#চন্দ্রাবতীর_রাতে #সৌরভে_সুবাসিনী(moon) #পর্বঃ১৩

0
179

#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১৩

সাদা বেনারসি শাড়ির পাড়ে গাড় সোনালি রঙের কারুকাজ। পুরো শাড়ি জুড়েই সোনা রঙ। যেনো ফুটফুটে শুভ্র মেঘের ফাক ফোকড়ে সোনালি রোদ্দুর খেলা করছে।

স্বভাব বশত কারণেই আয়েত্রী ভাইয়ের সান্নিধ্যে বেশ আরামে রয়েছে। সত্যি আরামে আছে কি না সে কথা আপাতত বুঝতে পারছে না। কারণ দুচোখ বন্ধ করলেই কেউ না কেউ কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে।
সামনে বিছানো রয়েছে রঙবেরঙে জামদানী শাড়ি থেকে শুরু করে টাংগাইলের শাড়ি।
সবাই শাড়ি দেখতে ব্যস্ত। এই সুযোগে আয়েত্রী কয়েক মূহুর্ত ঘুমানোর প্ল্যান করেছিলো, কিন্তু বার বার সে প্ল্যান ভেস্তে যাচ্ছে বাধ্য হয়েই সোজা হয়ে বসে আয়েত্রী। সবাই মিলে যখন ঘুমের তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তখন ঘুম কে ছাড়িয়ে দেওয়াই উচিৎ।
প্রতীর কানে কিছু একটা বললে প্রতী ইস্তিয়াক কে বলল,

“কফি পাওয়া যাবে? গরুর দুধ দিয়ে স্ট্রং কফি? ”

মিনিট পাঁচেক পর কফি হাজির।
আয়েত্রীর সাথে বাকী দুজনের তেমন সখ্যতা গড়ে না উঠলেও প্রতীক্ষা,মানহা,মালিয়াত তাদের সাথে বেস মিশছে। আড্ডা দিচ্ছে,হাসি-তামাশা করছে।
আয়েত্রী এক পলক ওদের দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো।
গায়ে পড়া স্বভাব কারো নেই তবুও আয়েত্রীর বেশ বিরক্তি লাগছে। শাড়ি দেখা বাদ দিয়ে নানান প্যাঁচাল হচ্ছে এখানে।
অথচ একজোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ যে বার বার তাকেই দেখছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷

প্রতীক্ষা,মানহা,মালিয়াতের কাছে আয়েত্রী কথা শুনতে শুনতে সব মুখস্থ হয়েছে ইমতিয়াজ এবং ইলিয়াসের।
আয়েত্রীকে উনারা খেয়াল করেনি এমন কিন্তু নয়, তবে ভালোভাবে খেয়াল করার সুযোগ বা কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
ইমতিয়াজ ভীষণ ভাবে চমকিত হলো যখন
আয়েত্রী আয়াতের কফির মগ থেকে কফি পান করছিলো।
যতদূর শুনেছে কেউ বোতলে পানি খেলেও সে বোতলে পানি খায় না আয়েত্রী , অথচ ভাইয়ের এঠো কফি দিব্ব্যি মুখে নিচ্ছে।

“জানেন তো আগুন নিয়ে খেলা করলে রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলবে এমন টা বলা হয়? ”

মানহার সরাসরি প্রশ্ন ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ বললেন,

“হ্যাঁ জানি। ছোট বেলায় আমাদের বলা হতো। ”

“তাহলে সিগারেট খোর রা কেনো রাতে বিছানা ভেজায় না? নাহ্ দেশ টা কুসংস্কারে ডুবে গেলো। ”

“মানে?”
“হিসেব মতন তো সিগারেট যারা খায় তারাও আগুন নিয়ে খেলে। তাহলে তাদের তো বিছানায় ইউরিন ত্যাগ করার কথা ঘুমের মাঝেই। তারা তো করে না। আপনি করেন? ”

খোঁচাটা এবার সুবোধ বালকের দল বুঝতে পারলো। মেয়েদের সামনে না হলেও দূরে গিয়ে সিগারেট খেয়ে এসেছে ওরা। আর যাইহোক বেয়াইনগুলো যে সিগারেট পছন্দ করেনি এটাই ইশারায় বুঝিয়ে দিলো।
বলতে বাধ্য হচ্ছে সবাই মানহা বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে।

ইশরাক সবাইকে নিষেধ করেছে কেউ যেনো প্রতীর বিয়ে উপলক্ষ্যে কোন কেনাকাটা যেনো না করে। সবার মনে থাকবে সামনে একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে তাই কেনাকাটা।

সাদা বেনারসি ইশরাকের বেশ পছন্দ হয়েছে। তবে ইশরাকের পূর্বে আয়াত শাড়ি হাতে নিয়ে আয়েত্রীর মাথায় ঘোমটার মতন করে দিয়ে বলল,

“আত্রী! এই শাড়িটা পরে বউ সাজবে। সেদিন আমি তোমাকে বেলি ফুল এনে দিবো। পায়ে লাল টকটকে আলতা,দু হাতে মেহেদি।”

আয়াতের কথায় মুচকি হেসে আয়েত্রী উত্তর দেয়,

“ভাই! আমি আর বিয়ে? বাঁচবো কি তার কোন গ্যারান্টি নেই আবার বউ সাজবো?
আচ্ছা! প্রতীর বিয়ের দিন ওভাবে সাজবো। তবে কি জানো? আমার মনে হচ্ছে সে সাজ হবে আমার শেষ সাজ। সাদা তো কাফনের রঙ তাই না?”

পরিবেশ হঠাৎ থমথমে হয়ে যায়। সবার দৃষ্টি ভাই-বোনের দিকে। আয়েত্রীর চোখে পানি। নাক টান দিচ্ছে।
দুফোঁটা মুক্তো গড়িয়ে পড়লো।
নিষ্পৃহ কন্ঠে আয়েত্রী বলল,

“আমি জানি ভাই! আমার সময় শেষ। আমার মন বলছে। আমারো এমন জীবন ভালো লাগে না। আমিও আর দশটা মানুষের মতন হতে চেয়েছিলাম। জানিস তো! খুব কষ্ট হয়। শরীর মানছে না এসব। মনে হয় কেউ একজন আমার গলা চেপে ধরে রাখে। মাথায় হাতুড়ি পেটায় কেউ, কয় কথা বলবো বল ? এত এত সমস্যা হচ্ছে আমার।
আমি তো কারোর ক্ষতি করিনি। তবে আমার সাথেই এমন কেনো?”

আয়েত্রীর কথায় বাকী বোনেরা এসে জড়িয়ে ধরে প্রায় কান্না করে দিচ্ছিলো। ওদের কিছু সময় দেওয়ার পর ইশরাক এগিয়ে যায়। আয়েত্রীর চোখে চোখ রেখে বিশ্বস্ত দৃষ্টিতে বলল,

“আয়েত্রী আমি আছি তো! সব ঠিক করে দিবো। সবটা শুধু মৃত্যুর কথা মুখে আনবেন না। ”

গাড়ি ছুটে চলেছে বাড়ির পথে৷ আজ কুয়াশা নেই। নেই কোন মেঘ। চন্দ্রাবতীর জ্যোৎস্না ঝড়ছে চারিদিকে।হলদে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। বাড়ির সামনে পৌঁছে আয়েত্রীকে নামিয়ে নিয়ে যায় ইশরাক৷আয়েত্রীর মা রুমে এনে দেখলেন
পা বেশ খানিকটা ফুলেছে। টাখনুর উপরে কিছুটা সালোয়ার উঠিয়ে দেখলো একটা জায়গায় মনে হচ্ছে রক্ত নেই।

মেয়ের পুরো শরীর দেখতে লাগলেন। নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিলেন। আয়েত্রী চুপচাপ যে যা বলছে মেনে নিচ্ছে। পাঁচ দিন আগেও এমন কিছুই ছিলো না। সে তার বাসায় বেশ তো ছিলো। নানু বাড়ি এলো, পর পর দুটো মৃত্যু, মামা এলো, প্রতীর বিয়ে এসব যেনো জীবনের সন্ধিক্ষণে হচ্ছে। মৃত্যুর মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে আজ আয়েত্রী। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া করছে।
বাবার জন্য, ভাইয়ের জন্য, মায়ের জন্য।
মরে গেলে কি তারা খুব কষ্ট পাবে? হয়তো! হয়তো না।

কিছুক্ষণ আগে আয়েত্রীর বাবা আয়েত্রী এবং ইশরাকের বিয়ের কথা আয়েত্রীকে জানিয়েছেন।আয়েত্রী কি বলবে? বাবা অসুস্থ তাই দ্বিমত করেনি আবার সম্মতিও জানায় নি।

ইশরাক ওরা সবাই আজ এবাড়িতেই। এমনকি বিয়ের কয়েকদিন এখানেই থাকবে। গভীর রাতে লোক চক্ষুর আড়ালে আয়েত্রীর বেরিয়ে যেতে আজও সময় লাগেনি।

নদীর পাড়ে আজো সেই মানুষ বসে আছে। মনমরা হয়ে। আচ্ছা? সে কি জানে আয়েত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছে?
শুনলে কি কষ্ট পাবে? না কি অভিনন্দন জানাবে?
পাঁচ রাতে কি ভালোবাসা হয়? ভালোবাসা? এত সহজে? এত সহজে আর যাইহোক ভালোবাসা হয় না।
ভালোবাসা হয় বুঝে-শুনে। ক্ষণিকের অনুভূতির নাম মোহ। মোহ কেটে যেতে এক মূহুর্ত যথেষ্ট।
শাওন কি শুধুই মোহ? যদি মোহ হয় তবে এতটা কষ্ট কেনো হয় ওর নিরব চাহনিতে?

“প্রহর শেষে আলো রাঙা সেদিন চৈত্র মাস।
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ…..
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস……
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ……
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ……

আয়েত্রী শাওনের পাশে যেতেই শাওন নিমাই ভট্টাচার্যের কথাগুলো বেশ আবেগ দিয়ে বলল।
আয়েত্রী মুচকি হেসে বলল,

” এখন তো শীত কাল। আমার চোখে এমন কি সর্বনাশ দেখলেন? ”

“চন্দ্রাবতী তুমি নিজেও জানো না তুমি কি! যদি জানতে তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি আসতো না। কেনো বার বার তুমি ছুটে আসো আমার কাছে? ”

“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”
“বাহ্ ভালো তো! তুমি মনে করেছো আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাবো? সে হচ্ছে না।তুমি বিয়ে করবে না।”

আয়েত্রী খেয়াল করলো আজ শাওন আপনি করে বলছে না। শাওনের চাহনিতে অদ্ভুত ভয়ংকর মাদকতা। কেমন গা শিউরে উঠেছে আয়েত্রীর। দ্রুত নদীর পাড় থেকে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। কিছু দূর এগুতেই ধাক্কা লাগে কারো সাথে। তাকিয়ে দেখে শাওন দাঁড়িয়ে আছে।
ভয় আরো জেকে বসলো আয়েত্রীকে। শাওন আশ্বস্ত করলো ভয় না পেতে। যা ছিলো সব হ্যালুসিনেশন।
আয়েত্রীকে নিয়ে শাওন আজ আর নদীর পাড়ের পানির কাছে বসেনি। রাস্তার কাছাকাছি বসলো। আয়েত্রী বিয়ের কথা বললে শাওন অভিনন্দন জানায় নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো
“পালাবেন আয়েত্রী? ”

বিনিময়ে আয়েত্রী কিছু বলেনি। পিছন ফিরেও দেখেনি। শুধু মনে মস্তিষ্কে চিন্তা করছিলো

“সত্যি যদি হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে তাহলে শাওন বুঝলো কিভাবে? আয়েত্রী তো তাকে কিছুই বলেনি সে কি দেখেছে বা কি হয়েছে? শাওন পাড়ের দিকে থাকলে তাহলে পানির দিকেই বা কে ছিলো? ”

চলবে
#ছবিয়ালঃজান্নাত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here