তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৪৮

0
236

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৪৮
লেখনীতে-আফনান লারা
.
আসিফকে ছাড়া তটিনি থেকেছিল প্রায় সাতদিনের মতন।তার কি যে অবস্থা হয়েছিল।সারাদিন বাসার ল্যান্ড লাইন নয়ত বাবার ফোনের দিকে চেয়ে বসে থাকতো।ইশ কখন আসিফ একবার ফোন দিবে,আর বলবে সে কয়দিন পর ফিরবে।
আসিফ ঈদের ছুটিতে সাতদিনের জন্য যেতো।তখন তটিনির খুব খারাপ যেতো দিনগুলো।আসিফের অপেক্ষায় তার নাওয়া খাওয়া ঠিক মত হতোইনা।
কে জানতো একদিন এমন একটা মানুষ আসবে যার অনুপস্থিতিতে নাওয়া খাওয়াই উঠে যাবে!
নিয়তি কত অদ্ভুত তাই না!আমরা কাউকে ভালবেসে ভাবি এটাই আমাদের আসল ভালবাসার মানুষ!
এরপর মানুষটা ছেড়ে চলে গিয়ে যখন ২য়জন এসে হাত ধরে তখন বুঝতে পারি আসলে প্রথম মানুষটা পুরোটাই ভ্রম ছিল।
যা থাকার তা ২য়তেই!!
দেখোইনা!আসিফকে ছেড়ে সাতদিন থাকতে পারতো তটিনি!আর আজ বাপ্পিকে ছেড়ে কয়েকটা ঘন্টা তার কাঁটা গিলবার মতন অবস্থা করে ছেড়েছে।

বকুল আপু রান্নাঘরে তটিনির জন্য বেলের শরবত তৈরি করছিলেন।সেইসময় তার ফোনে একটা কল আসে।কলটা বাপ্পির। আপু ফোন হাতে নিয়ে ওর নাম দেখে মুচকি হাসি দিয়ে রেখে দিলেন।ফোনটা বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেলো।কয়েক মিনিট পর আপু যখন শরবতের গ্লাসটা ট্রে তে নিয়ে তার পাশে বাদামের বাটি নিলেন সেই আবারও কল আসলো।
এবার আপু ট্রেটা রেখে কল ধরলেন।

‘আপু ভাল আছো?’

‘খুব ভাল,তোর কি খবর?’

‘এই তো ভাল’

‘আর কিছু বলবি?’

‘দুলাভাই কই?’

‘সে তো ফিল্ডে গেছে।আর কিছু?’

‘না ঐ!তটিনি কই?’

‘সে কাঁদছে।খুব কাঁদছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ সব ফুলিয়ে ফেলেছে।মেয়েটাকে এত কষ্ট দিচ্ছিস?’

‘আমি কি করলাম বলো বুবু? সব তো মায়ের ইচ্ছাতেই হচ্ছে।তুমি ওরে একটু বুঝাও।আমি মাকে ঠিক করে ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো’

‘এক মিনিট,তোর কি ইচ্ছে করেনা তটিনির থেকে সেই ভালবাসাটা পেতে যেটা তুই ওকে বাসোস?’

নিরব হয়ে বাপ্পি বললো,’করে’

‘তাহলে এত তাড়া কিসের?সময় দে,সময় নে।এইসব ঠিক করতে একটু কষ্ট করা লাগে।তটিনি যেদিন তোকে নিজ থেকে মেনে নিতে পারবে সেদিন আমার আর আম্মুর চাইতে কেউ বেশি খুশি হবেনা।আমরাও চাই তোরা দুজন হ্যাপি কাপল হও’

‘আমি তো তাও পারছি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে।কিন্তু তটিনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে?’

‘হাহাহা!ওটা মজা করলাম।তটিনি মোটেও এমন বুক ফাটিয়ে কাঁদছেনা।সে জানালার গ্রিল ধরে ম্যানিকুইনের মতন থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে ভেতরটা তার পুড়ছে কিন্তু ব্লাস্ট হচ্ছেনা’
——-
রিনি আর আসিফ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছে।তারা যে পথটা ধরে আসছিল সেটি ছিল সরু একটা পথ।দুপাশে বহুতল ভবন।তার সাথে মোটা মোটা কারেন্টের তার আর পিলারের পর পিলার।
রিনি মনে মনে ভাবছে বাসায় ফিরলে ঐ আন্টি আর তার মেয়ে আবার কি জেরা করে।
আর আসিফ ভাবছে রিনির ঐ হাতটা ধরার যে হাতে সোনার বালা ঝুলছে।তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে হাতটা ধরেই ফেললো।
রিনি তখন একটা দালানের তলা গুনছিল।আসিফের হাতের স্পর্শ পেয়ে সে মুখটা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়।
আসিফ অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটছে।
রিনি মুচকি হাসি দিয়ে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে বললো,’
যাক!ঘি সোজা আঙ্গুলেই উঠছে’

আসিফ লজ্জায় লাল হয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।রিনি ও ওর সাথে পাল্লা দিয়ে আসতে আসতে বললো,’আম্মা মরি গেছে বলেই কি আঁই এত ভালবাসা হাইতেছি?
[মা মরে গেছে বলেই কি আজ আমি এত ভালবাসা পাচ্ছি?’]

আসিফের পা থেমে গেলো।সে রিনির হাতটা তখনও ছাড়েনি।তবে রিনির বলা কথাটা তার মনটাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো।কি যেন ভেবে পকেট হাতিয়ে একটা রুমাল বের করে সে রিনির দিকে ধরে।
তারিখ আজ থেকে বারো দিন আগের।সেখানে লেখা আসিফ রিনির কাছে ঋনী।,স্বামী হিসেবে ঋনী।এই ঋণ প্রেম দিয়ে শোধ করা হবে একদিন’
এই লেখা কোনো একটা নারীর হাতের লেখায় সিক্ত ঐ রুমালে।গ্রামগতর খুঁজে সেই নারীর হাতে বুনে এনেছে আসিফ এই রুমাল।রিনি জানেনা।
তার মা থাকতেই আসিফ নিজের মনে তাকে জায়গা দিয়ে দিয়েছিল,বলতে গেলে এখন সেই আনুষ্ঠানিকতা হলো।
রিনির চোখে অশ্রু ঠাঁইয়ের জায়গার অভাব পড়ছে আজ।আসিফ রুমালটা দিয়ে ওর চোখ মুছে দিয়ে পুনরায় টানা ধরলো হাতটাকে।
——–
তটিনি বেলের শরবত খেতে খেতে বকুল আপুর ফোনটা দেখছিল।বকুল আপু কাজের ফাঁকে সে দৃশ্য খেয়াল করে বললেন,’আমার ফোনের মডেলটা তোমার পছন্দ হয়েছে বুঝি?বাপ্পিকে বলবো এমন একটা তোমায় কিনে দিতে’

‘নাহ,মানে হ্যাঁ।সুন্দর’

‘ধরেও দেখতে পারো,আমি কিচ্ছু মনে করবোনা’

তটিনি বিড়বিড় করে বললো,’ধরে দেখা হয়ে গেছে, কি নামে সেভ করা কে জানে!”

‘উজবুক!’

‘এ্যাঁ?’

‘মানে আমি বাপ্পিকে উজবুক মনে করি,তুমি কি মনে করো?’

‘ঐ একই।আমার কাছেও ওনাকে উজবুক মনে হয়’
——
বাপ্পি তার মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।মা তখন ওর জন্য মুরগীর মাংস দিয়ে নুডুলস বানাচ্ছিলেন।তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার ছেলে কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু ভয়ে বলতে পারছেনা যার কারণে এক জায়গায় স্থির না থেকে শুধু ঘুরঘুর করছে।

‘কিছু বলবি?’

‘হ্যাঁ, আসলে….’

‘তটিনির কথা বাদ’

‘মা সে কষ্ট পাচ্ছে’

‘পাক!এ খবর কে দিলো?’

‘বকুল আপু’

‘তার মানে কথা সত্য।ভাল,আমি তো এটাই চেয়েছিলাম।’

‘মা তুমি কি খুশি হলে?’

‘মোটেও না,তবে শান্তি পেলাম।আমি এটাই চেয়েছি।সে বুঝুক,সে কষ্ট পাক।সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করুক তুই ওর খুব কাছের,খুব আপন’
———
রাতে বাপ্পি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিল,তটিনিকে ছাড়া কিরকম যে তার লাগছে সে যদি একবার মাকে বুঝাতে পারতো তাহলে মা তটিনিকে শাস্তি না দিয়ে টের পেতেন আসলে শাস্তিটা বাপ্পি নিজে পাচ্ছে।
সেইসময় দরজা খটখটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল অনেকক্ষণ যাবত।রাত ১:৩৪বাজে এই সময়ে বাপ্পিকে ডিস্টার্ব করার মতন কেউ নেই এই বাসায়।তাহলে কে এমন উন্মাদের মতন দরজায় নক করে যাচ্ছে?
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বাপ্পি উঠে গিয়ে দরজা খোলে।
খুলতেই ওপাশ থেকে সুবাসিত দেহের এক নারী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে।বাপ্পি অপরিচিত বলে চেঁচিয়ে উঠে নি।কারণ গন্ধটটা তার খুব চেনা।
এটা তো তটিনি!
তবে এত রাতে,এই খানে সে কিভাবে আসলো?সে কি স্বপ্ন দেখছে?

‘তটিনি?’

‘হুম’

‘তুমি?কি করে আসলে?কার সাথে আসলে?’

‘ক্যাব বুক করে এসেছি।আবার চলে যাবো, এই রাতটা পার হোক।ভোর হলেই চলে যাবো।বুশরা দরজা খুলে দিয়েছে’

‘একা একা আসার কোনো মানে আছে?এরকম পাগলামি কেন করলে?’

তটিনি দরজা লাগিয়ে বিছানায় উপর বসে বেলো,’অত্যাচার!পুরো বংশ মিলে আমায় অত্যাচার করছে।বকুল আপু আজ সেইসব রান্না করেছে যা আমার বাপের জন্মে আমাকে কেউ খাওয়াইতে পারে নাই’

‘কি রেঁধেছে?’

‘পাঙ্গাস মাছের চচ্চড়ি, মাসকলাই ডাল,করলা ভাজি দিয়ে হাঁসের ডিম ভাজি,কাকরোলের ভর্তা’

‘বাহ!আপু এগুলা খুব ভাল বানায়।আমি খেয়েছি’

‘কিন্তু আমি খাইনি বাপ্পি সোনা।এখন গিয়ে তোমাদের ফ্রিজ থেকে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো।আমি না খেয়ে আছি সোনা’

‘এভাবে সোনা সোনা বলে কি আদর করে ডাকতেছো নাকি টিটকারি মারছো?’

‘দুটোই’

‘আমাদের বাসায় রাতে ফ্রিজে ভাত তরকারি থাকেনা’

‘তাহলে অর্ডার দিয়ে আনুন।আমি কি না খেয়ে থাকবো?’

বাপ্পি মাথা চুলকে ফোন খুঁজে একটা রেস্টুরেন্টের পেজে ঢুকে অর্ডার করতে গিয়ে শোনে তারা এত রাতে অর্ডার নেয়না।অনেক খুঁজে তারপর অবশেষে একটা পেলো যারা কিনা মাঝ রাতেও ফুড ডেলিভারি করে।

খাবার আসতে সময় লেগেছে বিশ মিনিট।ওরা কল দিতেই বাপ্পি পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে গেট থেকে পার্সেল নিয়ে এসে বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পড়লো বরাবর।মা দুহাত ভাঁজ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।তারপর বললেন,’আজ দারোয়ান খাবার নেয়নি।ফ্রিজে মাংস,ডাল,সালাদ সব ছিল।ওগুলা খাওয়া ওরে।বাহিরের খাবার খাইতে হবেনা’

বাপ্পি ভয় পেয়ে চুপসে গেছে। কি থেকে কি বলবে।পরে মা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করতে করতে বললেন,’এরকম পাগলামি ভাল!আমার কথার অবাধ্য হয়ে সে এখানে চলে আসুক,এটা ঘটুক সেটাই চেয়েছিলাম।মেয়েটা সব কিছুতে পাশ করতেছে।আর যাইতে হবেনা।কয়েক ঘন্টাতেই তার আক্কল এসে গেছে দেখলাম। আমি আর শাস্তি দিব না।’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here