ফিরে_আসা ২ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
797

#ফিরে_আসা

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বারোটি ব্যস্ততায় ঘেরা দিন শেষে আজ ঢাকায় ফিরেছে অরা। ওই ঘটনার পর দুদিন নির্জনতায় কাটিয়ে আরশাদ নিজেই ডেকে পাঠায় ডিরেক্টর সাহেবকে। অনেক চিন্তাভাবনা শেষে সিনেমাটা করতে রাজি হলেও শর্ত জুড়ে দেয় নায়িকা পরিবর্তনের। ডিরেক্টর সম্ভবত আগেভাগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন শর্তটা। তাই পরদিনই কক্সবাজারে গিয়ে হাজির হয় নতুন নায়িকা। নতুন উদ্যমে শুরু হয় শুটিং। বরাবর মতোই আরশাদের অভিনয়ে সেটের সকলে হয় মুগ্ধ।

কক্সবাজারকে প্রকৃতি নিজ মমতায় যতই ঘিরে রাখুক না কেন, ঢাকার এই ব্যস্ততার মধ্যে থেকেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে অরা। এখানকার যানজট, দূষণ, জনসমাগম – এসবই যেন তার অধিক আপন। ঢাকায় ফিরে আজ মনের মাঝে বিচিত্র এক স্বস্তি অনুভূত হচ্ছে।

আরশাদও ঢাকায় ফিরে সোজা চলে গেছে বাসায়। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে আগামী দুটো দিন কোনপ্রকার কাজ করতে পারবে না। এই দুইদিন তাই অরারও ছুটি। আরাম করে ঘুম দেওয়া যাবে। কর্মব্যস্ততার পর যখন অবশেষে ছুটির দিন আসে, তখন ঘুম ছাড়া অন্য কোনো পরিকল্পনা মাথায় আসে না।

বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলো অরা। নিমিষেই দরজা খুলে দিলো সীমা। মেয়েটা এতক্ষণ দরজার অপরপ্রান্তেই অপেক্ষা করছিল কিনা কে জানে? দরজা খুলে এক মুহূর্তও অপচয় না করে অরাকে জাপটে ধরলো সীমা।

উৎফুল্ল গলায় বলল, “দোস্ত! কতদিন পর তোকে দেখলাম। তুই ভাবতেও পারবি তোকে কতটা মিস করেছি।”

অরাও প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে জড়িয়ে ধরলো প্রিয় বান্ধবীকে। প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা পরিবার থাকে। বাবা-মা, ভাই-বোন আরও কত কে! দিনশেষে প্রত্যেকেরই সেই পরিবারের কাছে ফেরার একটা তাগিদ থাকে। কারণ আর কেউ না হোক, একমাত্র পরিবারের মানুষেরাই পারে কাউকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে।

সেদিক থেকে অরার জীবনটা ব্যতিক্রম। পরিবার বলতে তার কিছুই নেই। ঢাকায় নেই, গ্রামের বাড়িতেও নেই। পৃথিবীর কোথাও নেই। আছে তো শুধু এই মেয়েটা। সীমার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে এক ছাদের নিচে বসবাস অরার। সীমারও তার মতো কেউ নেই। দুই অভাগীর ঠাঁই হয়েছে এই ফ্ল্যাটে। অবশ্য অভাগী বললে ভুল হবে। আপন বলতে কেউ নেই তো কী হয়েছে, কর্মজীবন নিয়ে তারা বেশ আছে। সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্যে একে-অপরে আছে।

শাওয়ার ছেড়ে লম্বা গোসল সারলো অরা। সারা শরীরে বালি কিচকিচ করছে। মানুষ কক্সবাজারে গিয়ে সাথে কিছু না আনলেও পোশাকে, জুতায়, ব্যাগে করে বালি বয়ে আনে।

অরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো ফ্লোরে পা ভাঁজ করে বসে আছে সীমা। তার সামনে অরার সুটকেসটা হা করে খোলা। অরা কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই বিশাল এক লিস্ট পাঠিয়ে দিয়েছিল তাকে। সীমা লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছে সবকিছু ঠিকঠাক এনেছে কিনা।

সীমা চিন্তিত গলায় বলল, “আমসত্ত্ব আনিসনি?”

অরা হাই তুলতে তুলতে বলল, “এনেছি তো। খুঁজে দেখ।”

“আধ ঘন্টা ধরে খুঁজছি! কিছুই পেলাম না। সত্যি করে বলতো, তুই আমসত্ত্ব কিনতে ভুলে গেছিস তাই না?”

অরা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, “আরে বাবা আমি নিজ হাতে কিনেছি। রেস্ট নিয়ে খুঁজে দেবো।”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সীমাও তার ক্লান্ত মুখটা দেখে বেশি জোরাজুরি করলো না।

সীমা অরার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “তুই খাবি না?”

“পরে খাবো।”

“তুই ঘুমানোর চিন্তাভাবনা করছিস না? মোটেও ঘুমাবি না। আগে আমাকে শুটিয়ের গল্প কর।”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বারোটা দিন ওই ঝামেলা সহ্য করলাম, এখন আবার সেই ঝামেলার গল্প করতে হবে?”

সীমা অন্যরকম গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, শুটিংয়ের গল্প করতে হবে না। আরশাদের গল্প কর।”

অরা বিরক্ত গলায় বলল, “পারবো না।”

সীমা আহত গলায় বলল, “তাহলে আমিও তোর সাথে থাকতে পারবো না। নতুন ফ্ল্যাটমেট খুঁজে নে। কবে থেকে বলছি আমার জন্যে আরশাদের একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আয়। সেটাও আনতে পারলি না। কেন? অটোগ্রাফের কথা বললে কি তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে?”

অরা খানিক হেসে বলল, “ফেলতেও পারে, ওই লোককে ভরসা নেই।”

“খবরদার আমার আরশাদকে নিয়ে উল্টো-পাল্টা কিছু বলবি না!”

অরা কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল, “তোর আরশাদ?”

সীমা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, “নয়তো কী? ওর মুখটা ভালো করে দেখেছিস অরা? একটা মানুষ এতটা হ্যান্ডসাম কী করে হয়? ইচ্ছা করে যেন সারাটা দিন ওর ছবির দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিই।”

“আর একটা দিন উনার আশেপাশে কাটালে তোর মনে হবে, ছুটে পালাই!”

“মোটেই না। আমি তো সারাজীবন ওর আশেপাশে কাটিয়ে দিতে পারবো। ইশ! আরশাদের ম্যানেজারের চাকরিটা যদি আমি পেতাম, তাহলে সারাদিন ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম।”

“ভাগ্যিস পাসনি, স্যার যদি দেখতো তুই কাজ বাদ দিয়ে উনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তোকে ফায়ার করতো।”

সীমা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। ভাবতেই অবাক লাগে যে মানুষটার জন্যে সে কাজ করে তার অতি প্রিয় বান্ধবী তারই রূপে-শুনে মুগ্ধ। সীমাকে শুধুমাত্র আরশাদের ভক্ত বললে ভুল হবে। বেচারি তার ওপরে আজন্মের ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।

অরা সীমার বিষণ্ণ মুখটা দেখে আশ্বাস দিয়ে বলল, “আচ্ছা যা! প্রমিস করলাম আমার চাকরিটা থাকতে থাকতে একদিন অবশ্যই তোকে স্যারের সঙ্গে দেখা করিয়ে আনবো।”

সঙ্গে সঙ্গে সীমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উৎফুল্ল ভঙ্গিতে অরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সত্যি? থ্যাংক ইউ দোস্ত! থ্যাংক ইউ! তুই আসলেই বেস্ট। একবার আরশাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে আন, আমার জানটাই তোকে দিয়ে দিবো।”

“হয়েছে, হয়েছে। ছাড় তো!”

সীমা অরার কাছ থেকে সরে আসলেও তার মধ্যকার উৎফুল্ল-উত্তেজনার কোনো কমতি নেই।

সীমা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী পড়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই বলতো? শাড়ি না-কি ওয়েস্টার্ন। আরশাদ কোনটা পছন্দ করে?”

অরা লম্বা হাই তুলে বলল, “পছন্দ-অছন্দের বিচার করলে তো তোর যাওয়াই উচিত নয়।”

“কেন রে?”

“কারণ উনি মেয়েদের সহ্য করতে পারেন না।”

সীমা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “যত্তসব বাজে কথা! আরশাদ এমনটা হতেই পারে। মেয়েদের সহ্য করতে না পারলে পর্দায় এত সুন্দর রোমান্স করে কী করে?”

“অভিনয়ে খাতিরে কত কিছুই তো করতে হয়। পর্দার মানুষ আর বাস্তবের মানুষ কখনোই এক হয় না।”

সীমা অরার পাশে শুয়ে পড়ে বলল, “এই অরা?”

“হুঁ?”

“তুই কখনো আরশাদের প্রেমে পরিসনি?”

অরা মুখ বিকৃত করে বলল, “না!”

“এক সেকেন্ডের জন্যেও না?”

“না! উনি আমার বস সীমা। আর আমি উনার ম্যানেজার।”

“তো কী হয়েছে? আমি তো সামনা-সামনি না দেখেই ওর ওপর ফিদা হয়ে গেছি। বারবার ওর প্রেমে পড়েছি। আর তুই প্রতিদিন চোখের সামনে দেখেও প্রেমে পরিসনি?”

অরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “একদমই না। প্রফেশনাল জায়গায় আবার প্রেম-টেম কীসের? স্কুল-লাইফে দেখতাম মেয়েরা স্যারদের প্রেমে পড়ছে। এসবের কোনো মানে হয়?”

“আরে বাবা স্কুলের টিচারের প্রেমে পড়া আলাদা কথা, আর তুই যার জন্যে কাজ করিস সে হলো সুপারস্টার আরশাদ হক।”

“তবুও প্রেমে পড়িনি।”

সীমা হতাশ গলায় বলল, “তোর মতো রস-কসহীন মেয়ে আমি জন্মেও দেখিনি। এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমি তো ভেবেই পাই না, ওই বোকা মেয়েটা ওকে ছেড়ে গেল কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। একই প্রশ্নের উত্তর সেও ভেবে পায় না। অরা তার ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেওয়ার আট মাসের মাথায় আচমকা একদিন আরশাদ ফোন দিয়ে বলল, “অরা ডিভোর্স লয়ার ঠিক করো, নওশীনের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”

হঠাৎ করে কী এমন হলো যে এত বড় একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলো ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে সুখী দম্পত্তির। তাদের ডিভোর্সে অরা যতটা অবাক হয়েছে তার থেকেও হাজারগুণ বেশি অবাক হয়েছে তাদের ভক্তমহল। তাদের ডিভোর্সটা আজও রহস্যই রয়ে গেল। দুজনের কেউই মিডিয়ার সামনে কোনোদিন মুখ খুলে বলেনি প্রকৃত কারণ। বহু গুঞ্জন উড়ে এলেও তার সত্যতা সম্পর্কে সকলেই সন্দিহান।

সীমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “সবাই তো বলে আরশাদের দোষেই ডিভোর্স হয়েছে। ও না-কি নওশীনকে ধোঁকা দিয়েছে। কোন এক মডেলের সাথে না-কি অ্যাফেয়ার ছিল। আসলেই কি তাই?”

“আমি জানি না সীমা। অন্তত আমি স্যারকে কোনোদিন কোনো মডেলের সঙ্গে দেখিনি। আর তাছাড়া…”

“তাছাড়া কী?”

“আমার মনে হয় না স্যার এমনটা করতে পারেন। উনি বদমেজাজি, রেগে গেলে কোনপ্রকার হুস থাকে না। তবুও ভেতরে ভেতরে উনি ভালো একটা মানুষ। এমন কাজ করবে বলে মনে হয় না।”

“তুই কখনো জিজ্ঞেস করিসনি?”

“কী জিজ্ঞেস করবো?”

“ডিভোর্স কেন হলো!”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বোকার মতো কথা বলবি না তো সীমা। এত পার্সোনাল একটা প্রশ্ন আমি আমার বসকে করবো?”

“ও মা! করলে সমস্যা কোথায়? তুই দিনরাত তার জন্যে খেটে মারছিস আর তোর সামান্য প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না?”

“বাজে কথা বন্ধ কর তো সীমা। কানের কাছে ভ্যাজর ভ্যাজর না করে আমাকে রেস্ট নিতে দে।”

সীমা ব্যথিত গলায় বলল, “আমারও শখ নেই তোর সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করার। আমার কি কাজের অভাব পড়েছে?”

সত্যিই সীমার কাজের অভাব পড়েনি। বাংলাদেশে বসেই সে বিদেশের বড় বড় কোম্পানির জন্যে কাজ করছে । সফটওয়্যার ডিজাইন আর প্রোগ্রামিং করে আয় করছে ডলারে। আর এ সবই হচ্ছে ঘরের বাইরে পা না রেখে। সীমা একজন ফ্রিল্যান্সার।

অরা এবং সীমা দুজনেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তবে মজার ব্যাপার এদের কারোরই শিক্ষাজীবন শেষ হয়নি। এখনো অনার্স ফাইনাল আটকে আছে। গত বছরেই পাস করার কথা ছিল, তবে কাজের চাপে বেশ অনেকগুলো পরীক্ষা বাদ গেছে। অ্যাটেনডেন্সের অবস্থাও খুব এক সুবিধার নয়।

অরার ঘুম ভাঙলো বিকেলের দিকে। সেই থেকে সীমা তাকে অনুনয় করছে কাল ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্যে। কক্সবাজারে যাওয়ার আগে ছুটির আবেদন করেই গিয়েছিল অরা। গতকাল ছিল ছুটির শেষ দিন আর আজ শুক্রবার। কাল ক্লাসে না গেলে ক্ষতিটা অরারই হবে।

পড়াশোনা তার দারুন লাগে। সে তো কোনদিন ভাবতেই পারেনি ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে। সবটাই সম্ভব হয়েছে আরশাদের জন্যে। চার বছর অরা যখন এই চাকরিতে ঢুকেছিল, তখন সে সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা একটা মেয়ে। আরশাদ প্রথমদিনই গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিয়েছিল, তার ম্যানেজারকে কোয়ালিফায়েড হতে হবে। অরাকে চাকরির পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েশনও শেষ করতে হবে। যথাসময়ে আরশাদকে সার্টিফিকেট দেখালে না পারলেই ফায়ার!

অরা সেদিনই বুঝে গিয়েছিল কতটা ভালো মনের মানুষ আরশাদ। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার সে। তার ম্যানেজারের কোয়ালিফিকেশন কেউ দেখতে আসবে না। অরা যে তার ম্যানেজার এই পরিচয়টাই অনেক। তবুও আরশাদ তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে প্রমাণ করেছে, শক্ত খোলসের আড়ালে থাকা মনটা কত নরম।

সীমার জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পরদিন ভার্সিটিতে গেল অরা। পড়াশোনা তার যতটা পছন্দের, এ জায়গাটা ততটাই অপছন্দের। ক্লাসের কারোরই জানতে বাকি নেই কার ম্যানেজার অরা। তাই ক্লাসে ঢুকতেই সকলে ঘিরে ধরলো তাকে। একেকজন একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সবগুলো প্রশ্নই আরশাদকে ঘিরে। সীমার মতো আরও হাজারখানেক মেয়ে এ দেশে আছে যারা ওই একটা মানুষের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

অরা শান্ত ভঙ্গিতে সকলের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছে। আবার প্রয়োজনমতো প্রশ্ন এড়িয়েও যাচ্ছে। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়েদের এতটুকু জ্ঞান নেই যে কিছুকিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে তার উত্তর আশা করা ঠিক নয়। এই যেমন, “আরশাদের ফোন নম্বর কত?” “আরশাদ একটা সিনেমা করে কত টাকা পায়?” “আরশাদের বাসা কোথায়?”

অরার দিকে ছুটে আসা প্রশ্নের প্রবল স্রোত শান্ত হলো লেকচারের আগমনে। অরাও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ক্লাস শেষে কোনমতে এখান থেকে পালাতে পারলে হয়।

দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টা ক্লাস করে হাঁপিয়ে উঠেছে অরা। আগামী মাসে সেমিস্টার ফাইনাল। ম্যাডাম সকলকে মনোযোগ সহকারে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন। সীমা সহপাঠীদের প্রশ্নের তীর থেকে অরাকে বাঁচিয়ে বাইরে নিয়ে এলো।

ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছে দুজনে। এই জায়গাটার বাতাসে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। কিছুটা উচ্ছ্বাস, কিছুটা মোহ আবার কিছুটা বিষাদ। সীমা অনবরত কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। অনবরত কথা বলে যাওয়ার বিশ্ব রেকর্ডের ব্যবস্থা থাকে নিঃসন্দেহে এই মেয়ের নাম থাকতো সবার ওপরে। অবশ্য সীমাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। বেচারি এতগুলো দিন পর অরাকে পেয়েছে। মনে জমে থাকা কথাগুলো ওকে না বললে কাকে বলবে।

“অরা?”

হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো তারা। পেছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো সাবেরের মুখটা। এই ছেলেটাকে সীমা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাকে দেখামাত্রই তার শরীর যেন আগুনে জ্বলে উঠলো।

সাবের তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “অরা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।”

অরা কিছু বলে ওঠার আগেই সীমা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “তোমার কথা থাকতে পারে কিন্তু ওর নেই।”

“আমি তোমার সাথে কথা বলছি না।”

সীমা রাগী কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আমি তোমার সাথেই কথা বলছি। তোমাকে বলেছিলাম না, অরার সামনে আসবে না। কত বড় সাহস আবারও এসেছ ওর সঙ্গে কথা বলতে! এই অরা চলতো।”

অরা শান্ত গলায় বলল, “তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন সীমা? কথাই তো বলতে চেয়েছে।”

সীমা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “তুই এখন এই বদটার সঙ্গে কথা বলবি? বল। আমি তোর সঙ্গে নেই। আমি গেলাম, একা একাই বাসায় ফিরে যাস।”

অরা বাঁধা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে হনহন করে ক্যাম্পাসের বাইরে বেরিয়ে গেল সীমা। অদ্ভুত একটা মেয়ে। সাবেরের জন্যে সে এতটা ঘৃণা পুষে রেখেছে কেন কে জানে? ঘৃণা তো করা উচিত অরার।

ছোট্ট এক নিঃশ্বাস গোপন করে অরা বলল, “কী ব্যাপার?”

সাবের থেমে থেমে বলল, “তোমাকে একটা কথা বলবো।”

“সেই কখন থেকে শুনছি কথা বলবে। বলো!”

সাবের ইতস্তত করে নিচু গলায় বলল, “আই অ্যাম সরি।”

অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “এই কথাটা এর আগেও বলেছ। আর আমি বলেছি ইটস ওকে।”

“ওই ঘটনা নিয়ে আমাদের মাঝে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল…”

সাবেরকে থামিয়ে দিয়ে অরা বলল, “কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি তো। আমি নিজের চোখে দেখেছি এবং নিজের কানে শুনেছি।”

“আমি ভুল করে ফেলেছি অরা। আমার ছোট্ট একটা ভুলের জন্যে এত বড় একটা শাস্তি দেবে আমাকে?”

“ভুলের আবার ছোট-বড় হয় না-কি? ভুল তো ভুলই। আসলে ভুলটা আমিই করেছি। আমারই উচিত হয়নি অন্ধের মতো কাউকে বিশ্বাস করা।”

“তুমি আমাকে ঘৃণা কর, তাইনা?”

“না, ঘৃণা করলে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতাম না।”

“আরেকটা সুযোগ কি তাহলে দেওয়া যায় না? বন্ধুত্বের অধিকারও আমার নেই?”

অরা ক্ষীণ হেসে বলল, “প্রত্যেকটা সম্পর্কের ভিত্তি কী জানো সাবের? বিশ্বাস। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙেছো। যে একবার আমার বিশ্বাস ভাঙে তাকে আমি দ্বিতীয় সুযোগ দিই না। আরেকটা কথা, এভাবে পথের মাঝে আমার সঙ্গে কথা বলতে না এলেই খুশি হবো।”

বছর দুয়েক আগে এই সাবের ছেলেটা অরার জীবনে এসেছিল আয়নার মতো। আয়না যেমন মানুষকে প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়, ছেলেটাও তাই। অরা সাবেরকে
ভালোবাসেনি, প্রেমেও পড়েনি। কেবল বিশ্বাস করেছিল। সে আশপাশে থাকলে কেমন একটা স্বস্তি বোধ হতো। তার সঙ্গে মনের কথাগুলো ভাগাভাগি করে সাচ্ছন্দ্য বোধ হতো। ছেলেটাকে ভরসা করে অরা তাকে জানিয়েছিল অতীতের সবথেকে বড় ঘটনাটা।

মাস তিনেকের মধ্যেই সম্পর্কটা প্রেমের দিকে গড়াতে শুরু করেছিল, ভাগ্যিস গড়ায়নি। তার আগেই একদিন সীমা হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে ছুটে এসে বলল, “সাবের হলরুমে একটা মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছে। দেখে আয় তো ঘটনা কী?”

নিতান্ত কৌতূহলের বশেই অরা এগিয়ে গিয়েছিল হলরুমের দিকে। তবে জানালার আড়াল থেকে সে যা শুনলো, তো শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

মেয়েটা কেঁদে কেঁদে বলছে, “আমাদের এত বছরের সম্পর্ক ভেঙে তুমি কী করে ওই অরার কাছে যেতে পারলে?”

সাবের বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, “আরে বাবা বুঝতে পারছো না কেন? আমি কি কোনোদিন তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে পারি? ওই অরা কার ম্যানেজার জানো? নায়ক আরশাদ হকের। উঁচু মহলের সঙ্গে ওদের ওঠাবসা। ওই মেয়েটাকে পটিয়ে ভালো একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলেই ওকে ছেড়ে দেবো। তুমি প্লিজ কিছুদিনের জন্য এই অভিনয়টা সহ্য করে নাও। আমি তো তোমারই।”

সেদিনের পর থেকেই অরা বুঝে গিয়েছিল পৃথিবীতে অন্ধের মতো কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। আমাদের আশেপাশে ভালো মানুষের মুখোশধারী এমন অনেকেই আছে যারা একটু সুযোগ পেলেই আমাদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহন করতে চাইবে।

রিকশায় উঠে বসতেই অরার ফোন বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই দেখলো স্ক্রিনে মতিউরের নাম ভেসে উঠেছে। মতিউর আরশাদের বিশাল বাড়িটাকে সামলে রাখে। এই লোক এখন ফোন করছে কেন? সে কি জানে না আজ তার ছুটি?বহু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করলো অরা।

অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো মতিউরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, “আফা! স্যার কালকের রাইত থেইকা ঘরের দরজা বন্ধ কইরা বইসা আছে।”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “মানে?”

“কালকের রাইতে স্যার বলছে উনার মাইগেন উঠছে। উনারে যেন বিরক্ত না করি। আমি আর রাতে ডাকি নাই। সকালে দরজায় টোকা দিসি, দরজা খুলে না। কেমনটা লাগে কন তো আফা? মাথায় বেদনা, তয় কিছু খাইবো না। ওষুধও খায় না। খালি ভিতর দিয়া কইছে, আমারে ঘুমাইতে দাও। বিরক্ত কইরো না। কী করি কন আফা?”

অরা লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরশাদকে নিয়ে আর পারা যায় না। এই লোকটার স্বভাব শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়া। কী লাভ অসহ্য ব্যাথা সহ্য করে বিছানায় পড়ে থেকে? চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলেই তো হয়!

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি আসছি।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here