তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_২
লেখনীতে-আফনান লারা
রাতুল আর মিনারের খুব বেশি ঝামেলা হয়ে গেছে অচেনা মেয়েটিকে নিয়ে।বয়সে তারা নিজেরাই মেয়েটির চেয়ে বেশ ছোট।কিন্তু মেয়েটির কথাবার্তার কারণে তারা না পারছে মেয়েটিকে ফেলে যেদিকে চোখ যায় পালাতে আর না পারছে মেয়েটিকে পাশে রেখে তার ঠিকানায় পৌঁছে দিতে।
মেয়েটির সমস্যা হলো সে বলতে পারছেনা সে ঢাকার কোন জায়গায় যাবে।
হাতে করে ফোন আনেনি,তবে কাড়ি কাড়ি ব্যাগ এনেছে।দুটো হাতে নিয়েছে রাতুল,আর দুটো মিনার নিয়েছে।তারা কেন মেয়েটিকে হেল্প করছে তারা জানেনা,কিন্তু এই কয়েক মাস আগেই স্বেচ্ছাসেবকের তালিকায় নিজেদের নাম উঠেছে তাদের, যার দরুণ এইসব ছোটখাটো সাহায্যে নিজেদের মাথা ঢুকাতেই হতো তাদের।মেয়েটিকে দিয়েই যাত্রা করে দুজনেই।মেয়েটি হাতে পুটলি ঝুলিয়ে ওদের পিছু চলছে,
গন্তব্য স্থান পুলিশ স্টেশন। যেহেতু মেয়েটা জানেনা সে কোথায় যাবে তাই তাকে পুলিশের হাতে তুলে ওরা দুজনে শান্তির ঘুম দেবে।মেয়েটির হাতে একটা ব্রেসলেট। তাতে একটা নাম্বার লিখে কাগজ আটকানো।নাম্বারটা তার স্বামীর।সে বাড়ি থেকে বের হবার আগে অনেকবার কল করেছে এই নাম্বারে কিন্তু কলের অপর প্রান্তের মানুষটি তার কল ধরেনি।এই নাম্বারের কথা মেয়েটি রাতুল আর মিনারকেও জানিয়েছে সবে।আর তাই মাঝপথে তারা হাঁটা বন্ধ করে সেই নাম্বারে কল দেয়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।বিকালের এই সময়টাতে মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হলো রাতে মেয়েটির কি হবে!তাকে কোথায় রাখবে।তারা দুজনেই কনজারভেটিভ পরিবারের ছেলে।এমন বয়সের একটা মেয়েকে নিয়ে ঘরে তুললে তাদের ঘরের বাইরে থাতে হবে।তবে এই মেয়েটিকে তারা কোথায় রাখবে!তার উপর যে ভাষায় ফটফট করছে সেটা সবসময় ট্রান্সলেট করা সম্ভব হচ্ছেনা তাদের জন্য।মেয়েটি একটা দোকানের বাইরের টুলে বসে পা দোলাচ্ছে এখন আর মিনার রাতুল মিলে কল করেই চলেছে ঐ নাম্বারে।রিং হয় তাও কেউ ধরেনা।আজব কারবার!
রাতুল মেয়েটার দিকে চেয়ে বললো,’আপা আপনার স্বামী কি বেঁচে আছে আদৌ?না মানে বত্রিশবার কল দেয়ার পরেও যে লোক ধরেনা সে লোক তো মরা।তার নাম্বার মরা!’
এই কথা শুনে মেয়েটি রেগে বলে,’কিয়া কন এগিন!মইরবো কিল্লাই!আঁর জামাই এবো বাঁচি আছে!’
রাতুল ভ্রু কুঁচকে মিনারের দিকে তাকায়।মিনার ফুস করে হালকা দম ফেলে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় এরপর আকাশ,গাছপালায় একবার চোখ বুলিয়ে আবারও রাতুলের দিকে তাকাতেই দেখে সে এখনও চেয়ে আছে ওর দিকে।
‘কি!এমন চেয়ে আছিস কেন?’
‘মেয়েটি মাত্র কি বললো?বুঝিয়ে বল আমায়’
‘আমিও ঠিক বুঝি নাই, শুধু বুঝছি ওর স্বামী বেঁচে আছে’
‘ওহ!আমার মনে হলো আমায় গালি দিছে’
‘গালি এত সুন্দর হয়না’
‘তোর কাছে সুন্দর লাগছে?আপার বয়স তোর চাইতে পাঁচ বছরের বেশি হবে।ক্রাশ খাওয়ার আগে ভেবেচিন্তে খাইস!’
‘আমি ক্রাশ খাইনি।কথার কথা বললাম।মেয়েটিকে আমার বড় আপুর মতন লাগে বলেই হেল্প করতেছি’
———-
বাপ্পিকে দেখে রুমের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতন অবস্থা।সকলেই জানে যে বাপ্পি জানেনা তটিনি কেন কবুল বলছেনা।তটিনির বাবা সবার চোখ এড়িয়ে তটিনির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন সে যেন তাড়াতাড়ি কবুল বলে দেয়।
তটিনি আবারও বলতে চাইলো সে কবুল বলবেনা কিন্তু সেই সময় সে খেয়াল করে আসিফ ভাইয়া কোথাও নাই।
বিছানা থেকে নেমে আসিফকে খুঁজতে খুঁজতে সে রুম থেকে বের হয়েই যাচ্ছিল ঠিক সেইসময় বাপ্পি ওর হাত ধরে ফেলে।নরম গলায় তাকে আদেশ করে সে যেন আর সময় নষ্ট না করে।তটিনি বাপ্পির এই কথায় আরও রেগে যায়।
টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে ধমকে বলে,’বিয়েটা করবোনা আগেও বলেছি।আজ প্রমাণ করে দিব’
বাপ্পি যেন ওর কথাটা শোনেইনি!!ওর হাত আবার ধরে হুজুরের কাছে নিয়ে এসে জোর করে বসিয়ে দেয় চেয়ারে।তারপর বলে বিয়ের কাজটা যেন সম্পন্ন করা হয়।
বাবাও এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে।তটিনি বাধ্য হয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,’আসিফ ভাইয়া কোথায় আপনি!জলদি আসেন।আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
সবাই চুপ করে রইলো তটিনির এই কথায়।কেউ কিছুই বললোনা, একটা পাতাও নড়লোনা।হুজুর আবারও দোয়া শুরু করেছেন।
তটিনি উঠতে চাইলো কিন্তু বাপ্পির কারণে পারলোনা।বাপ্পি ওর হাত ধরে চাপ দিয়ে রেখেছে।
‘দেখুন!আপনি যে কতটা স্বার্থপর মানুষ সেটা আমার আগেই জানা হয়ে গেছে।আপনাকে বিয়ে না করার এই একটা যথেষ্ট কারণ আমার কাছে আছে।ভালই ভালই আমায় জোর করা বন্ধ করেন নাহয় সব কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলবো!সই করা তো দূরে থাক’
বাপ্পির উপর যেন কেনো কিছুরই প্রভাব পড়ছেনা।তটিনির বাবা রীতিমতন অবাক হচ্ছেন বাপ্পিকে এত শান্ত থাকতে দেখে।অন্য কোনো ছেলে হলে মুখের উপর অপমান করে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে চলে যেতো আর সেখানে বাপ্পি চুপচাপ সব সহ্য করে যাচ্ছে।
হঠাৎ করে তটিনি বাপ্পির হাতে জোরেশোরে কামড় বসিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেছে।বাপ্পি হাত ঝাঁকিয়ে কেবল ওর চলে যাওয়া দেখলো।
———-
এত জোরে কামড়েছে যে হাত থেকে রক্ত পড়ছে বাপ্পির।এক মাসে বাপ্পিকে তটিনি হাজারবার রিকুয়েস্ট করেছে বিয়েটা না হতে দেবার জন্য।বাপ্পি শোনেনি,যার কারণে দিনের পর দিন ওর প্রতি ঘৃনা জন্মেছে তটিনির মনে।আজ সেই ঘৃনা থেকে সে এত জোরে কামড়ে গেলো।
তটিনির বাবা আর মামা তটিনির পিছু ছুটেছেন।
এদিকে বাপ্পি বিছানায় বসে টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে হাতের রক্ত মুছতেছিল।
‘বাবা এই মেয়েকে বিয়ে করোনা।সংসারে তোমার শুধু অশান্তি থাকবে’
হুজুরের কথা শুনে বাপ্পি হাতে চাপ দিয়ে মুছতেছে এবার তাও সে চুপ।
এরপরই রুমে আগমন ঘটে বাপ্পির মায়ের।তার মুখে প্রচণ্ড রাগ ভাসছে।বোঝাই যাচ্ছে সব কিছু তিনি জেনে গেছেন।বাপ্পি এতটাও বিরক্ত ছিলনা যতটা বিরক্ত হলো মা সব জেনে যাওয়ায়।মা এসেই ওর হাত টেনে ধরে বললেন,’মেয়ে বিয়ে করবেনা তো আমরা আর থেকে কি করবো?আমার ছেলের জন্য কি মেয়ের অভাব?’
বাপ্পির হাত টানলেও সে একটুও নড়েনি,সে বসেই আছে।অন্য হাত দিয়ে কামড়ের দাগ লুকাতে শেরওয়ানির হাতা টেনে দিলো কিছুটা।মা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,’মেয়েটা কেন বিয়ে করবেনা জানিস?প্রেমিক আছে?আমাকে একজনে বললো তটিনি নাকি কবুল বলছেই না’
‘আমায় পছন্দ না।ওর বিসিএস ক্যাডার লাগতো,আমি তো ক্যাডার না!’
‘ওমা এটা কি ধরনের কথা!আমার ছেলের বেতন কত সে জানে??তার চৌদ্দ গুষ্টির জমি একসাথে কিনার মতন টাকা আমার ছেলে প্রতি মাসে কামাই করে আর মেয়ে কয় কি!’
বাপ্পি মাকে ধরে বসিয়ে বলে,’মা শান্ত হও।আমি দেখছি।তটিনি বাচ্চামানুষ।গুলিয়ে গেছে এত এত ভীড় দেখে।তুমি তো জজানো ও অনেক ভাল একটা মেয়ে।আমি ওকে নিয়ে আসছি, তুমি গিয়ে তটিনির আম্মুর রুমে রেস্ট নাও।তোমার না সুগার লো হয়ে গেছে?এইসবে জড়াতে গেলে কেন?যাও গিয়ে একটু শুয়ে নাও’
বাপ্পি তার বোন বুশরাকে ইশারা করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।তটিনি বাসার সামনের উঠানে মাটিতে বসে আছে।বাবা আর মামা মিলে ওকে ঘিরে রেখে বকাবকি করছেন।বাবা এরই মাঝে দুই তিনটা চড় ও মেরে দিছেন তাও কাজ হচ্ছেনা।আসিফ কোথাও নেই।বাপ্পি তখন তটিনির কাছেই যাচ্ছিল সেইসময় দূরে আসিফকে দেখে থামে সে।আসিফ ইশারা করে ওকেই ডাকছিল।
কৌতুহল নিয়ে সে আসিফের কাছে আসে।আসিফের হাতে একটা ব্যাগ ঝুলছে।সে অনেকটা হাঁপিয়ে আছে।তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা গুছিয়েছিল।গলায় হাত দিয়ে ঘাম মুছে বাপ্পিকে সে বললো,’ভাই আমি জানি তুমি তটিনিকে অনেক পছন্দ করো।সে হয়ত অনেক কিছুই বলেছে তোমায়,আমায় নিয়ে,এবং এটাই সত্যি।কিন্তু আমি চাইনা তটিনি আমায় বিয়ে করে একটা কষ্টের জীবনে পা রাখুক।আমি ওকে সেই সুখ দিতে পারবোনা, যে সুখে সে বড় হয়েছে।আমি ওরে অনেক বুঝিয়েছি।সে বুঝতে চায়না।আবেগের বশে সব করছে।বাস্তবতা অনেক কঠিন সেটা তটিনি জানেনা, আমি চাইনা জানুক।ও তোমার কাছে থাকলে অনেক ভাল থাকবে,তুমি ওকে যত্নে রাখবে এটা আমি এই কদিনে বেশ বুঝেছি।আমি চলে যাচ্ছি এখন।আমি এখানে থাকলে আজ বিয়েটা হবেনা।তটিনি হতে দিবেনা।আমার দূর্বলতা আছে,সেই দূর্বলতার কথা আমি তটিনিকে জানাইনি।ওর মনটা অনেক নরম।আমি ভাঙতে চাইনি।তাও ভাঙবে আজ।চেয়েছি কখনও যেন না ভাঙ্গে এই মন।কিন্তু আমার হাতে আর উপায় নেই।এই দলিলের ফটোকপিটা তুমি তটিনির হাতে দেবে।আশা করি এর পর তটিনি আর কোনোদিন আসিফকে চাইবেনা।এটার আসল কপি আমার কাছেই আছে।ইচ্ছে করেই আসল টা দিচ্ছিনা,তটিনি রাগ করে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।তুমি শুধু ওর হাতে এই কপিটা দিবে।আমি আসি। আর আমায় মাফ করে দিও।আমার কারণে তটিনি হয়ত তোমায় সহজে মেনে নিতে পারবেনা!তুমি সামলে নিও ওকে’
আসিফ চোখের কোণার জমা পানি মুছতে মুছতে ছুটে চলে গেলো মেইন রোডের দিকে।বাপ্পি দলিলটা সামনে ধরে পড়লো।পুরোটা পড়ে তার মুখে হাসি ফুটে গেলো।তটিনিকে হারানোর যে ভয় তার মনে বাসা বেঁধে ছিল সেই ভয়টা মূহুর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।এমন করে সে তটিনিকে পেয়ে যাবে তা ভাবেইনি!!দলিলটার দাম এখন তার কাছে অনেক বেশি!মুখে হাসিরেখে বাপ্পি তটিনির দিকে এগিয়ে যায়।
———–
‘এখন এই আপাকে কই রাখবো আমরা?এই শুন রাতুল! সাবিনার বাসায় রেখে আসবি?’
‘সাবিনা আমায় এক কাপ চা খাওয়ার টাকা দেয়নাই জীবনে,ও এই আপুটাকে তার বাসায় রাখবে?ঐ কিপটার থেকে এটা আসা করোস?’
‘পুলিশ স্টেশনে যেতে ভয় করছে, কি করবো বল!’
‘তা ছাড়া উপায় নাই।নাহলে এরে কোথায় রাখবো আমরা?’
‘মিনার তোর বাসার খাটের তলায় রাখ একদিনের জন্য’
‘এটা কি সিনেমা চলছে??আমার আম্মা প্রতিদিন রাতে খাটের তলায় লাইট মেরে চেক করে চোর আছে কিনা!আর খাটের তলা কি এই আপুর জন্য খালি পড়ে আছে??আম্মা রুসুন,পেঁয়াজ,আলু দিয়া ভরাই রাখছে।কথা বললেই হইলো আর কি!’
‘তোর আম্মা তাও খাটের তলায় আলু,পেঁয়াজ রাখে। আমার আম্মা তো পুরান ভাঙ্গা শো-কেস একটাকে চিৎ করাই শোয়ায় রাখছে খাটের তলায়।বেচবেও না,ফেলবেও না’
চলবে ♥