোর চল্লিশা’র দাওয়াত খেতে এসেছে। দুদিন আগে যার সাথে তোর ঝামেলা হয়েছিল। আজ সকালে তার লাশ রুপসী খালপাড়ে পাওয়া গেছে। তা-ই এদের সবার ধারণা তুই ঐ লোকটাকে খুন করেছিস। এই জন্য সাত সকালা সবাই দলবদ্ধ হয়ে এখানে এসেছে।”
দাইয়ান এসব কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,”ঐ ডাস্টবিনের নোংরা চরিত্রের লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে সবাই দলবেঁধে আমাকে আসামী সাজাতে চলে এসেছেন?”
দাইয়ান একটু থেমে আবারো বলে ওঠে,”কাল রাতে আমার বিয়ে হয়েছে। নিজের সুন্দরি বউ কে রাত্রির বেলা একা রেখে আমি অবশ্যই খুন করতে যাব না?”
দিরহাম তখন নিজের স্ত্রী কে উদ্দেশ্য করে বলে,” এই রাইসা নতুন বউ কে সাথে নিয়ে একটু এদিকে এসো।”
রাইসা রিমশা কে সঙ্গে করে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। দুজনে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে দিয়েছে যেনো অন্যরা তাদের চেহারা না দেখতে পারে।
দিরহাম তখন রিমশা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কাল সারারাত কি দাইয়ান তোমার সাথে ছিলো? না কি দাইয়ান তোমাকে রেখে সারারাত বাহিরে কাটিয়েছে?”
রিমশা লজ্জায় মরে যাচ্ছে! নিজেদের পারসোনাল কথা কি এভাবে সবার সামনে বলা সম্ভব?
দাইয়ান তখন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”রিমশা সত্যি কথা বলো। কারণ এখানে উপস্থিত সকালের ধারণা কাল সারারাত আমি বাড়ির বাহিরে ছিলাম। এখন তোমার কথার উপর নির্ভর করছে আমার আসামী হওয়া আর না হওয়াটা। ”
রিমশা তখন বলে, “জি উনি কাল সারারাত আমার সাথে ছিলেন।”
তখন ঝর্ণা সেখানে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,”আপনাদের লাজলজ্জা নাই? বিয়েরপর দিন সকাল হতে না হতেই একটা বউ কে জিজ্ঞাস করছেন তার বর সারারাত ছিলো কি না? আপনাদের চোখ কি আকাশে? বাড়ির উঠানে তাদের ভেজা কাপড়চোপড় দেখেও কিছুই বোঝেন না?”
এবার সেখানে উপস্থিত লোকেরা লজ্জা পেয়ে ওদের কাছে মাফ চেয়ে স্থান ত্যাগ করে।
ইলমা ঝর্ণা কে এসে বলে,”তুই কিন্তু বড়দের বেপারে অতিরিক্ত কথা বলা শুরু করেছিস। এভাবে বড়দের মাঝে কথা বলা মেয়েদের উচড়ে পাকা বলে।”
এরপর ইলমা আর ঝর্ণা দু জনে রিমশা কে নিয়ে আড্ডা দিতে চলে যায়। এদিকে সকালের নাস্তা করে দিরহাম র দাইয়ান তাদের বাবা কে কাজে সাহায্য করতে বেড়িয়ে পড়ে।
রিমশা রুমে বসে ভাবছে ঐ লোকদের তো আমি মিথ্যা কথা বলি নাই। কারণ উনি রাতে আমার সাথে কথা বলে রাগ করে কয়েক ঘন্টা বাহিরে ছিলেন। দুই তিন ঘন্টায় কাউকে একা খুন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার উনার উপরে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস আছে। উনি কখনো কাউকে খুন করতে পারবে না।”
নিজের চিন্তার দুনিয়া থেকে বেড়িয়ে এসে রিমশা ইলমা আর ঝর্ণার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রিমশা’র শাশুড়ি মা মানুষটা অদ্ভুত তার ছেলের সাথে এভাবে বিয়ে হয়েছে। তাতে তার কোন খারাপ মন্তব্য নেই।




চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here