মেয়ে ধ’র্ষি’তা কথাটা ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়তেই বরপক্ষ বিয়ে ভে’ঙে দিয়ে চলে গেলেন। ইপ্সিতার পরিবারের মাথায় আকাশ ভে’ঙে পড়ল। যে সত্যটা লুকিয়ে রাখার জন্য অন্য শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন সেই সত্যটাই সকলের সামনে চলে আসলো, আবার ইপ্সিতার বিয়ের দিনই।
লোকজন কানাঘুষা করছে। ইপ্সিতার মা আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করে চলেছেন, আর ইপ্সিতা?
বর বিয়ে না করে চলে গেছে, কিংবা লোকে নানান কথা বলছে এতে ইপ্সিতার কিছুই যায় আসেনা। ওহ বিয়ে করতে চাইনি, বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করতে রাজি হতে হয়েছিল কিন্তু শেষে কি হলো? সত্যিটা জেনে বিয়েটা ভেঙে দিলো। কেউ তো জানতে চাইলো না, সেইদিন কি হয়েছিল। সমাজ ধ’র্ষি’তাকে দায়ী করে, ধ’র্ষ’ককে নয়।
সমস্ত লোকজন আসতে আসতে চলে যেতে লাগল, বিয়ে বাড়িটা নিমিষেই মরার বাড়িতে পরিনত হয়ে গেল। ইপ্সিতার ফুপি আসমিনা বেগম বললেন,
– ‘দেখলি দাদা তোকে আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে তোর মুখ পো’ড়াবে দেখলি তো।’
– ‘আহ বোন চুপ করবি।’
– ‘আমাকে চুপ করালেও লোকজনকে কি চুপ করাতে পারবি? আবার এই শহর ছেড়ে অন্য শহরে পালিয়ে যাবি নাকি?’
ইপ্সিতা এতক্ষন চুপ করে থাকলেও আর পারল না।মুখটা খুললো এইবার,
– ‘আমরা কোথাও যাবো না, এই শহরেই থাকব যদি দরকার পরে আমাদের দেশের বাড়িতে ফিরে যাবো তবুও আর পালিয়ে যাবো না।’
– ‘মেয়ের কত বড়ো বড়ো কথা।’ (মুখ বেঁকিয়ে)
ইপ্সিতা হাসলো, মানুষটি ওকে অপছন্দ করে সেটা ওর অজানা নয়।
– ‘তা মুখপু’ড়ি তোর করা অকা’জ গুলোর জন্য আমার দাদাকে কথা শুনতে হবে কেন? তুই ম’রতেও তো পারিস।’
– ‘দিদি তুমি এসব কি বলছো?’ (ইপ্সিতার মা)
ইপ্সিতার বাবা মা দুজনেই চমকে উঠল। যাই হয়ে যাক বাবা মায়েরা কখনোই সন্তানের মৃ’ত্যু চাইতে পারে না।
– ‘আন্টি আমি আপনার সমস্ত অভিযোগ মেনে নিচ্ছি, আমার কারনেই আমার বাবা মাকে অপমানিত হতে হচ্ছে কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আমি যে ধ’র্ষি’তা এটা সবাই জানল কিভাবে?’
আসমিনা বেগম ঘাবড়ে যায়। প্রশ্নটা ইপ্সিতার বাবার মনেও ধরা দেয়।
– ‘সত্যি তো, এই কথাটা সবাই জানলো কিভাবে?’
– ‘সেটাই তো বাবা। এইখানে আমাদের নিজেদের মানুষ এবং আমার অতীত সম্পর্কে জানে একটা মানুষই ছিল আর সেটা আন্টি।’
আচমকা আক্রমনে আসমিনা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। ইপ্সিতার বাবার সন্দেহ আরো বেড়ে গেল,
– ‘বোন এইসব তুই করিস নি তো?’
– ‘দাদা এইসব তুমি কি বলছো?’ (ন্যাকা গলায়)
– ‘যদি ঘটনাটা সত্যি হয়, তাহলে আজকের পর থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না কথাটা মনে রাখিস। ইপ্সিতা মা ভেতরে চল।’
ইপ্সিতার বাবা ওকে আর ওর মাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আসমিনা বেগম ফুঁসে ওঠে কিছু একটা বিরবির করে বললেন।
ইপ্সিতার বাবা মুহিদ মেয়েকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন,
– ‘মারে আমাকে মাফ করে দিস। আমি একজন ব্যর্থ বাবা।’
– ‘বাবা তোমার তো কোনো দোষ নেই, সব দোষ আমার কপালের। পো’ড়া কপাল আমার, দ্যাখো না প্রথমে ধ’র্ষি’তার ট্যাগ লাগল আবারো একটা ট্যাগ লেগে গেল।’ (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)
ইপ্সিতার মায়ের দুচোখ ভরে পানি এলো, ছোট থেকে মেয়েটাকে বড্ড আদর স্মেহে বড়ো করে তুলেছেন কিন্তু গত ২বছরে মেয়েটার উপর দিয়ে কি বয়ে চলেছে তাতেও যে মেয়েটা শক্ত হয়ে আছে এটাই অনেক বেশি কিছু। জোর করে মেয়েটার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু কি হলো সব শেষ…
মাঝে কেটে যায় কয়েকটা দিন। ইপ্সিতা নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়, অনেক তো ভেঙে পড়া হলো এইবার ঘুরে দাঁড়ানো হোক।
ইপ্সিতা বাবার কাছে গিয়ে বলল,
-‘বাবা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
-‘কি কথা?’
– ‘বাবা আমি তোমাদের কথা মতো বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। তোমাদের কথা শুনে ২বছর আগে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে এসেছিলাম, তোমাদের সমস্ত কথা শুনেছি। আজকে আমার একটি কথা রাখবে..’
– ‘কি কথা মা।’
– ‘আমি আবারো বাড়ি ফিরে যেতে চাই।’
– ‘কি বলছিস তুই!’
– ‘হ্যাঁ বাবা অনেক হয়ে গেছে এইবার সমস্ত কিছু ফেরত দেবার পালা। তোমরা প্লিজ অমত করো না।’
মেয়ের মাঝে একটা অন্যরকম কিছু উপলব্ধি করতে পারলেন মুহিদ চৌধুরী। মেয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে রাজি হয়ে গেলেন।
– ‘ঠিক আছে যাবো।’
ইপ্সিতা বাবাকে জড়িয়ে ধরল। মুখের কোনে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত হাসি।
ইপ্সিতার মা অমত প্রকাশ করলেও শেষে মেয়ের জেদের কাছে হার মানতেই হলো। ১সপ্তাহ পর ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
ইপ্সিতাদের দেশের বাড়ি বীরভূমে। পশ্চিমবঙ্গের একটা জেলা, যেটিকে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি বলা হয়ে থাকে। বীরভূম জেলা লালমাটির দেশ, নানান ঐতিহ্য সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ। বাকিটা ধীরে ধীরে জানব।
গাড়িটা ইপ্সিতাদের বাড়ির সামনে থামলো, বিশাল দুইতলা বাড়ি। ইপ্সিতার দাদু ব্যবসায়ী ছিলেন, বাড়িটা ওনারই তৈরি। ওনার পরে ইপ্সিতার বাবা মুহিদ এই ব্যবসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ব্যবসা সূত্রে প্রায় সময়েই শহরে যাতায়াত করতেন তার জন্য শহরে বাড়িও কেনা ছিল, ইপ্সিতার সাথে ঘটনাটা ঘটার পর লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েকে নিয়ে শহরের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। ২বছর এই বাড়িতে এক বারের জন্যও আসেনি।
বর্তমানে বাড়িটির দ্বিতীয় তলা ভাড়া দেওয়া আছে, যদিও বিষয়টা ইপ্সিতার অজানা। ২বছর পর নিজের চেনা শহর, দেশের মাটির গন্ধে ইপ্সিতার মনটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। শহরে থাকলেও মনটা এই লালমাটির দেশেই পড়ে থাকত, ইচ্ছা করত ছুটে চলে আসতে কিন্তু অনেক বাঁধা, দ্বিধা বারবার আটকে দিত। নিজের অতীতকে সামনে থেকে দেখার ভয়টা ঘিরে ধরত কিন্তু আর নয় ওহ তো কোনো অন্যায় করেনি তাহলে কেন ভয় করবে!
গাড়িটা বাড়ির সামনে থামতেই লোকজনের ভীড় জমা হতে থাকে। আশেপাশের মানুষরা ভীড় জমিয়ে নানান কথা বলতে থাকে। ইপ্সিতা সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, এইবার আর ভা’ঙতে নয় বরং ভে’ঙে দিতে এসেছে।
ইপ্সিতার মুখের হাসিটা মানুষজনের কাছে অদ্ভুত লাগল। মেয়েটার কি লজ্জাশরম কিছুই নাই এতকিছুর পর আবার হাসছে।
ইপ্সিতা বাড়িটাতে চোখ বুলিয়ে দেখল সবকিছু আগের মতোই আছে। ওর মনটা ভারি হয়ে উঠল, বিরবির করে বলল,
– ‘তোরা সবাই সেই আগের মতোই আছিস শুধু আমার জীবনটাই বদলে গেছে।’
***
নিভ্র ল্যাপটপে নিজের কাজ করছে, তখনি ওর মা নিরস মুখে ঘরে আসলো। মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, মা মুখ গোমড়া করে আছে।
– ‘কি হলো মা, তোমার মুখ এইরকম কেন?’
– ‘আর বলিস না, বাড়িওয়ালারা ফিরে এসেছেন।’
– ‘এতে কি হয়েছে?’ (ভ্রু কুঁচকে)
– ‘অনেক কিছু হয়েছে, আশেপাশের লোকজনরা বলাবলি করছিল বাড়িওয়ালার মেয়েটা নাকি ধ’র্ষি’তা। বাবু আমি বলি কি তুই অন্য একটা বাড়ি দ্যাখ আমি আর এই বাড়িতে থাকব না।’
নিভ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘মা অবুঝের মতো কথা বলো না, একজন মেয়ে ইচ্ছা করে ধ’র্ষি’তা হয় না। আর দোষী সাব্যস্ত করলে ধ’র্ষ’ককে করো, ধ’র্ষি’তাকে নয়।’
– ‘আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না, মেয়েদেরও দোষ থাকে। তুই অন্য বাড়ি দ্যাখ।’
– ‘মা এত ভালো ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। তোমার যদি অসুবিধা হয় তাহলে ওই মেয়ের সাথে কথা বলবে না, তবুও বাড়ি ছাড়ার কথা বলো না প্লিজ।’
নিভ্র বিরক্ত হয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল। মা ওকে নিয়ে একটু পজেটিভ ওহ জানে কিন্তু তাই বলে একজন মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়েকে অপমানিত করবেন সেটা তো মেনে নিতে পারবে না। নিভ্র ছোট থেকে মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান করে, একজন মেয়ে তো কারোর বোন, কারোর মেয়ে আবার কারোর মা। তাকে অপমান করা মানে গোটা নারী জাতিকে অপমানিত করা।
নিভ্র ছাদ উঠে থমকে গেল, একটা মেয়ে উল্টে দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। পরনে হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ, মাথায় ঘন কালো লম্বা কেশ কোমড় ছাপিয়ে গেছে, নিভ্র আনমনে বলে উঠল, – ‘বেনে বউ।’
#চলবে…
এক ধ’র্ষি’তা মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম।
#বেনেবউ
#পর্ব_১
#তানজিলা_খাতুন_তানু