#চোরাবালি_মন (পর্ব ১)

0
534

নীলা আলমারি খুলে একগাদা শাড়ি নিয়ে বিছানায় বসে। পেটিকোটের কাছে অনাবৃত ফর্সা পেটে একটা আদুরে ভাঁজ পড়েছে। নীলার চোখমুখে সিদ্ধান্ত নিতে না পারার একটা অনিশ্চয়তা। কোন শাড়িটা পরবে আজ? সবুজ শাড়িটা গায়ের সাথে একটু মেলে ধরে, শাড়িটায় ছোট ছোট সবুজ পাতার কাজ করা। কিন্তু সবুজ পরবে? নাহ, একটা মিষ্টি কালার পরা দরকার। ও খুঁজে পেতে একটা মিষ্টি কালারের শাড়ি বের করে। এবার শাড়িটা ব্লাউজের উপর পেচিয়ে ধরে কোমরের কাছে এসে একটু গুজে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখেমুখে একটা সন্তুষ্টি ফুটে ওঠে। ওর গায়ের রঙের সাথে যেন মিলে গিয়ে ওকে আরও উজ্জ্বল, গোলাপি দেখাচ্ছে। একটা লাজুক হাসি হাসে। তাহাসনের সাথে আজ প্রথম বাইরে কোথাও দেখা হবে, ভাবতেই একটা শিহরণ টের পায় নীলা।

কয়েক মাস আগে পরিচয়, একটা কাজে ভদ্রলোকের সাহায্য দরকার হয়েছিল। ও যে কোম্পানিতে কাজ করে তার জন্য একটা বড় লোনের দরকার হয়ে পড়েছিল, তখনই তাহসানের সাথে পরিচয়। যে ব্যাংক থেকে ওরা লোনটা চাচ্ছিল তাহসান সেই ব্যাংকের বেশ উঁচু পদেই আছে। নীলাকে দেখে তাহসান একটু অবাকই হয়েছিল, একটা মেয়ে হয়ে এত কম বয়সে একটা কোম্পানির ফিন্যান্স এন্ড একাউন্সের হেড হয়ে কাজ করছে ও ভাবতে পারেনি। প্রথম দেখাতেই একটা মুগ্ধতা টের পেয়েছিল নীলা। তা ভদ্রলোক সব নিয়ম মেনেই ওদের কোম্পানির জন্য লোনটা দিয়েছিল।

লোনটা যেদিন অনুমোদন হয় উনি নিজেই নীলাকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন, ‘আপনাদের লোনটা আজ ডিসবার্স হয়ে গেল।’

নীলা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, খুব উপকার হলো। এমডি স্যার আপনাকে থ্যাংকস জানাবেন। আপনার এই উপকারটা ভুলব না।’

ওপাশ থেকে তাহসানের দুষ্টুমি গলা পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ, ভুলে যাতে না যান সেজন্যই আপনাকে মাঝে মাঝে ফোন করব, বিরক্ত হবেন না তো?’

নীলা একটু অবাক হয়, আবার একটু খুশিও হয়েছিল। ওনার সাথে যোগাযোগ রাখাটা খুব দরকার, তাতে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আর লোকটাও দারুণ হ্যান্ডসাম। এসব বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে কি বেছে বেছে এমন লোকজনই বসায় কিনা কে জানে। তা যা ইচ্ছে হোক, নীলার তখন মনে হয়েছিল, ওর কাজই হলো ব্যাংকের লোকদের সাথে একটা সুসম্পর্ক রাখা। তাই আর সেদিন দ্বিধা করেনি, বলেছিল, ‘অবশ্যই ফোন দেবেন, আমি খুশিই হব।’

তা নীলা খুশিই হয়েছিল যেদিন হঠাৎ করে ওর জন্মদিনে একটা বড় ফুলের বাকেট আর কেক পাঠিয়েছিল তাহসান। ও তো সেদিন অফিসে এসে চমকে গিয়েছিল, খবর নিতেই জেনেছিল এটা তাহসান সাহেব নাকি পাঠিয়েছে। ভদ্রলোককে থ্যাংক্স জানিয়ে ফোন করতেই উনি বলেছিলেন, ‘আহা, এটা তো আমাদের একটা নিয়মের মতো। বড় বড় কোম্পানির সিএফও দের আমরা জন্মদিনে উইশ করি। আর আপনি হাতে গোনা কয়েকজন নারী সিএফও দের মধ্যে একজন। আবার তাদের মধ্যে একমাত্র সুন্দরী সিএফও, ব্রেইন উইথ বিউটি, আপনাকে জন্মদিনে উইশ না করলে হয়?’

প্রশংসা শুনে একটু বিব্রতই হয়েছিল, আবার একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরেছিল। হ্যাঁ, মেয়েদের মধ্যে চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার খুব কম, তাও মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। এটা ওর গর্ব করার মতোই বিষয়। আর ও যে সুন্দর, সেটা অবশ্য আলাদা করে বলে দিতে হয় না। এটা শুনে ও অভ্যস্ত। কিন্তু উনি কী সুন্দর করে ওর সিএফও টাকে আলাদা করে প্রশংসা করলেন, খুব ভালো লেগেছিল।

সেই ভালো লাগাটা শুধুই বেড়েছে। না, উনি এখন পর্যন্ত বেচাল কিছুই বলেননি। ফেসবুকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হয়। খুব হাসাতে পারে লোকটা। সেদিন হঠাৎ করে ফোন করে গম্ভীর গলায় তাহসান বলছিল, ‘NASA থেকে লোকজন এসেছে, আপনাকে খুঁজছে।’

নীলা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল,’মানে? নাসা থেকে লোকজন আমাকে খুঁজতে এসেছে!?’

তাহসান আরও গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘ওরা বলল, পৃথিবীর একটা উপগ্রহ, চাঁদ, নাকি হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছে না। আমি তখন ওদের আপনার অফিসের ঠিকানা দিয়ে দিলাম।’

বুঝতে একটু সময় লেগেছিল নীলার, তারপর হাসতে হাসতে ও ভেঙে পড়েছিল। একটা মানুষ এমন মজা করে ওর প্রশংসা করতে পারে, ও মুগ্ধ হয়েছিল।

সেদিন হুট করেই তাহসান বলছিল আজ সন্ধ্যায় যদি পারে তাহলে বাইরে কোথাও এক কাপ কফি খেতে চায়। নীলা হেসে বলেছিল, ‘অবশ্যই।’

নীলা এবার শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজটা বের করে পরে। তারপর দ্রুত অভ্যস্ত হাতে শাড়িটা পরে নেয়। গলার লকেটটা খুলে একটা মুক্তার মালা বের করে। পরতে যেয়ে থমকে যায়, নাহ থাক।।এত সাজগোজ করে গেলে সবার কৌতুহল বেড়ে যাবে। নীলা মালাটা খুলে লকেটটা আবার পরে নেয়। নিজের এই অস্থিরতায় নিজেই একটু বিরক্ত হয়। এমন না যে ও আগে শাড়ির সাথে মুক্তার মালা পরে অফিস যায়নি, কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে সবাই ওকে দেখলেই বুঝে ফেলবে ও তাহসানের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।

নীলা মাথা থেকে ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে। আচ্ছা চোখে একটু কাজল দেওয়া যায়। নীলা এবার আরবান ডিকের কাজলটা বের করে, এই কাজলটা খুব প্রিয় ওর। অন্য কাজলগুলোর মতো সময়ের সাথে সাথে চোখে লেপটে যায় না।

বাথরুম থেকে এতক্ষণ পানি পড়ার একটা আওয়াজ হচ্ছিল, সেটা থেমেছে। আবিরের গোসল শেষ হলো, নীলা ভাবে। ওরও অফিস দশটায় শুরু।

আবির বের হয়েই একবার নীলার দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘আজ কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?’

নীলা একটু চমকায়, কাজলটা ছড়ে যায় একটু। মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত হয়, ও এমন ভয় পাচ্ছে কেন? নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ওই আর কি। যা থাকে আমাদের।’

আবির ততক্ষণে ব্যালকনিতে চলে গেছে তোয়ালেটা মেলে দিতে। তার মানে ও হয়ত এমনিই জিজ্ঞেস করেছে। নীলা নিজেকে একটু বকা দেয়।

আবির নাস্তা করে রেডি হতে হতে বলে, ‘টুকুন স্কুলে গিয়েছে?’

নীলা মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, ওদের তো মর্নিং শিফট। আগামী বছর যখন ও ক্লাশ নাইনে উঠবে তখন দুপুর থেকে ক্লাশ।’

মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে নীলার। দুপুরেই চলে আসে মেয়েটা। ওদের আসতে আসতে তো সেই সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। অবশ্য একটাই স্বস্তি আবিরের মা মানে ওর শাশুড়ি বাসায় থাকেন, ওদের সাথেই। এদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। এই বয়সের একটা মেয়েকে একা বাসায় রাখার কথা চিন্তা করতেও বুক কাঁপে।

নীলা এবার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে শাশুড়ির রুমে ঢোকে, উনি কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। নীলা গলা খাকড়ি দিতেই, পড়া থামিয়ে তাকান, বলেন, ‘বের হচ্ছ? আমার জন্য আজ ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট নিয়ে এসো তো। শেষ হয়ে গেছে, আবিরের তো কিছুই মনে থাকে না।’

হ্যাঁ, এটা ঠিক। আবির হয়ত ওদের ম্যারেজ ডে টাও ভুলে গেছে, মানে প্রায়ই ভুলে যায়। ওর জন্মদিনটাও। নীলা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা মা, আমি আসার সময় নিয়ে আসব। আপনি তো আগে যেটা খেতেন সেটাই খাচ্ছেন?’

দিলারা, মানে নীলার শাশুড়ি মাথা নাড়েন। নীলা এবার ওর কথাটুকু বলে, ‘মা, টুকুন আসলে আজ ফ্রাইড রাইস আর চিকেনটা মুক্তাকে গরম করে দিতে বইলেন। কাল রাতে খেতে চেয়েছিল, আমি বানিয়ে রেখে গেলাম।’

দিলারা হেসে বলেন, ‘আচ্ছা, তুমি অফিস যাও, চিন্তা করো না। টুকুন সোনা আসলে আমি ফোন করে জানাব।’

নীলা এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, প্রতিদিনই এই কথাটা শোনার জন্য ও অপেক্ষা করে।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামে। আবির এর মধ্যেই বের হয়ে গেছে ওর অফিসের গাড়িটা নিয়ে। ওর অফিসটা একটু দূরে তাই আগেই বের হতে হয় ওকে।

নীলা নিচে নামতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। নীলা ওর অফিসের কালচে নীল রঙের সি আর ভি তে ওঠে। সিটে হেলান দিয়ে বসেই চোখটা বন্ধ করে। একটা ভাবনা মনকে স্বস্তি দিচ্ছে না। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরছে। আচ্ছা, ও কী কোনো অপরাধ করছে? তাহসানের সাথে দেখা করাটা কী ঠিক হচ্ছে? ওর তো কোনো অন্য উদ্দেশ্য নেই। তাহসানের সাথে ওর একটা বন্ধুত্বের মতো হয়ে গিয়েছে, এক কাপ কফি তো ও খেতেই পারে। তাতে নিশ্চয়ই দোষের কিছু নেই। এই ভাবনাটা ওকে স্বস্তি দেয়, একটু আগের অপরাধবোধটা আর থাকে না। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। আচ্ছা তাহসান আজ ওকে শাড়ি পরা দেখে কী বলতে পারে? নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়ে যাবে, একটা শিহরণ খেলে যায় নীলার বুকে৷ সেইসাথে ছোট্ট একটা অপরাধবোধ।

সেদিন অফিসে যাওয়ার পর থেকেই সবাই টুকটাক কিছু না কিছু বলে প্রশংসা করে। লাঞ্চের সময় কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের হেড আলতাফ সাহেব তো বলেই ফেলেন, ‘নীলা, আপনাকে আজ যা লাগছে! খবরদার, বডিগার্ড ছাড়া বের হবেন না।’

ওনার কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই মজা পায়, হাসে, আর আড়চোখে দেখতে থাকে। নীলা আজ একটু বেশি অস্বস্তি বোধ করে। আলতাফ ভাই প্রায়ই ওর প্রশংসা করে, সবার সামনেই, তখন অত অস্বস্তি হয় না, বরং ভালোই লাগে। কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে। এর মাঝেই তাহসানের মেসেজ আসে, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা ঠিক আছে তো?’

নীলা মেসেজটা দেখে, সাথে সাথে রিপ্লাই দেয় না। একটু অপেক্ষা করুক, টেনশনে থাকুক।

লাঞ্চ শেষে নীলা নিজের রুমে বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে মেসেঞ্জারটা অন করতেই অনেকগুলো টুন টুন শব্দ হয়। এর মধ্যে আরও তিনটা মেসেজ এসেছে তাহসানের। লোকটা অস্থির হয়ে গেছে। শেষ মেসেজটা পড়ে নীলা হেসে ফেলে, ‘আপনার সাথে দেখা হবে বলে আমি আগের দিন ফেসিয়াল করে এসেছি। এখন আজ যদি না আসেন আমার পুরো টাকাটাই লস।’

নীলা ঠোঁটের কোণে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে উত্তর লিখে, ‘লস হবে না, কারণ আমি আসছি।’

সেদিন নীলা ইচ্ছে করে অফিস শেষেও কাজ করতে থাকে। কয়কেজন কলিগ যাবার সময় ওর রুমে মাথা ঢুকিয়ে বলে, ‘কি, যাবেন না?’

নীলা অসহায়ের মতো মুখ করে বলে, ‘আজ একটু কাজ আছে, দেরি হবে।’

আধা ঘণ্টার মধ্যে পুরো অফিসটা প্রায় খালি হয়ে যায়। কয়েকজন অবশ্য রয়ে গেছে, বিশেষ করে ওর ডিপার্টমেন্টের। বস না গেলে ওরাও যেতে পারছে না।

সন্ধ্যার দিকে নীলা নামে। গাড়িতে ওঠেই ড্রাইভারকে বলে, ‘গুলশানের আড়ংয়ে চলো।’

বুদ্ধিটা নীলা নিজেই ভেবে বের করেছে। কেউ যদি দেখেও ফেলে তখন না হয় একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে যে ও এখানে কিছু কিনতে এসেছিল। অবশ্য ওর সত্যিই কিছু কেনাকাটা আছে। টুকুন সেদিন একটা পার্লের ব্রেসলেটের কথা বলছিল। এই ভাবনাটা ভাবতেই ওর ভালো লাগে। ও আসলে কেনাকাটা করতেই যাচ্ছে। কিন্তু সাথে সাথে তাহসানের কথা মনে হয়, এক হারা লম্বা গড়ন, চওড়া কাঁধ, মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল। একটা আকর্ষণ অনুভব করে নীলা। হঠাৎ করেই একটা অস্থিরতা টের পায় মনে, নিশ্বাসটা ভারী হয়ে আসে। গাড়িটা যতই আড়ংয়ের কাছে আসে ততই ওর বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। নীলা হ্যান্ডব্যাগে থেকে একটা ছোট্ট আয়না বের করে আরেকবার মুখটা দেখে নেয়, চুলটা একটু ঠিক করে। তারপর গলার দু’পাশে হালকা করে পারফিউম স্প্রে করে নেয়।

গাড়ি থেকে নেমেই ও সোজা আড়ংয়ের অর্নামেন্টের সেকশনে চলে যায়। নিজেকে একটু শান্ত করা দরকার। নীলা এবার মনোযোগ দিয়ে টুকুনের জন্য ব্রেসলেট দেখতে থাকে। কী সুন্দর মুক্তোর ব্রেসলেটগুলো! নীলা সাদার মধ্যে একটা, আরেকটা বিভিন্ন রঙ এর ব্রেসলেট নেয়। কাউন্টারের দিকে যেতে যেতে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নাহ, এখন পর্যন্ত পরিচিত কাউকেই চোখে পড়েনি। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নীলা।

ব্রেসলেট দুটোর দাম দিয়ে ব্যাগে ভরতেই ফোনটা আসে, ‘আপনি কি আজ আসবেন না? আমি আধা ঘণ্টা ধরে বসে আছি।’

নীলা হাসে, বলে, ‘আহা, এই তো আসছি। দুই মিনিট।’

নীলা আর দেরি করে না। আড়ং এর মূল দোকানটা থেকে বের হয়ে হাতের বামে নতুন রেস্টুরেন্টেরটার দিকে এগোয়। এটা নতুন হয়েছে, খুব সুন্দর। নীলার এখন বুকটা সত্যিই ধুকপুক করছে। জোরে নিশ্বাস নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই একটু ধাক্কা খায়, অনেক লোকজন। দ্রুত আশেপাশে চোখ বোলায়, পরিচিতি কাউকে চোখে পড়ে না।

তাহসানের সাথে চোখাচোখি হতেই ও হাত নাড়ে। নীলা অল্প করে মাথাটা ঝাকায়, তারপর এগিয়ে যায় পূর্ব পাশের এক কোণে টেবিলটার দিকে। তাহসান আজ কালো শার্ট পরেছে, খুব মানিয়েছে।

কাছে আসতেই তাহসান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, বলে,’নাসার লোক সত্যি সত্যিই আজ চলে আসবে তাদের হারানো চাঁদের খোঁজ। তা না হলে যে রাতের আকাশ আজ অন্ধকার থাকবে। শাড়িতে আপনাকে অপূর্ব লাগছে।’

নীলা বসতে বসতে একটা লাজুক হাসি হাসে, প্রশংসাটা ভালো লাগে। তারপর একটু অনুশোচনার গলায় বলে, ‘সরি, আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। কী খাবেন বলুন?’

তাহসান তখনও চেয়েই আছে, নীলার যদিও অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু ও এমনটাই চেয়েছিল। নীলার কথায় ওর ঘোরটা কাটে, বলে, ‘আপনি যা বলবেন।’

নীলা হেসে মেন্যুটা দেখতে দেখতে বলে, ‘এখানকার চিকেন নুডুলসটা খুব ভালো। আমার একটু ক্ষুধা পেয়েছে, আপনি খাবেন তো?’

তাহসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমার তৃষ্ণা পেয়েছে, চাঁদ দেখার।’

কথাটা বলেই হেসে ফেলে, বলে, ‘আচ্ছা, দিন। আমারও ক্ষুধা পেয়েছে।’

খেতে খেতে নীলা ওদের ব্যাংকের খুঁটিনাটি অনেক কিছুই জানতে চায়। তাহসানও নীলার অফিসের খোঁজ খবর নেয়। সবই অফিসের কাজের কথা।।কিন্তু এই কেজো কথার মাঝেও নীলা ঠিক টের পায় তাহসানের মুগ্ধ দৃষ্টি। নীলারও একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরতে চায়।

আধা ঘণ্টার মতো সেদিন ও থাকে তাহসানের সাথে। বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতেই মনটা আবার খারাপ হতে থাকে, কাজটা ঠিক হলো? আজ এখানে না এলে তো এক ঘন্টা আগেই বাসায় পৌঁছাতে পারত। টুকুন অপেক্ষা করে আছে ওর বাসায় ফেরার। নীলা এবার ড্রাইভারকে একটু তাড়া দেয়।

বাসার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করেই নীলার শাশুড়ি মায়ের ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের কথা মনে পড়ে যায়। হায় হায়, এটা না নিয়ে গেলে তো আজ কথা শুনতে হবে। নীলা এবার বিরক্তির সাথে ড্রাইভারকে গাড়িটা ঘুরিয়ে একটা বড় ওষুধের দোকানে রাখতে বলে। নাহ, কী করে ও আজ ওষুধ কেনার কথা ভুলে গেল!

বাসায় ফিরতেই টুকুন ‘আম্মু’ বলে কাছে আসে। নীলা ব্যাগ থেকে ব্রেসলেট দুটো বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বলে, ‘পরে দেখ তো, কেমন লাগে।’

টুকুন আগ্রহের সাথে ব্রেসলেট দুটো নেয়, নীলার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে ‘থ্যাংক ইউ আম্মু। খুব সুন্দর ব্রেসলেট দুটো।’

নীলা হেসে মেয়েকে আদর করে দেয়। তারপর শাশুড়ির ঘরে ঢুকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট এর বোতলটা দিতেই উনি খুশি হন, বলেন, ‘যাক, তাও মনে করে এনেছ। সারাদিন তোমার যা ব্যস্ততা থাকে। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি কুমড়ো ফুলের বড়া ভেজেছি, খাবে।’

নীলা খুশি হয়, বলে, ‘আপনার ছেলের তো এটা খুব পছন্দ। আমারও খুব ভালো লাগে।’

নীলা টের পায় ওর মন খারাপ ভাবটা এখন আর নেই। টুকুনকে ব্রেসলেট আর মাকে ওষুধটা দিতে পেরে ওর অপরাধবোধটা অনেকখানিই কমে এসেছে।

আবির এখনও আসেনি। রুমে ঢুকে ও শাড়িটা খুলতেই হুট করেই তাহসানের মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা মুখটা মনে পড়ে যায়। একটু লজ্জা পায় যেন ও। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে শাড়িটা পাল্টাতে থাকে।

রাতে আবির ফিরলে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। নীলা মেয়ের স্কুলের পড়াশোনার খবর নেয়। প্রাইভেট পড়ার টিচাররা ঠিকমতো পড়াচ্ছে কিনা তাও খোঁজ নেয়।

আবির সোফায় আধাশোয়া হয়ে টিভিতে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান মারদাঙ্গা ছবি দেখছে। ভুঁড়ি হয়েছে ওর, মাথার চুলও পাতলা হয়ে এসেছে। নীলা একবার তাকায়, তারপর একটু বিরক্তির সুরে বলে, ‘আচ্ছা, অফিস থেকে এসে সেই যে সোফায় বসো, একটু জিম করলে তো পারো। ভুঁড়িটা বাড়ছে, খেয়াল আছে?’

আবির নীলার দিকে তাকিয়ে হাসে, তারপর বলে, ‘ভুঁড়ি আভিজাত্যের অংশবিশেষ। এখন একটু ভুঁড়ি না থাকলে কেউ দাম দেয় না।’

নীলা রাগ করতে যেয়েও করে না। আবির কখনই ওর কথার গুরুত্ব দেবে না। মাথা নেড়ে ও বেডরুমে যায়, বিছানা গুছিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করে। আবির মনে হয় সিনেমা শেষ না করে ঘুমোবে না।

আবির অবশ্য একটু পরেই আসে, বলে, ‘আজ দারুণ ঘুম পাচ্ছে, শুয়ে পড়ি। আচ্ছা, তুমি কী আজ আড়ংয়ে গিয়েছিলে?’

নীলা বিছানার চাদর ঠিক করছিল, হাতটা থেমে যায়। বুকটা কেঁপে ওঠে, একটু তোতলানো গলায় বলে, ‘কেন বলো তো?’

আবির অবশ্য ওর এই ভড়কে যাওয়াটা খেয়াল করে না। ও হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘না, টুকুন ওর ব্রেসলেট দেখাচ্ছিল, সুন্দর হয়েছে। তুমি আড়ং যাচ্ছ জানলে আমার জন্য একটা লুঙ্গি আনতে বলতাম। ওদের লুঙ্গিগুলো খুব মোলায়েম হয়, পরে আরাম করে ঘুমানো যায়।’

নীলা চেপে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ে, উফ, ও তো ভেবেছিল ওকে বুঝি কেউ দেখেছে। নীলা মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা এরপর গেলে নিয়ে আসব।’

সেদিন রাতে আবির দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে। নীলার অবশ্য ঘুম আসে না। ও কী তাহসানের সাথে জড়িয়ে পড়ছে? একবারই তো কফি খেয়েছে। বন্ধুর মতো কারও সাথে একবার ও বসতেই পারে, এতে দোষের কিছু তো নেই। কিন্তু কেন অপরাধবোধ লাগছে ওর? তাহলে কী কারণটা একসাথে বসা না, বরং মনের দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য?

#গল্প
#চোরাবালি_মন (পর্ব ১)

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০৭/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here