বৃষ্টিময় প্রেম -পর্বঃ৬২

0
703

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৬২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সাবধানতার সাথে কোল থেকে পূর্ণর মাথা উঠিয়ে পাশের বালিশে রাখতেই পুনরায় ফোন বেজে উঠলো৷ ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে কিছুদূর যেতেই কেটে গেলো কল। হয়তো জরুরি কিছু হবে ভেবে বারান্দায় প্রবেশ করে রায়হান ভাইকে কলব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক তখনি তার মেসেজ এলো ফোনে,
—এ অসময়ে ফোন দেওয়ার জন্য সরি। কিন্তু আমি একটা দরকারি কথা বলার জন্যই ফোন দিয়েছি। সময় পেলে কলব্যাক করো। অপেক্ষায় থাকবো।
তার মেসেজ দেখে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হলো। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। একটি শ্বাস ফেলে কলব্যাক করলাম রায়হান ভাইকে। দু-একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করলেন তিনি। আমি কিছু বলার আগেই অস্থির কণ্ঠে তার আওয়াজ,
—হ্যালো, তুরফা? ভেরি সরি এই মুহুর্তে কল দেওয়ার জন্য এন্ড থ্যাংকস কলব্যাক করার জন্য। কিছু কথা বলার ছিলো, দুটো মিনিট হবে?
—ইটস ওকে, ভাইয়া। বলুন কি বলবেন।
—তুমি একটু আমাকে প্রিয়ার সাথে কথা বলানোর ব্যবস্থা করবে, প্লিজ? ও ক’দিন ধরে আমাকে ইগ্নোর করছে। এ পর্যন্ত তো ঠিক ছিলো কিন্তু আজ ওর সাথে দেখা করার পর বাসায় যেয়ে আমায় ব্লক করে দিয়েছে৷ বড় একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে আমাদের ভেতর। এটাকে প্রশ্রয় দিলে সমস্যা। তুমি একটু ওকে যেয়ে ফোনটা দিবে প্লিজ? আমার কথা বলিও না, তাহলে নিবেনা। শুধু ওকে ফোনটা…
—ভাইয়া, শান্ত হোন। থামুন একটু? আমি আপনার চিন্তা বুঝতে পাচ্ছি কিন্তু চাইলেও প্রিয়াকে ফোন দিতে পারবোনা এখন। কারণ সে বড়াম্মুর সাথে ওর খালার বাসায় গিয়েছে বিকেলে। মা-মেয়ে দুজনই আজ ওখানেই থাকবে৷
—কোন খালার বাসায় গেছে? মেজো খালা কি?
—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি এসব জানলেন কিভাবে?
—ওহ নো! জানো ওর ওই খালা নাকি ওর জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ পেয়েছে। সেই ছেলে বিদেশ থেকে আসার কথা ছিলো এ মাসে, ওকে দেখতে আসার জন্য। প্রিয়া আমায় মজার ছলে বলেছিলো এ ব্যাপারে। আমি তখন পাত্তা দিইনি কারণ আমি জানতাম ও রাজি হবেনা। কিন্তু এখন আমার ভয় হচ্ছে রাগের বশে ও যদি রাজি হয়? মেয়েটা এত জেদি, ওকে নিয়ে আমি করবো! আমার খুব টেনশন হচ্ছে, তুরফা।
রায়হান ভাইয়ের কথায় আকাশ থেকে পড়লাম। খানিকক্ষণ লাগলো তার কথা বুঝে উঠতে! তাদের দুজনের মাঝে যে এতকথা আদানপ্রদান হয় জেনে কিছুটা বিস্মিত হলাম বটে! তবুও তাকে শান্ত রাখতে বললাম,
—ভাইয়া, রিল্যাক্স। আমি প্রিয়াকে চিনি। ও রেগে গেলেও এমন কিছু করবেনা। আর আমার মনে হয়না সেই ছেলে ওকে দেখতে আসবে। এমন কিছু হলে তো বড়াম্মু অবশ্যই বাসায় বলতো! আপনি এত টেনশন নিয়েন না!
তবে আমার এত বুঝানোতেও তার মনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন হলো বলে মনে হলোনা। আগের ন্যায় অস্থির কণ্ঠেই বললেন,
—আমি আর কিছু ভাবতে পাচ্ছিনা। যা ভাবার ভেবে নিয়েছি। আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে চাই। ওর বোর্ড পরীক্ষা শেষ হলেই আমরা বিয়ে করবো, তুমি প্লিজ পূর্ণকে বলো কাল আমার সাথে দেখা করতে। আমি নিজে ওর সাথে কথা বলে প্রিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চাই!
রায়হান ভাইয়ের কথায় আঁতকে উঠলাম! এত বড় একটা কথা হঠাৎ করেই বলছেন যে, বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয়ে তাড়াহুড়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া তো উচিত নয়। বিচলিত কণ্ঠে তাকে বললাম,
—দেখুন ভাইয়া, প্লিজ একটু ঠান্ডা হন। আপনি হয়তো নিজেও বুঝছেন না ঝোকের বশে কি বলছেন। আমি জানি আপনি ওকে পছন্দ করেন তাই বলে বিয়ের ব্যাপারে এত তাড়াতাড়ি ডিসিশন নেওয়া ঠিক না, একটু সময় নিয়ে ভাবুন….
—আমি সময় নিয়েই ভেবেছি। আজ বিকেল থেকেই ভাবছি এ ব্যাপারে। প্রিয়াকে প্রপোজ করে ওর এইচএসসির পর তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর ইচ্ছে ছিলো আমার। কিন্তু মেয়েটা আমাকে জ্বা/লি/য়ে মা/র/ছে দেখছি! শান্তিতে থাকতে দিবেনা। এখন ওকে ওর ভাষাতেই মানাতে হবে। পূর্ণ যদি তোমার আশেপাশে থাকে তবে ওকে ফোন দেও প্লিজ! আমি ওর সাথে কথা বলে কাল দেখা করতে বলবো আমার সাথে। আই হোপ ওর টাইম হবে?
—উনি তো ঘুমোচ্ছেন। মাথা ব্যথা ছিলো তাই আর ডাকবোনা এখন, একটু শান্তিতে ঘুমাক। আর আপনি যখন এত করে বলছেন তাহলে আমি তাকে অবশ্যই বলবো আপনার সাথে দেখা করার কথা। তবে ভাইয়া, কাল কিন্তু উনার ফ্লাইট আছে রাতে। চট্টগ্রাম যাবেন তিনদিনের জন্য। তাই এর আগেই সময়-সুযোগ বুঝে উনার সাথে দেখা করতে হবে আপনার মাথায় রেখেন!
—হুম, ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ সময় নিয়ে আমার কথা শুনার জন্য। এখন তাহলে রাখছি। পূর্ণ উঠে যাবে হয়তো? ভালো থেকো।
—ঠিকাছে। আল্লাহ হাফেজ।
রায়হান ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে রুমে প্রবেশ করলাম। পূর্ণ এখনো ঘুমোচ্ছেন। এদিকে রাত প্রায় ন’টা বাজে। উনি টাইম-টেবিল মেইনটেইন করে চলা মানুষ! এখন না খেলে হয়তো রাতের খাবার খাবেন না আর! তাকে ডাকার উদ্দেশ্যে বিছানায় বসলাম। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতেই কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে ঘুমুঘুমু চোখ মেলে তাকালেন তিনি। আমায় দেখে একগাল হেসে আড়মোড়া ভেঙে উঠে গেলেন। খাটে হেলান দিয়ে বসে আমার দিক তাকাতেই উৎফুল্ল মুখে বলে উঠলাম,
—এখন একদম ফ্রেশ লাগছেনা? মাথাব্যাথা পুরোপুরি চলে গিয়েছে বলুন?
আমার চঞ্চলতায় একগাল হেসে খানিকটা এগিয়ে এলেন তিনি। নিজ হাতের মুঠোয় আমার হাতজোড়া পুরে নিয়ে বললেন,
—তোমার হাতে জাদু আছে, তুরফা রাণী। মাথাব্যথা-কে তো পালাতেই হতো!
কথা বলা শেষ করে আলতোভাবে চুমু খেলেন আমার হাতজোড়ায়। এদিকে আমি লাজুক হেসে তার কীর্তিকলাপ দেখে চললাম শুধু! মুহুর্তের মাঝেই তিনি বলে উঠলেন,
—খুব ক্ষুধা লেগেছে, বউ। লাঞ্চ করার পর কিছুই খাইনি। তাড়াতাড়ি খেতে দেও। ডিনারের টাইম পার হয়ে যাচ্ছে!
—জানি তো এমনটাই হবে! সারাদিন কাজ করতে করতে অন্যকিছুর হুশ থাকে আপনার? এগুলোই করবেন। তারপর যেদিন শরীর খারাপ হবে ওইদিন বুঝবেন! এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে!
দ্রুত বেগে কথাগুলো বলতে বলতে তাকে বিছানা থেকে তুলে ওয়াশরুমের দিক ঠেলে পাঠালাম। এরপর নিজেও চলে গেলাম রুমের বাহিরে। এ লোকটা দুনিয়ার সবার খেয়াল রাখতে পারে শুধু নিজের খেয়াল রাখতে পারেনা। এমনটা করলে হয়? উনাকে নিয়ে আর পারা যায়না। অসহ্য!
_____________________
পরেরদিন সকালে পূর্ণ রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরোনোর আগে তার হাত ধরে থামিয়ে দিলাম। উনি ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলেন “কি?”। জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে উনাকে রায়হান ভাইয়ের কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। মনে সাহস জোগাড় করে বললাম,
—একটা কথা বলার ছিলো। কাল থেকে বলবো বলবো করে আর বলাই হলোনা। একটু শুনবেন?
—তুমি একটা কেন হাজারটা কথা বলতে পারো আমাকে। তোমার কথা আমি কখনো শুনিনি এমনটা হয়েছে? তবে যাই বলার তাড়াতাড়ি বলো, তুর পাখি। অফিসে দেরি হয়ে যাবে কিন্তু!
—আসলে রায়হান ভাই ফোন দিয়েছিলো কাল, আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন তখন। তো উনার আর প্রিয়ার ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে চাইছিলেন আপনার সাথে, হয়তো বিয়ের প্রস্তাব দিবেন। আমিও মানা করেছিলাম প্রথমে, আপনার যে আজ সময় নেই সেটাও বলেছিলাম তারপরেও অনেক অনুরোধ করলেন বেচারা! তাই আর ফেলতে পারলাম না৷ ভাইয়া নিজেই চলে যাবে আপনার কাছে। আপনি শুধু তার সাথে একটু দেখা করবেন তাহলেই হবে। করবেন না বলুন? আমার উপর রাগ করবেন না প্লিজ?
ভয়ে ভয়ে এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। ভেবেছিলাম এই বুঝি রেগে যাবেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ শান্ত চোখে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। দু-হাতে আমার কাধ ঝাকিয়ে বললেন,
—কাম ডাউন, তুরফা। এত ভয় পাচ্ছো কেন? আমি রেগে নেই তোমার উপর। তোমার তো দোষ নেই এখানে!
তার কথায় স্বস্তির সাথে খুশির ঝলক খেলে গেলো চোখেমুখে। খুশির চোটে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—সত্যিই আপনি রেগে নেই? আমার যে কি ভালো লাগছে! আচ্ছা, আপনি তাহলে দেখা করছেন তো রায়হান ভাইয়ের সাথে তাই না?
—দেখা করতে চাইছিলাম না। কিন্তু তুমি যখন কথা দিয়ে ফেলেছো দেখা করানোর তখন তোমার সম্মানের খাতিরে তো দেখা করতেই হচ্ছে। ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে কোন সময় আসতে চায়।
—উম ঠিক বলেছেন। কখন ফ্রি থাকবেন আমায় বলিয়েন, আমি তাহলে ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বলে দিবো ওই সময় আপনার সাথে দেখা করতে যেতে!
—তোমাকে এত পাকনামি করতে হবেনা। আমার কাছেও ওর নাম্বার আছে। অযথা তুমি কেন কথা বলবে ওর সাথে? আমিই ফোন দিয়ে বলে দিবো।
আমায় ছেড়ে দিয়ে মাথায় গাট্টি মেরে চোখ পাকিয়ে বললেন তিনি। বাধ্য বালিকার ন্যায় এক গাল হেসে তার কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলাম। অতঃপর বরাবরের ন্যায় কপালে চুমো দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বিদায় নিলেন তিনি।
______________________
চৌধুরী অফিসের আশেপাশেই এক ক্যাফেতে বসে আছে রায়হান। সামনের চেয়ারটা ফাঁকা কেননা পূর্ণ এখনো আসেনি। অবশ্য যে সময় দেখা করার কথা ছিলো সে সময় এখনো হয়নি, ৫ মিনিট বাকি আছে। রায়হান নিজেই আগেআগে চলে এসেছে। হবু শ্যালকের সামনে নিজের ইম্প্রেশন খারাপ করতে চায়না কিনা? যথারীতি ঘড়ির কাটায় ৫ মিনিট পেরোতেই চলে এলো পূর্ণ। বরাবরের ন্যায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে রায়হানের সামনের চেয়ারটায় বসলো সে। যদিও সে জানে এখানে রায়হান কেন এসেছে তবুও ব্যাপারটা চেপে শান্তমুখে নিজের সামনে বসা নার্ভাস রায়হানকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো,
—আশা করি ভালো আছো? জানোই তো আমার হাতে আজ বেশি সময় নেই। তো ঝটপট বলো, হঠাৎ এভাবে দেখা করার কারণ?
এতক্ষণ নিজের মধ্যে কনফিডেন্স থাকলেও পূর্ণর শান্ত গলা শুনে হঠাৎ করেই যেন নার্ভাসনেস বেড়ে গেলো রায়হানের। মনে হচ্ছে যেন ভাইভা বোর্ডের সামনে বসে আছে সে! নিজেকে ঠান্ডা করতে পরপর কয়েকটা বড়বড় শ্বাস নিয়ে প্রস্তুত হলো সে! আজ যে ও পূর্ণকে বুঝিয়েই ছাড়বে প্রিয়ার প্রতি ওর মনের অনুভূতির কথা, যেভাবেই হোক তাকে মানিয়েই ছাড়বে সে! এটাই রায়হানের বিশ্বাস! প্রিয়াকে নিজের করে পেতে হলে যে তাকে এটা করতেই হবে!
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here