#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২১
#Nishi_khatun
সকালের ঘটনা সারাদিনেও রিমশা ভুলে যায়নি। রাতে দাইয়ান যখন রিমশা’র রুমে আসে ঘুমানোর জন্য তখন রিমশা দাইয়ান কে উদ্দেশ্য করে বলে, “কাল সারা রাত কিন্তু আপনি বাড়িতে ছিলেন না। তাহলে কী ধরে নিবে খুনটা আপনি করেছেন? ”
দাইয়ান তখন নির্বাক দৃষ্টিতে রিমশা’র দিকে তাকিয়ে বলে,” তোমার কি মনে হয়?”
রিমশা মজার ছলে বলে, “আমার মনে হয় খুনটা আপনি করেছেন।”
দাইয়ান তখন বলে,” আমার প্রতি তোমার এই বিশ্বাস নিয়ে সংসার করতে এসেছো। কী দরকার এই ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে সারাজীবন থাকার। ”
রিমশা বলে,”বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা এখানে আসছে কেনো? খুন হয়েছে আর আঙ্গুল আপনার দিকে তুলছে সবাই। সেখানে সহজ একটা প্রশ্ন করেছি মাত্র। ”
দাইয়ান সহজেই বলে,” একটা খুনির সাথে রুম শেয়ার করতে তোমার রুচিতে বাধবে। বাবা কে বলে খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে এ সম্পর্ক থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবো।”
বলেই সে রুম থেকে হনহন করে বেড়িয়ে সোজা তার রুমে চলে যায়। ঐ যে রিমশা’র থেকে মুখ ফিরিয়ে রুম ছেড়ে চলে গেলো।
এরপর আর কখনো রিমশা’র সাথে কথা বলতো না। এমনকি সব সময় রিমশা কে এড়িয়ে চলত। দাইয়ানের রুমে রিমশা’র প্রবেশ করার অনুমতি ছিলো না।
এরপর রিমশা বহুত বার চেষ্টা করেছে দাইয়ানের সাথে কথা বলার তবে দাইয়ান তাকে বারংবার ইগনোর করেছে।
এভাবে চলছিল তাদের দুজনের মনোমালিন্যের সংসারটা। রিমশা বিয়েরপর কখনো বাবার বাড়িতে যেত না। রিমশা যেতে চাইলেও তার বাবা বারবার নিষেধ করে দিত। তার কথা এ গ্রামটা তোমার জন্য অভিশাপের মত। এখানে আসলে তোমার সাথে খারাপ কিছুই হবে। কী দরকার এখানে এসে নিজের অশান্তি বাড়ানোর?
তা-ই বাবার বাড়িতে যাবার চিন্তা বাদ দিয়ে রিমশা চেয়ারম্যান বাড়ির সবাইকে আপন করে নিতে শুরু করে। ইলমা আর ঝর্ণা কে লেখাপড়া তে সাহায্য করে।
তা দেখে রেহেনা বেগম রিমশা কে বলে,”দেখো মা ওদের প্রাইভেট পড়তে বহুদূরে যেতে হয়। তুমি যদি ওদের প্রাইভেটের ম্যাডাম হতে তাহলে ভাল হতো। দূরে যেতে হয় বলে ওদের লেখাপড়া বন্ধের দশা। ”
রিমশা শাশুড়ি মা কে আশ্বাস দান করে সে ওদের দুজনকে নিজের বোনের চোখে দেখবে।
রেহেনা বেগম কখনো তার দুই ছেলের বউকে পরের বাড়ির মেয়ে ভাবত না। নিজের মেয়ে ভাবত।
ইদানীং রাইসার শরীরটা খুব খারাপ থাকে। শরীর খারাপ থাকার জন্য সারাদিন সে শুয়ে বসে থাকে তবু মনে শান্তি পায়না।
রিমশা শাশুড়ি মা কে বলে রাইসা কে জোড় করে গ্রামের স্বাস্থকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান রাইসার চেকআপের পর ডাক্তার বলে রাইসা গর্ভবতী।
রিমশা সে কথা শুনে খুব খুশি হয়। তবে রাইসার চেহারা দেখে সে কোন কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে খুশি না দুঃখী।
এদিকে বাড়িতে এসে খুশির খবর সবাইকে জানাতে সবাই কেমন যেনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। রাইসা সোজা তার শাশুড়ি মা কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাইসা চোখেরজল দেখে সেখানে উপস্থিত সকলের চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করে।
রিমশা কোন কিছুই বুঝতে পারছে না! এখানে হচ্ছে টা কি? কিছু জিজ্ঞাস করতে যাবে তার আগে রাইসা কান্নারত অবস্থায় বলে ওঠে,”ও আম্মা আমার রিদি ফিরে আসবে তো? আমার রিদি কে দরকার! ও মা আমার রিদিকে যেনো ফিরে পাই। ”
এবার রিমশা’র মাথায় টনক নড়েছে আরে হ্যা দাইয়ান রিদির কথা বলেছিল। একটা বাচ্চার জন্য এতো কান্নার কী আছে? দুনিয়াতে তার হায়াত ফুরিয়ে গেছে তা-ই সে চলে গেছে।
এভাবে গুমোট পরিবেশের মধ্যে সেদিন টা পাড় হয়ে যায়।
এদিকে তিন কন্যা বিকালে পুকুরপাড়ে এসেছে গল্প করতে।
তখন রিমশা তাদের দু জনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা রিদির কী হয়েছিল? সে মারা গেছে কিভাবে? ”
দুজনে কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর ইলমা বলতে শুরু করে। বাবা বড় ভাইয়ার লেখাপড়া করা অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেয়। তার বিয়ের একবছর পর আমাদের বাড়ি আলোকিত করে রিদির জন্ম হয়। আমাদের বাড়িতে মেয়েদের প্রতি আলাদাভাবে কেয়ার নেওয়া হয়। মেয়েদের অতিরিক্ত ভালবাসা হয়। রিদিও সবার ভালোবাসাতে সিক্ত ছিলো। মেয়েটা দেখতে দেখতে কখন যে বড় হয়ে গেলো কেউ বুঝতেই পারি নাই। মেয়েটা আমাদের প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে হাই স্কুলে ভর্তি হলে সেবার। সবাই তো অবাক! এই পিচ্চি হুট করে এতো বড় হয়ে গেছে? রিদি দেখতে একদম পরীর মত সুন্দর ছিলো। হঠাৎ করে মেয়েটাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না এগারো বছর বয়সী মেয়ে সে। তাকে দেখে বয়স বোঝা যেতো না। শরীর স্বাস্থ্য মাশাআল্লাহ।
একদিন সকালে মেয়েটা স্কুলে গেলো তবে বিকালে রোজকার মতো আর বাড়িতে ফিরে আসল না। সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। চারিদিকে তাকে খুঁজতে শুরু করে সকলে তবে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে মেয়েটা হাওয়া হয়ে গেলো? খবর নিয়ে জানা গেলো রিদির সাথে আরো দুটো বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বাড়িতে কান্নাকাটি করে সবার অবস্থা খারাপ। দাদাভাই রিদির চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাবীর ও একি অবস্থা। এভাবে একটা দিন কেটে যায়। পরের দিন সকালে আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসে। তাদের সাথে আমাদের যেতে বলে। আমরা তাদের সাথে চুপচাপ যেতে শুরু করি। রুপসী খালের পাড়ে এসে দেখি বহু মানুষের ভীড়। আমাদের মতো আরো দুই মেয়ের পরিবারের সদস্য সেখানে উপস্থিত।
কিছু সময়পর ভীর ঠেলে সকলে সামনে দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি। খালের পাড়ে দেখি সাদা চাদরে ঢাকা তিনটে দেহ। একজন মহিলা পুলিশ একে একে তিনটা লাশের মুখ থেকে চাদর সরাতেই আমরা স্তব্ধ।
রিদির ঘুমন্ত মুখটা আমরা দেখতে পাই। রিদি বলে চিৎকার করে ভাবী মেয়ের লাশটা কে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। ভাই সেখান পাথরের মত স্তব্ধ। ভাবী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে হাজারো চুমো দিয়ে ভরিয়ে দিতে থাকে। সে বলে তার মেয়ের কিছুই হয়নি জলদি ডাক্তার ডাক দাও। মেয়েকে আমার ডাক্তার দেখাতে হবে। আমার মেয়ের শরীরটা এমন ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে কেন? আর এমন সাদা চাদরে ঢাকা কেন? ভাবী একটানে চাদর সরিয়ে দিতেই সেখানে উপস্থিত সকালের চোখ লজ্জায় নিচু হয়ে যায়। মেয়েটার শরীরের কাপড়ে একটুকরাও নাই। সারা শরীরের রক্তে ভরা। লাশটা দেখে মনে হচ্ছে কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার মেয়েটার খুবলে খেয়েছে। এমন নিষ্ঠুর হৃদয়হৃীন দের মতো কাজ কোন মানুষ করতে পারে না। ভাই দ্রুত মেয়ের শরীরটা কে ঢেকে দেয়। যে মেয়েকে মাথায় তুলে রাখত সে মেয়েকে আজ এভাবে জনসম্মুখে বেপর্দা হতে দেখতে হবে ভাবতেও পারে নাই।
তিন মেয়ে হারানো পরিবারের কান্নায় সেদিন রুপসী খালপাড়ের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গেছিলো। কেউ কোনদিন ভাবতেও পারে নাই এমন ঘটনার স্বাক্ষি হবে তারা। পুলিশেরা রিদির লাশটা কে নিয়ে যায়। তারপর তারা আমাদের কলিজার ঐ ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে আবারো কেটেকুটে সেলাই করে বাড়িতে দিয়ে গেছিলো। এরপর ভাবী নিজেই মেয়েকে শেষ গোছল করিয়ে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে চিরোদিনের মতো বিদায় দিয়ে দেয়। এরপর রিদির শোকে দাদাভাই কিছুদিন পর আমাদের ছেড়ে সারাজীবনের মতো চলে যায়। এরপর আমাদের সব কিছু বদলে যায়।”
এসব কথা বলে ইলমা নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। জানো ভাবী মেয়েটা আমাকে ফুপুমনি ডেকে সারাদিন অস্তির করে রাখত। আজ দুই বছর আর এই ডাকটা শুনতে পারি না।
রিমশা’র আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছিল না। বুঝতেই পারছে রিদির কথা মনে পড়াতে এদের কতোটা কষ্ট হচ্ছে।
রিমশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ বসে ভাবে তাহলে ভাইয়ার বিয়ের দিনের দূর্ঘটনায় এই পরিবার তাদের মেয়ে হারিয়ে ছিল।
এক মায়ের কোল খালি হয়েছে। তাহলে সে বাড়ির পুরুষের বদলে যাওয়াটা স্বাভাবিক!
(আস্তে আস্তে সব ক্লিয়ার করা হচ্ছে)
”
”
”
চলবে….