#বৌপ্রিয়া #আভা_ইসলাম_রাত্রি #পর্ব – ২৭

0
459

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৭

বিকেলের দিকে একদম হঠাৎ করে উচ্ছ্বাস হোটেল থেকে উধাও হয়ে গেছে। কুসুমকে বলেও যায় নি কিছু। ফোন তুলছে না। একপ্রকার যোগাযোগ করা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কুসুম চিন্তায় অস্থির আপাতত। সে বারবার ফোন করেই যাচ্ছে। অথচ পাষাণ লোক কুসুমের ফোন তোলার প্রয়োজন বোধ করছে না।
কুসুমের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রাত প্রায় নয়টায় উচ্ছ্বাস রুমে এল। কুসুম উচ্ছ্বাসকে দেখে রেগেমেগে তেড়ে এলো। উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ বিকেল থেকে কোথায় ছিলেন? ‘

উচ্ছ্বাস কুসুমকে এতটা রেগে যেতে দেখে কিছুটা ভরকাল। খানিক দমে গিয়ে উত্তর দিল,

‘ আশেপাশেই বেড়িয়ে ছিলাম। চিন্তায় ছিলে? ‘
‘ না, খুব মজায় ছিলাম। আমাকে বলে গেলেন না কেন? ফোনও তুলেন নি। ‘

উচ্ছ্বাস দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করল। কুসুমের কয়েকটা মিসডকল দেখে বেচারা আহাম্মক হয়ে গেছে। আড়চোখে কুসুমকে একবার দেখে নিয়ে বলল,
‘ সাইলেন্ট ছিল। ‘

কুসুম কি আর বলবে। চুপ করে সরে বিছানায় বসল। উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ সেখানেই দাড়িয়ে থাকল। খানিক পর এগিয়ে এল। কুসুমের পাশে বিছানায় বসল। কুসুম সরে গেল। উচ্ছ্বাস আরো একটু গা ঘেঁষে বসল। এবারেও কুসুম সরে যেতে চাইলে উচ্ছ্বাস হাত বাড়িয়ে কুসুমের কোমর আকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে বসিয়ে রাখল। কুসুম কথা বলল না, সরেও গেল না। চুপচাপ বসে আছে। উচ্ছ্বাস খানিক পর কুসুমের কানের কাছে ফিসফিস করে শুধাল,

‘ সারপ্রাইজ রেডি করার জন্যে বেরিয়ে ছিলাম। সমুদ্র দেখতে এসে বউকে সারপ্রাইজ দেয় না কোন নরাধম? তাড়াহুড়োয় ফোন কখন সাইলেন্ট হয়েছি বলতে পারিনি। সরি। ‘

কুসুম এতেই যে গলে গেল। মৃদু হেসে পরপরই মুখ শক্ত করে থাকল। উচ্ছ্বাস তবুও বুঝতে পারল, কিছুটা কাজ হয়েছে। তাই সে উঠে দাঁড়াল। সোফার উপর রাখা দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে কুসুমের দিকে এগিয়ে দিল। কুসুম মাথা তুলে তাকাল। উচ্ছ্বাস বলল,

‘ রাগ কমেছে? কমলে প্লিজ দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। এত কষ্ট করে করা সারপ্রাইজ নষ্ট করো না প্লিজ, বুকে লাগবে। ‘

কুসুম এতটা কাতর কণ্ঠ শুনে নেতিয়ে গেল। চুপ করে উঠে দাঁড়াল। শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস নিজেও রুমে তৈরি হয়ে নিল। ঘড়ি দেখে নিল কয়েকবার। তারপর বাথরুমে টোকা দিয়ে বলল,

‘ কুসুম, হয়েছে তোমার? ‘
কুসুম উত্তর দিল,’ আর অল্প সময়। ‘

উচ্ছ্বাস আরো একবার ঘড়ি দেখল। তারপর রুম জুড়ে পায়চারি করতে লাগল। কুসুম বের হল গুনেগুনে আধা ঘন্টা পর। উচ্ছ্বাস তখন সোফায় বসে মোবাইল দেখছে। কুসুম বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আরেকটা প্যাকেট থেকে গয়নার বাক্স বের করল। ছোট একটা সাদা রঙের ডায়মন্ডের নোজপিন, দুটো ছোট আকারের কানের দুল, আর একটা চিকন চেইন। কুসুম নোজপিন পরবে, তবে উচ্ছ্বাস এসে আটকে দিল। হাত বাড়িয়ে কুসুমের হাত থেকে নোজপিন নিজের হাতে নিল। কুসুম দেখল সব। উচ্ছ্বাস নিজ হাতে কুসুমকে নোজপিন পরিয়ে দিল। পরানোর সময় কিছু কথা আওড়াল,

‘ ডায়মন্ড এর নোজপিনটা কিনেছিলাম বিদেশে থাকতে। পার্টটাইম জব করার টাকা জমিয়ে জমিয়ে কেনা। নিজের টাকায় তখন এই ছোট নোজপিনটাই এফোর্ড করতে পেরেছিলাম। এটা কেনার সময় একটা কথা ভেবেছিলাম। ‘

কুসুম মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রশ্ন করল, ‘ কি ভেবেছিলেন? ‘

উচ্ছ্বাস হালকা হাসল। উত্তর দিল, ‘ বিয়ে করা বউ খুব ছোট ছিল। হঠাৎ বিয়ে হবার কারণে প্রেমে পড়তে পারিনি। বউকে ভালো করে উপলব্ধি করার আগেই বিদেশে পাড়ি। তাই এই নোজপিনটা কেনার সময় ভেবেছিলাম যেদিন আমি আমার বউয়ের প্রেমে পরব, সেদিন তাকে উপহার স্বরূপ নিজের প্রথম কষ্ট করে উপার্জন করা টাকায় এই ডায়মন্ডের নোজপিন দেব। শুধু উপহার দেব না, নিজ হাতে তাকে পরিয়েও দেব। ভাবনাটা খুব দ্রুতই সত্যি হয়ে গেল, তাইনা?’

কুসুম মাথা নত করে সামান্য হাসল। উচ্ছ্বাসের এই কথাগুলো তার কি ভীষন ভালো লেগেছে সেটা সে নিজে মুখে বলতে পারবে না। উচ্ছ্বাস বাকি গয়নাগুলো কুসুমকে নিজে পরিয়ে দিয়ে আয়নার মুখোমুখি করাল। কুসুম মাথা নত করে দাড়িয়ে আছে। মুখে লজ্জার আভা। উচ্ছ্বাস আয়নায় কুসুমের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরপর সম্মোহনের ন্যায় বলল,

‘ তুমি খুব বেশি সুন্দর, কুসুম। তোমাকে যেভাবেই দেখি সেভাবেই আমার মারাত্মক সুন্দর লাগে। কেন বলো তো? ভালোবাসি তাই বলেই কি? ‘

কুসুম আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। শ্যামলা গায়ের বরণের নারীকে উচ্ছ্বাস এতটা মুগ্ধ চোখে দেখছে, সুন্দর বলছে। এতেই কুসুমের খুশিতে পরান উড়ে যায় যায়। কুসুম হাসল।
___________________________________
সমুদ্রের পাড়ে এসে কুসুমের চোখ ছানাবড়া। অত্যধিক খুশিতে কুসুম মুখে হাত চেপে ধরে ঠায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। উচ্ছ্বাস পাশে দাড়িয়ে কুসুমের খুশি দেখছে। রাতের আকাশের নিচে সমুদ্র মোটেও কালো দেখাচ্ছে না। বরং চারদিক কেমন আলোয় পূর্ণ। অসংখ্য ফানুস উড়ছে আকাশে। মনে হচ্ছে দিনের আলোয় সমুদ্রের পানি ঝলমল করে উঠছে। কুসুম দৌড়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। পরপরই অবাক হয়ে দাড়িয়ে গেল। আরো একটু দৌড়াল, আবার দাড়াল। কুসুম থামল। সমুদ্রের পানিতে কুসুমের পা ডুবে। উচ্ছ্বাস নিজেও কুসুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একসময় উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল, ‘ ভালো লাগছে? ‘

কুসুম খুশিতে চিৎকার করে বলল, ‘ এমন ভালো লাগা আমি কখনোই পাইনি। উফ, চারপাশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে। কিভাবে করলেন এসব? এত এত ফানুস, এত এত আলো। উফ!কি করেছেন এসব? ‘

উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে ফেলল। সে খুব একটা বেশি কিছু করেনি। শুধু ফানুস উড়িয়েছে। এতেই কুসুম খুশিতে কেঁদে দেবার উপক্রম। যারা এত ছোট ছোট বিষয়ে খুশিতে পাগল হয়ে যায়, এদেরকে বারবার ছোট ছোট আনন্দের বিষয়গুলো দেখিয়ে খুশি করতে মন চায়। উচ্ছ্বাস পেছনে থেকে কুসুমকে জড়িয়ে ধরল। কুসুমের কানের কাছে মুখ এনে বলল,

‘ কুসুম, নিজ হাতে ফানুস উড়াবে? ‘

কুসুম ঘাড় কাত করে পাশ ফিরে তাকাল। উচ্ছ্বাসের থুতনি কুসুমের ঘাড়ে। উচ্ছ্বাসের এটুকু স্পর্শে কুসুম আপাতত নেতিয়ে। কুসুম মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

অতঃপর কুসুম-উচ্ছ্বাস আগুন জ্বালিয়ে ফানুস উড়ালো। একটা দুটো অসংখ্য। ফানুস উড়ানোর সময় উচ্ছ্বাস কুসুমের চোখের দিকে চেয়ে এতদিন জমানো অনুভূতি স্বীকার করে বসে,’ভালোবাসি কুসুম। ‘
প্রতিবার ফানুস উড়ানোর বেলায় একই স্বীকারোক্তি, একই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।

কুসুম এসব পাগলামি দেখে লজ্জায় নত হচ্ছে, আবার শব্দ করে হেসে হেসে উঠছে। শেষ ফানুস উড়ানোর সময় উচ্ছ্বাস আবারও একই কথা উচ্চারণ করবে তার আগে কুসুম উচ্ছ্বাসের মুখ চেপে ধরল।
লজ্জায় জমে গিয়েও নিজে থেকে উচ্চারণ করল,
‘ ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব। ‘

কুসুমের এটুকু কথা উচ্ছ্বাসকে তাক লাগিয়ে দিল। মেয়েরাও বুঝি এতটা কাউকে ভালোবাসতে পারে? কুসুমের ভালোবাসার পরিমাপ করতে গেলে উচ্ছ্বাসের জনম লেগে যাবে যে। উচ্ছ্বাস হাসল। আচমকা জড়িয়ে ধরল কুসুমকে। কুসুম উচ্ছ্বাসের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। উচ্ছ্বাস অনুভব করে কুসুম কাদঁছে। কাঁদুক না। ভালোবাসার সুখে এটুকু তো কাঁদতেই হয়।
______________________
হোটেল রুমে এসে কুসুম আরো এক দফা অবাক হয়েছে। বাসর ঘরের ন্যায় আবারও সাজানো হয়েছে। লাভ শেপের বিছানায় গোলাপের পাঁপড়ির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা বিছানার আশেপাশে। লজ্জায় এবার কুসুমের মুখ জ্বলছে, ভারী হয়ে আসছে। কুসুম আশপাশ দেখে নিয়ে বলল,

‘ এসব কখন করেছেন? ‘
উচ্ছ্বাস উত্তর দিল, ‘ আমরা বেরুনোর পর করিয়েছি। ‘

কুসুম আর কিছুই বলল না। এমনিতেও এই ভালোবাসার অনুভূতি ওকে শেষ করে দিচ্ছিল। এখন আবার বাসর! লজ্জায় কুসুম মরে যাচ্ছে না কেন? ইশ! কুসুম পালাতে চাইল। এদিক ওদিক চেয়ে বলল,

‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ‘

কুসুম বাথরুমের দিকে চলে যাবে তার আগেই উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত টেনে ধরল। কুসুমকে টেনে নিজের বুকে উপর মিশিয়ে নিয়ে বলল,

‘ আজকে আর বাথরুমে রাত কাটাতে দিচ্ছি না। আজকে আমরা স্বপ্নের রাত কাটাব। ‘

উচ্ছ্বাস ডান চোখ আলগোছে বুজে চোখ টিপে দিল। কুসুমের দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। ভাঙা স্বরে বলল,

‘ ফ-ফ্রেশ হ-হব না? ‘

উচ্ছ্বাস কুসুমকে পাজকোলে তুলে নিল। বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘ ফ্রেশ হবে তো। কাল সকালে আমরা দুজন একসঙ্গে ফ্রেশ হব। আমি ফ্রেশ করিয়ে দেব তোমায়। ডোন্ট ওরি মিসেস উচ্ছ্বাস। ‘

কুসুমের গলায় কথা আটকে আটকে আসছে। লজ্জায় কি করবে ঠাহর করতে পারছে না। আনমনে উচ্ছ্বাসের বুকের দিকে চেয়ে আছে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই কুসুম উঠে চলে যেতে চাইল। উচ্ছ্বাস আটকে ধরল কুসুমের শাড়ির আঁচল। কুসুম থমকে গেল। উচ্ছ্বাস লজ্জায় অবনত কুসুমের দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে শাড়ির আঁচল নিজের হাতে পেচিয়ে নিয়ে খুলে ফেলল সম্পূর্ন আঁচল। কুসুম লজ্জায় পাশ ফিরে দ্রুত মুখ লুকাল উচ্ছ্বাসের বুকে। উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে এক পৃথিবী জয় করা হাসি লেগে রইল।

#চলবে
গল্পের পরবর্তী সকল আপডেট পেতে যুক্ত হোন লেখিকার নিজস্ব গ্রুপে। গ্রুপ লিংক,
https://facebook.com/groups/929533097975216

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here