#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১২
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, হালকা বাতাসে শীত যেনো জমে উঠেছে।
গন্তব্য শহরের বাহিরের জমিদার বাড়ি। আজ পুরো বিকেল সেখানে কাটানোর কথা। সন্ধ্যেবেলা বিয়ের শপিং বলতে শুধুমাত্র শাড়ি, যা দেখানোর জন্য কারিগর আসবে জমিদার বাড়িতেই।
পুরো রাস্তায় আয়াতের সাথে টুকটাক কথা বলে কাটিয়েছে ইশরাক। কথার বিষয় আয়েত্রী।
খুটিয়ে খুটিয়ে যেমন প্রশ্ন করছিলো ইশরাক আয়াত ঠিক তেমন বাধ্য ছেলের মতন উত্তর দিচ্ছিলো।
আদ্যোপান্ত শুনে এটা কারো বুঝে আসছে না যে আয়েত্রী সাথেই এমন কেনো হচ্ছে। সব ঘটনার পরি-প্রেক্ষিতে আয়েত্রীকে কয়েকভাবে ভিক্টিম করা হয়েছে।
প্রসাধনী, কাপড়, সব শেষ পুতুলের দিকটায়।
কোন এক মনে ইশরাক আয়াত কে বলে,
“দাদার সময় যে ভদ্রলোক এসেছিলেন আমরা একবার তার খোঁজে যেতে পারি কিন্তু….. ”
আয়াত সহমত প্রকাশ করে কারণ ইশরাককে খারাপ মনে হয়নি কখনো। যদিও আয়েত্রীর বিয়ে নিয়ে সে ইশরাকের উপর কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলো তবে আজকের ব্যবহারে মুগ্ধ।
এমন একজনের হাতে সে বোনের হাত তুলে দিতেই পারে। কারণ এটা যে হবে সৎ পাত্রে কন্যা দান।
ওদের কথার আরো একটি বিষয় ছিলো আয়েত্রী এক্টিভিটি। আয়েত্রী যদি সবার সাথে কথা বলে,সময় কাটায় এতে হয়তো কিছুটা শারিরীক ইম্প্রুভমেন্ট আসবে।
জমিদার বাড়ি যাওয়ার আগের গ্রামের মেঠোপথ যেনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছোট্ট একটা গ্রাম।
বৃষ্টি পড়েছে মাঠের ঘাসে,হালকা বাতাসে তীব্র মাটির গন্ধ। আয়াত হালকা স্বরে আয়েত্রী কে ডেকে তুলে। আয়েত্রী বেশ ঘুমিয়েছে। উঠে আড়মোড়া ভাঙতেই কফি এগিয়ে দেয় ইশরাক। মুচকি হেসে আয়েত্রী কফি নিয়ে নেয়।
কফি শেষে আয়াতের জ্যাকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাই! আমার না এখন বেশ হালকা লাগছে। কিন্তু মুখে টক ভাব। মনে হচ্ছে এই বুঝি বমি হবে। ”
“মিস আয়েত্রী! আপনি কি কখনো অরক্ষণীয়া পড়েছেন?”
ইশরাকের প্রশ্নে আয়েত্রী ভাইয়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ইশরাকের দিকে তাকায়। সাবলীল বাংলায় বলল,
“আমি বই পড়ি না। উপন্যাস পড়লে মাথায় বড্ড যন্ত্রণা হয়। অনুভূতি ভোতা ভোতা লাগে। ”
আয়েত্রী কথায় এক গাল হাসে ইশরাক। হাসির মধ্যেও এক প্রকার ডিসিপ্লিন চোখে পড়লো আয়েত্রী। আচ্ছা তাদের কি হাসতেও নিয়ম মেনে চলতে হয়? কি জানি বাপু!
“শুনতে তো পছন্দ?”
“আমার লাশের গল্প ভালো লাগে না। আমার রক্ত ভালো লাগে না। আমার ফুল ভালো লাগে না, না ভালো লাগে কোন পাখি।”
“কি ভালো লাগে? ”
“চাঁদ ভালো লাগে, জ্যোৎস্না ভালো লাগে আর ভালো লাগে নদীর পাড়”
কথা গুলো বলতেই আয়েত্রী মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। শাওনের কথা ভিষণ করে মনে পড়ছে।
নদীর পাড়ে ছোট্ট একটা বালুচর। বালুচরের বা পাশের দিকে একটা ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর। বর্ষার পানিতে যখন ডুবে যায় মাঠঘাট, আশ্চর্য ভাবে ভেসে থাকে এই ঝুপড়ি ঘর।
একদল উৎসাহী যুবক সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিলো সে ঘরের দিকে। গ্রামের প্রবীণ লোকেরা না করেছিলো এক বার, দুই বার, বার বার। কিন্তু বালকদের তখন রক্ত গরম৷ বয়স টাই এমন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর সংকল্প কবিতার মতন হয়তো তারাও চেয়েছিলো
“রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।”
যখন একবুক পানি সাতরে যুবকদল সেই ঝুপড়ি ঘরের কাছাকাছি পৌঁছালো তখন দেখলো পানির মধ্যে বিশাল পাক সৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশের সব টেনে নিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে তখন কয়েকজন ফিরে আসলো। দুইজন পাক বাঁচিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর যখন ঝুপড়ির কাছে পৌঁছেছে তখন শুরু হলো আর্তনাদ। বাঁশের তালাইয়ের দরজা ঠেলে ভিতরে তাকাতেই শিউরে উঠে।
কেনোনা সতেরো বছর বয়সী এক যুবতী সে ঘরে বসে করছিলো প্রেত সাধনা। তার পাশেই বসে ছিলো চারপা বিশিষ্ট এক জন্তু। যে খুবলে খুবলে খাচ্ছিলো এক বাচ্চার মস্তিষ্ক। অথচ সবটা হচ্ছিলো পানির উপরে। তারা পানির উপরে এমন ছিলো যে মনে হচ্ছিলো পানির উপরে নয় স্বচ্ছ কাঁচের উপরে বসে আছে। সব থেকে ভীবৎষ ছিলো মেয়েটির পাশে থাকা এক গামলা চিনা জোক। যা কিলবিল করছিলো। মেয়েটির চোখ ছিলো বন্ধ। হঠাৎ একটা লাশ ধীরেধীরে পানির তল ভেদ করে উঠে এলো। জোক গুলো আপনা আপনি নেমে এলো। এসে লাশের শরীরের সব রক্ত কয়েক মূহুর্তে শুষে নিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়।
দুই যুবক তখনো নিশ্চুপ দেখছিলো। বলতে বাধ্য যে যুবকদ্বয়ের ছিলো অশেষ ধৈর্য্য শক্তি।
তবে মানুষের ধৈর্যের একটি সীমানা আছে, সীমানা অতিক্রম করলে টিকে থাকা দুষ্কর।
হলোও তাই! যখন লাশ থেকে ছাল,মাংস একে একে উঠে যাচ্ছিলো বালকদ্বয় সহ্য করতে পারলো না। চিৎকার করলো জোরে জোরে৷ ধ্যান ভাংলো স্বর্গের অপ্সরীর।
শুনেছি শিশুবালক কৃষ্ণ কে অপ্সরী বেশে দুধ খাওয়াতে এসেছিলো এক পিশাচিনী।
এ যেনো সেই রুপসী, অপ্সরী বেশে পিশাচিনী।
চোখ দুটো জ্বলন্ত আগুনের অগ্নিকুণ্ড।
বালকদ্বয় ভয় পেয়ে কোন রকমে পাড়ে ফিরে আসে। কিন্তু ফিরতে পারলো না স্বাভাবিক জীবনে।
দুমিয়ে জ্বর এলো, প্রচন্ড জ্বরে বিলাপ করছিলো। আধো ভাষায় বর্ণনা করে ঘটে যাওয়া সব।
সাত দিন পর এক গভীর রাত, আনুমানিক রাত একটায় মৃত্যু হয় দুই বালকের।
সেই রাতেই তলিয়ে যায় সেই ঝুপড়ি ঘর। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। মনে করা হয় এখানে সেই মেয়েটা প্রেত সাধনা করতো। সাধনায় ব্যঘাত ঘটানোর জন্য প্রাণ দিতে হলো দুই বালক কে।
জমিদার বাড়ি বুড়ো লোকের থেকে এতক্ষণ গল্প শুনছিলো সবাই। বাহিরে বৃষ্টির আনাগোনা লেগেই আছে।
বিশাল বৈঠক খানায় বসে চায়ের কাপে জমে উঠেছে আড্ডা। বৃষ্টির সাথে চা আর সাথে ভৌতিক গল্প। পারফেক্ট কম্বিনেশন।
আয়েত্রী বসেছে আয়াত, মানহার মাঝে। ইশরাকের মুখোমুখি।
ইশরাক খেয়াল করলো আয়েত্রীর দুইচোখ নিভু নিভু। যখন তখন ঢ’লে পড়বে ঘুমের রাজ্যে।
বুড়ো লোককে বলে নিচে বিছানা পাতার ব্যবস্থা করতে বলল ইশরাক। হালকা নাস্তা, সাথে গরম পানি নিয়ে আসতে বলে।
নিচে বিছানা পেয়েই যেনো ঘুম আরো জেকে বসেছে। ভালোভাবে গায়ে চাদর জড়িয়ে কেবল মাত্র আয়েত্রী চোখ বন্ধ করবে ঠিক তখন ইশরাক এসে পাশে বসে। হাতে থাকা ডিম সেদ্ধ এগিয়ে দেয় আয়াতের দিকে। বিনাবাক্যে আয়াত হাতে নিয়েই চালান করে আয়েত্রীর মুখে। পর পর দুটো ডিম খেয়ে আয়েত্রীর গলা অবধি ভরে গিয়েছে । এটা আয়েত্রীর কথা।
এদিকে ইশরাক খেয়াল করলো
যখন যখন প্রতী-ইস্তিয়াকের বিয়ের কথা হচ্ছে আয়েত্রীর অস্বস্তি হচ্ছে।
ঠিক তখন মনে হলো আয়েত্রীর বলা কথা,
আয়েত্রী বলেছিলো বর পক্ষ আসবে,পছন্দ করবে বিয়েও হবে।অর্থাৎ প্রতীর বিয়ে হওয়া মানেই আয়েত্রীর মুখের কথা সত্যি হওয়া।
এবং এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া মৃত্যুর দিকে।
চলবে
#ছবিয়ালঃ কায়সার_মাহমুদ