ফিরে_আসা ৩+৪

0
1116

#ফিরে_আসা
৩+৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আরশাদের ঘরের দরজায় অনবরত ধাক্কা দিতেই যাচ্ছে অরা। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো প্রকার সাড়া-শব্দ নেই। তবুও ক্ষান্ত হবার কোনো ভাবলক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। প্রবল জেদী এবং ধৈর্যশীল মেয়েটা। আরশাদ দরজা না খোলা পর্যন্ত ক্লান্ত না হয়ে অনবরত দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার আছে।

অবশেষে বদ্ধ দরজার অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো আরশাদের বিরক্তিমাখা কণ্ঠস্বর, “গেট আউট মতিউর!”

অরা শুকনো ঢোক গিলে উঁচু গলায় বলল, “স্যার আমি অরা।”

অপরপ্রান্ত থেকে আর কোনো আওয়াজ এলো না।

অরা শান্ত গলায় বলল, “স্যার প্লিজ একবার দরজাটা খুলুন। আপনাকে মেডিসিন নিতে হবে।”

আরশাদ ভেতর থেকে থমথমে গলায় বলল, “আমি দরজা খুলবো না। তুমি চলে যাও।”

অরা জেদী হলেও আরশাদের জেদের কাছে তা কিছুই না। একবার যখন বলে দিয়েছে দরজা খুলবে না, তখন কিছুতেই খুলবে না। আপাতত দরজার সামনে থেকে সরে গেল অরা। বেশিক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলে আরশাদ রেগেমেগে ভয়ংকর কিছু ঘটাতে পারে।

এই বিশাল দোতলা বাড়িতে আরশাদ একা থাকে। এখান থেকে সামান্য দূরেই একটা ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে কেবল মাত্র তার টিমের সদস্যদের জন্যে। সেলিব্রিটি মানুষেরা সাধারণের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চায় না। সিনেমার অন্যান্য সাধারণ অভিনেতাদের কস্টিউম যে ডিজাইন করে, সে কী আরশাদের মতো বড় সেলিব্রিটির কস্টিউম ডিজাইন করবে? আরশাদের রয়েছে নিজস্ব কস্টিউম ডিজাইনার। এছাড়াও নিজস্ব মেকাপম্যান, হেয়ার ড্রেসারও। আরশাদ আবার বারো মাস ডায়েট করে। তার ডায়েট অনুযায়ী রান্না করা সকলের সাধ্য নয়। এছাড়া এর তার হাতের রান্নাও খেতে পারে না। একজন সুদক্ষ বাবুর্চিও রয়েছে তার টিমে।

এমন নামকরা একজন তারকা, অথচ তার কোনো শত্রু থাকবে না – এটা তো হয় না। আরশাদেরও রয়েছে। যে মানুষগুলো তাকে খ্যাতির শিখরে দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে যায় সেই মানুষগুলোই তার শত্রু। শত্রুপক্ষ চাইলে কোনো একদিন অতর্কিতভাবে তার ওপরে হামলা-টামলা করে বসতে পারে। এমন নির্মমভাবে কোনো মানুষের হাতে মরতে চায় না আরশাদ। এ কারণেই সে যেখানেই যায়, তার সঙ্গী হয় ঝড়-তুফান। সিনেমার জগতে প্রায় সকলেই নকল নাম ব্যবহার করে। ঝড়-তুফানও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দুই ভাই রাশিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। সর্বক্ষণ এদের পরনে কালো পোশাক, চোখে সানগ্লাস আর কাঁধে ঝুলন্ত লাইসেন্স করা বন্দুক। টিমের এই সকল সদস্যরা শুটিংয়ে আরশাদের সঙ্গে যায়। শুটিং বাদে অন্যান্য মিটিংয়ে কেবল ঝড় ঝড়-তুফান এবং অরা যায়।

একটা মানুষের এত ক্ষমতা, চারপাশে ভক্তদের এত ভালোবাসা, সামান্যতম কাজ করার জন্যেও যার রয়েছে কর্মচারী তার কীসের এত জেদ কে জানে? নিজেকে কষ্ট দেওয়া আরশাদের বরাবরের অভ্যাস। নিজেকে দেওয়া এই কষ্টই যেন তার কাছে আনন্দের। টিমের সকলে দীর্ঘদিন ধরে খুব কাছ থেকে দেখছে সুপারস্টার আরশাদ হককে। ভক্তদের কাছে সে অসম্ভব বিনয়ী, স্বল্পভাষী এবং উদার প্রকৃতির। তবে ব্যক্তিগত জীবনে আরশাদ যেন একটু বেশিই অন্যরকম।

বসার ঘরের সোফায় এসে বসলো অরা। সঙ্গে সঙ্গে কফির মগ হাতে আগমন ঘটলো মতিউর।

মতিউর মগটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে চিন্তিত স্বরে বলল, “স্যার কি দরজা খুলছে আফা?”

অরা কফির মগে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল, “উহুঁ।”

“খালাম্মারে একটা ফোন দেই?”

অরা হতাশ গলায় বলল, “আপনার কি লজ্জা নেই মতিউর ভাই? গতবার যখন স্যার মাইগ্রেন নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে ছিলেন তখনও উনাকে ফোন করেছিলেন। পরে কী ঝাড়িটাই না খেলেন স্যারের কাছে!”

আরশাদের মা সেলিনা হক থাকেন সিলেটে। ছেলে বিরাট তারকা হওয়া সত্বেও তার স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত ছোট্ট বাড়িটায় রয়ে গেছেন। মাস দুয়েক আগে ঠিক এভাবেই মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছিল আরশাদের। আরশাদ যথারীতি ওষুধপথ্যের ঝামেলা এড়িয়ে নিজেকে ঘরে বন্দি করেছে রেখেছে। মতিউর অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করে বসে সেলিনা হককে। আরশাদের মাথা ব্যথা ওই দিনই সেরে গেলেও পরদিন সকালে সেলিনা এসে হাজির এ বাড়িতে।

কোনো এক অজানা কারণে আরশাদ তার মায়ের মুখোমুখি হতে চায় না। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মায়ের আগমনে তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে বেচারা মতিউরের ওপরে।

মতিউর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গেরামে গেলে সকলে কয়, নায়কের বাড়িত কাম করো তোমার মতো সুখী কয়জন? তারারে কে বোঝাবে আসলে কী জ্বালা? পারলে কবে এই কাম ছাইড়া দিতাম। মানুষটার মায়ায় পড়ে গেছি বইলা পারি না।”

আরশাদের জন্যে এই মানুষটার উদ্বেগ যেন একটু বেশিই। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। ক্যারিয়ার প্রায় শুরু থেকেই আরশাদের সঙ্গে আছে মতিউর।

অরা বলল, “ডাক্তারকে খবর দিন মতিউর ভাই।”

“ডাক্তাররে খবর দিয়া লাভ কী? স্যারে তো দরজাই খুলে না।”

“তাতে কী? ডএসে বসে থাকুক, স্যার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তো তাকে প্রয়োজন হবে।”

মতিউর ঘাড় নেড়ে চলে গেল। আনমনে অরার
চোখ পড়ল দেওয়ালে ঝুলন্ত প্রকান্ড ছবিটার দিকে। সিলেটের কোনো এক চা বাগানে তোলা ছবি। পেছনে ডুবন্ত সূর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরশাদ। আরশাদের কোলে ছয় মাস বয়সী কথা। বাচ্চাটা এ বাড়িতে থাকলে বেশ ভালো হতো। কথা যদি একবার তার কোমল হাতে দরজায় টোকা দিয়ে তার বাবাকে বেরিয়ে আসতে বলতো, আরশাদ কি পারতো এই সমস্ত জেদ ধরে রাখতে?

আরশাদ এমনটা ছিল না। চাকরির চার বছরের প্রথম বছরটায় অরা দেখা পেয়েছিল ভিন্ন এক আরশাদের। সেই আরশাদ হাসি মুখে সকলের সঙ্গে কথা বলতো, কঠিন পরিস্থতিতে নিজের স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতো, মাসে দুমাসে একবার স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতো, কাজে একটু অবসর পেলেই ছুটে যেত মায়ের কাছে। সেই মানুষটা হঠাৎ করেই বদলে গেল।

হঠাৎ করে বললে ভুল হবে, ডিভোর্সের পর। আরশাদের আকাশচুম্বী খ্যাতিতে ডিভোর্সের মতো নেতিবাচক ঘটনার কোনো আঁচই পড়েনি। বরং তার কর্মজীবনের সাফল্য হয়ে উঠেছে আরও শতগুণ উজ্জ্বল। সুপারস্টার আরশাদের জীবন যতটা উজ্জ্বল হয়েছে, ব্যক্তি আরশাদের জীবন হয়েছে ঠিক ততই নিষ্প্রভ। নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছে সে। কাজের বাইরে সারাক্ষণ চোখমুখে স্থায়ী হয়ে থাকে বিচিত্র এক কাঠিন্য। বছর পেরিয়ে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না। মায়ের সঙ্গেও কথা হয় না বহুকাল।

তার এই বদলে যাওয়ার পেছনে ডিভোর্সই কি একমাত্র কারণ? ডিভোর্স নিয়ে আরশাদকে কখনোই খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হয়নি অরার। নওশীনের প্রতি তার মনে কোনপ্রকার অনুভূতি অবশিষ্ট থাকাও অসম্ভব। ডিভোর্সের পর থেকে আরশাদ তাকে সহ্য করতে পারে না। নওশীনের নামটা শুনলেও যেন রাগে তার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে।

নওশীন যদিও চেয়েছিল সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্সের পর স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক বজায় রাখতে। মূলত তা সম্ভব হয়নি আরশাদের জন্যেই।

অরার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে – সে এখানে বসে আছে কেন? অনেক দিন পর একটা ছুটির দিন পেয়েছে। কোথায় আরাম করে ঘুম দেবে, সীমার সঙ্গে সিনেমা দেখবে! স্যারের জেদ ভাঙিয়ে দরজা খোলানো নিশ্চয়ই ম্যানেজারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আরশাদ তাকে এই দায়িত্ব পালন করার নির্দেশও দেয়নি।

মেয়েমানুষ হওয়ার এই জ্বালা! কারোর যন্ত্রণা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। বিশেষ করে যে মানুষটা অরার জীবনটাকে বদলে দিয়েছে, তার যন্ত্রণা এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এছাড়াও মতিউরের মতো সেও মানুষটার মায়ায় পড়ে গেছে।

অরার সাত-পাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়লো রিংটোনের শব্দে। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সীমার নাম। মেয়েটা নিশ্চয়ই ভার্সিটি থেকে ফিরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে তীক্ষ্ণ তীরের মতো ছুটে এলো প্রকান্ড এক ধমক, “কোথাও তুই? এতক্ষণ লাগে বাসায় ফিরতে? তুই কি এখনো ওই সাবেরের সাথে রয়েছিস? শুনে রাখ অরা, তুই যদি আবারও ওই ছেলেটার কাছে ফিরে যাস তাহলে এই বাসায় ফিরে আসবি না।”

অরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো এতসব ঝামেলার ভিড়ে সে ভুলেই গিয়েছিল আজ দুপুরে কয়েক মিনিটের জন্যে সাবেরের সঙ্গে হওয়া সেই কথোপকথনের ব্যাপারটা। কী আশ্চর্য ব্যাপার! যে মানুষটাকে এক সময় সবথেকে বেশি ভরসা করতো, আজ তার কথা ভেবে এক সেকেন্ডও অপচয় করছে না মস্তিষ্ক।

অরা থমথমে গলায় বলল, “আমি তোর ক্রাশের বাড়িতে।”

সীমা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আরশাদের বাড়িতে? তোর না আজ ছুটি?”

অরা আক্ষেপের সুরে বলল, “আর ছুটি! যতদিন এই চাকরি আছে, ততদিন মনে হয় না কোনো ছুটি পাবো।”

“ওই বদটার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলিসনি তো?”

“না।”

“ভেরি গুড। তোর ফিরতে কি দেরি হবে?”

“বুঝতে পারছি না। চেষ্টা করবো সন্ধ্যার আগে ফিরতে।”

সীমার সঙ্গে কথা শেষ করে অরা ডায়াল করলো আরশাদের নম্বর। অনবরত দরজায় ধাক্কা দিয়ে এক দফা বিরক্ত করা হয়েছে। এবার আরেকদফা বিরক্ত করা হবে অনবরত ফোন দিয়ে। অরা বারবার আরশাদের নম্বরে ডায়াল করছে, আর বারবার অপরপ্রান্ত থেকে কল কেটে দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে অরা খেয়াল করলো আরশাদের নম্বরে কল যাচ্ছে না। কারণ একটাই, বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে আরশাদ নিজের ম্যানেজারকেই ব্লক করে দিয়েছে।

অরাকে অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা বিচলিত বলে মনে হলো না। এর আগেও সে বহুবার তার স্যারের কাছে ব্লক খেয়েছে। শুটিংয়ের সময় সাধারনত আরশাদের ফোনটা তার কাছে থাকায় নিজ দায়িত্বে সেই ব্লক তুলেও ফেলেছে।

ডাক্তার ইশতিয়াক ইতোমধ্যে চলে এসেছেন। আরশাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তিনি। এছাড়াও ঢাকার নামী এক হাসপাতালে চেম্বার আছে তার।

ড. ইশতিয়াক চিন্তিত গলায় বলল, “স্যারকে গত মাসে যে মেডিসিনগুলো দেওয়া হয়েছিল সেগুলো কি রেগুলার নিচ্ছেন?”

অরা না-সূচক মাথা নাড়লো।

“কোনো মানে হয়? আমি উনাকে বারবার বুঝিয়েছি মেডিসিনগুলো রেগুলার না নিলে তিনি ক্রমশ আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমি দুয়েকবার মেডিসিনের কথা বলে ধমক খেয়েছি। একটা মানুষ যদি নিজের ভালো নিজেই না বুঝতে পারে তাহলে আমার কী করার আছে বলুন?”

ড. ইশতিয়াক হতাশ গলায় বললেন, “আমি বুঝি না স্যার কেন নিজের চিকিৎসার বেলায় এতটা উদাসীন। তিনি বাংলাদেশের অ্যাসেট। উনার কোনো ক্ষতি হওয়ার অর্থ ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “ভালো কথা বললেন তো! আমি আসছি।”

সঙ্গে সঙ্গে অরা উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে আবারও চলে গেল আরশাদের ঘরের সামনে।

দরজায় ছোট্ট টোকা দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “স্যার? ইশতিয়াক সাহেব এসেছেন। একবার দরজাটা খুলবেন, প্লিজ?”

অপরপ্রান্ত থেকে কোনপ্রকার সাড়াশব্দ এলো না। সেটাই তো স্বাভাবিক। আরশাদ একবার যখন ঠিক করেছে দরজা খুলবে না, তখন সমগ্র পৃথিবী উল্টে গেলেও খুলবে না।

অরা আবার বলতে লাগলো, “কাল থেকে কিন্তু আবারও শুটিং শুরু হচ্ছে স্যার। এখন যদি আপনি দরজা না খোলেন, তাহলে ইশতিয়াক সাহেব আপনার ট্রিটমেন্ট করতে পারবেন না, আপনি সুস্থও হতে পারবেন না। আগামীকাল শুটিংও করতে পারবেন না। আমি কি তাহলে ডিরেক্টরকে ফোন করে বলবো শুটিং ক্যানসেল করতে?”

ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ নায়ক-নায়িকা সফলতার স্বাদ পাওয়া মাত্রই অহংকারে ডুবে যায়। কাজের প্রতি মনোযোগ তাদের হারিয়ে যায়। মনে করে এখন তো তারা সফল নায়ক-নায়িকা, অতিরিক্ত পরিশ্রম না করলেও তাদের সিনেমা হিট হবে। তাই দেরি করে সেটে যাওয়া, যখন তখন শুটিং ক্যানসেল করা হয়ে দাঁড়ায় তাদের প্রতিদিনকার অভ্যাস।

সেদিক থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম আরশাদ। ব্যতিক্রম বলেই হয়তো সফলতার শিখরে অবস্থান তার। নিজেকে অবহেলা করলেও কাজকে কখনোই অবহেলা করতে পারবে না সে। ক্যারিয়ারের এতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে, এত এত সিনেমা সাফল্যের খাতায় নাম লিখিয়েছে, তবুও কাজের প্রতি তার উৎস একাগ্রতা ঠিক আগের মতই।

দীর্ঘ নীরবতার পর অবশেষে ভেতর থেকে শোনা গেল আরশাদের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, “টু ফোর জিরো নাইন।”

অরা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুদ্ধি তার মস্তিষ্কে তরঙ্গের মতো খেলে বেড়ায়। তাই এলোমেলো এই সংখ্যাগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে এতটুকুও অসুবিধা হলো না তার। সংখ্যাগুলো দরজার লকের পাসওয়ার্ড। শত্রুর অভাব নেই বলেই আরশাদের এই বাড়িতে হাই সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবগুলো ঘরের দরজায় পাসওয়ার্ডযুক্ত লক। সঠিক পাসওয়ার্ড ছাড়া এই লক খোলার উপায় নেই, কেউ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে এলার্ম বেজে উঠবে।

এক মুহূর্তের জন্যে নিজের প্রতি মুগ্ধ হলো অরা। আরশাদকে দরজা খোলাতে সক্ষম হয়েছে বলে নয়, তার বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বলে। আরশাদের যে ঘরটাতে থাকে তার পাসওয়ার্ড একমাত্র আরশাদ ছাড়াও কেউ জানে না। এমনকি মতিউরও না। আর সেখানে এতটা অবলীলায় অরাকে সেই পাসওয়ার্ড বলে দিলো?

ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে, জানালার পর্দা টেনে দেওয়া। পর্দায় ফাঁক থেকে এক চিলতে আলো ঘরে এসে পড়লেও তার তীব্রতা অতি ক্ষীণ। ছোট ছোট পা ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেও কী যেন একটা পায়ে বাঁধলো। অরা নিচে তাকিয়ে দেখলো অসংখ্য কাগজ-পত্র, বিশাল একটা ডায়েরি আরও কী সব হাবিজাবি মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সবই আরশাদের হোমওয়ার্ক। শুটিংয়ের আগে নিজের চরিত্র নিয়ে খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা এবং পর্দায় সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া তার সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ।

কাগজগুলো সাবধানে মেঝে থেকে তুলে টেবিলের ওপরে রাখলো অরা। ঘরের আবহাওয়া হিমশীতল, প্রচন্ড শীতে গা কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ ধরে এসি চলছে কে জানে? বিছানার পাশে থাকা সাইডটেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে এসি বন্ধ করে দিলো অরা। তবুও কমছে না শীতের তীব্রতা।

ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল অরা। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আরশাদ। অরা হাঁটু গেঁড়ে তার মাথার কাছে মেঝেতে বসে পড়লো। ঘরে আলো নেই তবুও অরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মলিনতায় ছেয়ে থাকা তার মুখটা। আরশাদের ঠোঁটদুটো একটু পর পর কেঁপে উঠছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে? প্রচন্ড মাথা ব্যথায় সে ঘুমাতে পারে না।

একটু আগে শুধু ঠোঁটদুটো কাঁপলেও এখন কেঁপে উঠছে তার পুরো শরীর। আরশাদের কি জ্বর এসেছে? এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেশিক্ষণ এই হিমশীতল পরিবেশে থেকে যে কেউ জ্বরে কাবু হয়ে যেতে পারে।

অরার খুব ইচ্ছে করছে আরশাদের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরিমাপ করে দেখতে। কাজটা কি ঠিক হবে? যদি নারীবিদ্বেষী আরশাদ এতে রেগে গিয়ে তাকে চাকরি থেকে ফায়ার করে দেয়?

চাকরি হারানোর ভয় উপেক্ষা করে অরা তার কম্পিত হাতটা রাখলো আরশাদের কপালে, আরশাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তবে সঙ্গে সঙ্গে অরার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। জ্বরে গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই তীব্র জ্বর সহ্য করা সম্ভব না-কি?

আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে অরা ছুটে গেল ড. ইশতিয়াকে খবর দিতে। পরবর্তী দুইটি ঘন্টা কাটলো আরশাদের চিকিৎসায়। তার মাথায় পানি দেওয়া হলো, মাইগ্রেন এবং জ্বরের ঔষধ খাওয়ানো হলো, ইনজেকশন পুশ করা হলো। এতক্ষণ জেদ ধরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেও এখন চিকিৎসার সবগুলো ধাপে বাধ্য ছেলের মতো ডাক্তার সাহেবকে সহযোগিতা করলো আরশাদ।

যদিও ওষুধের প্রভাবে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না। তীব্র মাথা ব্যাথার কারণে গতকাল রাতেও ঘুম হবার কথা নয়। আরশাদ ঘুমিয়ে পড়ার পর ডাক্তার সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে বেশ অনেকগুলো কথা বললেন অরাকে। কথাগুলোর সারমর্ম যে করেই হোক গতমাসে দেওয়া ওষুধগুলো তাকে খাওয়াতে হবে।

পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। আকাশে রক্তিম আভার ছড়াছড়ি। সীমাকে দেওয়া কথাটা রাখা গেল না। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা যাবে। আরশাদ ঘুমিয়েছে আধঘন্টা হলো। ঘুম ভাঙতে এখনো বেশ দেরি। সে ঘুম থেকে ওঠার আগে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে যেতে পারে না।

এই ফাঁকে কয়েকটা কাজ এগিয়ে রাখবে বলে ঠিক করলো অরা। ভাগ্যিস ব্যাগে ল্যাপটপটা ছিল! কাল আরশাদের শুটিং ঢাকার এক শুটিং হাউজে। সিনেমার পর্দায় নায়ক-নায়িকাদের বাড়ি বলতে আমরা যা দেখি, তা মূলত এই শুটিং হাউজই। অবিকল সাধারণ বাড়ির মতো সাজানো গোছানো একটা বাড়ি। তবে মজার ব্যাপার হলো এই বাড়ির কোনো ঘরেই ফ্যান বা এসি নেই। ফ্যানের শব্দে শুটিং করা সম্ভব নয়। এছাড়াও যে ঘরে দৃশ্যধারণ করা হয় তার ছাদে বিশাল বিশাল লাইট ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফ্যান থাকলে যা করা সম্ভব নয়।

একটা সিনেমার স্ক্রিপ্টে গল্প অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে দৃশ্যগুলো সাজানো থাকে। তবে শুটিংয়ের সময় দৃশ্যধারণ করা হয় এলোমেলো ভাবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো স্ক্রিপ্টের প্রথম দৃশ্যে নায়িকা মারা গেছে, দ্বিতীয় দৃশ্যে নায়ক শোকে পাথর হয়ে বসে আছে। শুটিংয়ের সময় চাইলে শোকে পাথর হয়ে থাকার দৃশ্যটা আগে ধারণ করা যেতে পারে। আবার যে দিন প্রথম দৃশ্য ধারণ করা হয় সেদিন দ্বিতীয় দৃশ্য ধারণ না করলেও সমস্যা নেই। পুরোটাই নির্ভর করে শুটিংয়ের সুবিধা- অসুবিধার ওপর। পরবর্তীতে এডিটের সময়ে আবারও স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ধারণকৃত দৃশ্যগুলোকে সাজিয়ে ফেলা হয়।

এই যেমন আরশাদের এই সিনেমার আটত্রিশ নম্বর দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা গাড়িতে ঝগড়া করতে করতে ঢাকার এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। একটুপর কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে তাদের ফ্লাইট। আবার, ঊনত্রিশ নম্বর দৃশ্যটা এমন, তারা প্লেন থেকে কক্সবাজার এয়ারপোর্টে নেমেছে। নায়ক সেই ঝগড়ার জন্যে বারবার ক্ষমা চাইছে তবুও নায়িকা রাগ ধরে বসে আছে।

ঊনত্রিশ নম্বর দৃশ্যের শুটিং ইতোমধ্যেই করা হয়ে গেছে। আগামীকাল ধারণ করা হবে আটত্রিশ নম্বর দৃশ্য। এভাবে এলোমেলো দৃশ্যধারণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় তা হচ্ছে কস্টিউম। সিনেমার শুটিংয়ে নায়ক-নায়িকা যে পোশাক পরে থাকে ওগুলোই কস্টিউম।

যেহুতু ঊনত্রিশ নম্বর দৃশ্যটা আগে ধারণ করা হয়েছে, তাই ওই দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার পরনে যে কস্টিউম ছিলো আটত্রিশ নম্বর দৃশ্যে সেই একই কস্টিউম থাকতে হবে। না হলে দেখা যাবে নায়ক-নায়িকা কক্সবাজারের উদ্দেশ্য যাচ্ছে এক পোশাকে আর সেখানে গিয়ে নেমেছে আরেক পোশাকে।

কস্টিউমগুলো যত্নে নিজের কাছে রাখার কাজ কস্টিউম ডিজাইনারের। অরা ফোন করলো আরশাদের কস্টিউম ডিজাইনার শাওনকে। শিডিউল মিলিয়ে আগামীকাল কোন কোন কস্টিউম লাগবে তা জানিয়ে দিলো।

শাওনের সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই ফোন এলো অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের। অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরকে সংক্ষেপে বলা হয় এডি। শুটিংয়ের আগের দিন এডির ফোন আসার অর্থ একটাই, কল টাইম জানানো। শুটিং সেটের সকলকেই আলাদা আলাদা কল টাইম দেওয়া হয়। নিজ নিজ কল টাইম অনুযায়ী সকলে সেটে উপস্থিত হতে হয়। আগামীকাল আরশাদের কল টাইম সকাল সাড়ে আটটায়।
এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার। ঘুমিয়ে-টুমিয়ে যেতে পারবে আরশাদ। কখনো কখনো ভোর ছয়টাও কল টাইম দেওয়া হয়। অরা আরও কিছু কাজ সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

হঠাৎ মতিউর এসে বলল, “আফা স্যার উঠছেন।”

অরা ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “কী করছেন উনি?”

“বারান্দায় বইসা কোফি খাইতেছে। আফনেরে ডাকে।”

আরশাদ ডাকছে শুনেও তৎক্ষণাৎ ছুটে গেল না অরা। এ বাড়ির ষ্টাডি রুমে একটা প্রিন্টার আছে। সেখান থেকে কতগুলো কাগজ প্রিন্ট করে পা বাড়ালো আরশাদের ঘরের দিকে।
ঘরটা এখন চকচক করছে। একটু আগেও কেমন এলোমেলো ছিল সবকিছু। মতিউর নিমিষেই গুছিয়ে ফেলেছে ঘরটাকে। কাগজগুলো আরশাদের টেবিলে রেখে অরা গেল বারান্দার দিকে।

আরশাদের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিশাল বারান্দাটা এ বাড়ির সবথেকে আকর্ষণীয় জায়গা। ঢুকতেই সবার আগে চোখে পড়বে একটা ফুলের বাগান। নাম না জানা বিদেশি কিছু ফুল চাষ করা হয় এখানে। বাগান থেকে একটু এগিয়ে যেতেই ছোটখাটো সুইমিং পুল। এই বারান্দায় আগে সুইমিং পুল ছিল না। কথার জোরাজুরিতে সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েটা কোন এক কার্টুনে যেন দেখেছে ঘরের পাশে সুইমিং পুল। জেদ ধরে বসে রইল তারও এমন সুইমিং পুল চাই।

সুইমিং পুলের পাশেই বসার ব্যবস্থা। একটা গোল টেবিল টেবিল আর তিনটি চেয়ার। আরশাদ তার একটায় বসে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুইমিং পুলের জলধারার দিকে। অরার উপস্থিতিতে তার দৃষ্টিতে কোনোপ্রকার ছেদ পড়লো না।

অরা টেবিলটার কাছে গিয়ে বলল, “স্যার আমাকে ডেকেছেন?”

আরশাদ আড়চোখে একবার অরার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সুইমিং পুলের দিকে। গম্ভীর গলায় বলল, “বসো অরা।”

অরা আরশাদের বিপরীত দিকে থাকা চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “এখন কেমন ফিল করছেন স্যার।”

“ভালো।”

অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আগামীকাল আমাদের কল টাইম সাড়ে আটটায়। আমি কালকের শিডিউলটা আপনার টেবিলে রেখে এসেছে। আর কস্টিউমগুলো…”

আরশাদ হুট করে অরাকে থামিয়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমাকে আজ আসতে কে বলেছে? আমি তো ছুটি দিয়েছিলাম তোমাকে।”

অরা হেসে বলল, “কেউ বলেনি তো স্যার। মতিউর ভাইয়ের পক্ষে আপনাকে দিয়ে দরজা খোলানো সম্ভব নয় বলেই এসেছি।”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি যখন প্রথম এই চাকরিতে জয়েন করেছিলে তখন তোমার বয়স কত ছিল?”

অরা কিছুটা চিন্তা করে বলল, “ঠিক মনে নেই, উনিশ কিংবা বিশ।”

“সবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিলে তাইনা?”

“জি স্যার, রেজাল্টের অপেক্ষা করছিলাম।”

“কখনো মনে হয়নি, যেখানে আমার ম্যানেজার হিসেবে আরও কোয়ালিফায়েড কাউকে প্রয়োজন ছিল, সেখানে তোমাকে কেন চাকরিটা দিলাম।”

বহুবার এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেয়েছে অরার মাথায়। উত্তর জানতে চেয়েছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।

অরা অবাক গলায় বলল, “কেন স্যার?”

আরশাদ মুগ্ধ গলায় বলল, “তোমার গল্পটা শুনে। ক্যারিয়ারের শুরুতে আমিও তোমার মতো রেবেল ছিলাম। যা চাইতাম তা পাওয়ার জন্যে অনেক বেশি ইগার ছিলাম। তাছাড়া পড়াশোনার প্রতি তোমার ডেডিকেশনও মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার ম্যানেজার হিসেবে এমন ডেডিকেটেড কারোরই প্রয়োজন ছিল।”

অরা কিছুই বলল না। প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটে। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল চলে আসছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে অরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেই জল আটকে রাখার।

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করি। কারণ বকা খাওয়ার মতো কাজ তুমি করো। তারপরও কাজের প্রতি তোমার সিরিয়াসনেস দেখে আমি খুশি।”

অরা কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here