অবাধ্য_বাঁধনে #পলি_আনান [পর্ব সংখ্যা ৩০খ]

0
489

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩০খ]
_____________________
বিকাল বেলায় বৃষ্টিটা বেশ কমে এসেছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেঘলা আকাশটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে মাহমুদার কাছে।এত বড় বাড়িতে তারা অল্প কয়েকজন ছেলেরা বাড়ির বাইরে থাকলে সবটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখে মাত্র বসার ঘরে ফিরলেন মাহমুদা।তখনি সদর দরজায় উপস্থিত হয় ঈশান ছেলেটার হাত রক্তে জবুথুবু।বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠলো মাহমুদার চপল পায়ে এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে।

” ঈশান কি হয়েছে তোমার?”

” বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার?সত্যিটা বলবে।”

” না হয়নি।কেন কি হয়েছে আগে বলো তোমার হাত কাটলো কি করে।”

” তোমার স্বামী কি পেয়েছে যা বলবে আমি তাই করবো?আজকে আমাকে বললো মেয়ে ঠিক করেছে আমি যেন সে দেশে যাই।এতই সোজা আম্মু?আমি যদি সবটা মেনে নিতাম তবে আমার বসবাস আজ এদেশে হতো না।আজ হাত কেটেছি আগামীকাল পা কা ট বো।আমার জেদ সম্পর্কে তুমি অবগত হেরফের হলে নিজের গলা কা টতেও দ্বিধা করবো না।

” ঈশান এসব কথা পরে হবে আগে তুমি….”

” আমি শেষ বারের মতো বলছি আম্মু আগামী এক সাপ্তাহের মধ্যে তোমরা ঈশার বাবার সাথে কথা বলবে।সব ফাইনাল করবে যদি না হয় এর ফল বেশি ভালো হবে না।”

ঈশান উপরে চলে গেলো।মাহমুদার শরীর কাঁপছে ছেলের এই হাল তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না।ছেলেটার হাতে ব্যান্ডেজ করা দরকার তিনি ছুটলেন ঈশানের রুমে।বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে ঈশান হাত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে সফেদ টাইলসে সেই রক্তের প্রতিটা ফোঁটা মাহমুদার বুকে তীরের ন্যায় বিঁধছে।

“এত গোঁ তোমার হাত কাটলে কিভাবে?”

” রুমার বাসায় ছিলাম ক্লাস চেপে ভেঙে দিয়েছি।”

“চলো ডাক্তারের কাছে যাই অনেকটা ক্ষত হয়েছে।”

” যাব কিন্তু আগে কথা দাও আমি যা বলেছি তাই হবে।”

” অবশ্যই হবে তোমার কথা শেষ কথা।বাবারে তোমার মায়ের আর এসব সহ্য হচ্ছে না।এবার তোমার হাতের কিছু একটা কর।”

ঈশান উঠে দাঁড়ালো টিস্যুর বক্স থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে চেপে ধরলো হাতে।তাতেও লাভ হলো না নরম টিস্যুটি তরলের সংস্পর্শে এসে নুইয়ে যাচ্ছে।সঙ্গে দুইজন গার্ড নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয় ঈশান।হাতে কেমন ঝিম ধরে গেছে অনুভব হচ্ছে কা টার যন্ত্রণার।অবশ্য রাগের দরুনে এতক্ষণ ব্যথা অনুভব হয়নি তার কিন্তু এখন রাগ পড়ায় প্রচন্ড অস্থির লাগছে।
৬৯.
সেই সময়ের পর ঈশানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ঈশা।ঈশান সেচ্ছায় ঈশার ফোন তুলেনি।রাত যত গভীর হলো ঈশার চিন্তা তত বাড়লো।রাসেল বলেছে ঈশান এখন ঠিক আছে কিন্তু মানুষটার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত মনে যে শান্তি হবে না।মুজাহিদ হাসান আর সুলতানা মিলে মুভি দেখছিলেন তাদের সাথে যুক্ত হতে ডাকা হয় ঈশাকে কিন্তু তার এখন মুভি দেখার মন নেই মন তো পড়ে আছে প্রেমিক পুরুষটার কাছে।বৃষ্টি নেই তবে রাতের আকাশ কি এখন স্বচ্ছ?হয়তো।জানলার সাহায্যে আকাশ দেখার চেষ্টা চালালো ঈশা কিন্তু বুঝতে পারলো না আকাশে মেঘ আছে কি না।ফোন বেজে উঠতে ছুটে গেলো সে।হ্যাঁ ঈশান ফোন করেছে এতক্ষণে তবে তার সময় হলো।

” ঈশান কেমন আছেন?”

” বেশ ভালো।তুমি জানলায় দাঁড়িয়ে কি খুঁজো?আমাকে?”

ঈশা কিঞ্চিৎ অবাক হলো সরু চোখে তাকালো রাস্তার বাঁকে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঈশানের গাড়ি দেখা যাচ্ছে ছেলেটা গাড়ির সামনে দাঁড়ানো।

” আপনি এখানে কেন?”

” নিচে নামবে?”

” না বাবা মা বসার ঘরে সম্ভব না।”

” আর অনু তোমার নাম করে বেরিয়েছে জানো?রাসেলের সাথে কথা বলছে আর তুমি আসবে না।”

ফিক করে হেসে ফেললো ঈশা।হেই হাসি দূর থেকে স্পষ্ট দেখলো ঈশান।কানে বেজে উঠলো ঈশার হাসির ঝংকার।

” মেয়েটা আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে প্রতিটা জায়গায়।ওদের দেখা করা জরুরি ঈশান।আগে বলুন আপনার হাতের কি অবস্থা?”

” পাঁচটা স্টিচ লেগেছে।”

” হঠাৎ কি এমন হলো যে এমন তুফান করলেন জানেন রুদবা রুমা আপু কতটা ভয় পেয়েছে।আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।”

” মাঝে মাঝে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়া ভালো এতে করে এটেনশন পাওয়া যায়।”

” অদ্ভুত আপনি।হাত ব্যথা করছে তাই না?”

” তোমার অধর স্পর্শে ঠিক হয়ে যাবে সব।আসবে তুমি?”

” এসব আবেগী কথা রাখুন আপনার এসব আমি সহ্য করতে পারবো না ঈশান।একটা মানুষ এতটা রুক্ষ কি ভাবে হয় যে নিজের যত্ন করে না।”

” তোমার যত্ন করলে তো হবে আর কি চাই?”

ঈশা নিশ্চুপ রইলো।বাইরে আকাশ ডাকছে আচমকা বিজলি চমকাচ্ছে।রুমের পর্দা টেনে বিছানায় বসলো ঈশা তার কণ্ঠে মিশে গেলো ভয়ের আদল।

” আকাশ ডাকছে ঈশান আপনি ফিরে যান।”

” তুমি জানলা থেকে সরলে কেন ভয় পাও?”

” হুম।”

” আমি আসবো?এসে ভয় দূর করে দেবো।”

” আপনি পাশে থাকাটাই আরেক ভয়।”

” তা কেনো?”

ঈশার প্রত্যুত্তত করার আগে আকস্মিক বাজ পড়লো কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো ঈশা।উঠে গিয়ে দ্রুত জানলা বন্ধ করে বিছানায় ফিরলো সে।ঈশান ঈশার কান্ডকারখানা বুঝতে পারলো।তাই মেয়েটার মন ঘুরাতে রসিয়ে বলে,

” ঈশা।”

” হুম।”

” বউকে চোখ টিপ দিয়ে রুমে ডাকার মতো ওয়েদার।”

” এই যে একটু আগে বলেছিলাম আপনি পাশে থাকাটাই আরেক ভয়।”

” আমাকে ভয়?”

“বুঝতে পারছি তো জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার মতো ওয়েদার আর আপনি বৃদ্ধি করেই ছাড়বেন”

ঈশা চট করে ফোন রাখলো।ঈশান স্তব্ধ, নিশ্চুপ, সে ভেবেছিলো ঈশাকে লজ্জা দেবে মেয়েটার কান গরম করে ছাড়বে আর এই মেয়েতো তার থেকে এক ধাপ উপরে।
.
আকাশের ডাকে ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো অনু কিন্তু রাসেলের সামনে তা প্রকাশ করা যাবে না।আজ সে রাসেলের সাথে অভিমান করেছে ভাব দেখিয়ে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।তার ভাব দেখে মনে মনে হাসছে রাসেল এই ভাব কতক্ষণ থাকবে সেও দেখবে।

” পড়তে বসেছো আজ?”

” আপনি আমার টিচার লাগেন?দেখা হলে সারাদিন পড়া পড়া করেন কেন?”

” ভালো কথা তোমার ভালো লাগে না তাই না?।”

” না লাগে না।আপনি হলেন আমার প্রণয় সংঘটিত শিক্ষক আর আপনি কি না সারাদিন পড়া নিয়ে পড়ে আছেন।একটু প্রেম প্রেম বুলি কি মুখে ফুটে না?”

” না ফুটে না। আমি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী।”

অনু আড় চোখে তাকালো রাসেলের দিকে।ছেলেটার সহজ সরল কথার বাঁক উলটো ধরে বসলো অনু।সে এগিয়ে এলো রাসেলের কাছে ডান হাতের সাহায্যে চুলে হাত বুলিয়ে স্বল্প স্বরে বলে,

” তুমি এত দুষ্টু কেন?”

” মানে?”

” কচি খোকা কিচ্ছু বুঝে না।”

রাসেল স্তব্ধ হয়ে রইলো।অনুর কথার মানে বুঝতে পেরে কান টেনে ধরলো তার।

” অল্প বয়সে পেঁকে গেছো।এতটা না পাঁকলেও হতো।”

_
ছেলের জেদের কাছে হারলেন মাহমুদা আর মাহমুদার জেদে হারলেন আবিদ।বিয়ের পর থেকে মাহমুদা এতটা অভিমান অভিযোগ করেনি যতটা না গত দু’এক দিনে করেছেন।ঈশান যেদিন বাড়ি ছেড়েছে এই মানুষটা শুধু কেঁদেছে প্রতিটা আর্তনাদে বলেছে, ” আমার ছেলে চলে গিয়ে ভালো করেছে এখানে তার জীবন জাহান্নাম হয়ে যেত।” ছেলের দূরত্বটাও হজম করলেন এই নারী কিন্তু দিনের পর দিন ছেলে বিগড়ে যাওয়াটা সহ্য করতে পারলেন না।আবিদের উপর একের পর এক চাপ পড়লে তিনি বাধ্য হন ঈশানের বিয়েতে সম্মতি জানাতে।নিজের স্ত্রীকে মোটেও কষ্ট দিতে চান না আবিদ গত দুইদিনে স্ত্রীর পা গ লামোতে মন মেজাজ সবটা ভোঁতা হয়ে গেছে তাই না চাইতেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।ঈশার বাবার সাথে কথা বলে ঈশা এবং ঈশানের এঙ্গেজমেন্টের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।ঈশার বাবার শর্ত অনুযায়ী যেদিন ঈশানের বাবা দেশে ফিরবেন সেদিন সব আলাপ আলোচনা সেরে বিয়ের আয়োজন করা হবে।ঈশান তাতে সম্মতি জানায় অন্তত যে করে হোক প্রেয়সীকে নিজের বলে দাবি করার মাধ্যম তো আছে।
৭০.
সিদুর রাঙা লাল জামদানি শাড়ি মানানই স্বর্ণের মোটা চেইন।ঠোঁটে চকচক করছে মেরুন রঙের লিপস্টিক।দুই হাতে লাল কাচের চুড়ি।লম্বা কেশ ছেড়ে দিয়েছে বাধাহীন।কপাল ছুয়ে গালে নেমেছে ক’গাচি চুল।রুমা আগাগোড়া পরখ করলো মেয়েটাকে।বিশেষ ভাবে তাকে কখনো পরখ করেনি রুমা কিন্তু আজ মেয়েটাকে দেখে চোখে মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি।ভাই বুঝি এই মেয়ের চোখে সুখ দেখেছে?
নাকি পূর্ণতার ইঙ্গিত পেয়েছে?চোখে হাসলো রুমা।ঈশার কানে দুল নেই ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে আছে গোল্ডেন রঙের এক জোড়া ঝুমকা।এই ঝুমকা পড়লে মেয়েটাকে পরিপূর্ণ লাগবে।

” ঝুমকা পরবে না ঈশা?কান তো খালি।”

ঈশা মাথা দুলালো রুদবাকে চুল আচড়ে দিচ্ছিলো সে।মেয়েটা বাসা থেকে তৈরি হয়ে এলেও বায়না ধরে বসলো তার ঈশামনির কাছে চুল বাঁধবে।

” পরবো আপু।রুদবারটা শেষ করি আগে।”

রুদবার চুল বাঁধা শেষে কানে দুল পরলো ঈশা।নিজেকে একবার আয়নায় দেখে বসে পড়লো রুমার পাশে।রুদবা এগিয়ে এসে থুতনিতে হাত রাখলো ঈশার।আদুরে সুরে হাসি মুখে বলে,

” জানো আম্মুর ফোনে আমি একটা কার্টুন দেখেছিলাম।সেখানে বউটা দেখতে তোমার মতো।না না তুমি সেই বউটার মতো।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রুদবা।তার হাসিতে হাসলো ঈশা।মেয়েটার নাক টেনে বলে,

” জানো আমি ফেইরি টেলসের একটা কার্টুন দেখেছিলাম হোয়াইট গাউনে একটা প্রিন্সেস ছিলো সেই প্রিন্সেটা দেখতে একদম তোমার মতো।একদম মিষ্টি মিষ্টি।”

দুজনের খুনশুটিতে হেসে উঠলো অনু।ঈশার পুরো রুমটা গুছিয়ে রাখছিলো সে।এবার পালা নিজেকে সাজানোর গোল্ডেন রঙের একটি থ্রিপস নিয়ে প্রবেশ করলো ওয়াশরুমে।আজ ঈশার এঙ্গেজমেন্ট অনুষ্ঠান।স্বল্প আয়োজনে পুরো ঘরটা সাজানো হয়েছে।বর পক্ষে আসার আগে রুমা বেশ তাড়াতাড়ি এসে বসে আছে এর পেছনেও অবশ্য একটা কারণ আছে আর সেটা হলো রুদবা।মেয়েটা বায়না ধরেছে ঈশামনিকে দেখবে।না পেরে সবার আগে মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো রুমা।

নিজেকে পরিপাটি করে আয়নায় তাকালো ঈশা।আজ সারাটা দিন বোধহয় তার অস্থিরতায় কাটবে।বার বার চোখে ভেসে উঠছে সেদিনের স্মৃতি যেদিন ঈশানের সাথে প্রথম দেখা। প্রথম আলাপনটা ছিল তাদের ঝগড়ার মাধ্যমে।এই মানুষটাকে যতটা অপছন্দ করতো তার থেকেও বেশি এখন ভালোবেসে ফেলেছে।মেসেজের টোনে ধ্যান ভাঙে ঈশার।ঈশান মেসেজ পাঠিয়েছে,

” বেশি সাজসজ্জার প্রয়োজন নেই।যদি আমার মন ঘুরে যায় মেয়ে তবে মনে রেখো আজকে বাপের বাড়িতে তোমার শেষ দিন হবে।”

এই কথার মানে ঈশা কি বুঝেছে?হয়তো হ্যাঁ।তাই তো মেয়েটার চোখে মুখে লজ্জার হাসি।
#চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here