হাত_বাড়িয়ে_রই (পর্ব ১) #মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

0
730

“বিয়ের এত বছরেও সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি এমন মেয়ের সাথে আর সংসার করতে হবে না বাবা। তোকে আমি আবার বিয়ে করাবো।”

রুমের পাশ দিয়ে যেতেই শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো রুপন্তির। হয়তো কখনো ভাবতেও পারেনি তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের সাজানো সংসারে নতুন কারো আগমনের প্রসঙ্গে কথা উঠবে। এক মুহুর্তেই যেন বোবট হয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইল সেখানে।
মায়ের এমন কথায় সাঈদ ক্ষনিকটা অবাক হয়ে বলে,
“হটাৎ এসব কি বলছো মা! যা বলছো ভেবে বলছো তো?”

নুর জাহান বেগম অনেকটাই শক্ত গলায় বলে,
“আমি ভেবে চিন্তেই বলছি তোকে। অনেক অপেক্ষা করেছি নাতি-নাতনির মুখ দেখতে। কিন্তু সব কিছুর একটা সীমা আছে। সত্যি করে বল তো, তোর কি কখনো বাবা হতে মন চায়নি?”

মায়ের কথায় কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল সাঈদ। বাবা হওয়া এক অন্য রকম অনুভূতি। আর এই অনুভূতির স্বাদ পাওয়ার স্বপ্নটা প্রত্যেক ছেলেদের মাঝেই থাকে। তেমন সাঈদের মাঝেও আছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের একটা সংসার হোক এটা সেও চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলেও একটা কথা আছে। যা মানুষ মেনে নিতে না পারলেও তার সাথে মানিয়ে চলতে শিখতে হয়।

সেখানে আর স্থির থাকতে পারলো না রুপন্তি। এক হাতে মুখ চেপে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো সে।
কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটলে নুর জাহান বেগম পূনরায় বলে,
“বাবা, আমি বুঝতে পারি তোর মনের অবস্থা। চাপা কষ্ট আর কতদিন লুকিয়ে রাখবি তুই? মা হিসেবে আমিও চাই আমার নাতি-নাতনী দিয়ে তোর সংসার ভরে উঠুক। অনেক তো হয়েছে। আর জেদ ধরে থাকিস না বাবা। এটাই তোর কাছে তোর মায়ের শেষ চাওয়া।”

এক পাশে স্ত্রী, অন্য পাশে মায়ের কঠিন অনুরুধ। মস্তিষ্ক যেন শুন্য হয়ে আসছে সাঈদের। আজ হটাৎ মায়ের এমন অনুরুধে সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
“এটা কেমন চাওয়া মা? তাছাড়া রুপন্তি কি এটা মেনে নিবে?”

নুর জাহান বেগম আবারও কিছুটা কড়া গলায় বলে,
“মেনে নিতে হবে তাকে। বিয়ের পাঁচ বছরে সে তোকে সন্তানের মুখ দেখাতে পেরেছে? পারেনি। এটা নিয়ে আশে-পাশের মানুষ অনেক কথা বলে। যেগুলো আর নিতে পারছি না আমি। সোজা কথা আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। আমার বংশের উত্তরাধিকার প্রয়োজন। তোর বৌকে তুই এই ব্যাপারে বুঝাবি। তাকে বলবি, মেনে নিতে পারলে নিবে, আর না পারলে ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে হবে।”

বলেই ছেলের পাশ উঠে চলে গেলো নুর জাহান। মায়ের শেষ কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো মনে হলো সাঈদের কাছে। দ্বিতীয় বিয়ে, ডিভোর্স এই শব্দ গুলো সে রুপন্তির সামনে কোনো ভাবেই উচ্চারণ করতে পারবে না। ভয়ে না, বিবেক ও মায়ায় বাধা দেয়। যে মেয়েটা নিজের সবটুকু দিয়ে সংসার সাজিয়ে রাখতে চায়, তার কাছে কোন মুখে এসব বলবে?

বিষণ্ন মনে বসে রইল সাঈদ। একটু সময়েই যেন মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে পড়েছে তার। রুপন্তুির মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বিয়ের কথা সে কিভাবে বলবে? কোনো মেয়েই তো তার স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারে না। রুপন্তিও ঠিক তার ব্যাতিক্রম।

বছর খানেক আগের কথা। সাঈদের মামারা এসেছিল সেদিন। সাথে এসেছে তার মামাতো বোন নিধি। সাঈদের অন্য কাজিনদের তেমন ভালো মতো না চিনলেও নিধিকে খুব ভালো ভাবেই চেনে রুপন্তি। কারণ প্রথমে নিধির সাথে নাকি সাঈদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।

নুর জাহান বেগম নিজের ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করতে চেয়েছিল। আপত্তি ছিল সাঈদের বাবা সাজিদ রহমানের। আত্মিয়তার মাঝে পূনরায় সম্পর্ক করতে চায়নি সে। তাছাড়া নিধির তখন এসএসসিও শেষ হয়নি। তাই এমন বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে সাঈদও অমত পোষণ করে। যার ফলে তখন নুর জাহানের ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেলো।

সেদিন মেহেদী হাতে দিয়ে সাঈদের পাশে এসে বসেছিল নিধি। মেহেদী লাগিয়ে দিয়েছিল রুপন্তি নিজেই। তার কাছে মেহেদী দেখে নিধি বলেছিল লাগিয়ে দিতে, তাই।
সাঈদের দিকে চেয়ে নিধি ন্যাকা স্বরে বলে,
“নুডলস গুলো খাইয়ে দাও তো ভাইয়া। আমার হাতে মেহেদী দেওয়ায় খেতে পারছি না।”

সাঈদ ফোন হাতে কিছুটা ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলল,
“মাকে গিয়ে বল সে খাইয়ে দিবে।”
“ওরা তো সবাই এক সাথে বসে কথা বলছে।”
“তাহলে তোর ভাবিকে গিয়ে বল।”
ভেবিছিল এবার রেহাই পাবে। কিন্তু না। নিধি আবারও ন্যাকা স্বরে বলে,
“ভাবি সবার জন্য চা বানাচ্ছে।”

বাধ্য হয়ে বাটি’টা হাতে তুলে নিল সাঈদ। খাইয়ে দেওয়ার সময় চা হাতে রুমে প্রবেশ করে রুপন্তি। ঐ সময়ে কিছু বলেনি সে। চুপচাপ তাদের পাশে চায়ের কাপ রেখে চলে গিয়েছিল। ঐ সময়ে পৈশাচিক আনন্দ পায় নিধি। চুপচাপ বসে থেকে নিজের মাঝে বলে, আমার জায়গায় কখনোই ভালো থাকতে পারবে না ভাবি। এই জায়গাটা আমার হওয়ার কথা ছিল।

তারা যাওয়ার পর দুই দিন সাঈদের সাথে কোনো কথা বলেনি রুপন্তি। স্বামীর ব্যাপারে মেয়েটা খুবই হিংসুটে। সে কিভাবে স্বামীর পাশে অন্য কাউকে মেনে নিবে?
,
,
বিছানায় খুলে রাখা সাঈদের আগোছালো জামা গুছিয়ে রাখছে রুপন্তি। গতকাল রাতে শাশুড়ির বলা দ্বিতীয় বিয়ের কথাটা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথা থেকে যেন সরতেই চাইছে না। কিভাবেই বা সরবে? তার সাজানো সংসার ভাগ হওয়ার প্রসঙ্গ এটা।

সাঈদ তখন ওয়াশরুম-এ। রুপন্তি জামা কাপড় গুছিয়ে এক পাশে রাখলো। এমন সময় বিছানায় রাখা সাঈদের ফোনে একটা মেসেজ নোটিফিকেশন শুনে সেদিকে তাকায় রুপন্তি। নিধির ছোট একটা মেসেজ,
‘তোমার নাকি শরির খারাপ? এখন কেমন আছো?’

নিধি এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। যথেষ্ট বড়ো সে। তাই সাইদের ফোনে নিধির এমন কেয়ারিং মেসেজ পাঠানো দেখে অনেকটাই হিংসে হলো তার। এই মুহুর্তে রাগে ফোনটা আছাড় মারতে মন চাইছে। তবুও চুপচাপ নিজের রাগকে কনট্রোল করে আগের জায়গায় ফোনটা রেখে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে বসে চিরুনি হাতে তুলে নিল সে।

কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো সাঈদ। ঘাড়ে টাওয়াল রেখে এক হাতে মাথা মুছতে মুছতে বিছানা থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোনের দিকে চেয়েই রুপন্তিকে বলে,
“আমি অসুস্থ ছিলাম এটা নিধিকে কে বলেছে? তুমি বলেছো?”
“না। মা বলেছে হয়তো।”

বলেই নিশ্চুপ হয়ে আছে সে। টাওয়ালটা এক পাশে মেলে দিয়ে রুপন্তির দিকে তাকালো সাঈদ। কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে আনমনে চুলে চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে এক পলক তাকালো সাঈদ। রুপন্তির বিষণ্ন মন লক্ষ করলে তার কাছে এগিয়ে গেলো সে।
পেছন থেকে ধরে দাড় করালো তাকে। নিজের দিকে ফিরিয়ে রুপন্তির দু’কাধে হাত রেখে বলে,
“আমার রুপার কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”

রুপন্তি চুপ করে তাকিয়ে রইল নিচের দিকে। কেন জানি আজ সাঈদের চোখের দিকে তাকানোটা অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। রুপন্তিকে চুপ থাকতে দেখে সাঈদ পুনরায় বলে,
“কোনো সমস্যা হয়েছে? নাকি কোনো কিছু নিয়ে আপসেট? এমন কিছু হলে আমাকে বলো।”

রুপন্তি এবার মাথা তুলে সাঈদের দিকে তাকালো। জড়তা কাটানোর চেষ্টা করে বলে,
“তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। বলবো?”

সাঈদের মাঝে কিছুটা চিন্তা ভর করলো মুহুর্তে। রুপন্তি তো কিছু বলার আগে অনুমতি চায়নি কখনো। যা মনে এসেছে তা খুব সহজেই বলে দিয়েছে। এখন কি এমন বলবে যে, এমন করে অনুমতি চাইছে?
সাঈদ ক্ষনিকটা কৌতুহল নিয়ে বলে, “কি?”

রুপন্তুি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কয়েকটা নিশ্বাস নিল। এই মুহুর্তে নিশ্বাস গুলোও যেন ভাড়ি হয়ে আসছে তার। তবুও পরপর কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে সাঈদের বুক বরাবর দৃষ্টি রেখে বলে দেয়,
“আমি চাই তুমি আরেকটা বিয়ে করো সাঈদ। আমার সাথে থেকে তুমি কিছুই পাবে না। আমি চাই না তুমি বাকি পুরোটা জীবনও বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত থাকো। তাই এমন কাউকে বিয়ে করো যে তোমাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিতে পারবে।”

এক মুহুর্তের জন্য সাঈদ যেন হা করে চেয়ে আছে রুপন্তির দিকে। এসব কি বলছে এই মেয়ে? তার জ্বর এসেছে কিনা চেক করতে কপালে হাত রাখলো সাঈদ। না, সব ঠিকঠাকই আছে। রুপন্তির কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে গালে হাত রেখে কিছু বলতে চাইলে রুপন্তি সেই সুজুগ না দিয়ে কিছুটা সরে দাড়িয়ে বলে,
“অনেক কাজ পরে আছে আমার। এগুলো শেষ করে দুপুরের জন্য রান্না বসাতে হবে।”

বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে সে। আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে বোধ হয় কান্নাই করে দিত সে। যা সে কখনোই চায় না। কারণ, শুধু আবেগ দিয়ে কেবল প্রেমই সুন্দর হয়, সংসার না।

To be continue…………..

#হাত_বাড়িয়ে_রই (পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

~ আবারও নতুন গল্প নিয়ে হাজির হলাম প্রিয় ভাই-বোনদের মাঝে।💖

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here