তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৩

0
379

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৩
লেখনীতে-আফনান লারা

বাপ্পি চাইলেই তটিনিকে এই বিয়েটা করে নিতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে,কিন্তু তটিনির মনের আশাটাকে সে যেমন এতটাদিন চাপা দিয়ে এসেছে সেই আজ শেষ মূহুর্তে এসে আর চাপা দিতে পারলোনা।দলিলটা দেখাতে নিয়েও সে আর দেখালোনা।তার হাত সামনে এগোচ্ছেনা।তটিনির বাবা বাপ্পিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেলেন তার সাথে পেলেন এক বুক দুঃখ।মেয়ের প্রতি ক্রোধ আর বাপ্পির প্রতি লজ্জা তাকে ভাবিয়ে তুললো।তার বুকে ব্যাথা বেড়ে গেলো আরও।তটিনিকে টেনে তোলার বদলে তিনি নিজেই পড়ে গেলেন মাটিতে।দেহটা মাটির বালির সাথে লেপটে গেলো তার।চোখ দুটো বুজে গেলো নিমিষেই।
বিয়ের আসর আর বিয়ের আসর রইলোনা।সব ধুয়ে মুছে গেছে।
ডেকোরেশনের লোকেরা এসে তাদের সব মালপত্র খুলে নিয়ে যাচ্ছে।অনেক খাবার বেঁচে গেছিলো সেগুলো আশেপাশের গরীব পরিবারে দিয়ে দেয়া হলো।
বাড়িতে তটিনির খালা খালুরা আছেন এখন।বাকি সবাই হাসপাতালে।বাপ্পির পরিবারও হাসপাতালে।তটিনির বাবার ছোটখাটো একটা হার্ট এটাক হয়েছে।তটিনিকে বাবার কেবিনে ঢুকতে দিচ্ছেনা কেউ।মা তো বলেছেন ওর মুখ আর দেখতে চান না।তটিনি করিডোরের একটা কোণায় নিচে বসেছিল।তার ঠিক দশ কদম দূরেই বাপ্পি ছিল।মায়ের কথায় দু কাপ কফি নিয়ে এসেছিল সে, একটা তার জন্য আর একটা মায়ের।মায়ের হাতে তার কাপটা বুঝিয়ে দিয়ে বাপ্পি তটিনির দিকে তাকায়।ওকে কাপটা দেয়ার সাহস নেই তার।নিবে তো না তার সাথে ঝাড়ি দেবে।কিন্তু হয়ত এখন কফিটা তার প্রয়োজন।
অনেক ভেবে বাপ্পি বুদ্ধি করে তটিনির বোন ঐশীকে ডেকে ওর হাতে কাপটা দিয়ে বলে তটিনিকে পৌঁছে দিতে।ঐশী মাথা নাড়িয়ে তটিনির কাছে চলে যায়।তটিনি কাপ দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,’জানিস তো আমি কফি খাইনা।উজবুকটাকে এটা বলতে পারলি না?সামনে থেকে সর এখন!’

তটিনির ঝাড়ি খেয়ে ঐশী কাপটা নিয়ে আবার ফেরত চলে এসেছে বাপ্পির কাছে।শেষে বাপ্পি ওটা ঐশিকেই খেতে বলে মায়ের পাশে চলে আসলো।মা বোঝেন বাপ্পি তটিনিকে অনেক পছন্দ করে যার কারণে তিনি এর উপরে কিছুই বলছেন না।ছেলের পছন্দ মেনে চললে ছেলেরা মা পাগল হয় এই ট্রিক্স তিনি জানেন বলেই বাপ্পির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করেন না।
বাপ্পি তটিনির দিকে আবারও আড় চোখে তাকালো।তটিনি পা চুলকাচ্ছে,হাসপাতালে অনেক অনেক মশা।এতক্ষণ ছিল না অবশ্য,সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মশা বেড়ে গেলো।কেবিনের ভেতর তটিনির মা আছেন ওর বাবার পাশে,সাথে ওনার বড় বোন ও আছেন।
তটিনির খুব ইচ্ছে হলো বাবাকে দেখতে যাবে কিন্তু সাহস পায়নি।মাকেও সে ভয় পায়।মা ওকে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বলেছেন।
কোথাও আসিফকে সে দেখেনি তার মানে আসিফ যে চলে গেছে সেটা তটিনি বুঝেছে।কোথায় গেছে সে জানেনা।আসিফের পিছু পিছু সে ছুটলে এদিকটা কে দেখবে?যতই হোক!হাসপাতালের বেডে শোয়া মানুষটা তো তারই জন্মদাতা।
———–
আসিফ একটা দোকানে এসে বসে ছিল।গ্রামে ফেরার ইচ্ছা তার নেই।সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। গ্রামে গিয়ে আবার আসতে হলে পরীক্ষার ডেট এসে যাবে।এখানে একটা বন্ধুর বাসায় গিয়ে থাকতে হবে তাকে।তটিনির হয়ত এতক্ষণে বিয়েও হয়ে গেছে।বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!!
“মেয়েটা প্রেমে পড়ার মতই!!কিন্তু আমি অসহায়!আমার হাতে কিছুই নেই তটি!!মাফ করে দিস!”

ঐশীকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য পকেটে হাত ঢুকায় আসিফ।
———-
পুলিশ স্টেশনে বসে আছে রাতুল মিনার।তাদের সাথে বসা আছে সেই মেয়েটিও।
পুলিশ অফিসার ফোনে এক নেত্রীর সাথে কথা বলছেন দীর্ঘ ৩৪মিনিট ধরে।রাতুল মিনারকে পাত্তাই দিচ্ছেন না।মেয়েটিও বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে একটা সময়ে বলে উঠলো,’হোয়াগ কত ব্যাডার!লাগে জেন হেতেনের বউ!হলে তো কোনাইগার কোন বেডি🙄😼’

রাতুল আর মিনার দুজনেই মেয়েটির বিড়বিড় করা এই দুই লাইন কথা শুনে ফেলেছে কিন্তু ব্যাডা বেডি ছাড়া আর কিছুই তারা বুঝে নাই।তাও বুঝার ভান ধরে দুজনে বলে উঠলো,’হ্যাঁ ঠিক বলছো আপা’

পুলিশ অফিসার অবশেষে কথা শেষ করে ফোন রেখে বললেন,’হুম বলো তোমাদের কি সমস্যা! ”

‘স্যার আমরা এই আপুটাকে সায়দাবাদে পেয়েছি।আপুটি কোথায় যাবে সেই ঠিকানা জানেনা। যার কাছে যাবে সে ফোনই ধরছেনা’

‘তো তোমাদের কি লাগে?’

‘অচেনা একটি মেয়ে বিপদে পড়েছে তাই আমরা সাহায্য করছি,এই টুকুই!’

‘ওহহহহহ!তা মেয়ে তোমার নাম কি?’

‘রিনি সুলতানা ‘

‘বাড়ি কই?’

‘নোয়াখালী,ছাতারপাইয়াতে’

‘ওহ অনেকদূর! তা তুমি এখানে কার কাছে এসেছো?’

‘আঁর জামাইর কাছ’

‘তার পুরো নাম বলো’
———–
আসিফ ফোন হাতে নিতে গিয়ে দেখে ফোন নেই, সে ওটা বাসাতেই ফেলে এসেছে।ফোনটা ওতেটা জরুরি না কিন্তু কাউকে কল করতে হলে তো লাগবে।এখন ঐ বাসায় তটিনির থাকার কথা না।গিয়ে ফোন নিয়ে চলে আসা যাবে।ব্যাগটা বন্ধুর বাসায় রেখে এসে আসিফ তটিনির বাসার দিকে রওনা হয়।
ঐদিকে পুলিশ অফিসার রিনির দেয়া নাম্বারে অনেকবার কল করেও পায়নি তার স্বামীকে।কলই ধরছেনা লোকটা!!
———-
তটিনি করিডোরের ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছিলো।ঘুম ভাঙ্গে মায়ের ধমকে। তিনি তটিনিকে এখান থেকে চলে যেতে বলছেন।তটিনি মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।মাতৃস্নেহকে হুরহুর করে মনে করিয়ে দেয় সে পা ধরে কান্নার মাধ্যমে।মায়ের মন নরম বলে সহজেই সবসম মেনে নিলেও নিজের স্বামীর এই করুণ দশার যে ভাগিদার তার উপর কোমল হতে পারলেন না,যতই হোক না নিজের পেটের সন্তান।কঠোর তাকে হতেই হবে!

‘ঐশী তোর বোনকে বল সে যেন এখন নাটক না করে!!’

এই কথা বলে পা ছাড়িয়ে মা চলে গেছেন বাপ্পির মায়ের কাছে।তটিনি এই সুযোগে বাবার কেবিনে ঢুকে গেলো।বাবা সেসময় চোখ খোলা রেখে শুয়ে ছিলেন।তটিনিকে দেখে তার আরও রাগ হলো।মুখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে।
তটিনি বাবার পাশে এসে হাত ধরতে নিতেই বাবা হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন। সবাই তার উপর রেগে আছে।এটা তটিনি সহ্য করতে পারেনি। বাবাকে আর কিছু না বলেই সবার সামনে দিয়ে সে চলে গেলো।
বাপ্পি হাসপাতালের বাইরেই ছিল।অফিস থেকে কল আসায় বাইরে এসে কথ। বলছিল, তখনই সে তটিনিকে দেখে ছুটতে ছুটতে চলে যাচ্ছে।
বাপ্পি দেরি না করে তটিনির পিছু নেয়।তটিনি কিছুদূর ছুটে গতি কমিয়ে এবার ধীরে ধীরে হাঁটছে।অবাধ অশ্রুর জন্যে চোখে ঝাপসা দেখছে সে।রাস্তাও ঝাপসা। হাঁটা থামিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে আবারও তাকায় রাস্তার দিকে।এবার সামনে বাপ্পিকে দেখে মেজাজটা আরও খারাপ হলো তটিনির।কিন্তু কিছু বললোনা।পাশ কাটিয়ে পুনরায় হাঁটা ধরে সে।
বাপ্পি পেছনে ফিরে বলে,’বিয়েটা হয়ে গেলে আজ এত কিছু হতোনা’

তটিনি থেমে যায়।এরপর হঠাৎ করে মুখ ফুটে বাপ্পির কাছে ওর ফোনটা চায়।বাপ্পি সাথে সাথে ফোন এগিয়ে ধরে ওর দিকে।
তটিনি কল করে আসিফকে।
আসিফ সেসময় বাড়িতে এসেছিল ফোন নেয়ার জন্য।ততক্ষণে সে জেনে গেছে তটিনির বাবার শরীরের খবর।সে হাসপাতালের দিকেই আসছিল।বাপ্পির নাম্বার থেকে কল দেখে রিসিভ করলো।যদি জানতো তটিনি কল করেছে তবে কখনওই ধরতোনা।বাপ্পির নাম্বারে তটিনির গলা শুনে আসিফ চমকে যায়।তটিনি শুধু বলে,’ভাইয়া একবার আসো,আমার এখানে কিছু ভাল লাগছেনা।কেউ আমায় সহ্য করতে পারছেনা এখানে’

আসিফ ধমকে বললো কলটা বাপ্পিকে দিতে।তটিনি বিরক্ত হয়ে ফোন টা ফিরিয়ে দেয় বাপ্পিকে।বাপ্পি হ্যালো বলতেই আসিফ ওর কাছে জানতে চাইলো সে দলিলটা দেখিয়েছে কিনা।বাপ্পি একটু সরে গিয়ে বললো,’নাহ দেখাবোনা।আমি চাইনা পরিস্থিতির চাপে পড়ে তটিনি আমায় বিয়ে করুক।সে তার ইচ্ছেতে করলে করবে নাহয় থাক।ভাগ্যে হয়ত সে নেই তাই এত বাধাবিপত্তি আসছে!’

‘তুমি আমার কথা বুঝতেছোনা বাপ্পি!তখন সময় মতন দলিলটা দেখিয়ে দিলে আঙ্কেলের এই অবস্থা হতোনা এখন!’

‘দলিল দেখালে তটিনি রাগ করে আমায় বিয়ে করতে রাজি হবে,সেটা আমি চাইনা আসিফ! ‘

‘আমি সেটাই চাই।এখন কথা হচ্ছে আঙ্কেলের সুস্থতা। তুমি বলতে না পারলে আমায় দাও,আমি বলে দিচ্ছি।সেই সাহস আছে আমার।দাও ওকে ফোন’

বাপ্পি তটিনির দিকে তাকালো।সে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে।
নিষ্পাপ ঐ চাহনি তাকে এক মূহুর্তের জন্য সব কিছুর বাইরে নিয়ে গেলো।
এই চেহারার মানুষটির চোখে অশ্রু মানায় না!!শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু টুকু এই চেহারার জন্য বিষ স্বরুপ!হাসি ছাড়া আর কিছু মানায় না এই চাহনিতে!!এই মেয়েটিকে এত বড় ধাক্কা সে দিতে পারবে না!’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here