হৃদয়ের সুখ আপনি – পর্ব 23

0
303

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-২৩
#Nishi_khatun
চেয়ারম্যান বাড়িতে এসে রিমশা উঠানের মাঝে ধপাস করে বসে পড়ে। কিছু সময় সে নিরব থাকার পর হঠাৎ করে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাকিরা সবাই দর্শকের ভূমিকা পালন করে রিমশা’র কান্নাকাটি দেখছে। কেউ এগিয়ে তাকে শান্তনা দিচ্ছে না।
রিমশা চিৎকার করে বলে,”আপনি শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করে একটা অবৈধ সম্পর্কে ছিলেন? আপনার প্রতি থাকা আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা, সম্মান সব আজকে ঘৃণায় পরিণত হয়েছে।
যার মাইন্ড এমন ক্রিমিনাল মার্কা তার জন্য এ বাড়িতে পড়ে থাকার মানে হয় না। ”
বলে রিমশা নিজের রুমে যায়। সেখান থেকে নিজের ব্যবহিত কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়। সকলে এখনো নিরব দর্শক।
ঠিক সে সময় ঝর্ণা রিমশা’র হাত ধরে তাকে বাড়ির বাহিরে নিয়ে আসে।
চেয়ারম্যান বাড়ির পেছনের দিকে নিয়ে আসে। পেছনে বাঁশ বাগান, দিনের বেলাতেও এখানে অন্ধকার ভাব থাকে। সেখানে এই কেনো নিয়ে আসছে?
ঝর্ণা বাঁশ বাগান পার করে একটু ফাঁকা স্থানের সামনে এনে দাঁড়ায়। সামনে ইশারাতে তাকিয়ে দেখতে বলে।
সামনে একটা ছোট কুঁড়েঘর। সে ঘরের ভেতরে কেউ চিৎকার করে কান্না করছে। ঝর্ণা দরজাটা খুঁলে দিতেই দেখতে পায় ভেতরে তাদের বয়সী একটা মেয়ে তবে সে অর্ধনগ্ন অবস্থায় হাতে পায়ে দড়ি বাধা।
ঝর্ণা রিমশা’র হাত ধরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বলে,”এটা আমার বড় বোন! অনেক সুন্দরি। গরীবের ঘরে সুন্দরি মেয়ে জন্ম নেওয়া আজন্ম পাপ। জানেন তো ভাবী? আমরা দু বোন খুব ছোট থাকতে বাবা মারা যায়। তখন মা কূল হারা হয়ে দু বোন কে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তখন চেয়ারম্যান সাহেবের বাবা আমার মা কে তাদের বাড়িতে থাকতে বলে। তবে একটা শর্তে তাদের বাড়ির মেয়ে বউকে কাজে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু কখনো নিজেদের কাজের লোক ভাবা যাবে না। তাদের ভালোবাসার চাদরে সিক্ত হয়ে আমরা দু বোন এবাড়ির অন্যদের সাথে একই ভাবে বেড়ে উঠছিলাম। কিন্তু রিদি মা মারা যাওয়ার পরে চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে ভেঙে পড়ে। আমার বড় আপু রিদিকে খুব ভালো বাসত বলতে গেলে রিদি তার জান ছিলো। আমরা ছোট ছিলাম, তবে সে আমাদের বড় ছিলো, সে নিজের হাতে রিদিকে বড় করেছে! সেই জনের সাথে যে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে তাকে খুঁজতে সে রাস্তায় নেমে পড়ে। একে একে নানারকম তদন্ত সে নিজেই করতে থাকে। সব কিছুতে ইফার নাম সামনে আসে কারণ স্কুল থেকে ফেরার পথে তিন জনের সাথে ইফাকে দেখা গেছিলো। ”
ইফা তখন বলে, “আমি এ পথে যাচ্ছিলাম ওদের সাথে দেখা। ওদের কে আমি রতন স্যারের সাথে যেতে দেখেছিলাম।”
সেই হিসাবে রতন স্যার কে পুলিশে আটক করে। কিন্তু আদালতে স্বাক্ষি দিতে যেয়ে ইফা বলে,”রতন স্যার কে সে দেখে নাই। চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে তাকে বাধ্য করেছে এসব মিথ্যা কথা বলতে।”
ইফার বলা মিথ্যা কথার জন্য আদালতে আমরা হেরে যায়। তবে এতেই আপু থেমে থাকে না। তাদের সকলের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ আপু সংগ্রহ করে। তারা যখন জেনে যায়! যে মেরিনা সব কিছু জেনে গেছে তখন ঐ ইফা আপুকে মিথ্যা কথা বলে তার সাথে নিয়ে যায়। তারা আপুকে কিছুদিন পতিতালয়ে নিয়ে তাকে শেয়াল কুকুর দিয়ে খুবলে খাওয়ানোর পর রুপসী খালের পাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়।
এবার বলো যে মেয়ে এতো নিকৃষ্ট কাজ করে তার সাথে একটু অন্যায় হলে দোষের কী আছে? আর এটা জানো তো! তোমাদের ঐ আশ্রিত মেয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র না! ঐ মেয়ের কত জনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিলো? উঁহু জানো না। জানবে কি করে? নিজের স্বামীর চরিত্রের দোষ খুঁজতে তুমি ব্যস্ত।
এই ভাবী তুমি জানো দাইয়ান ভাই তোমার থেকেও হাজার গুণ ভালো। কে জানে তোমার চরিত্রে কোন কালির দাগ আছে কি না? কিন্তু আমার দাইয়ান ভাই একদম নির্দোষ। সে ইফাকে আজ পর্যন্ত কামুক হাতে স্পর্শ পর্যন্ত করে নাই। প্রতিদিন রাতে ইফার খাবারে কড়া জোড়ের ঘুমের মেডিসিন মেশানো হতো। তা-ই রাতে তারে সাথে কিছু হয়েছে কি না সে বলতে পারবে না। তবে সকালে দাইয়ান ভাই তার সাথে গভীর কিছু হওয়ার নাটক করতো। সারারাত সে বাহিরে থাকতো আর তার অনুপস্থিতি তে রুমে আমরা থাকতাম। তুমি তো দিব্বি মনের সুখে সারারাত ঘুমে কাটাতে। এদিকে কতো গুলো লোক নির্ঘুম থাকতো তার খোঁজ জানো?
আর ভাবছো আমি এতো বেশি উচড়ে পাকা হলাম কি করে? আর যার বাড়িতে দুই দুইটা মেয়ে ধর্ষিত হয়ে মারা যায়। সে বাড়ির মেয়েদের সকল প্রকারের। জ্ঞান থাকতে হয়।
রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”বুঝলাম তার সাথে ইফার কোন সম্পর্ক নেই। তোমাদের কাছে যখন এতো প্রমাণ ছিলো তখন কেনো এতো নাটক না করে তাকে সোজা পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিলে না? আর গ্রামে এতো খুন খারাপি হচ্ছে সে সব কিছুর পেছনে তোমরা আছো কী? ”
ঝর্ণা বিরক্তিকরভাবে বলে,”ভাবী আপনি না বাপের বাড়িতে যাচ্ছিলেন? চলেন আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। আপনার বাপের বাড়ির লোকেদের এখন আপনাকে খুব বেশি দরকার হবে।”
রিমশা :- মানে কী?
ঝর্ণা বলে,”সেখানে যান তারপর না হয় সবটা বুঝতে পারবেন। ”
রিমশা বাবার বাড়িতে চলে এসেছে। সে দাইয়ানের উপরে রেগে আছে কি না জানে না। তবে তার নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ হচ্ছে।
যে বাড়ির দুইটা মেয়ের জীবন একটা মেয়ের জন্য উজাড় হয়ে গেছে। সে মেয়ে তো দিব্বি শান্তিমত ঘুড়ে বেড়াচ্ছ। সে কি শাস্তি পাবে না?
*
*
পরেরদিন সকালে রুপসী খালপাড়ে ইফা আর মেম্বার সাহেবের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের লাশ দেখে অনেকেই লজ্জায় দূরে সরে এসেছে। তারা আপত্তিকর অবস্থায় ছিল। ঠিক সে সময় কেউ তাদের দু জনকে একসাথে খুন করেছে।
আমিও দর্শকের মতো ইফার লাশ দেখতে গেছিলাম। ওর লাশ দেখে কোন অনুভূতি প্রকাশ হচ্ছিল না। অনুভূতি গুলো আমার তিক্ত হয়ে গেছে।
ইফার লাশ দেখে এটাই বলেছি,” শতশত মেয়ের সম্মান নষ্ট করে, কেউ সম্মানের সাথে মরতে পারে না। ইফাকে অসম্মতি হয়ে মরতে হয়েছে। তার দুজনের লাশ দেখে সকলে থুঃথুঃ দিয়েছে। সবাই জানতে পেরেছে এই সাধারণ দেখতে মাসুম চেহারার মেয়ের নিকৃষ্ট রুপের কথা।”
পুলিন এসে তাদের লাশ নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের শেষে লাশ কবর দেওয়ার জন্য আপনজনের নিকটে হস্তান্তর করতে চেয়েছিল। তবে ইফার মা ইফার লাশের দাফন- কাফনের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। আর গ্রামের মানুষেরা তার জানাজাতে অংশগ্রহণ করতে নারাজ ছিলো।
তাই বাধ্য হয়ে পুলিশেরা বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে ইফা আর মেম্বারের লাশ কবর দেয়
এদিকে দাইয়ানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণ না হওয়াতে আদালত তাকে মুক্তি দিয়ে দেয়।
এদিকে দাইয়ান বাড়িতে ফিরে আসলে গ্রামের সকলে তার কাছে মাফ চেয়ে ফুলের মালা দিয়ে তাকে বরণ করে বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়িতে এসে সবাইকে হাসিখুশিতে দেখালেও তাদের হাসিতে প্রাণ ছিলোনা। ইলমা তার ভাইকে বলে,”ভাবী রাগ করে বাবার বাড়িতে চলে গেছে।”
দাইয়ান চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিরহাম ছোট ভাইয়ের কাছে এসে বলে,”রিমশা’র কাছে মাফ চেয়ে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।”
দাইয়ান বিয়েরপর আজ প্রথম শ্বশুর বাড়িতে এসেছে।
সবাইকে সালাম দিয়ে সে রিমশার সাথে দেখা করতে যায়।
রিমশা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিক মুখ করে তাকিয়ে থাকে। দাইয়ান তখন বলে,”জানি আমি অনেক ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তবে আজকের পর আর কখনো কোন ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিবো না প্রমিজ। আসলে ভেবেছিলাম এ পথে গেলে হয়তো আমি বাঁচবো না। ইফা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা হয়তো আমাকে মেরে দিবে। কিন্তু দেখো ভাগ্যের পরিহাস আজকে সে মৃত।”
রিমশা বলে,” আজকে সে মৃত না হলে কি নিজ হাতে তাকে খু-ন করতেন?”
দাইয়ান বলে,”আমাকে কি তোমার খুনি মনে হয়?”
রিমশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”আপনার আশেপাশের সবাইকে এখন বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়।”
দাইয়ান :-আমাদের প্রতি তোমার এতো অবিশ্বাস?
রিমশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,” পাপের বিনাশ করতে যে পাপ করতে হবে এর কোন মানে হয় না। এ গ্রামে এতো খুন হলো অথচ আসামী কে তা কেউ জানে না! এমনটা কি করে সম্ভব? ”
দাইয়ান বলে,”এসেছিলাম তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে নিজের সাথে নিয়ে যেতে। তবে এখন সেই ইচ্ছাটা আর নাই। তা-ই তোমাকে নিয়ে আর ঐ বাড়িতে যাচ্ছি না। তুমি থাকো তোমার পাপ-পূণ্যের হিসাব নিয়ে!”
এরপর দাইয়ান সেখান থেকে প্রস্থান করে।
(সত্যি কি রিমশা এখানে ভুল?)



চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here