যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া #আনিশা_সাবিহা পর্ব ৪

0
599

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪

গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর মাথা লাগিয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। পাশেই রয়েছে সৌমিত্র। সে হতাশ চোখে নিজের ভাইকে দেখছে। দুজনের মাঝে নীরবতা বিরাজ করলেও আকাশের গুড়গুড় আওয়াজ পরিবেশটাকে নীরবতা পালন করতে দিতে চাইছে না। নীরবতা ভেঙে এবার সৌমিত্র থমথমে গলায় বলল,
“মনে হচ্ছে খুব জোরে বৃষ্টি আসবে, ভাই!”

“তো আমি কী করব?”

“তোমাকে তো কিছু করতে বলিনি। শুধু বৃষ্টি আসবে বললাম। আচ্ছা একটা কথা ভাবো, প্রবলবেগে বৃষ্টি শুরু হলো আর তার মাঝে পুরো একটা পরিবার রাস্তায় দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাও সেটা তোমার জন্য। মনে মনে একটা অস্থিরতা অনুভব করবে না?”

বেশ কৌতূহল নিয়ে স্বচ্ছকে প্রশ্নটা করার স্বচ্ছ সোজা হয়ে বসল। কাঁচের গ্লাস ভেদ করে তার দৃষ্টি গেল অন্ধকার আকাশের দিকে। আসলেই বৃষ্টি আসবে? ভাইয়েই মৌনতা দেখে সৌমিত্র ফের বলল,
“আমি জানি তোমাকে মেয়েটা যেভাবে ভুলক্রমে হেনস্তা করে ফেলেছে সেটা তুমি ডিজার্ভ করো না। কিন্তু মেয়েটার ভুলের শাস্তি পুরো পরিবারও তো ডিজার্ভ করে না তাই না?”

স্নচ্ছ এবারও কোনো জবাব দিলো না। উত্তরের আশায় বসে থেকে সৌমিত্র উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলে,
“ভাই, ভেবে দেখো! এর সাথে কিন্তু বাবারও সম্মান জড়িয়ে আছে। আজ তোমার থা/প্পড় খাওয়া ভাইরাল হয়েছে। কাল সেই সুন্দরী লাইভে এসে বলতেই পারে একজন মন্ত্রী যার কাজ মানুষের সেবা এবং ভালো করায় নিয়োজিত থাকা তার ছেলে অন্যের ক্ষতি করতে ব্যস্ত থাকে। তুমি বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?”

“তুই নেমে যা তো গাড়ি থেকে।”

স্বচ্ছের আচানক এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সৌমিত্র। থতমত খেয়ে জানতে চায়,
“হ্যাঁ? কী বললে?”

স্বচ্ছ অকপটে বলে ওঠে,
“গাড়ি থেকে নামতে বলছি। নাম!”

“কিন্তু….”

“তুই নামবি নাকি তোর সামনে থাকা পছন্দের ব্রান্ডের বাইকটাকে মে/রে দিয়ে চলে যাব।”

ঢক গিলে সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতে খুলতে বলে,
“আরে বাবা নামছি! মনে দয়ামায়া নেই তোমার।”

গাড়ি থেকে নেমে দরজা লাগিয়ে দেওয়ামাত্র স্বচ্ছ গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। ঠাঁই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হাসল সৌমিত্র। তার কথায় হয়ত কিছুটা হলেও মনে ক্রোধের দাবানল কমেছে ভাইয়ের। দুহাত উপরে তুলে হাত প্রশস্ত করতেই অনুভব করল সৌমিত্র বৃষ্টির পানির।
“নাও বৃষ্টিও এসে গেল! বাড়ি তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!”

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। বাহিরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। ঝড় উঠেছে। মাঝেমাঝে তুমুল শব্দের বজ্রপাতে কেঁপে উঠছে ধরণী। বর্ষার সময় কখন বর্ষণ নামে ঠিক নেই। বাহিরের এমন খারাপ পরিস্থিতি দেখে মিসেস. সুফিয়া স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বললেন,
“ভাগ্যিস অটো সময়মতো পেয়ে গিয়েছিলাম নয়ত ঝড়ে আটকা পড়তে হতো।”

কারেন্ট নেই। অন্ধকারে এক হাতে মোমবাতি আরেক হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে সুফিয়ার ভাই সাইফুলের স্ত্রী আফিয়া এগিয়ে এসে শরবত এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,
“তা ভাবী! ছেলেটা শেষমেশ একটা থা/প্পড়ের প্রতিশোধ নিতে এমন কাজ করতে পারল? বুঝি না! আজকাল এসব বড়োলোকরা নিজেকে কী মনে করে।”

সুফিয়া গ্লাসটা এগিয়ে নিয়ে কড়া সুরে বলেন,
“ছেলেকে দোষ দিয়ে আর কী করব? আমার মেয়েটাও তো কম যায় না। ওর ভুলেই তো এতসব হচ্ছে।”

বসার চেয়ারে ঘুমন্ত ইথানকে নিয়ে একমনে বসে ছিল মোহ। মায়ের কথায় তার ভাবান্তর হলো না। ভুলটা যে আসলেও তারই। মোহের মামা সাইফুল হোসেন আজহার সাহেবকে আশ্বাস দিয়ে বলেন,
“কোনো সমস্যা নাই দুলাভাই! আপনার যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকুন। আমি তো আপনার ভাইয়ের মতোই।”

আজহার সাহেব মলিন হাসেন। কিছু বলতে উদ্যত হলেন তবে বলা হলো না। ফোনের রিংটোন বেজে উঠল উচ্চ শব্দে। এত রাতে কে কল করল ভেবে ফোনটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে বাড়িওয়ালার নম্বর দেখে উনার কপালে ভাঁজ পড়ল। ইচ্ছে করল না কল রিসিভ করতে। তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে কানে ধরলেন উনি।
“হ্যালো, আজহার ভাই বলছিলেন?”

ফোনের ওপাশ থেকে বাড়িওয়ালার বিচলিত কণ্ঠ শুনে আজহার সাহেব ক্ষীণ গলায় বলেন,
“জি! বলুন?”

“আমি যা করেছি আপনার সাথে তার জন্য আমি খুবই লজ্জিত, ভাই। আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে। এভাবে এত রাতে পুরো পরিবারকে বের করে দেওয়া ঠিক হয়নি। অন্যায় হয়েছে আপনাদের সাথে।”

আজহার সাহেব বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অথচ কিছুক্ষণ আগেই সেই লোকটিই বড্ড নির্দয়ের মতো বাড়ি থেকে বের করে তবেই দম নিয়েছিলেন।
“যা করার করেই তো ফেলেছেন। এখন শুধুমাত্র ক্ষমা চাওয়ার জন্য কল করলে করার দরকার নেই। আমি রাখছি। ভালো থাকবেন।”

বাড়িওয়ালা হম্বিতম্বি করে বললেন,
“না, না! দয়া করে আমার কথাটা শুনুন। আমি আমার ভুল শুধরে নিতে চাই। আপনারা বাড়িতে ফিরে আসুন। আপনারা তো আমাদের পরিবারেরই মতো।”

“অদ্ভুত মানুষ তো আপনি! প্রথমে নিজেই অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন এখন নিজেই আবার বাড়িতে ডাকছেন। আপনার কি মনে হয়? আমাদের আত্মসম্মান নেই? আমরা আর আপনাদের বাড়িতে ফিরছি না। খুব দ্রুত নতুন বাড়ি দেখে উঠে পড়ব সেখানে। পরবর্তীতে কল করে বিব্রত করবেন না।”

বাড়িওয়ালার কল লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল। সামনে দাঁড়িয়েই স্বচ্ছ সবকিছু শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। আজহার সাহেব এভাবে নাকচ করে দেওয়ায় চোখ গরম করে বাড়িওয়ালার দিকে তাকায়। বাড়িওয়ালা অবস্থা তখন নাজেহাল। ঢক গিলে আতঙ্ক নিয়ে ফোনে বললেন,
“ভাই, ভুল বুঝবেন না। ওরা তখন এমনভাবে ভয় দেখিয়েছিল যে নিজের পরিবার নিয়ে আমিও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ওরা রাজনীতির মানুষ। বোঝেনই তো এসবে আমি কতটা ভয় পাই। দয়া করে আমার কড়া ব্যবহার মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন।”

“হঠাৎ কেন আমাদের ফিরিতে নিতে মরিয়া হয়ে উঠলেন? আমরা ফিরলে তো আপনার সমস্যা আবারও হতে পারে!”

“হবে না, হবে না। বরং আপনারা না এলে এবার আমার বাড়ি ভাঙচুর করবে।”

কথাগুলো মুখ ফসকে বলেই দিলেন বাড়িওয়ালা। পরক্ষণেই ভড়কে গিয়ে স্বচ্ছের দিকে তাকালেন। ভেজা টিশার্ট গায়ে স্বচ্ছ চোয়াল শক্ত করে চেয়ে আছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জানান দিচ্ছে বাড়িওয়ালা কথাগুলো বলে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছেন।
আজহার সাহেব হতবাক হলেন এবার। নির্বিঘ্নে চাইলেন মেয়ের দিকে। মোহ ইশারা করে জানতে চাইছে, কী হয়েছে! তিনি মোহকে হাতের ইশারায় থামতে বললে মোহ ইথানকে সুফিয়ার কোলে দিয়ে বাবার পাশে এসে বসে ফোনের কথা শোনার চেষ্টা করল। আজহার বলেন,
“কী অদ্ভুত! আমরা বাড়ি না ছাড়লেও দোষ, বাড়ি ছাড়লেও দোষ আপনি চাইছেনটা কী বলবেন?”

“আমি আর কোথায় চাইছি যার চাওয়ার সে চাইছে। আমার কোনো দোষ নেই।”

মোহ কথাগুলো শুনতে পেল। ফট করে বাবার ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনাকে কেউ এসব বলতে শিখিয়ে দিচ্ছে আঙ্কেল? যদি তাই হয় তবে আগেই বলে দিই এসবে কোনো কাজ হবে না। আমার পরিবার কোনো পুতুল নয় যে যার তার ইশারায় নাচবে। আমরা ওই বাড়িতে ফিরছি না। ধন্যবাদ! রাখছি আমি ফোন।”

মোহ বাড়িওয়ালার আর কোনো জবাব না শুনেই একপ্রকার মুখে ওপর কল কেটে দিলো। অসহায় পানে স্বচ্ছের দিকে চেয়ে রইলেন বাড়িওয়ালা। স্বচ্ছ নিজের ভেজা চুল আস্তে আস্তে টেনে বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“পেটে কোনো কথা থাকে না তাই না?”

বাড়িওয়ালা মাথা ঝাঁকালেন। অর্থাৎ আসলেই তিনি পেটে কথা রাখতে পারেন না। স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“খাবার খাওয়ার জন্যেও পেট থাকবে না। পেটই উধাও করে দেব। একটা কথা শুনুন, কালকের মধ্যে ওই মেয়ে আর তার পরিবারকে যেন আপনার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন। তাদের কী করে নিয়ে আসবেন সেটা আপনার ব্যাপার। আর আমি ওদেরকে ফিরে আসতে বলেছি সেটা যেন ওরা না জানে। গট ইট?”

বাড়িওয়ালা বাধ্য মতো মাথা দুলাতেই স্বচ্ছ প্রস্থান করল দ্রুতই। বাড়ি ফিরতে হবে তার। নিশ্চয় না চিন্তা করছে! স্বচ্ছ চলে যেতেই বাড়িওয়ালা উপরদিকে তাকিয়ে আকুতি করে বলল,
“ইয়া আল্লাহ! আমায় কোন ঝামেলার মধ্যে ফেললে? আমায় বাঁচাও!”

পরদিন সকালবেলা আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। ঝকমকে রোদ বেরিয়েছে। কালো মেঘ কাটিয়ে সাদা-নীল মেঘে ঝলমল করছে সূর্য! মোহ তৈরি হচ্ছে। আজ ইন্টারভিউ আছে তার। তাও তার মামার ফ্যাক্টরিতেই। মোহ বারবার করে বলেছিল অন্যকোথাও চাকরির খোঁজ করবে। তবে মায়ের কথা আপন মানুষ থাকতে অন্যদিকে খোঁজ করতে যেতে হবে না। মোহ তৈরি হয়ে ঘুমন্ত ইথানের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তার চোখ পড়ল নিজের ফোনের দিকে। একাধারে ফোনে কল আসছে। আর কলটা কার তার জানা। বাড়িওয়ালার কল আসছে বারংবার। এমনকি সারারাত আজহার সাহেবকে ঘুমাতে দেননি এই লোক! বারবার ফোন করে আকুতি করেছেন। শেষমেশ সুফিয়ার কথায় বিকেলের মধ্যে বাড়িতে ফিরবে তারা। এই সিদ্ধান্ত জানানোর পরেও যেন বাড়িওয়ালার দুশ্চিন্তা কমছে না। যেন তাদেরকে বাড়ি ফেরাতে না পারলে লোকটির জান চলে যেতে পারে! ফোনটা বন্ধ করে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে এলো মোহ। নাস্তা করতে করতে মাকেও বলল যেন ইথান উঠলে প্রথমেই ওকে জোর করে ব্রাশ করিয়ে দেয়। ছেলেটা ব্রাশ করতে চায় না একদমই। হালকা খেয়েদেয়ে সে সাইফুল সাহেবের সাথে বেরিয়ে পড়ল। অটো ধরে দুজন গেল ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে মোহ বলল,
“মামা! আপনার কাছে আমার একটা আবদার আছে।”

সাইফুল সাহেব সাবলীলভাবে জানতে চাইলেন,
“হ্যাঁ, বল! মামা হয় কী জন্য? আবদার পূরণ করার জন্যই তো!”

মোহ ঠোঁট টিপে হেঁসে বলে,
“কাজের জন্য অনেকে আসবে তাই না? ইন্টারভিউ দিতে তো অনেক লোক হবে। তাই আমি চাই যে চাকরির যোগ্য তাকেই চাকরি দেবেন। আমি আপনার বোনের মেয়ে শুধু সেকারণেই আমাকেই চাকরি দিয়ে দিয়েন না। যোগ্যতার পরীক্ষা করবেন! ঠিক আছে?”

সাইফুল সাহেব বিস্তর হাসলেন ভাগনির কথায়। অবাক হলেন মেয়ের চিন্তাধারা দেখে।
“আরে পাগলি, সামান্য ফ্যাক্টরির কাজে এসব যোগ্যতার থেকে কে কতটা বিশ্বস্ত সেটা দেখতে হয়। তাছাড়া আমি জানি তোর কোয়ালিফিকেশন ভালো। আর তুই তো নিজের বিশ্বস্ততার পরীক্ষা মাত্র দিয়ে দিলি!”

“তবুও আপনি সবাইকে যাচাই করবেন। যদি অন্যকাউকে আমার চেয়ে বিশ্বস্ত মনে হয় তবে চাকরিটা তারই হবে।”

সাইফুল সাহেব সম্মতি জানালেন।

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here