#হাত_বাড়িয়ে_রই (পর্ব ৩)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
“সাঈদ ভাইকে আমি বিয়ে করবো মানে! এটা কিভাবে সম্ভব মা? তাছাড়া তার পূর্বের বিয়ে করা স্ত্রী আছে।”
অবাক ভঙ্গিতে মায়ের দিকে চেয়ে কথা গুলো বলে নিধি। কপালে এক হাত দেখে উত্তোজিত ভাব নিয়ে বলে,
“ও মাই গড। তার মানে তোমরা এই কারণে দু’দিন বেড়ানোর নাম করে আমাকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছো?”
কিছুক্ষণ অস্থিরতায় কাটিয়ে বিছানার এক পাশে বসে গেলো নিধি। তার মা পাশে বসে কাধে হাত রাখলো তার। নিধির দিকে চেয়ে বলে,
“এমন ভাবে বলছিস যেন সাঈদ তোর অচেনা কেউ? ঐ দিন গুলো কথা কি ভুলে গেলি, যখন সাঈদের বিয়ের সময় পাগলের মতো কাঁন্না করেছিলি। সাঈদকে কেমন ভালোবাসিস সেটা আর কেউ না জানলেও আমি ভালো করেই জানি।”
নিধি মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“এখন সবকিছু পাল্টে গেছে মা। তাছাড়া সাঈদ ভাই এখন বিবাহিত। তার প্রথম বউ এর উপস্থিতিতে আমাকে তার দ্বিতীয় বউ বানাতে চাইছো তোমরা?”
নিধির মা ‘চ’ সূচক একটা শব্দ করে বলে,
“তুই বুঝতে পারছিস না বিষয়টা। এত বছরেও রুপন্তির কোনো সন্তান হয়নি। যার কারণে সাঈদ দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তুই তাকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারলেই পুরো সংসারটাই তোর হয়ে যাবে। তখন রুপন্তি হবে তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি। তখন সাঈদকে বুঝিয়ে রুপন্তিকে এ বাসা থেকে বের করে দেওয়াটা তেমন কঠিক কাজ হবে না। মা রে, আমাদের অবস্থা তো জানিস। টেনে টুনে দিন কাটাতে হয় আমাদের। সাঈদ’রা চাইলে আমাদের মতো পরিবারকে দশ বার কিনতে পারে। এমন ঘরে নিশ্চই আমার মেয়ের কোনো কিছুর অভাব হবে না। তাছাড়া জানিস তো তোর ফুফি তোকে কতটা ভালোবাসে। আমাদের দুঃসময়ে সব সময় পাশে থাকে তারা। তাদের কথা আমরা কিভাবে ফেলে দিই বল।”
নিধি চুপ করে রইল মায়ের কথা শুনে। কেমন যেন বুকটা টিপটিপ করছে তার। তার মা পূনরায় বলে,
“চিন্তা করিস না মা। রুপন্তি চলে গেলে এই পুরো সংসারই একসময় তোর হাতের মুঠোয় থাকবে। তখন বাকি জীবন তুই তোর ভালোবাসার মানুষকে নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবি।”
নিধি চুপ করে রইল। তার ধারনা, এই রুপন্তির জন্যই সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েছে। নিধি তো সেদিনও শপথ করেছিল, রুপন্তিকে একদিন হলেও এর মাশুল দিতে হবে। নিধি কিছুক্ষণ দু’চোখ বন্ধ করে অতঃপর মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
“তোমরা যদি ভালো মনে করো তাহলে আমি রাজি। সাঈদ ভাইয়ের দ্বিতীয় বউ হতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
,
,
রুপন্তির পাশে এসে বসে সাঈদ। রুপন্তি স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“ভেবেছিলাম তোমার জন্য দ্বিতীয় পাত্রী আমি খুঁজে দিব। কিন্তু এখন দেখছি তোমার পাত্রী আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তবুও একটা কথা বলি?”
সাঈদ সম্মতি সুচক মাথা নাড়ালো। রুপন্তি সাঈদের চোখে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমার সংসার ভাগ হলেও আমি চাই সংসারের প্রতিটা মানুষ হ্যাপি থাকুক। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। যে আসবে তাকেও আমি মেনে নিব। কিন্তু আমি চাই না নিধি তোমার বৌ হয়ে এই ঘরে আসুক। অন্য কোনো মেয়ে আসুক, বাট নিধি না। তাকে আমার কেন যেন তোমার সাথে একদম সহ্য হয় না।”
সাঈদ রুপন্তির দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমার কাছে মায়ের শেষ চাওয়া, আমি যেন নিধিকে বিয়ে করি। অন্য কেউ যেমন বউ হয়ে আসবে তেমন নিধিও বউ হয়েই আসবে। এতে সমস্যা কোথায়?”
সাঈদের মুখে অন্য কাউকে বউ নিসেবে শুনতে পেয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো রুপন্তির। তবুও বিষাক্ত অনুভূতি গুলো লুকিয়ে চুপচাপ সহ্য করে নিল সে। সাঈদ পূনরায় বলে,
“তুমি নিজেই আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছিলে। মা ও চাপ দিচ্ছিল। এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয়েছে এই বিয়েতে। নয়তো আমি কখনো এসব নিয়ে ভাবি নি। আমার মনে সব সময় তুমি ছিলে, তুমিই থাকবে।”
রুপন্তির কান্না পাচ্ছে খুব করে। কেন এমনটা হচ্ছে? সংসারটা ভাগ না হয়ে এক হাতে সামলানোটা ভাগ্যে লেখা থাকলে কি খুব বেশিই ক্ষতি হয়ে যেত? মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, ভাগ্য এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে?
রুপন্তি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
“নিধিকে আমি নিজের বোনের মতোই ভালোবাসবো। তার ঘরে সন্তান আসলে তাকেও নিজের সন্তান হিসেবেই ভালোবাসবো, আগলে রাখবো, নিজ হাতে বড়ো করবো। কারণ, তোমার সন্তান সে আমারও সন্তান। একটুও পার্থক্য বুঝতে দিব না।”
সাঈদের দ্বিতীয় বউ হিসেবে নিধিকে বেছে নিয়েছে এটা নিধিরা আসার আগেই বুঝতে পেরেছিল রুপন্তি। তার শাশুড়ি মা খুব ভালো ভাবেই একটা বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব মেনে নিতে। মানতে না পারলে সংসার ত্যাগ করতে হবে। রুপন্তির বাবার বাড়ির অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তার বড়ো আপা স্বামী মারা যাওয়ার পর গত এক বছর ধরে বাবার বাড়িতে পড়ে আছে। এখন রুপন্তিও ডিভোর্সি হয়ে বাবার বাড়ি গিয়ে উঠলে মান সম্মান আর একটুও অবশিষ্ট থাকবে না। মা-বাবাও বলে দিয়েছে, সব হাসি মুখে মেনে নিতে। কত মানুষই তো দুইটা তিনটা বিয়ে করে।
তাছারা রুপন্তি নিজেই সাঈদকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। সাঈদের মুখে হাসি দেখতে সেও চায়। যে হাসির কারণ সে গত পাঁচ বছরেও হতে পারেনি।
,
,
নিধির সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে সাঈদের। নিজে সব কিছুর সম্মতি দিলেও যেন বুকটা পুড়ে যাচ্ছে রুপন্তির। তবুও মুখ বুঁজে সহ্য করে নিচ্ছে সব।
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো আজ। কতাবার্তা শেষে চলে গেলো সবাই। সাইদ এখনো বসে আছে সোফায়। রুপন্তিকে ডেকে বলে নাস্তা দেওয়া কাপ প্রিচ গুলো এখান থেকে নিয়ে যেতে।
চুপচাপ এগিয়ে আসলো রুপন্তি। নিজের স্বামীর বিয়ের মেহমানদের আথিতেয়তা করছে সে। এর চাইতে বর চাপা কষ্ট এই মুহুর্তে দ্বিতীয়টা মনে হচ্ছে না তার।
চায়ের কাপ গুলো ট্রে তে নেওয়ার সময় সাঈদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
“বিয়ের দিন কবে ঠিক হয়েছে?”
সাঈদ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আগামী শুক্রবার।”
আর কিছু বললো না রুপন্তি। চায়ের কাপ গুলো ট্রে-তি নিয়ে নিজের চাপা রাগ নিয়ে জোরে টান দিয়ে ট্রে টা হাতে নিতেই কাপ গুলো ছিটকে পরে গেলো ফ্লোরে। ভাঙার শব্দ তুলে চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে গেলো কাপ গুলো। সাঈদ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুপন্তির দিকে।
রুপন্তি ক্ষনিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সাঈদের দিকে চেয়ে বলে,
“স্যরি, আমি ইচ্ছে করে করিনি এটা। এক্ষুনি পরিষ্কার করে নিচ্ছি সব।”
বলেই ফ্লোরে বসে একে একে ভাঙা টুকরো গুলো তুলে নিচ্ছে সে। সাঈদ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। এবার আর নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারলো না রুপন্তি। অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে টপটপ করে আছড়ে ফ্লোরে।
,
,
সাঈদের বিয়ের দু’দিন আগে বাবার বাড়ি চলে গেলো রুপন্তি। বিয়ের এই দিন গুলো সে বাবার বাড়িতেই কাটাবে। সব শেষ হলে তারপর নিয়ে আসবে সাঈদ।
সাঈদদের বাড়িতে চলছে বিয়ের আয়োজন। যা অসহ্য লাগছে দেখেই কয়েক দিনের জন্য বাবার বাড়ি চলে গেলো রুপন্তি।
সন্ধা পেড়িয়ে গেলো। বর যাত্রী রওনা দেওয়ার সময় হয়েছে। সাঈদ রুপন্তিকে ফোন দিলে শুভ কামনা জানিয়ে ফোন কেটে দিল রুপন্তি। একটা দির্ঘশ্বাস ছাড়লো সাঈদ। মায়ের মন রাখতে অনেক বড়ো সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছে তাকে। সে এমন পরিস্থিতিতে আটকা পরেছে। একজনের মন রাখতে গেলে অন্য জনের মনে আঘাত দিতে হবে। তাছাড়া বাবার মৃত্যুর সময় সে কথা দিয়েছে মাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না সে।
ওদিকে পার্লার থেকে সাজিয়ে এনেছে নিধিকে। নতুন সংসার বাধার স্বপ্নে হাস্যজ্জল মুখে অপেক্ষায় আছে বর যাত্রীর। অপর দিকে অন্যজন সংসার ভাগ হওয়ার চাপা কষ্টে নিরবে চোখের জল ফেলছে।
আজ বিকেল থেকেই শরিরটা দুর্বল লাগছিল রুপন্তির। একটু আগে সাঈদকে শুভ কামনা জানিয়ে বিছানার এক পাশে বসেছিল সে। পাশে তার বড়ো আপু বসে শান্তনা দিচ্ছে তাকে। আচমকাই মুখ চেপে দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো রুপন্তি। পেছন পেছন ছুটে গেলো তার বোনও।
ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠানে এসে বমি করতে শুরু করলো রুপন্তি। তার বোন পানি নিয়ে এসে রুপন্তির পাশে এসে দাড়ালো। রুপন্তি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই তার হাতে পানি ঢেলে বলে চোখেমুখে ছিটিয়ে নিতে। রুপন্তি তাই করলো। অতঃপর ক্লান্ত শরিরে সোজা হয়ে দাড়ালো সে। রুপন্তির বোন কাধে এক হাত রেখে বলে,
“ঠিক আছিস?”
রুপন্তি হ্যাঁ সুচক উপর নিচ মাথা নাড়ালো। কয়েক সেকেন্ড দাড়িয়ে থেকেই ক্লান্ত শরিরে ঢলে পড়ে গেলো সে। রুপন্তির বোন তাকে ধরে ঘরের দিকে চেয়ে উচু গলায় বলে,
“মা,,,, বাইরে আসো। দেখো রুপন্তি অজ্ঞান হয়ে গেছে। মা,,, বাবা,, কোথায় তোমরা?”
ওদিকে বাইরে গাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে সবাই। নুর জাহান ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল হাসি মুখে। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে সাঈদ। তার সাথে গাড়িতে উঠে নিধিদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয় সবাই। উদ্দেশ্য একটা নতুন সম্পর্ক।
To be continue…………..