#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৩]
___________________
সকালে ঘুম থেকে কার মুখ দেখে উঠেছিল সেটা ভেবে অস্থির অনু।না জানি কার চাঁদবদন মুখখানি দেখে তার জীবনে শনির আগমন ঘটেছে।কুরিয়ার থেকে কল আসায় পার্সেল আনতে কুরিয়ারে যাচ্ছিলো অনু।বিকাল বেলায় ঈশার টিউশনি থাকে তাই পার্সেলের উদ্দেশ্যে একাই বেরিয়েছিল সে।রাস্তার অর্ধেকটা যেতে পথ আটকে দাঁড়ায় কয়েকজন লোক।তাদের পরনে ছিল কালো স্যুট সাদা শার্ট।দলের যে প্রধান তার পকেটে একটা পিস্তল সাদৃশ্যমান।আর তা দেখে ভয়ে আত্মা উড়ে যাওয়ার অবস্থা অনুর।লোক গুলোর ভাব গম্ভীরতা দেখে অনু বুঝে নিয়েছে এরা ঈশানের লোক।তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির মাঝে একজন কাউকে ফোন করে তাদের অবস্থান বলছিলো অপরদিকে অনুর কাচুমাচু মুখ দেখে দলের প্রধান বলে,
” ভয় পাবেন না মেম।আমাদের ঈশান স্যার পাঠিয়েছেন।স্যার শুধু আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।”
” আমার সাথে তার কী কথা?”
” সে সব আমরা জানি না মেম।”
অনুর গলাটা শুকিয়ে এলো।ঈশান শাহরিয়ার বড্ড ডেঞ্জারাস লোক তার চোখে পড়া মানে সহজ সরল আনন্দের জীবনটাকে আতঙ্কের খাতায় নাম দেওয়া।লোকগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কারো মুখে রা নেই।আশেপাশে খুব বেশি পথচারী মানুষের বালাই নেই।রাস্তাটা নিরিবিলি।কয়েকটা গাড়ি ছুটে চলছে তার গতিতে।কিছুক্ষণ পরপর আসা রিক্সাওয়ালারা অনুর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে।দূর থেকে কালো গাড়িটা দেখে অনু নিশ্চিত হয় এটা ঈশানের গাড়ি।
ঈশান গাড়ি থেকে নেমে গার্ডদের সরে যেতে বলে।অনু বেচারি ঘেমে একাকার।ঈশানকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে অফিস থেকে এখানে এসেছে।
” তোমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি বলে দুঃখিত।”
দুঃখিত!ঈশানের মুখ এই শব্দটা ঠিক হজম করতে পারলো না অনু।ছেলেটা এতো বিনয়ী হয়ে কথা কেন বলছে তার সাথে?”
” কি বলবেন বলুন।”
” কোথাও বসে কথা বলা যাক।”
” আমার তাড়া আছে আপনি এখানেই বলুন।”
” রাসেলের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?”
সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো অনু।এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
” আমার সাথে রাসেলের কোন সম্পর্ক নেই।”
” সত্যি বলছো?”
” মিথ্যা বলবো কেন?”
ঈশান সরু চোখে তাকালো অনুর দিকে।মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে অথচ মিথ্যা বলতে একবারেও কলিজায় লাগলো না?
” অনু আমি জানি তোমাদের মাঝে কিছুতো চলছে।যদি আমার ধারণা ঠিক হয় তাহলে.. ”
” আপনি উলটা পালটা ভেবে নিলে তো আর হবে না।আমার আর রাসেলের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই।ঈশার গলায় আঘাত লাগলে তখন তিনি আমার নাম্বার নিয়েছিলেন।ব্যস এইটুকুই আমাদের মাঝে আর কোন যোগাযোগ নেই।”
ঈশানের রাগটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি দ্বিধাহীন একের পর এক মিথ্যা বলছে অথচ সত্যিটা সে জানে।ঈশান নিজের ধৈর্যের তারিফ করলো।অনুর পরিবর্তে যদি এতক্ষণ অন্য কেউ হতো তাহলে তো হয়েই যেতো।রাসেল নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো।সোজাসাপটা বললো,
” শেষ বারের মতো জানতে চাই রাসেলের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?”
” আর কয়…”
অনুর কথার মাঝে একটা কার থেকে ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটি ইচ্ছাকৃত গাল ভরতি থুথু ছুড়ে জানলার বাইরে ছুড়ে। আর সেই থুথু ঈশানের পায়ের কাছে পড়ার আগে ছিটকে সরে যায় সে।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডরা দ্রুত সেই গাড়ি আটকে ধরে।ড্রাইভারের কাজটা ঈশানের সম্মানে আঘাত লেগেছে।তাইতো নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে বরাবরের মতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।একজন গার্ড দরজা খুলে লোকটাকে টেনে হিচড়ে বের করে ঈশানের পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলে ঈশান হাটু মুড়ে বসে পড়ে লোকটার সম্মুখে।
” কার সাথে বেয়াদবি করিস?এত সাহস।”
” মাফ করুন স্যার আর হবে না।”
” তুই কার হাতে পড়েছিস ধারণা করতে পারছিস না।পরবর্তীতে তোর মুখে থুথু আসার আগেই গিলে ফেলবি।”
ঈশান উঠে দাঁড়ালো একজন গার্ড এগিয়ে এসে হাতে জ্বলন্ত সিগারেটটা লোকটার ঠোঁটে চেপে ধরলো।সবটা নিজের চোখে দেখে জান যায় যায় অবস্থা অনুর।ঈশান পুণরায় অনুর মুখোমুখি দাঁড়ালো এবং শান্ত সুরে বলে,
” কি বলছিলে যেন?”
অনু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সত্যটা প্রকাশ করবে।ঈশান নিশ্চয়ই কোন সংকেত পেয়েছে আর সেই কারণে তার কাছে জানতে চেয়েছে।যদি সে মিথ্যা বলে তার অবস্থা যে ড্রাইভারের মতো হবে না তার কি গ্যারান্টি?
” রাসেলের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ কয়েক মাস যাবৎ।আমাদের পরিচয় ফেসবুকে।আমরা দুজনে বন্ধুর মতো তবে রাসেলের দিক থেকে এর চেয়েও বেশি আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন।”
” হুম বুঝলাম।আমি যে তোমার কাছে এসব জানতে চেয়েছি তুমি কী তা রাসেলকে বলবে?”
” এ..একদমি না।কোনদিন না আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
” গুড গার্ল।তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট খুঁকি।আজ আসি আবার হয়তো দেখা হবে।”
২৬.
অনুর সাথে দেখা করে পুণরায় অফিস ফিরলো ঈশান।ক্লান্ত দেহটা ছেড়ে দিলো চেয়ারে তার পিছন পিছন কেভিনে প্রবেশ করে রাসেল।ঈশান হঠাৎ কোথায় ছুটে গেল সেটাই জানতে চাইছে সে।কিন্তু ঈশান নাছোড়বান্দা লোক সে কিছুতেই তার মুখ থেকে সত্যি প্রকাশ করবে না।ব্যর্থ হয়ে রাসেল বসে পড়লো ঈশানের পাশে।হাতে থাকা ফোনটা স্ক্রুল করতে করতে ঈশার দেওয়া সাম্প্রতিক পোস্ট তার নজরে আসে।ঈশা একটা ছবি পোস্ট করেছে। যে ছবিতে শাড়ি পরা ঈশার হাস্যজ্বল মুখ সাদৃশ্যমান।রাসেল বুকের বাম কোনে হাত ঠেকালো মোবাইলটা চোখের কাছে নিয়ে ঈশানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” এভাবে চলতে থাকলে একদিন হার্ট এটাক হয়ে যাবেরে।”
” মানে?”
” দেখ।”
রাসেল ফোনটা এগিয়ে দিলো ঈশানের কাছে।ঈশান ঈশার ছবিটা দেখে নিজেও ঘাবড়ে গেল।আকাশী রঙা শাড়িতে মেয়েটা একটু বেশি সুন্দর লাগছে।মাথার উপর নীল আকাশটা যেন শাড়ির সাথে মিশে গেছে।
গলার টাইটা হাতের সাহায্যে টেনে দিলো ঈশান তার বড্ড হাঁশফাঁশ লাগছে।ঈশার ছবি দেখে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কি আছে অদ্ভুত।
” তুই নাটক করছিস কেন রাসেল?”
” আমি নাটক করছি?”
” তুই ঈশাকে সত্যি ভালোবাসিস?আমার তো মনে হয় না।তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস?”
ঘাবড়ে গেল রাসেল।টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক শব্দে দ্রুত শেষ করলো পানি।নিজেকে ঝেরে কেশে স্থির হয়ে বলে,
” শুন ধরে নে আমি দুই চারখানা প্রেম করছি।তবে বিয়ে ঈশাকেই করবো আন্টির পছন্দের মেয়ে বলে কথা।”
” তুই মায়ের কথায় বিয়ে করতে চাইছিস?তুই ঈশাকে বিয়ে করতে না চাইলে আমায় বল আমি মাকে সামলে নিব তুই..”
” তুই বেশি ভাবছিস ঈশান।আমি রাজি আছি।তুই বরং আন্টিকে যত দ্রুত সম্ভব দেশে আসতে বল।”
রাসেল বেরিয়ে গেল।ঈশানের রাগ লাগলো নিজের উপর।এই ছেলেটা চাইছে কী?অনুর সাথে প্রেম ঈশার সাথে বিয়ে এমন মানুষ তো রাসেল নয়।এমন উদ্ভট রাসেলকে ঈশান চেনে না আর চিনতেও চায় না।
২৭.
টিউশনি থেকে এক সাপ্তাহের ছুটি পেলো ঈশা।আর সেই সুযোগটা কাজে লাগালো সে।হাসিন এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো আজকে ঈশাকে নিয়ে যাবে বলে অপেক্ষা করছে।ঈশা ব্যাগপত্র গুছিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।তখনি ঈশাদের বাসায় আসে অনু।
” ঈশুরে আমিও রেডি।উফফ কতদিন পর তোর ফুফির বাড়ি যাব।”
” হাসিন ভাই অপেক্ষা করছে এবার চল।”
ঈশা অনু দুজনে বেরিয়ে পড়লো।মুজাহিদ হাসান তাদের যাওয়ার সুবিধার জন্য একটা সিএনজি ভাড়া করলেন।
.
মধ্যরাতে অফিসের ফাইলগুলো পুনরায় চেক করছিলো ঈশান।তার পাশে বসে রাসেল টুকটাক কাজ সারছে।তাদের আগামীকাল সকালে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে তাই তো নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে।সেন্টার টেবিলে থাকা ফোনটা বেজে উঠতে মনোযোগ ভঙ্গ হলো ঈশানের।দ্রুত হাতে ফোন ধরে “Ma” নামটি দেখে হাসিমুখে রিসিভ করে।
” হ্যাঁ মা বলো।”
” জেগে ছিলি?”
” হুম অফিসের কাজ করছিলাম।”
” আমি দেশে আসছি ঈশান।”
মায়ের কথা শুনে স্তব্ধ ঈশান।কত বছর পরে মা আসবে তার কাছে আসবে এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।বুকের ভেতরে থাকা হাহাকার এবার ঘুচবে তবে।
” কবে আসবে মা?এই দিনের অপেক্ষায় আমি কত বছর যে প্রহর গুনছি।”
” তোর বাবা অনুমতি দিয়েছে শীঘ্রই আসবো বাবা।তোকেও তোর হাতের কাজ খুব শীঘ্রই সারতে হবে।ঈশার পরিবার রাজি থাকলে বিয়েটা খুব দ্রুত সারতে চাই।”
” অবশ্যই মা রাসেলের বিয়ে তো ঈশার সাথেই হবে।তুমি কোন চিন্তা করো না আমি আমার দিক থেকে সব ব্যবস্থা করে রাখবো।”
হাতের কলমটা রেখে ঈশানের কাছে বসলো রাসেল।ঈশার সাথে বিয়ে মানে?সে এখন বিয়ে করতে চায় না তাছাড়া ঈশা কে তো কখনোই না।
ঈশান কান থেকে ফোন সরাতে রাসেল অস্থির হয়ে বলে,
” ঈশান কিসের বিয়ে আন্টি কি বলছে?”
” তোর বিয়ের কথা বলেছে।”
” কখনো না।আমি এখন বিয়ে করবো না।”
” কেন করবি না?”
” ঈশান তোকে একটা সিরিয়াস কথা বলছি আমি ঈশাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
” কেন পারবি না?এতদিন আমার ভাবী ভাবী বলে কানের পর্দা ফাটিয়েছিস এখন বিয়ে করবি না মানে?”
” আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি।প্লিজ ঈশান তুই বোঝার চেষ্টা কর।তুই ঈশার পেছনে পড়ে ছিলি তাই না পেরে আমি ঈশাকে তোর হাত থেকে বাঁচাতে এসব বলেছি।কারন আমি জানি তুই কখনো আমার ওয়াইফের সাথে বাজে ব্যবহার করবি না।আর আন্টিকে তুই বুঝিয়ে বলিস আমি বললে নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পাবেন।”
“তাহলে ঈশার প্রতি তোর কোন ফিলিংস নেই?”
” আরে ভাই নারে।”
রাসেল উত্তেজিত হয়ে পড়লো।ছেলেটা একটু একটু ঘামছে ঈশান রাসেলকে জব্দ করতে পেরে বেশ খুশি।
” ঠিক আছে এরপর থেকে ঈশার সাথে যা যা হবে তাতে তোর কোন মতামত আমি গ্রহণ করবো না রাসেল।”
” যা যা হবে মানে?কি বলতে চাস তুই?”
” আমি আর কি বলবো।কথা তো সময় বলে।সময়ের অদলবদলে সব পাল্টে যায় হোক সেটা বন্ধু কিংবা শত্রু।”
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ ❌