তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৩৯

0
180

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৩৯
লেখনীতে-আফনান লারা
.
হাতে হাত রেখে সেই পরিচিত মাটির পথটা ধরে তারা দুজন চলছে।গন্তব্য খুব একটা কাছে নয় তাও কেন যেন দুজনে হাঁটার গতি কমিয়েই হাঁটছে।যেন তারা চাইছে আজ দেরি হোক!
পথে কোনো মানুষ নেই।দুপাশে ডোবা নয়ত ক্ষেত।এভাবেই পথটা চলছে।তারা নিশ্চুপ হয়েও বেশ মনে মনে কথা বলছে।তটিনি তার ভেজা চুলগুলোর একটা পাশে হাত রেখে বুলিয়ে বাপ্পির দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছিল আর মনে মনে বলছিল ‘কোনো এক কালে যে পাঞ্জাবিওয়ালার প্রেমে হাবুডুবু খেতাম আজ সেই পাঞ্জাবিওয়ালার পাঞ্জাবি পরিহিত সয়ং আমার স্বামী আমার সঙ্গে পথ চলছে!অনুভূতি কিরুপ হওয়া উচিত!’

আর বাপ্পি তটিনির হাতটাকে আরও আগলে ধরে পথ চলতে চলতে মনে মনে বলছিল,’যাকে প্রথমে ভাল লেগেছিল সেই মানুষটার চোখে আজ নিজের প্রতি ভাললাগা দেখতে পাওয়া কতটা সৌভাগ্যের?!”

প্রকৃতি যেন তাদের দুজনের মনের কথা বুঝে গেলো।হালকা বাতাসে গাছগুলোর হলুদ,খয়েরী রঙের পাতা সব দলে দলে ছিঁড়ে হেলেদুলে পড়তে লাগলো ওদের গায়ে!
সামনে তাকালে সেই পাতার ঝরে যাওয়ার দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর লাগে।তাও তারা সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য্য দেখছেনা।কারণ তারা দুজনেই সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য্য বহন করে চলছে।

সামনে সেই মাটির পথটি শেষ।তারপর পাকা রাস্তার শুরু।মাঝে একটা সাঁকো।দুই হাতের সাঁকো।বেশি তাড়া থাকলে সাঁকোর তলা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে।নিচে খুব একটা পানি নেই।পায়ের গোড়ালি ডোবা পানি!
দুজনে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো!সাঁকো দেখে মনে হয় পা রাখলেই চিটপটাং হয়ে ভেঙ্গেচুরে যাবে।
অনেক ভেবে বাপ্পি বলে,’নাও নিচে নামো।এই সাঁকোর উপর ভরসা করে তোমায় চড়ানো যাবেনা।পরে হাঁড়গোড় সব ভেঙ্গে ফেলবে’

তটিনি মাথা নাড়িয়ে নিচে নামতেই হোচট খেয়ে গিয়ে পড়ে বাপ্পির বুকে।
বাপ্পি দাঁত কেলিয়ে বললো,’কেমন একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ফিলিংস্ হচ্ছে’

তটিনি মাথা তুলে কোমড়ে হাত রেখে বললো,’সিনেমাই যদি হয় তবে কোলে নিন’

‘নিচে দেখেছো?কাদা সব।তোমায় কোলে নিলে লিফটের মতন করে কাদাতে দেবে যাবো।তার চেয়ে বরং হাতটি ধরো আমি তোমায় উড়িয়ে নিয়ে যাই’

এই বলে বাপ্পি তটিনিকে নিয়ে সেই দুইহাতের সাঁকোর তলা পার হয়ে গেলো।
——
রিনির জন্য খাবার নিয়ে আসছে আসিফ।রিনি মাথা টিনের বেড়ায় লাগিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল।এই জানালার দ্বারে বসে মা কত কোরআন শরীফ পড়েছেন!ছোটকালে রিনি ততক্ষণ মায়ের পাশে বসে থাকতো যতক্ষণ মা কোরআন পাঠ করতেন।আর আজ সেই মা নেই।কোরআন শরীফ আছে আগের জায়গায়।চোখ মুছে রিনি বিছানা ছেড়ে গেলো অজু করতে।সে কোরআন শরীফ পড়বে।
অজু করে এসে বসেও গেলো।আসিফ খাবার নিয়ে এসে দেখে রিনি কোরআন শরীফ পড়ছে।তাই আর ডাকেনি।খাবারটা নিয়ে সে বাহিরে গেছে রিনির ভাইকে খুঁজতে।সে এতক্ষণ বাবাকে আগলে রাখলেও হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।তাকে খুঁজে বের করা জরুরি।এ বয়সের তরুণ!এত বড় ধাক্কা সইতে না পেরে কি না কি করে বসবে!তাছাড়া শুরু থেকেই কেমন আধমরা ছিল।যারা এ সময়ে কাঁদেনা তারাই ভুলভাল কাজ করে বসে।তাদের বিশ্বাস নেই।সেই ভয়ে আসিফ হন্ন হয়ে রিনির ভাইকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে।

কারিম মায়ের কবরের কাছে এসে কাঁদছিল।অথচ এ ছেলেটা শুরু থেকে এক ফোটা চোখের পানিও ফেলেনি।কারিম কখনওই কাঁদেনা।আজ ও কাঁদতোনা কিন্তু কি করবে!আজ যে সে সর্বহারা হয়ে পড়েছে।যার মা হারায় সেই তো আসল সর্বহারা!সে কাঁদবেনা তো আজ কে কাঁদবে!

আসিফ ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো।ছেলেটা সব কিছু ভুলে চিৎকার করে কাঁদছে এখন ।মায়ের কবরের কাছেই মসজিদ।হজুরেরা সেখানে বসে থেকে ওকে দেখছিলেন।
অথচ তারাই এই ছেলেটাকে আজ অবধি হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতে দেখেছেন।সেই ছেলেটাই এখন চিৎকার করে কাঁদছে।দৃশ্যটা খুবই নতুন এবং বেদনাদায়ক তাদের কাছে।
——-
বাপ্পি আর তটিনি ফিরতেই আসিফের মা ব্যস্ত হয়ে তাদের জন্য প্লেট রেডি করছিলেন।তটিনি কাছে এসে বললো,’এত ব্যস্ত হইয়েন না। আমরা পরে খেতে পারবো’

‘আরেহ না কি বলো!’

এই কথা বলে তিনি তটিনির গায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।তটিনি ভীষণ লজ্জা পেলো।কারণ সে তো উনারই শাড়ী পরে আছে!
বাপ্পি উঠানো হাঁটাচলা করছিল সেসময় আসিফ কারিমকে নিয়ে উঠানে আসতেই থেমে যায়।বাপ্পির গায়ের পেস্ট কালারের পাঞ্জাবিটা তার খুব চেনা মনে হলো।অনেকক্ষণ দেখার পর মনে আসলো এটা তো তারই।গলার কাছে হলুদ দাগ আছে।তার মানে এটা শতভাগ তারই পাঞ্জাবি!
আসিফকে ওরকম করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাপ্পি হেসে বলল,’আসলে হয়েছে কি!’

‘বুঝেছি!সমস্যা নেই।ভালই লাগছে তোমাকে’

এটা বলে আসিফ কারিমকে সঙ্গে করে বাড়ির ভেতর চলে যায়।বাপ্পি জিভ কামড়ে পেছনে মুড়তেই দেখে তটিনি বাড়ির একটা রুম থেকে জানালা দিয়ে ওকে ডাকছে খাওয়ার জন্য।
——-
রিনি কোরআন শরীফ রেখে বিছানা থেকে নামতেই আসিফের গলা শুনে জলদি বাহিরের রুমের দিকে গেলো।আসিফ কারিমকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে সেখানে।রিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
“যে মানুষটাকে এতদিন আমি চিনতাম আর আজ শুরু থেকে যে মানুষটাকে দেখছি তাদের মাঝে কত তফাৎ।!
এই মানুষটাকি আমাকে সবসময় দূরে ঠেলে দিতো!এই মানুষটাকি জোর গলায় বলতো আমি রিনিকে পছন্দ করিনা!আমি বাধ্য হয়ে তাকে বিয়ে করেছি!বাধ্য হয়ে করা বিয়েগুলো কি এভাবে পরিণাম পায়?’

এই ভেবে রিনি ডানের খোলা রুমটার দিকে তাকায়।বাপ্পি তটিনিকে রুই মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছে আর তটিনি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

“”””আসলেই!কিছু পরিণাম খুব সুন্দর হয়।””””

আসিফ হাত ধুয়ে এসে দেখে রিনি তটিনি আর বাপ্পিকে দেখছে।
তার চোখ মুখ দেখে মনে হয় এখনই পড়ে যাবে।আসিফ দ্রুত ওর হাতটা ধরে বলে,’অনেক হয়েছে।এবার কিছু খাবি।চল”

‘খিধে নেই।আঁর কথা বাদ দেন!আন্নে নিজেও তো কিছু খান ন’

আসিফ কিছু বলেনা।রিনিকে জোর করে রুমে নিয়ে এসে বসিয়ে ওর জন্য খাবার আনতে চলে যায় তার মায়ের কাছে।তিনি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন।

‘ বাবা আজ থাকবি?’

‘হ্যাঁ।আরও দুই/তিনদিন থাকবো’

‘তোর পরীক্ষা না?’

‘ওসব পরে হবে।আমার এখানে থাকা জরুরি’

‘রিনির খেয়াল রাখিস!যাবার সময় ওরে নিবি?’

‘না নিলে এখানে থেকে নিজের খেয়াল রাখা ভুলে যাবে।নিয়ে যাব ভাবছি।সে যাবে কিনা এটাও তো কথা’
——
আসিফ প্লেট নিয়ে নিজে লোকমা বানাতে বানাতে বললো,’আমি পরশুদিন চলে যাবো।তুই যাবি নাকি থাকবি এখানে?’

‘বাবা তো একা!কেমনে যাই?’

আসিফ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে লোকমা তুলে ধরে রিনির মুখে।আসিফ চলে যাবার কথা ওঠায় রিনির চোখ ছলছল করে উঠলো।সব রেখে আসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে।ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে ধীর গলায় বললো,’আঁরে থুই যাইয়েন না।’

আসিফ প্লেট রেখে বাম হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’পরীক্ষা যাক!গেলাম না!’
——–
বাপ্পি আর তটিনি রাত হতেই চলে এসেছে ঢাকায়।সকলে বলেছিল একদিন থাকতে কিন্তু সেখানে জায়গার অভাব বলে তারা থাকেনি।এত এত মানুষ তারাই বা থাকবে কই!আসিফদের বাড়িও ভর্তি রিনির ফুফু,মামিদের দিয়ে।
তাই ওরা দুপুরে খাবার খেয়েই রওনা হয়েছিল।আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেছে।বুশরা জেগে ছিল দরজা খুলে দেবে বলে।ওরা আসায় সে দরজা খুলে হাই তুলতে তুলতে চলে গেছে।

তটিনী রুমে ঢুকা ধরতেই বাপ্পি বলে ওঠে’তটিনি আমার খুব খিধে পেয়েছে!’

তটিনি সঙ্গে সঙ্গে থেমে পেছনে তাকায়।সে কি করবে সেটাই ভাবছিল হঠাৎ মনে হলো ফ্রিজে খাবার থাকতে পারে।তাই ছুটে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখে কিছু নাই।বাপ্পি সেসময় চেয়ার টেনে বসে বললো,’আজকে শনিবার!এই দিনে খাবার থাকেনা ফ্রিজে।রাতের শেষ খাবারটা দারোয়ান নিয়ে যায়।তার বউ শনিবার বাপের বাড়িতে থাকে বলে রাতে খাবার পাঠায়না’

তটিনি ফ্রিজ বন্ধ করে কোমড়ে আঁচল গুজে বলে,’কি খাবেন বলুন’

‘শুনলাম তুমি শুধু ম্যাগী নুডুলস বানাতে পারো’

‘এই কথা কে বললো?’

‘আসিফ’

এই বলে বাপ্পি হাসছে মিট মিট করে।তটিনি মুখ বাঁকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।বাপ্পি ও সেখানে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলে,’আমি কিন্তু নুডুলস কম খাই।তবে তুমি বানালে বেশি খেতে পারবো’

‘থাক কষ্ট করতে হবেনা’

‘তাহলে কি বানাচ্ছো?’

‘খুব মজাদার!খেলে খুশির ঠেলায় পাগল হয়ে যাবেন’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here