#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৭]
_____________________
” হঠাৎ আপনার মাথায় কি চলছে?আমাদের বাসায় কেন আসবেন?”
” অনেকদিন হলো ভালো মন্দ খাইনি তাই…”
” বাজে কথা বলবেন না মিথ্যুক।গতকাল সুন্দরী রমণীর পাশে বসে তো গোগ্রাসে গিলেছেন আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
” উফফ আবার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো।সকাল থেকে চার বার বাথরুমে যেতে হয়েছে এবার বুঝেছি হঠাৎ এমন কেন হলো।তুমি গতকাল নজর দিয়েছো তাই আজ আমার পেট খারাপ করেছে।”
ঈশানের কথায় থতমত খেয়ে গেলো ঈশা।ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
” বাজে কথা বলছেন কেন?আমি কখন আপনার খাবারে নজর দিলাম?”
” এই তো বললে আবার অস্বীকার করছো।”
” ঈশান..”
” আস্তে আস্তে কানে লাগে তো এই ভাবে কেউ চিৎকার দেয় জান?যদি আমার কানের পর্দা ফেটে যায় তুমি কবুল বললে আমি শুনবো কি করে হুম?”
” সাত সকালে আপনি আমার মাথাটা গরম করছেন কেন?”
” এটা সাত সকাল?সাড়ে নয়টা বাজতে চলেছে।আচ্ছা যাও বাদ দাও এবার বলো পায়ের কি অবস্থা? তোমাকে বলেছিলাম চলো ব্যান্ডেজ করে আসি তুমি তো শুনলে না।”
” পা যেমন ইচ্ছা তেমন আছে।”
” জেদ করবে না।বাসায় গিয়ে ব্যান্ডেজ করেছো?”
” হুম।”
” ব্যথা আছে পায়ে?”
” না আমার তো লোহার শরীর আঘাত লেগেছে ব্যথা থাকবে কেন?”
ঈশান নিশব্দে হাসলো।অধিকাংশ মেয়ের এই এক দোষ সোজা উত্তর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে দেবে।
” সাবধানে থাকবে পায়ে যেন আর চোট না লাগে।এখন ফোন রাখছি।”
ঈশানদের আসার খবরটা শুনে বেশ চমকে গেলো ঈশা মনে তার ভীষণ ভয় কাজ করছে কি থেকে কি হবে।মুজাহিদ হাসান অনেকবার রিকুয়েষ্ট করেছিলো ঈশানকে যেন তার মা’কে নিয়ে আসে প্রতিবার সেই প্রস্তাব ঘুরিয়ে দিয়েছিলো ছেলেটা।কিন্তু হঠাৎ ঈশান আসতে কেন রাজি হবে?তাও ওতটা কাছের আত্মীয়র বাড়িতে নয় বরং দূর সম্পর্কের।প্রশ্নরা যখন কিলবিল করছিলো ঈশার মাথায় তখন বেখেয়ালি হাটতে গিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় পায়ে চোট লাগা স্থানে পুনরায় আঘাত লাগে।তৎক্ষণাৎ পা ধরে মেঝেতে বসে যায় ঈশা।গজ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল তার পা হঠাৎ আঘাত লাগায় টনটনে ব্যথায় মুষড়ে উঠলো।সাদা গজ কাপড়টা এতক্ষণে রক্তে ভিজে উঠেছে।প্রতিদিন কাজে সাহায্য করার মানুষটা ঈশাকে দেখে এগিয়ে এলো হাক ছেড়ে ডাকলো সবাইকে।
” খালা কাউকে ডাকবেন না।আম্মু দেখলে ভীষণ বকবে।”
” কি কও।আঙুল দেহো কতডি রক্ত ছুডছে।”
” থাক থাক।আমাকে একটু ধরেন রুমে দিয়ে আসেন।”
সুলতানা ছাদে ছিলো বিধায় শুনতে পেলো না।তবে মুজাহিদ হাসানের কানে ঠিকি গেলো ঈশার আর্তনাদ।দ্রুত পায়ে তিনি ছুটে এলেন মেয়ের কাছে হাসিন তার পেছনেই ছিল।কাজের চাপে অনেকদিন হলো আসা হয়নি তাই আজ ভোরে হাসিন এসেছে।ঈশার পায়ে রক্ত দেখে বিচলিত হলেন মুজাহিদ হাসান।
” মারে পায়ে কি হলো?”
” টেবিলের সাথে বারি লেগেছে আব্বু।”
” তুমি দেখে হাটবে তো একটুও নিজের প্রতি যত্নশীল নও তুমি।”
ঈশা দাঁতের সাহায্যে ঠোঁট কামড়ে ধরলো ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে।তা অবস্থা বুঝতে পেরে আগলে ধরে হাসিন।
” চল হাসপাতালে যাই।”
” না না ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।”
” কতটা ঠিক হবে বুঝতে পারছি ইনফেকশন হয়ে গেলে?এক্ষুনি চল।
ঈশা তৈরি হয়ে হাসিনের সাথে বেরিয়ে যায়।সাদা ব্যান্ডেজটা সম্পূর্ণ রক্তিম হয়ে আছে সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো সে।
৬১.
মাহমুদা নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছেন।ঈশান অনেকক্ষণ যাবৎ তাকে ডেকেও যখন পেলো না তখন জেদের তাড়নায় আশেপাশে শোপিস ফুলদানি একে একে ভাঙতে শুরু করলো।ভাঙাচুরার শব্দে চমকে গেলেন মাহমুদা একেরপর এক শব্দটা ক্রমশ আসছে রাসেলের গলাও পাওয়া যাচ্ছে ছেলেটা কেমন চিৎকার চেচামেচি করছে।ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো মাহমুদার।রাগের মাথায় ভাঙচুর করার অভ্যস ঈশানের নতুন নয় বরং পুরোনো।ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই এমন।তাই তিনি দরজা খুলে দ্রুত বের হলেন।দরজার বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হলেন।
” কী বলেছিলাম আমি?বলেছিলাম আগে নিজেকে সামলাও তারপর আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব নেবে তারপর বিয়ে করবে আর এখন তুমি…”
” আমি কেন রেগে গেছি সেটা তুমি ভালো করে জানো আম্মু।এক ঘন্টা যাবৎ দরজা খুলতে বলছি খুলেছো?সবচেয়ে বড় কথা খালা বললো তুমি নাকি ঈশাদের বাড়ি যাবে না।”
” হ্যাঁ ঠিক শুনেছো।”
” তুমি কি অসুস্থ?শরীর খারাপ লাগছে?”
” না না আমি ঠিক আছি বাপ।”
” তাহলে কেন যাবে না?”
মাহমুদা চুপসে গেলেন।আমতা আমতা সুরে বলেন,
” ইয়ে মানে যদি ঈশার বাবা এই বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন?”
” তুমি এই ভয়ে যাবে না?ফিরিয়ে দিলে দিবে তাই বলে চেষ্টা করবে না।”
” ঈশান..”
” আমি এবার ভীষণ রেগে যাচ্ছি আম্মু তুমি জানো না আমি কতটা রেগে আছি।আজ আমার নিজের ধৈর্য্যর প্রশংসা করতে মন চাইছে।”
মাহমুদা কথা খুঁজে পেলেন না।ঈশানের পাশে দাঁড়িয়ে তখন নিশব্দে হাসছিলো রাসেল।ঈশান রাগে ফসফস করছে এক্ষুনি যেন আরো কিছু ভাঙবে ভাঙতে ভাঙতে কখন না আবার রাসেলকে তুলে আছাড় দেয়।বেচারা ভয়ে মাহমুদার পাশে দাঁড়ালো।
” আন্টি ভয় পাচ্ছো?”
” এমন ছেলে যার সর্বদা ভয় তার।”
“ভয় সবাই পায়,গলা সবারি শুকায় তাই ডিউ খাও।ভয়কে হারাও।মাউন্টেন ডিউ ভয়ের পর জয়।”
রাসেলের নাটকীয় কথায় ভ্রু কুচকালেন মাহমুদা।ছেলেটার পিঠে চাপড় মে রে কপট রাগ দেখি বলেন,
” মজা নিচ্ছিস?তোর মা হই।”
রাসেল মাহমুদার হাত ধরলো তাকে ঘুরিয়ে গাল টেনে বলে,
” মাই বিউটি কুইন আমার মজায় তোমার যদি সাজা দিতে ইচ্ছে হয় দিয়ে দাও আমি সব গ্রহণ করবো।”
মা ছেলের কান্ডে রাগের মাঝেও অগোচরে কিঞ্চিৎ হাসলো ঈশান।রাসেল তার দিকে তাকাতে পুনরায় গম্ভীর ভাব ধরে।
” আম্মু যাও রেডি হও এক্ষুনি যাবে।”
মাহমুদা চলে গেলো নিজের রুমে রাসেল এগিয়ে আসলো ঈশানের সম্মুখে তার ঘাড়ে হাত রেখে ব্রু নাচিয়ে বলে,
” বিয়ের এত তাড়া মনে কি চলে হুম?”
” চুপ কর।”
” এতো চুপ করার বিষয় নয় এত তাড়া কিসের? ”
রাসেলের প্রশ্নের জবাব দিলো না ঈশান গটগটে পা ফেলে চলে তৎক্ষণাৎ গেলো।
.
ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে আয়নায় নিজেকে পরখ করছে অনু নাহ সব ঠিক ঠাক শুধু একটুখানি কাজল দিলেই হবে।মৃদু বাতাসে ওয়াল হ্যাংগিং গুলো টিংটং আওয়াজ করছে বিছানার উপর ফেলে রাখা ফোনে গান চলছে।আয়নায় তাকিয়ে মিষ্টি হেসে গলা ছেড়ে গান ধরে,”মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষেরো সনে।” গানটা শেষ করার আগে কক্ষে এলেন দোয়েল মেয়ের দিকে পরখ করে বলেন,
“তৈরি হয়েছিস?এবার তাহলে যা।গিয়ে আবার মেহমানের মতো বসে থাকবি না তোর আন্টির হাতে হাতে কাজ করবি।”
” তা তোমায় বলতে হবে না আমি অবশ্যই করবো।”
” ঈশান শাহরিয়ারের আশেপাশে যাবি না খবরদার ওই ছেলেটা নাকি ভালো না।”
ভ্রু কুচকে এলো অনুর।হাতের কাজলটা রেখে ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে।
” এই কথা তোমায় কে বললো?”
” তোর মনে নেই তোর আঙ্কেলের কাছে পাওনা টাকা পাবে বলে গু ন্ডা ব দ মা শ নিয়ে এসেছিলো।আমি বুঝিনা হঠাৎ ঈশানের পরিবারের সাথে তোর আন্টিদের কিসের এত ভাব?”
” তুমি ভুল ভাবছো তখন যে ঝামেলাটা হয়েছে সেটা এখন আর নেই।তাছাড়া ঈশান ভাইয়া ভীষণ ভালো ছেলে।”
” ভাইয়া?”
ভ্রু কুচকে গেলো অনুর মা দোলনের।তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিক্ষেপ করলেন তীর্যক চাহনি।সেই চাহনিতে গলাটা শুকিয়ে এলো মেয়েটার।মা নিশ্চিয়ই সন্দেহ করছে।
” মা তাহলে কী বলবো?”
” ঈশান ভাইয়া এমন ভাবে উচ্চরণ করলি যেন..”
সহসা ফোন বেজে উঠলো অনুর।তাও ফোন করেছে ঈশা।দ্রুত হাতে ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসার বাইরে।ঈশার সাথে কথা শেষ করে ফোন করলো রাসেলকে ছেলেটা মাত্র গোসল করে ফিরেছে।ভিডিও কলে রাসেলকে দেখে মিষ্টি হাসলো সে।
” কোথায় যাচ্ছো অনু?”
” ঈশাদের বাসায় আন্টি যেতে বলেছে।”
” তার মানে তুমি থাকবে?”
” হুম।”
” এটা তো মস্তবড় সুসংবাদ।”
” খবরদার রাসেল ভুলেও আমার দিকে তাকাবে না আঙ্কেল আন্টি সন্দেহ করলে আমি ফেঁসে যাবো।সবচেয়ে বড় কথা হাসিন ভাই নাকি এসেছেন উনি ভীষণ রাগী।”
” শিকারী আমার আশেপাশে ঘুরবে আর আমি তার দিকে নজর দেবো না এটা হতে পারে?”
” চাইলে হতে পারে।”
” হাসিন ভাইটা আবার কে?”
” ঈশার ফুফাতো ভাই।আচ্ছা যদি ঈশার বাবা মা প্রস্তাবে রাজি না হয় তবে কি হবে?”
” কি আবার হবে?তুমি যা ভাবছো তাই হবে।”
.
দেয়াল ঘড়িতে দুইটা বাজে বাসার গেটের সামনে এসে থেমেছে ঈশানদের গাড়ি।ঈশা জানলার বাইরে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো সেদিকে।একে একে প্রত্যকে বের হলো।তার পেছনে এসে থেমেছে ঈশানের গাড়ি।রাসেল বেরিয়ে
সবাইকে নিয়ে গেটের দিকে গেছে। ঈশান জানলা দিয়ে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে তাকালো ঈশাদের জানলায় উপর থেকে ঠিকঠাক ভাবে বুঝতে পারলো না তাই নিশব্দে চলে গেলো সবার পিছু পিছু।ঈশাদের জন্য নেওয়া প্রতিটা খাবার ড্রাইভার একে একে গাড়ি থেকে বের করছে।অজানা অনুভূতিতে মুষড়ে উঠলো ঈশা।কেন জানি মনে হচ্ছে ঈশানের আগমন স্বাভাবিক ভাবে ধরে নেওয়া যায় না। কেন এসেছে সে?
টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরেক রকমের রান্না।কি নেই তাতে?চাইনিজ প্লেটার থেকে শুরু করে বাঙালিয়ানা সব রান্না।ডোর বেল বাজতে চমকে গেলেন মুজাহিদ হাসান দ্রুত দরজা খুলে সবাইকে অভ্যর্থনা জানান।রুদবা পিটপিট চোখে চেয়ে বলে,
” এটা আমার ঈশামনির বাসা ঈশামনি কই?”
বাচ্চা মেয়েটার আগ্রহ দেখে কিঞ্চিৎ হাসলেন মুজাহিদ হাসান।মেয়েটার গাল টেনে বলেন,
” তোমার ঈশামনি আসছে মামনি।এখন একটুখানি বসো তুমি।”
রুদবা চপল পায়ে এগিয়ে গেলো ঈশানের দিকে বসলো তার কোল জুড়ে।সুলতানা এগিয়ে এসে সবার সাথে দেখা করে গেছেন।ততক্ষণে ড্রাইভার একে একে সব খাবারের প্যাকেট এনে রাখলেন বসার ঘরে।অর্ধেকটা জায়গা দখল করে হয়ে গেলো ঈশানদের আনা খাবারে।
” এসবের কি দরকার ছিল আপা?আপনারা আসবেন শুনে এতে আমি খুশি হয়েছি।”
” কুটুমবাড়িতে খালি হাতে যাওয়া যায় না ভাই এটা আর বেশি কি?একটু আধটু।”
ঈশান হাশফাশ করছিলো এসির মাঝেও ঘামছে সে, মনের কোনে জমে থাকা সব সাহস এক নিমিষে ফুস ফাস উড়ে গেছে।ঈশানের হাশফাশ দেখে হাসিন পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।
” পানিটা নিন স্যার।”
ঈশান চমকে তাকালো হাসিনের দিকে।তাকে স্যার বলছে কেন?অবশ্য হাসিনের সাথে এখনো খোলামেলা আলাপ হয়নি ঈশানের।
” আমাকে স্যার কেন ডাকছেন?নাম ধরে ডাকুন আমরা সমবয়সী।”
হাসিন কিঞ্চিৎ হাসলো।রুমার স্বামী রেদোয়ান এগিয়ে এলো ঈশানের পাশে।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
” শালা বিয়ে বিয়ে করে লাফিয়েছো এখন এত ঘামছো কেন হুম?”
” তুমি কীভাবে বুঝবে?জীবনে এই ভাবে রিক্স নিয়ে তো বিয়ে করোনি।”
” দূর তোমার থেকেও ডেঞ্জারাস ভাবে বিয়ে করেছি আমি।অন্যত্র রুমার বিয়ে নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল তখন রুমা আর আমি কোট ম্যারেজ করেছিলাম তার সাত আটমাসের মাথায় আমাদের বিয়ে হয় ভাগ্যসি বিয়েতে শশুড় শাশুড়ী রাজি ছিল।”
ঈশান চমকে তাকালো রেদোয়ানের পানে।তার চোখ যেন এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে মাথাটা আকস্মিক ঝিম ধরে গেলো।সে যতটুকু জানে রুমার বিয়ে পারিবারিক ভাবে অথচ এরা পূর্ব পরিচিয় ওদের প্রেমের বিয়ে এই সত্যি এত বছর পর প্রকাশ পেয়েছে।ঈশানের চাহনি দেখে নিজের ভুল বুঝতে পারলো রেদোয়ান।এক গাল হেসে নিজের অস্থিরতা দমিয়ে রাখতে বলে,
” থাক এই কথা কাউকে বলো না।আর বললেও কি এখন আমার একটা মেয়ে আছে।”
ঈশান মাথা দুলালো।এদিকে রেদোয়ান ঘামছে।পকেট থেকে রুমাল বের কর কপাল মুছলো দ্রুত হাতে।
” তুমি ঘামছো কেন দুলাভাই?”
” না না ইয়ে মানে..”
মুজাহিদ হাসান তাকালেন দুজনের দিকে সন্দিহান স্বরে বলেন,
” এসি কি বাড়িয়ে দিব?তোমরা ঘামছো কেন বাবা?”
” না না আঙ্কেল আমরা ঠিক আছি।”
কথার মাঝে বসার ঘরে এলো ঈশা।মেয়েটা পা খুড়িয়ে হাটছে অথচ মুখে লেগে আছে এক চিলতে হাসি।তাকে দেখে থমকে গেলো ঈশান, তার বুকের ভেতরটা খা খা করে উঠলো।হাসিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ধরলো ঈশার হাত বসিয়ে দিলো তার পাশে।ঈশার অবস্থা দেখে মুখে আঁধার নামলো রুমা এবং মাহমুদার।
” ঈশা তোমার কি হয়েছে?”
” আপু তেমন কিছুনা নখটা উলটে গেছে।”
” সাবধানে চলবে তো।”
শেষোক্ত বাক্যটি বললেন মাহমুদা।ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে স্থির রইলেন কিছুক্ষণ।মুজাহিদ হাসান বলেন,
” সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছে বলে দৌড়ে দৌড়ে হাটছিল।কোথা থেকে কুকুর এসে নাকি দৌড়াতে থাকে আর মেয়েটাও দৌড় দিতে গিয়ে দেখুন নিজের কি হাল করলো।”
ভরা মজলিশে কেশে উঠলো ঈশান।গ্লাসে থাকা বাকিটা পানিটা শেষ করে তাকালো ঈশার দিকে।মেয়েটা ঠোঁট কুচকে ক্রূর হাসছে।সেদিন ঈশান তাকে ছুঁতে গেলে ঈশা দ্রুত পায়ে হাটতে থাকে তারপর এই অবস্থা অথচ সে বললো তাকে কুকুর দৌড়ালো।তবে এখানে কুকুরটা কে? ঈশান নয় কি।
রাসেল অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে তার পেট ফেটে হাসি আসছে ঈশানটা আজ দারুন ভাবে জব্দ হলো।
.
খাবার টেবিলে এলাহি কান্ড এত এত খাবার এক বৈঠকে কি খাওয়া যায়?তবুও মুজাহিদ হাসান,সুলতানা, হাসিন জোর করে সবার প্লেটে খাবার দিচ্ছেন।ঈশান এক সঙ্গে এত খাবার খেতে অভ্যস্ত নয় কিন্তু এদের জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে।ঈশা রুদবাকে চেয়ারে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে মেয়েটা এটা ওটা প্রশ্ন করছে ঈশাকে।ঈশান নিজের খাওয়ার আড়ালে তাকাচ্ছে ঈশার দিকে।শেষ পাতে দই না হলে জমে না তাই দইয়ের হাড়ি এনে টেবিলে রাখলো অনু সবাইকে বাটি ভরতি দই বেড়ে এক কোনে দাঁড়ালো।রাসেলের সাথে চোখাচোখি হতে চোখ রাঙালো সে।নিলর্জ্জ ছেলেটা কেমন তাকিয়ে আছে পলকহীন।
খাওয়ার শেষে টেবিল পরিষ্কার করলেন সুলতানা।সব কিছু নিরিবিলি হতে মাহমুদা হাত টেনে বসালেন সুলতানাকে।
” আরে আপা কি করছেন?”
” চুপচাপ বসুন তো।”
মাহমুদার কান্ড বুঝতে পেরে রেদোয়ান হাত টেনে ধরলেন মুজাহিদ হাসানের একে একে সবাই বসিয়ে দিলো ঈশাদের পরিবারের সবাইকে।
মাহমুদা আহ্লাদী সুরে বলেন,
” এবার আপনাদের পালা আমরা বেড়ে খাওয়াবো।কোন দ্বিধা করবেন না কিন্তু ভাইজান..।”
চমকে গেলো সবাই।পোলাওর বাটি হাতে তুলে নিলো রুমা,চিংড়ির বাটি হাতে তুললো রেদোয়ান,ঈশান তুললো রোস্টের বাটি,অপরদিকে মাহমুদা সালাদের বাটি নিয়ে সবার প্লেটে সালাদ দিলেন।খালি হাতে দাঁড়িয়ে রইলো রাসেল কি করবে ভেবে না পেয়ে ভর্তার প্লেটার হাতে তুলে সবাইকে দিলো।
ঈশান সবার অগোচরে দাঁড়ালো ঈশার পাশে মুরগির আরেকটা লেগপিস তুলে দিলো তার প্লেটে।চমকে তাকালো ঈশা একটু আগে একটা নিয়েছে এখন আবার!তার চাহনি বুঝতে পেরে ঈশান স্বল্প সরে বলে,
” আমি জানি এটা তোমার পছন্দ খেতে থাকো।”
সব মিলিয়ে দিনটা সবার বেশ ভালো কাটলো।সুলতানা ভেবেছিলেন ঈশানদের পরিবারের মানুষগুলো বাদবাকি সবাই নিশ্চয়ই দাম্ভিক হবে,খুত ধরা স্বভাবের হবে বড়লোক বাড়ির মানুষ বলা তো যায় না কেমন।নিরহংকারী মানুষ খোঁজা যে আজকাল দায়।অথচ তার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করলো সবাই।এরা এত ভালো! প্রতিটা সদস্য অমায়িক।
৬২.
“ওষুধ খেয়েছিস ঈশা?”
হাসিনের প্রশ্নে জিভে কামড় বসালো ঈশা।ওষুধ খায়নি এই কথা শুনলে এখন এক গাদা লেকচার দেবে।এই মুহূর্তে তার লেকচার শোনার ইচ্ছে নেই।তবুও স্বল্প স্বরে বলে,
” ভ..ভুলে গেছিলাম দাঁড়াও খেয়ে আসি।”
” তুই বস আমি নিয়ে আসছি।”
শেষোক্ত বাক্যটি বলে স্থির রইলো না হাসিন।বড় বড় পা ফেলে দ্রুত নিয়ে এলো ঈশার ওষুধ।মুজাহিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
” মামা তোমার মেয়ে ভালো হবে না।নিয়মিত ওষুধ না খেলে এই আঙুল ভালো হবে?”
” তুমি অযথা চিন্তা করো ভাইয়া।”
” আমি অযথা চিন্তা করি?ধর তোর আঙুলে ইনফেকশন হলো এই আঙুল কে টে ফেলে দিলো তখন তোর জন্য বর পাবো কই?সবাই বলবে আঙুল কা টা ঈশা কেউ বিয়ে করবে না তোকে।”
” না করলে না করবে আমার বয়েই গেছে।”
” আমি যে বলেছিলাম তোর জন্য রাজপুত্র নিয়ে আসবো নাকি রাজা লাগবে তোর?”
” আমার রাজকন্যা ভাবি লাগবে
তোমার জন্য।”
কথাটি বলে হাসলো ঈশা।ভাই বোনের খুনশুটি দেখছিলো মুজাহিদ হাসান নিশব্দে হাসলেন তিনি।রুদবা ঈশার কোল ঘেষে বসেছে মুখোমুখি ঈশান এবং রাসেল।ঈশানের মনে হাসিনকে নিয়ে সন্দেহ বাঁধলেও ধীরে ধীরে তা পালটে গেছে।নিজেকে নিজে হাজারটা গাল দিতে ভুললো না।এটা কি তার রোগে পরিনত হয়েছে?এই যে কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে ওভার পসেসিভ হওয়া।
কিছুক্ষণ আলাপ সেরে বেরিয়ে পড়লো ঈশান তার সাথে গেলো রাসেল।সন্ধ্যা হতে বেশি সময় নেই সবাই এখন বাড়ি ফিরবে আর বাড়ি ফিরে আসার আগে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হবে সেই মুহূর্তে ঈশান থাকাটা বেমানান।রুদবাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষে গেলো ঈশা তার সাথে ছিলো অনু।বসার ঘরে মাহমুদা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন বলে বাকিদের জড়ো করেছেন।সুলতানার হাত ধরে আকুতি নিয়ে মাহমুদা বলেন,
” একটা আবদার রাখবেন আপা?”
” সাধ্যমতো হলে..”
” সাধ্যমতো চাইছি বোন।ঈশাকে আমাদের সবার ভীষণ পছন্দ।আমরা চাই আমার ঈশানের বউ করে তাকে ঘরে তুলতে।”
ক্ষণিকে হাসি মুখটা থমথমে হয়ে গেলো সবার।হাসিন শক্ত চোখে তাকালো মুজাহিদ হাসানের দিকে।সুলতানা কি বলবেন ভেবে পেলেন না।তাদের এলোমেলো চাহনিতে ঘাবড়ে গেলো রুমা ঈশারা আজ যদি ফিরিয়ে দেয় তবে যু দ্ধে র ময়দান তৈরি হবে বাড়িতে।পরিস্থিতি সামাল দিতে সে বলে,
” আমারা ঈশাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করি আঙ্কেল।আজ আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যে এটাই বলতে পারেন।তাছাড়া ঈশা কোন দিক থেকে অসুখী হবে না খালামনি দেশের বাইরে ফিরে গেলে সংসার তার একার।স্বামী সংসার নিয়ে সবটা তার।”
মুজাহিদ হাসান মাথা দুলালেন।এতক্ষণ মনে থাকা আনন্দেরা যেন নুইয়ে পড়েছে।মেয়ের বিয়ের কথা ভাবনায় আসতে শরীরটা কেমন নেতিয়ে যাচ্ছে,বুকটা দুরুদুরু করছে চোখটাও ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে।বড্ড আদরের মেয়ে এই মেয়েটাকে কি করে বিদায় দেবেন তিনি।
” আপনারা প্রস্তাব এনেছেন আলহামদুলিল্লাহ শুনে খুশি হয়েছি।তবে ঈশান কি এতে রাজি?আমার মেয়েকে বিয়ে কেন করবে সে?তার পায়ে পা লাগিয়ে চলতে গেলে আমার মেয়ে এক কথায় তার জীবন সাথী হিসেবে বেমানান।আরো উচ্চশিক্ষিত ভালো পরিবার ডিজার্ভ করেন আপনারা।”
” এ কথা বলেবেন না ভাইজান।অর্থবিত্ত আমরা চাই না আমরা চাই একজন ভালো মেয়ে।তার পরিবারটা যেন ভালো হয়।ঈশানের সম্মতি নিয়ে এই প্রস্তাব রাখছি।তাছাড়া ঈশানের সাথে শুরুর দিকটা আপনাদের বড্ড তিক্ততার ছিল আমি জানি তা নিয়ে আমি লজ্জিত।”
” দোষ আমার রক্তের ছিল আপন ভাইয়ের ছিল সে আমাকে বাজে ভাবে ফাঁসিয়ে দিলো।পাওনা দারের কোন দোষ নেই।”
” আমার উপর ভরসা রাখুন ভাইজান আমার ঈশান একটু মাথা গরম স্বভাবের তবে আপনার মেয়েকে ভীষণ ভালো রাখবে। আমাদের দিক থেকে সবার মতামত আছে বাকিটা আপনাদের হাতে।”
মুজাহিদ হাসান তাকালেন হাসিনের দিকে।ছেলেটা যেন কিছু বলতে চায়।তার চোখে মুখের অস্বাভাবিকতার ছাপ বুঝতে পারলেন তিনি।গলা ঝেরে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন,
” আমি আমার পরিবারের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত জানাবো।”
#চলবে__