তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৪০

0
176

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৪০
লেখনীতে-আফনান লারা
.
রাতটা রিনির যেন আরও খারাপ যাচ্ছে এবং যাবেও।চোখ বুজলেই মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।রুমে থাকা তার জন্য জঘন্যতম কাজ বলে মনে হচ্ছে এখন।কোনো কিছু করেও শান্তি খুঁজে পাচ্ছেনা রিনি।
আসিফ সারাদিন পাগলের মতন ছুটেছে বলে এখন ক্লান্তিতে একসের হয়ে ঘুমাচ্ছে রিনির পাশেই।রিনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসেই আছে,কোনো আওয়াজ করছেনা,আসিফকে ডাকার সাহস এবং ইচ্ছা তার নেই।চোখের সামনে ছেলেটাকে ব্যস্ত দেখেছে আজ সারাটাদিন।
মা একদিন বলেছিল,’শুন রে রিনি!জামাই যেমনই হোক!সে তোর জামাই।খুব আদরে রাখবি।আর আসিফ বাবাকে তো আমি চিনি।সে ছাড়ার মতন ছেলেনা।একটু আলাদা কিন্তু খুব করে ধরে রাখতে জানে।তার হাত শক্ত!মন শক্ত।ছোটকাল থেকে চিনি তো!’

আজ মায়ের কথাগুলো কেমন টেপ রেকর্ডারের মতন বেজে যাচ্ছে।চোখের পানি মুছে আসিফের পিঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে রিনি।
ওরা যে বিছানায় শুয়ে আছে সেটা বেশ পুরোনো খাটের বলে অনেক নড়ছিল।
আসিফ অল্পতেই জেগে গেছিলো কিন্তু কিছুই বলেনি।রিনি বলছেনা তাহলে সে কি বলবে!
এখন যখন রিনি ওর পিঠে মাথা ঠেকালো তখন সে মনে মনে স্বস্তি অনুভব করলো।এতক্ষণ নেহাত ভাবছিল রিনি আসলে বসে কি করে!
———
তটিনি নুডুলসের একটা পাকোড়া তৈরি করে দিচ্ছে বাপ্পিকে। বাপ্পি তাকের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তটিনির রান্না করা দেখছিল।তটিনি চুলে খোঁপাই করেছিল কিন্তু কাঠি দিতে ভুলে গেছে।আর তাই তার মাথা নাড়াচাড়ার কারণে খোঁপাটা খুব সহজে খুলে গেলো।এবার শুরু হলো ঝামেলা।এদিকে সে এক হাত দিয়ে চুল সামলাতে পারছেনা।মনে মনে ভেবেছিল সিনেমার মতন করে বাপ্পি বুঝি তার চুল সামলে দিবে।এই ভেবে তটিনি মিটমিট করে হাসছিল।
কিন্তু বাপ্পি কি করলো! সে তটিনির খোলা চুলকে আরও এলোমেলো করে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
ওর মা একবার বলেছিল বাপ্পি ঝাল খেতে পারেনা।বাপ্পির এরুপ কাজে তটিনির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে ইচ্ছামত ঝাল দিয়ে পাকোড়াটা বানিয়ে নিয়ে সামনে রেখেছে বাপ্পির।
বাপ্পি খিধায় বসেছিল অনেকক্ষণ। গরম গরম পাকোড়া আর তার সাথে টমেটো সস দেখে আর লোভ সামলাতে না পেরে গোটা একটা মুখে পুরে চিবানো শুরু করে সে।

তটিনি দাঁত কেলিয়ে আছে বাপ্পির রিয়েকশান দেখার জন্য।কিন্তু বাপ্পি সবটা পাকোড়াই খেয়ে নিয়েছে চুপচাপ।কোনো রিয়েকশান তার নেই।তটিনি হা করে তাকিয়ে থেকে ধপ করে ওর সামনে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ঝাল নেই?’

বাপ্পি মুচকি হাসলো,ওমনি তার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়লো তটিনির হাতে।সে হেসে বললো ‘বাবা বলেছে নতুন বউয়ের হাতের প্রথম রান্না যাই হোক!খুব আনন্দ করে খাবি।তুমি তো জানো আমি বাবার কথা শোনা ছেলে’

তটিনি হাত দিয়ে বাপ্পির চোখ মুছে দিয়ে বললো,’আপনার বাবা বলেছে বলে এটা করেননি আপনি!আমায় পাগলের মতন ভালবাসেন বলেই এখন এই ঝাল দেয়া পাকোড়া সবটা খেলেন’

বাপ্পির চোখ সেই আবারও ভিজে গেলো।তটিনি ঠিক তার মনের কথা জেনে গেছে আজ,পড়তে পেরেছে।আসলেই বাবা এই কথা বলেননি!সে বানিয়ে বললো।
তটিনি হঠাৎ এগিয়ে এসে বাপ্পির গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।এরপর চোখ বুজে বললো,’আই এম সরি!আর কোনোদিন ঝাল দিব না’

‘ঝাল দিবে!অবশ্যই দিবে,তা নাহলে যে এই জড়িয়ে ধরার দেখা মিলবেনা’

তটিনি আরও আবেশে বাপ্পির খুব গভীরে চলে গেলো।বাপ্পি ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসা ছিল।তটিনির ভারে চেয়ার পিছিয়ে পড়ে যাওয়া ধরলো ওমনি বাপ্পি এক হাতে দেয়াল ধরে ফেলে তাকে এবং তটিনিকে আটকে ফেলে পড়ে যাওয়া থেকে।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলা বকুল আপু এসেছিলেন।মাকে নিয়ে ডায়াবেটিস হসপিটালে যাবার জন্য।আপুর ও ডায়াবেটিস। দুজনে একসাথেই যান প্রতিবার।হাসপাতালের কাজ শেষে এ বাসাতেই থেকে যান তিনি।
রাত করে খুব পিপাসা লাগলো বলে তিনি পানি নিতে রুম ছেড়ে বের হতেই দেখেন ফ্রিজের উপরে জ্বলা সবুজ ড্রিম লাইটের আলোয় দুজন মানুষ এক চেয়ারে হেল দিয়ে বসা।বকুল আপু একটু এগিয়ে আলো জ্বালাতেই বাপ্পি ভয় পেয়ে দেয়াল থেকে হাত ছেড়ে দিলো আর ওমনি দুজনে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়।
আপু কোমড়ে হাত রেখে বললেন,’এইসব করিস রাতদুপুরে??তোদের জন্য রুম নাই?গোটা এক ডিসিমের মতন দেখতে একটা রুম বাবা তোকে বানিয়ে দিয়েছে।সাউন্ডপ্রুপ দরজা আছে তাও তোরা এগুলা করিস!আমার ছোট ছেলেটা এইসব দেখলে কি শিখতো?’

বাপ্পি গলায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে আছে।তটিনি ব্যাথা পায়নি, সে বাপ্পির বুকের উপরই ছিল।বকুল আপুর কথায় লজ্জায় লাল হয়ে সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।বকুল আপু কাছে এসে হাতের বোতলটা টেবিলে ঠাস করে রেখে বললেন,’আপনাকে কি নিমন্ত্রণ করতে হবে উঠার জন্য?’

‘আহঃ বুবু গলায় ব্যাথা পেয়েছি।তোমাদের নতুন বউকে বলো টেনে তুলতে।কাল মনে হয় অফিস যেতে পারবোনা’

বকুল আপু তটিনির দিকে তাকাতেই তটিনি ব্যস্ত হয়ে বাপ্পিকে উঠতে সাহায্য করলো।

দুজনেই এখন চোরের মতন তাকিয়ে আছে আপুর দিকে।বকুল আপু পানি ঢেলে বোতল ভর্তি করে যাবার সময় লাইটের সুইচে হাত রেখে বললেন,’কিহ যাচ্ছ না কেন?যাও রুমে যাও দুজন!বিয়েরদিন আলাদা ঘুমায় আর বিয়ের কয়েকদিন পর একেবারে ডাইনিং রুমেই!!!’

বাপ্পি মাথায় হাত দিয়ে চলে গেছে।তটিনি লজ্জায় একেবারে ফ্রিজ হই গেছে। এত লজ্জা এর আগে কোনোদিন পায়নি।রুমে এসে বাপ্পি যখন দরজা লাগালো, তটিনি ওর সামনে এসে বললো,’আপুকে দেখে ধপাস করে পড়লেন কেন শুনি?’

‘নিজের ভার,তোমার ভার,চেয়ারের ভার সব একসাথে ধরতে পারা কঠিন ছিল!তাছাড়া না পড়লেও বুবু তো আমাদের ঐ অবস্থায় দেখলোই’

তখনই আবারও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসলো।বাপ্পি এসে দরজা খুলতেই বুবু ওর হাতে গরম তেলের বাটি ধরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,’তটিনি!স্বামীর গলায় মালিশ করো!তোমার জন্য আজ সে এত ব্যাথা পেলো’

তটিনি মাথা নাড়ায়।উনি চলে যাবার পর বাপ্পি বাটিটা টেবিলের উপর রেখে আবার দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,’তুমি ঘুমাও।অনেক রাত হয়েছে।আমি পারবো তেল লাগাতে’

তটিনি বাটিটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে বললো,’দিন!আজ আমার ইচ্ছে আর মন দুটোই আছে।আজকের মন আর বিয়ের পরেরদিনের মনে তফাৎ প্রচুর’

বাপ্পির মুখে হাসি ফোটে।গায়ের আসিফের সেই পাঞ্জাবিটা খুলে তটিনির সামনে বসে সে।তটিনি হাতে গরম তেল ঘঁষে বাপ্পির গলায় মালিশ করছে আর বাপ্পি মাথা নিচু করে বসে পা দোলাচ্ছে।

‘আচ্ছা তখন জড়িয়ে ধরলে কেন?’

‘কেউ কাঁদলে তারে জড়িয়ে ধরতে হয় এতে করে তার কান্না থামে’

‘আর কাকে ধরছিলা?’

‘যদি বলি আসিফ ভাইয়াকে ধরছিলাম?’

‘বিশ্বাস করিনা।কারণ তুমি আজ যে জড়িয়ে ধরলে আমায় তার আগাগোড়া কিছুই হয়নি।জড়িয়ে ধরা জানতে হয়।আর যতদূর বুঝলাম মানুষ এসব বোকামি প্রথমবারই করে।তুমি সেই বোকামিটা আমাকে দিয়ে শুরু করেছো’

তটিনি মিটনিট করে হাসছে আর মালিশ করছে।বাপ্পি পা দোলাতে দোলাতে বললো,’আবার যদি কাঁদি।ধরবে?’
——–
‘রিনি?’

‘জাগি রইছেন?’

‘কাউকে মন ভাঙ্গা নিয়ে বসে থাকতে দেখে নিজে কি করে ঘুমাই?’

‘আঁই এককারি হত্তে হই গেছি’
[আমি বড্ড একা হয়ে গেছি]

‘আমি আছি রিনি!সবসময়।আজ থেকে মন খারাপ হলেই আমার কাছে বলবি।শেয়ার করবি।আমি চট করে ভাল করে দিবো।এতদিন যত কিছু বলে থাকিনা কেন ওসব মনে নিস না।আমি তোকে সেইসব দিবো যা তোর প্রাপ্য তাও নিজেকে একা মনে করিস না কখনও’

রিনির চোখ ভিজে গেলো আরও একবার।আসিফ টের পাচ্ছে বেশ তাও কিছু বলেনি।কাঁদতে দিলো রিনিকে।কাঁদুক।এরপর আর কখনও সে রিনিকে কোনো কিছুতে কাঁদতে দেবেনা।শপথ করেছে।
——-
তটিনি বাটি নিয়ে অন্ধকারে আসলো রাখতে এরপর রান্নাঘরের ভেসিনে হাত ধুয়ে রুমে ফিরবে।তটিনির দেরি হচ্ছে বলে বাপ্পি নিজে গেলো দেখতে সে কোথায়।
তটিনি তখন ফিরছিল। ওমনি অন্ধকারে দুজনের জোরেশোরে ধাক্কা লেগে গেলো।বকুল আপু তখনও জেগে ছিলেন।এত জোরে আওয়াজ শুনে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে আলো জ্বালাতেই দেখেন বাপ্পি আর তটিনি একজন আরেকজনকে ধরে উঠাচ্ছে।

‘এই তোমাদের আজ কি হলো বলো তো!কি শুরু করছো এসব??’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here