দ্বিতীয় পুরুষ-পর্ব ১৩

0
351

#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৩
_নীলাভ্র জহির
চিত্রার শাশুড়ি তাকে তিন দিন সময় দিয়েছেন যৌতুকের সাইকেলটা দেয়ার জন্য। কিন্তু তার অসহায় বাবা জানিয়েছেন তার সামর্থ্য নেই । দুদিন কামলা দিয়েছেন কিন্তু কোন টাকা পাননি। খেয়ে না খেয়ে কোনমতে তার দিন যাচ্ছে। এমতাবস্থায় তিনি জামাইয়ের সাইকেলের জন্য কোন টাকা দিতে পারবেন না। সকালবেলা ফোন করে কথাগুলো জানিয়েছে চিত্রার ফুফু। তিনি কিছুটা আশ্বস্ত করে বলেছেন তার ছেলেদেরকে আর কিছুদিন সময় দিলে ওরা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। কিন্তু সেই কথার মাঝে কোন ভরসা ছিল না। চিত্রা বেশ বুঝতে পারছে সামনে তার করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে তার মাথাটা এবার নিচু হয়ে যাবে। শাশুড়ি মায়ের সামনে কিভাবে দাঁড়াবে বুঝতে পারছেনা চিত্রা।
পরের দুদিন খুব দুশ্চিন্তায় কাটলো। সময় চাওয়ার পরেও ফুপাতো ভাইদেরকে আবার অনুরোধ করাটা সমীচীন হবে না। তাই আপন মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে তার সংসারে পড়ে রইল চিত্রা। কেটে গেল কয়েকটা দিন। এরমধ্যে জোসনা বেগম তাকে কিছুই বলেনি। চিত্রা সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে কখন তিনি সাইকেলের কথাটা তোলেন। কি উত্তর দেবে সেটাও ঠিক করে রেখেছে চিত্রা। সে বলবে আপনার পোলার লগে আমার কথা হইছে। সে আমারে কইসে কয়দিন পরে দিলেও চলব। তার উত্তরে হয়তো জোসনা বেগম বলবেন আমার পোলার মাথাটা খাইয়া বইসা রইছ। এ ধরনের অনেক কথাই হয়তো তাকে শুনতে হবে। সেটার জন্য চিত্রা নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করল। তিনি যাই বলুক না কেন ছেলের কথা বলার পর হয়তো আরো কিছুদিন সময় পাওয়া যাবে। তবে চিত্রা এই বিষয়ের উপরে কিছুই জানালো না।
দিন কাটছে তার নিজের গতিতে। শাশুড়ি মায়ের সংসারে চিত্রার অধিকার খুব একটা নেই। শাশুড়ি তাকে যখন যা আদেশ দেয় সে শুধু তাই পালন করে। তিনি এসে বলেন আজকে কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না। চিত্রা বাড়ির পাশ থেকে কচুর লতি তুলে নিয়ে এসে রান্না করে ফেলে। শাশুড়ি যখন বলে আইজ আমার ঘরের বিছানার কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে দিও। চিত্রা কাপড়গুলো পাজা করে নিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে সানন্দে কাপড় ধুয়ে দেয়। এভাবেই চলছে তার সংসার। কখনো বা নিজের বুদ্ধিতে তাকে কাজ করতে হয়। প্রথম প্রথম এসব কিছুই বুঝতো না সে। কিন্তু সকালবেলা যখন শাশুড়ি বলতো বইসা না থাইকা যদি থালা বাসন গুলো ধুয়ে আনতা তাও তো একটা কাম হইতো। কখনো বা চিত্রাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তিনি বলেন গরুর পেট ভরে নাই। একটু যে ঘাস কাইটা দিমু সেই সময়টাও পাইতাছি না। তাই বুদ্ধি করে আগেভাগেই চিত্রার গরুকে খাবার দিতে হয়। সংসারের টুকিটাকি কাজ এখন সে নিজে থেকেই সামলে নেয়। তবে মাঝে মাঝে হয়ে যায় ভুলভ্রান্তি। দেখা যায় সে এমন একটা কাপড় ধুয়ে ফেলেছে যেটা ময়লাই হয়নি। তখন জ্যোৎস্না তার সঙ্গে রেগে যান। দুদিন আগে ধোয়া কাপড় এখনও পড়াই হয়নি অথচ সেটা সে কেন ধুয়ে দিয়েছে। আবার কখনো দেখা যায় এমন কাজ করে বসে আছে যেটা তার করার কোন প্রয়োজন ছিল না। এভাবেই চলছে তার সংসার।
এরই মধ্যে একদিন জোছনা বেগম সাইকেলের কথা তুললেন। চিত্রাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন,, কোন খবর টবর নাই যে।
চিত্রা বলল, কিসের খবর আম্মা।
কিসের খবর আবার? আমার পোলাডা কি এবার হাইটা হাইটা কামে যাইবো।
চিত্রা বলে ফেলল, আপনার পোলা কি এতদিন হাইটা হাইটা কামে গেছে?
রেগে গেলেন জোসনা বেগম। রাগত স্বরে বললেন, তুমি দেখতেছ না সে কেমনে যায় কামে। অত কথা বুঝিনা বাপু। মেলাদিন হইয়া গেল। বিয়ের দুই মাস হইয়া যায়। এখনও সাইকেল দিল না। কোন দিন আর দিবো। দিতে না পারলে তোমার বাপরে কও কইয়া দিক। আমি আমার পোলারে কই সে যেন নিজের টাকায় সাইকেল কিনা লয়। পোলা মানুষ করতে পারছি আর একটা সাইকেল কিনে দিবার পারুম না। সবই পারুম। তাও মানুষের একটা শখ থাকে শ্বশুর বাড়ি থাইকা কিছু পাওনের। তাই বইলা ভাইবো না আমরা তোমাগো আশায় বইসা থাকমু। তোমার বাপে যদি না পারে তাইলে আমরা আমার পোলারে সাইকেল কিইনা দিমু। শ্বশুরবাড়ির কোন আদর যেহেতু তার কপালে নাই সাইকেলের ও কোন দরকার নাই।
চিত্রা বলল-আপনার পোলার লগে আমার কথা হইছে। সে কইছে আর কয়টা দিন পরে দিলেও চলব।
তা তো করবোই। পোলা তো আর পোলার মধ্যে নাই। সে তো নিজের সমস্যা দেখবার পারতেছেনা। অন্ধ হইয়া গেছে। পোলাগো বিয়া দিলে তখন পোলারা অন্ধ হইয়া যায়। চোখে কিছু দেখবার পারেনা।
বিড়বিড় করে নানান কথা বলতে বলতে জোসনা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তবে তার বিলাপ কমলো না। বাড়ির ভিতরে যা বিড়বিড় করে বলেছেন বাড়ির বাইরে গিয়ে তা জোরে জোরে বলছেন। বিষয়টা খুবই কষ্টদায়ক। চিত্রার মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট হয়। তার শ্বাশুড়ীর এই স্বভাবটা মোটেও ভালো লাগে না তার। নিজেদের ঘরের কথা তিনি স্বেচ্ছায় এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেন। যেখানে তার উচিত ছিল ঘরের সমস্যা ঘরেই মিটিয়ে ফেলার সেখানে তিনি সব কথা গ্রামবাসীকে জানিয়ে অনেক সুখ পান বোধহয়।
চিত্রা ভাবল আজকের মত ঝামেলাটা মিটেছে। হাতে আরও কয়েকদিন সময় পাওয়া গেল নিশ্চয়ই এর মধ্যে তার ভাইয়েরা একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। কিন্তু তার ধারনা ভুল। রাত্রিবেলা রূপক ফিরলে জোসনা আবারও এই কথাটা তুললেন। ঘরের দাওয়ায় বসে সবাই মিলে ভাত খেতে বসেছে।
জোসনা বেগম রূপককে বললেন, তোর শ্বশুর বাড়ির ব্যাপার স্যাপার কিছু বুঝতাছিনা। তারা কি তোর সাইকেলটা দিব না নাকি? আমি কিন্তু তোর বউরে কইয়া দিছি যদি না দিবার পারে তাইলে না কইরা দিক। তুই একটা সাইকেল কিইনা লস। একটা সাইকেলের দাম আর কতই হইবো। এত কিছু করবার পারতাছস, একটা সাইকেল কিনবার পারবি না। অবশ্যই পারবি।
রূপক নিঃশব্দে ভাত খাচ্ছে। এক ফাঁকে বলল, আচ্ছা দেখি পুরান সাইকেল একটা পাইলে কিনা লমু।
সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন জোসনা বেগম। তবে সরাসরি স্বামী ও সন্তানের মুখের উপর কিছু বলতে পারলেন না।
খাওয়া-দাওয়ার পর বিড়বিড় করে জোসনা বেগম ছেলের দুর্ভাগ্যের বিলাপ করতে লাগলেন। মৃদু স্বরে কথা গুলো চিত্রার কানে এলো, সে রূপককে এ ব্যাপারে কিছুই বলল না। এ তার দুর্ভাগ্য। সে জন্মেছে গরীবের ঘরে। এতোটুকু দুঃখ তো তাকে সইতেই হবে।
পরপর কয়েকটা দিন কেটে গেল। সাইকেল নিয়ে আর তেমন কোন কথা উঠল না। চিত্রার জীবনে অশান্তি নেমে এলো সেদিন, যেদিন রূপক একটা পুরনো সাইকেল কিনে বাড়ি ফিরল। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জোসনা বেগম এর মাথায়।
রূপক সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ঢুকে ঘরের দাওয়ায় হেলান দিয়ে রাখলো সাইকেলটা। জোসনা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন, এটা কই পাইলি? কার থাইকা আনছোস? মানসের সাইকেল লইয়া কদ্দিন চলবি।
রূপক সঙ্গে সঙ্গে হেসে উত্তর দিলো, মা আমি এইটা কিনছি। তুমিতো কইছিলা একটা সাইকেল কিনা লস। তাই কিইনা আনলাম। রফিককে কইছিলাম একটা সাইকেলের খোঁজ করতে। ও আইজ সাইকেলটার কথা কইল। দেখতে গিয়া নিয়া আইলাম।
জোসনা বেগম রাগত স্বরে বললেন, তোর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। কিল্লাইগা সাইকেল কিনছোস। তুই আইজ রাইতেই সাইকেল ফেরত দিয়া আসবি।
রূপক বলল, সেটা তো আর হইব না মা। সাইকেলটা আমি ঘন্টাখানেক চালাইয়া দেখছি। জিনিস সব ঠিকঠাক। নগদ টাকা দিয়া আইছি। এটাতো আর ফেরত দেওয়া যাইবো না। এই সাইকেল এখন আমার।
মাথা গরম হয়ে গেল জোসনা বেগমের। যে জিনিস ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাবার কথা সেটা ছেলে নিজের টাকায় কিনে নিয়ে এসেছে। অথচ তার নতুন বউ হেসে-খেলে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। সাইকেলের ব্যাপারে সে বাপের বাড়িতে কোনো জোরাজোরি ও করেনি মনে হচ্ছে। উলটো সে হয়ত নিজেই রূপককে কুবুদ্ধি দিয়ে এই পুরনো সাইকেল টা কিনিয়ে নিয়েছে। সব দোষ ঐ মেয়ের এটা ভেবে জোসনা বেগম ভয়ঙ্কর রেগে ঘরের ভেতরে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকিয়ে দিয়েন। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এত বড় একটা ঘটনা কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এই মেয়ে তার সংসারে একটা অশান্তি বয়ে নিয়ে আসবে তিনি নিশ্চিত ।
চিত্রা ঘর থেকে বের হয়ে সাইকেল দেখে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। রুপক তাকে ভালোবাসে এটা সেই ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। সে সাইকেল কিনে এনেছে মানে চিত্রার সম্মানটাকে উঁচু করেছে। কারণ এতে করে চিত্রাকে আর বাপের বাড়িতে সাইকেলের জন্য তাড়া দিতে হবে না। শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবেনা ছোট হয়ে। রুপক ভীষণ ভালবাসে তাকে। চিত্রা ছুটে এসে রূপকের হাতটা খপ করে ধরলো। এই প্রথম রূপকের হাত ধরতে তার লজ্জা করল না। অধিকারবোধের প্রবল টানে সে রূপকের বুকের কাছে নিজেকে লেপ্টে নিল। আবছা অন্ধকারের মাঝে চোখে চোখ রেখে বলল আপনি সাইকেল কিইনা আনছেন। কত টাকা দাম লইছে?
রুপক বলল, দাম শুনে কি করবা? জিনিসটা কেমন কিনছি হেইডা কও?
চিত্রা সাইকেলটা পরখ করে বললো ভালোই তো মনে হইতাছে।
আন্ধারের মধ্যে তো কিছুই বুঝবা না। সকালবেলা দেইখো। আমার মেলা দিনের শখ আছিল সাইকেলে বউরে বসাইয়া ঘুরতে বাহির হইবো।
লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল চিত্রার মুখ। সে বলল, আপনি খালি বেশি বেশি কথা কন? আম্মা সাইকেল দেইখা কি কইলো?
কিছু কয় নাই। অনেক ক্ষুধা লাগছে দুইটা ভাত দাও তো খাই।
আপনে হাত মুখ ধুইয়া আসেন আমি ভাত দিতাছি।
চিত্রা রান্নাঘরে গিয়ে গামলা ভরে ভাত ও বাটিতে করে তরকারি নিয়ে দাওয়ায় রাখল। হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো রূপক। তার শাশুড়ি ঘরের ভেতর। তাই চিত্রা নিজেই তার স্বামীকে আজকে আপ্যায়ন করল। এই প্রথম সংসারের এক অন্যরকম স্বাদ আস্বাদন করতে পারলো চিত্রা। স্বামীর ভাতের প্লেটে তরকারি তুলে দিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করতে পরম আনন্দ হচ্ছিল। যদিও বাতাস করার কোন প্রয়োজন নেই। দাওয়ায় দক্ষিণ দিক হতে শিরশির করে বাতাস আসছে। গা হিম করা বাতাস। সেই হাওয়ায় বসে পেট ভরে ভাত খাচ্ছে তার স্বামী। তবুও মনের সুখে চিত্রা হাতপাখা নেড়ে বাতাস করছে। এতে তার পরমানন্দ।
সারারাত আজ চিত্রার মনে পরম সুখ বিরাজ করল। সে জানতেও পারল না পরের দিন তার কপালে কত বড় দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। আজ রাতে রাগ করে জোসনা বেগম ভাত খেলেন না। স্বামীর সঙ্গে আগেভাগে ভাত খেয়ে ফেলায় সেটা জানতেও পারল না চিত্রা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজকর্ম করার সময় ভাতের হাড়িতে অনেকখানি ভাত দেখে চিত্রা অবাক হল। গরুর জন্য প্রতিদিন অল্প কিছু নষ্ট ভাত থাকে । কিন্তু এতগুলো ভাত থাকার কথা নয়। তাহলে এতগুলো ভাত পাতিলে কি করে এলো।
চিত্রা তার ননদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো রাতে আব্বা আম্মা ভাত খাইছে?
তার ননদ মৃদু স্বরে বলল আব্বা খাইছে আম্মা উঠে নাই।
উঠে নাই মানে?
আমার কাইল শরীর ভালো ছিল না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ছিলো। আব্বা আসার পর আর উঠে নাই। আমি তো আব্বারে ভাত দিছি।
চিত্রার মাথা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার শাশুড়ির শরীর খারাপ ছিল অথচ সে জানতো না। সে একবার খোঁজ নেয়নি এমনকি ভাত খাওয়ার ব্যাপারে শ্বশুর-শাশুড়িকে সাধেনি। একদম অন্যায় হয়েছে তার। অপরাধবোধে চিত্রা কুকড়ে গেল। টুকিটাকি কাজ করতে করতে মনে মনে সে ভাবছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে আজকে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
চিত্রা যখন পাতিলে চাল ধুয়ে দিয়ে জ্বাল ধরিয়ে দিল। তখন কোথা থেকে উদয় হলেন জোসনা বেগম। তার মুখটা গমগম করছে। চিত্রা বুঝতে পারল না কি হয়েছে উনার।
সে জিজ্ঞেস করল, আম্মা আপনার কি শইলটা খারাপ?
জোসনা বেগম কোন উত্তর দিলেন না।
চিত্রা আবারো বললো, আম্মা আপনের মনে হয় জ্বর আইছে। চোখ মুখ দেইখা তাই মনে হইতাছে। আপনে শুইয়া থাকেন। কি কাম করতে হইবো আমারে কন? আমি করতাছি।
জোসনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে ক্যাটক্যাটে গলায় উত্তর দিলেন, কি কাম আর করতে হইবো তোমার? স্বামীর লগে গিয়া শুইয়া থাকো। রঙ্গ তামাশা করো। পিরিতি পিরিতি খেলো। আর কি করবা?
মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল চিত্রা। মুহুর্তেই তার হৃদয়টা একদম বিষাক্ত হয়ে উঠলো। এ আবার কোন ধরনের ভাষা। নিজের কান ঝালাপালা করছিল তার। চিত্রা চুপ করে রইলো। জোসনা বেগম রান্না ঘরে ঢোকা মাত্রই চুলার ধার থেকে উঠে বেরিয়ে এলো সে।
চুলায় ভাত বসিয়েছিল। চুলার আগুন নিভাতে শুরু করেছে। জ্যোৎস্না বেগমের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি রান্নাঘরের মাচা থেকে পাতিল ও থালা বাসন গুলো নামিয়ে নিচে রাখতে লাগলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল চিত্রা।
সব হাড়ি-পাতিল নামানো হয়ে গেলে ছোট ছোট কিছু পাতিল একদিকে সরিয়ে দিয়ে জোসনা বেগম বললেন, এগুলা নিয়া যাও। আর কিছু দিতে পারমু না। অনেক কষ্টে সংসার এর জিনিস করছি।
কাহিনীর আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে চিত্রা বললো এগুলো দিয়ে আমি কি করুম?
যা চাইতাছ তাই করবা।
বুঝতে না পেরে চিত্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার শাশুড়ির দিকে।
জোসনা বেগম বললেন, তোমারে পাঁচ সের চাউল দিতাছি। নতুন চাউল ঘরে উঠলে তখন ভাগ কইরা দিমু চাউল। এইগুলা শেষ হইলে রূপককে কইবা বাজার থেইকা চাউল কিনা আনতে।
চাউল দিয়ে আমি কি করমু?
ভাত রাইন্ধা খাইবা।
আর আপনেরা?
তুমি কি ভাবছো আমি তোমার হাতের ভাত এখনো খামু? আমার কপালে যেন সেই খাওয়ান আর না জোটে। তোমার ভাত তুমি রাইন্ধা খাইও। তোমার নায়করেও খাওয়াইয়ো। ঘরের ওই পশ্চিম দিকে ওই জায়গায় ছোট কইরা একটা চালা তুইলা রান্না ঘর বানাইয়া লইও।
মুহূর্তেই চিত্রা বুঝে গেল তার শাশুড়ি কি করতে চাচ্ছেন। জোসনা বেগম আলাদা করে দিচ্ছে তাকে। এখন থেকে জোসনা বেগম আর তার সঙ্গে একই হাড়ির ভাত খাবেন না। একই বাড়িতে থাকলেও চিত্রার রান্না-বান্না ও সংসারের হিসাব-নিকাশ সবকিছুই হবে আলাদা। তাকে আলাদা করে বাজার করে নিজের মত করে সংসার চালাতে হবে। আর তার শ্বাশুড়ীর সংসারে তার কোন অধিকার থাকবে না। এমনকি চিত্রার সংসারে থাকবেনা জোসনার কোন অধিকার। বিয়ের মাত্র ক’দিনের মাথায় অকস্মাৎ এই আলাদা হওয়ার ব্যাপারটা চিত্রার খুব কষ্টদায়ক মনে হল। তার শাশুড়ি নিশ্চয়ই সাইকেল কেনার ঘটনায় আঘাত পেয়েছেন। কারণ তিনি সাইকেলটা যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন। আর এ কারনেই আলাদা করে দিলেন চিত্রাকে। সবকিছু বুঝতে পেরে চিত্রার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল। তার নিজের মা নেই সে ভেবেছিল জোসনা বেগমের বুকে মেয়ের মত থাকবে সে। অথচ এই বাড়ির বউ হয়ে আসতে না আসতেই মায়ের ছায়াটুকু সে হারিয়ে ফেলল। জোসনা বেগম তাকে সংসার থেকে আলাদা করে দিলেন।
চিত্রা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তার শ্বাশুড়ীর পায়ের কাছে এসে বসলো, আম্মা আমারে আলাদা কইরা দিয়েন না। আমি আপনাগো লগে থাকব। আমি তো সংসারের কিছুই বুঝিনা। আমি তো আপনের মায়ের মত।
জোসনা বেগম চোখমুখ শক্ত করে রইলেন। চিত্রা আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলল আম্মা আমারে আলাদা কইরা দিয়েন না।
জোসনা বেগম কোন কথা না বলে চুলার ওপর থেকে চিত্রার তুলে দেওয়া ভাতের পাতিল সাইডে নামিয়ে রাখলেন। তারপর অন্য একটা পাত্রে পানি ঢেলে সেই পাতিলটা যখন চুলার উপরে তুলে দিলেন তখন চিত্রা নিশ্চিত হলো তার শ্বাশুড়ীর হৃদয়টা ভীষণ নিষ্ঠুর। সবকিছু মেনে নিয়ে আলাদা তাকে হতেই হবে।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here