বৃষ্টিময় প্রেম -পর্বঃ61

0
477

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৬১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
দেখতে দেখতেই কেটে যায় সময়। তেমনিভাবে প্রান্ত-রাইসার অনুষ্ঠানের পর বেশ কয়েক সপ্তাহ পেরিয়েছে। এই কয়েক সপ্তাহে বদলেছে বেশ কিছু সমীকরণ। তার মধ্যে রায়হান-প্রিয়ার সম্পর্ক অন্যতম। এই যেমন সেদিন রায়হানকে অন্য মেয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলতে দেখে প্রিয়া ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। প্রথম প্রথম রায়হান বিষয়টা বুঝতে না পেরে অতটা পাত্তা দিতোনা কিন্তু দিন যত যাচ্ছে প্রিয়া ওকে ক্রমাগত ইগ্নোর করেই চলছে। তাই এ বিষয়ে প্রিয়ার সাথে কথা বলতে ওর কলেজের সামনে দাঁড়িয়েও ওর দেখা পায়নি, কেননা বরাবরের ন্যায় রায়হানের জন্য অপেক্ষা না করে এখন আগে আগেই বাসায় চলে যায় মেয়েটা! তাইতো আজ ওকে হাতেনাতে ধরার জন্য কলেজ ছুটির বেশ কিছু সময় আগেই চলে এসেছে রায়হান।
হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময় দেখে নিলো, মিনিট পাচেকের মধ্যেই বের হওয়ার কথা প্রিয়ার! এসব ভাবতে ভাবতে রায়হান হালকা হাসে৷ কখনো ভাবেনি তার জীবনে এক বসন্ত যেতে না যেতেই এভাবে আরেকটি বসন্তের দেখা মিলবে! কয়েকমাসের অল্প ব্যবধানেই যে বেশ গভীরভাবেই প্রিয়ার মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে! তাইতো আজ সব দ্বিধাদন্ড ভুলিয়ে প্রিয়াকে প্রপোজ করার উদ্দেশ্যে ছুটে চলে এসেছে!
সহাস্যে এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ পড়লো কলেজ গেটের দিকে। আর মুহুর্তেই যেন ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো রায়হানের! প্রিয়া একটি ছেলের সাথে মনের সুখে গল্প করতে করতে হেটে আসছে। দুজনের ভাব দেখে প্রত্যক্ষ যে তারা দুজনে বেশ ভালো বন্ধু, বুঝতে অসুবিধা হলোনা রায়হানেরও!
“শুধুই বন্ধু, নাকি অন্যকিছু? তুই প্রপোজ করিসনি বলেই হয়তো অন্য কারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে প্রিয়া!” প্রশ্ন করলো তার মস্তিষ্ক। কিন্তু মন যে মানতে নারাজ, প্রিয়া ওর সাথে এমনটা করবে সে বিশ্বাস করেনা। অপরদিকে দুজনের খিলখিলিয়ে হাসাটা জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করছে রায়হানের হৃদয়। চোখ-মুখ শক্ত করে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো সে। আচমকা রায়হানকে নিজের সামনে আবিষ্কার করে থতমত খেয়ে গেলো প্রিয়া! মুহুর্তেই হাসি উবে গেল তার ঠোঁট থেকে।
—আ-আপনি এখানে কি করছেন?
—লোকটা কে হয়, প্রিয়ু? তোমার পরিচিত নাকি?
কিন্তু প্রিয়াকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলোনা। ছেলেটার মুখে নিজ প্রিয়তমার আদুরে ডাক শুনেই রাগ কন্টোল করতে ব্যর্থ হলো সে। তাইতো টানতে টানতে নিয়ে গেলো প্রিয়াকে কলেজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
—এই, কি করছেন আপনি? হাত ছাড়ুন আমার! মানুষ দেখছে কিন্তু। শুনছেন? হাতে লাগছে আমার। ছাড়ুন প্লিজ, ভাইয়া।
প্রিয়ার শেষোক্ত কথায় হঠাৎ করে থেমে গেলো রায়হান। হাত ছেড়ে পেছন ফিরে রাগান্বিত কণ্ঠে তেড়ে এসে বলে উঠলো,
—কি বললে তুমি? ভাইয়া? এখন আমি তোমার ভাই লাগি নাকি?
সর্বদা শান্তশিষ্ট দেখে আসা ছেলেটার এমন রুপ দেখে বেশ বিচলিত হয়ে পড়লো প্রিয়া। রায়হানের এমন রুপ তো আগে কখনো দেখেনি! ইতস্তত করে কোনোমতে বললো,
—আপনি এমন করছেন কেন? কি সমস্যা?
—সমস্যা আমার? রিয়েলি? এ প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত! কি হয়েছে তোমার? সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠানের পর থেকে এরকম করছো কেন আমার সাথে? কতবার কথা বলার চেস্টা করেছি, ফোন দিয়েছি, মেসেজ দিয়েছি, খোজ নেওয়ার চেস্টা করেছি। কিন্তু তুমি সমানে ইগ্নোর করেছো। আর আজকে তো আরেকধাপ এগিয়ে গেলে! এটুকু টাইমের মধ্যে নতুন বয়ফ্রেন্ডও বানিয়ে নিলে মনে হচ্ছে! আমাকে আর ভালো লাগেনা?
—আপনার এসব বাজে কথা শুনার ইচ্ছে নেই আমার কাছে। আমি আপনাকে কোনোকিছুর কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। যার সাথে সেদিন হেসেখেলে গল্প করছিলেন তাকে গিয়ে এসব বলুন। আমাকে নয়, বুঝেছেন?
প্রিয়ার কথায় স্পষ্ট অভিমানের ছাপ, ঠিক কোন কারণে তাকে এতদিন ইগ্নোর করা হচ্ছিলো বিষয়টি এবার বুঝতে অসুবিধা হয়নি রায়হানের! প্রায় সাথে সাথেই কণ্ঠস্বর নরম করে তার উত্তর,
—আরে, তুমি এ বিষয়টার জন্য আমার সাথে এমন করছো? প্লিজ ভুল বুঝোনা। আমার পুরো কথাটা তো শুনো। ও আমার সব ফ্রেন্ডদের থেকে স্পেশাল তাই…
—ওহ। ও স্পেশাল? তাহলে আপনার স্পেশাল মানুষের কাছেই থাকুন। আমার কাছে আপনার কি?
তাচ্ছিল্যপূর্ণ কণ্ঠে কথাটা শেষ করতেই প্রিয়ার ফোন বেজে উঠে। ড্রাইভার ফোন করেছে, নিতে এসেছে তাকে। ফোনে কথা শেষ করে জোরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে বললো,
—দেখুন, এখন আমাকে যেতে হবে। ড্রাইভার নিতে এসেছে। আপনি আমার পিছে আসবেন না, ড্রাইভার দেখে ফেললে বাসায় বলে দিতে পারে। এ রিস্ক আমি নিতে চাইনা। আপনি চলে যান।
—কিন্তু প্রিয়া, আমাকে একবার বলার সুযোগ তো দেও…
—আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাইনা, রায়হান ভাই। বললাম না পথ ছাড়ুন? বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার!
অতঃপর কোনো কথা না শুনেই প্রিয়া চলে গেলো গাড়ির উদ্দেশ্যে। অসহায় চোখে সেদিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকলো রায়হান। হঠাৎ করেই যেন বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। একবার ভালোবাসাকে হারিয়েছে, দ্বিতীয়বার হারানোর সাধ্য নেই তার। বারকয়েক চোখ বুঝে বড় বড় নিশ্বাস ফেললো সে। অতঃপর ঠান্ডা মাথায় মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিজ জীবনের এক শক্তপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে!
__________________
সন্ধ্যাবেলা পড়ার টেবিলে বসে বসে পড়ছিলাম। এডমিশন একদম দরজায় কড়া নাড়ছে! সপ্তাহ দুয়েকেরও কম সময় বাকি আর! শেষ মুহুর্তে যতটুকু ঠান্ডা মাথায় পড়া যায় পড়ার চেস্টা করছি। আজকাল পূর্ণও বাসায় থাকলে না নিজে আমায় খুব একটা ডিস্টার্ব করেন, না অন্য কাউকে করতে দেন। আবার মাঝেমধ্যে তো উনি নিজেই রাইসাকে বলে আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসেন। এ নিয়ে যদিও রাইসা আমায় বেশ ক্ষেপিয়েছে, আমি উনাকে মানা করেছি তাও তিনি শুনলে তো! তার তো একটাই কথা – আমার ধ্যান-জ্ঞান এখন সব পড়াশুনার দিক দিতে হবে! সে যাই হোক, পড়তে পড়তেই কাধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরলাম। পূর্ণ অফিস থেকে ফিরেছেন। ঘড়িতে দেখি ৭টাও বাজেনি। উনি সচারাচর এত তাড়াতাড়ি আসেন নাহ। তাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে মিস্টি হাসি উপহার দিলাম, বিনিময়ে উনিও মলিন হাসলেন।
—পড়াশুনা হয়েছে, তুর পাখি?
—এইতো করছিলাম। তবে আপনি আজ এত জলদি এলেন যে?
—মাথা ব্যাথা করছে খুব। আর থাকতে পারছিলাম না তাই চলে এলাম।
ক্লান্ত মুখে বললেন তিনি। তার কথায় মনোযোগী দৃষ্টিতে ভালোভাবে খেয়াল করলাম, মুখ শুকনো লাগছে, ব্যাথার দরুন চোখজোড়াও ইষৎ লাল হয়ে আছে! চিন্তিত মুখে বললাম,
—আচ্ছা, ভালো করেছেন। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। দেখবেন তখন ভালো লাগবে।
—তা দিও। তবে আগে এক কাপ স্ট্রং কফি করে দেও। আমার ভালো লাগছেনা, বউ।
উনার কথায় দ্রুত মাথা নাড়িয়ে তাকে ওয়াশরুমের দিক ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঠেলে পাঠিয়ে নিজে রান্নাঘরে চলে গেলাম। খানিকক্ষণ বাদে কফি করে নিয়ে এসে দেখি ড্রেস চেঞ্জ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন পূর্ণ। চোখজোড়া বন্ধ করা, এক হাত নিজ কপালের উপর চেপে রেখেছেন। কফির মগটা খাটের পাশের সাইড টেবিলে রেখে আলগোছে বসলাম তার সামনে। আলতোভাবে উনার গালে হাত রাখতেই চোখ মেলে তাকালেন। আমি ইশারায় কফির মগ দেখিয়ে দিলাম তাকে। কিন্তু উনি দুহাত মেলে ইশারায় তার কাছে আসতে বললেন। বিনিময়ে ভ্রু তুলে আমিও ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে?”। পূর্ণ জবাব না দেওয়ায় উনার কাছে এগিয়ে যেতেই নিজেই হাত টেনে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। কিছুক্ষণ বাদে শ্বাস নিয়ে ধীর গলায় বললেন,
—কাল রাতে তিনদিনের বিজনেস ট্যুরে যাচ্ছি।
—মানে? কোথায় যাবেন?
—চিটাগং।
—একা একাই যাবেন?
করুণ সুরে বললাম। উনি আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতেই বললেন,
—তোমার পরীক্ষা না থাকলে তোমাকেও নিয়ে যেতাম। কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য আমি তোমার পড়াশুনার সাথে রিস্ক নিতে চাইনা। আমার অনুপস্থিতিতে বাসায় থেকে ভালোমতো পড়বে। মনে থাকবে না, তুর পাখি?
—হুম। জলদি আসবেন কিন্তু।
—কি হবে জলদি এসে? কেউ তো আমাকে মিস-ই করবে না!
উনার এহেন কথায় আরেকটু প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরলাম তাকে, বিনাবাক্যেই বুঝিয়ে দিলাম তাকে ঠিক কতটা মিস করবো। উনিও যেন ঠিক বুঝে নিলেন। কপালে চুমু একে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
—এখন সরো তো, কস্ট করে কফি বানিয়ে আনলে সেটা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো।
—ঠান্ডা হয়েছে? খেয়ে দেখেন তো! হলে বলুন, আমি আবার বানিয়ে আনবো সমস্যা নেই।
—হয়নি। আর কোথাও যেতে হবেনা তোমার। যথেষ্ট গরম আছে!
বলেই কফি খেতে আরম্ভ করলেন তিনি। আমিও চুপচাপ বিছানার এক পাশে বসে দেখতে লাগলাম তাকে। খাওয়া শেষ হতেই মগটা পুনরায় সাইড টেবিলে রেখে আমাকে বিছানায় উঠে বসতে বললেন। বিনাবাক্য ব্যয়ে তার কথা মেনে নিতেই আমার কোলে মাথা রাখলেন তিনি। এখন কি করতে হবে বুঝে আসতেই নিজ হতেই হাতজোড়া চলে গেলো তার চুলের ভাজে। উনার কালো ঘন চুলগুলো হালকাভাবে টেনে দিতেই প্রশান্তিতে চোখ বুজে এলো তার! সেদিক চেয়ে মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
—এখন কি একটু আরাম লাগছে আপনার? আর খারাপ লাগছে কি?
—তুমি কাছে থাকলে আমার কখনোই খারাপ লাগেনা, তুর পাখি।
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে কথাটি বললেন তিনি। এদিকে উনার কথায় আমার অন্তর প্রশান্ত হয়ে গেলো! এত আদুরে ভাবে কিভাবে কথা বলে লোকটা? ভাবতে ভাবতেই তার চুলে, কপালে ম্যাসাজ করে দেওয়ার মাঝেই ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলেন তিনি। তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটেও! মাথা ঝুকিয়ে তার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে পূর্ণ ঘুমিয়েছেন। তার মাথা কোলে থাকায় সেভাবেই খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম আমিও৷ আচমকা ফোন বেজে উঠতেই কাচা ঘুম ছুটে গেলো, উনার ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তড়িঘড়ি করে সাইলেন্ট করে দিলাম ফোন। রায়হান ভাইয়া ফোন দিয়েছেন। স্ক্রিনে তার নাম দেখে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হলো! কল কেটে যেতেই ফোনের স্ক্রিনে দেখলাম রাত ৮টা পেরিয়েছে একটু আগেই। হঠাৎ এ সময় রায়হান ভাই কেন ফোন দিচ্ছে আমায়? ভাবনার বিষয়!
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here