ফিরে_আসা ১ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
1376

“কতটা চরিত্রহীন হলে একটা মেয়ে কোনো ছেলেকে তার সঙ্গে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেয়! লজ্জা করে না তোমার?” রাগে ফেটে পড়ে বলল আরশাদ।

মেহেরীন থেমে থেমে বলল, “আপনি তো কত মেয়েকেই রোজ রাতে আপনার বেডে জায়গা দেন। আজ রাতের জন্যে সেই জায়গাটা আমি চেয়েছি। অনেক বড় অন্যায় কি করে ফেলেছি?”

আরশাদের চোখে মুখে রাগ দৃশ্যমান হয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। রেগে গেলে তার হাত পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে থেকে, কপালের রগ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তবুও সে লক্ষণগুলো রীতিমত উপেক্ষা করে কথাগুলো বলে গেল মেহেরীন।

আরশাদ হুংকার দিয়ে বলল, “হাউ ডেয়ার ইউ? কার সম্পর্কে কী বলছো তুমি?”

মেহেরীন ভয়ে ভয়ে বলল, “ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানে আপনি মেয়েদের নিয়ে রাত কাটান। আমি নিজ থেকে প্রস্তাব দিলাম বলেই দোষ?”

মেহেরীন মেয়েটা ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন। আগে দুয়েকটা সিনেমা করেছে। সর্বশেষ সিনেমাটা সুপারহিট যাওয়ায় নিজেকে বিশাল কিছু মনে করছে। নির্ভয়ে নির্বিকারে বেয়াদবী করছে সুপারস্টার আরশাদ হকের সঙ্গে। মেয়েটা হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে আরশাদের ক্ষমতা কতটুকু। সে চাইলে ঠিক এই মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে মেয়েটার ক্যারিয়ার।

আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। যাকে বলে বৃথা চেষ্টা। সে নিজেও জানে এই রাগ সহজে গলে জল হবে না। রাগের কারণেই জীবনে বহু কিছু হারিয়েছে সে। আবার এই রাগই তাকে এনে দিয়েছে অঢেল সাফল্য।

আরশাদ হঠাৎ হুংকার দিয়ে ডাকল, “অরা! অরা!”

অরা নামের মেয়েটি দরজার পাশেই দাড়িয়ে ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শোনা তার স্বভাবে নেই। তবুও কী যেন মনে করে দাড়িয়েছিল, ভাগ্যিস দাড়িয়েছিল! আরশাদ অনবরত ডেকেই যাচ্ছে। তবুও সামনে যাচ্ছে যাচ্ছে না অরা। সে যে দরজার পেছনে ঘাপটি মেরে ছিল, ব্যাপারটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।

মিনিট দুয়েক পর ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকল রিসোর্টের বারান্দায়। এখানেই বসেই নায়ককে কুপ্রস্তাব দেন নায়িকা।

অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “আমাকে ডেকেছেন স্যার?”

আরশাদ কড়া গলায় বলল, “এতক্ষণ লাগে আসতে?”

“সরি স্যার। কিছু বলবেন?”

আরশাদ এক নিঃশ্বাসে বলল, “আমি ফিল্মে কাজ করবো না। আর এক সেকেন্ডও এই সেটে থাকব না। ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে।”

অরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আগেভাগে কঠিন কোনো কথা শোনার প্রস্তুতি নিয়েই সে গিয়েছিল। ভেবেছিল আরশাদ হয়তো বলবে, “এই নায়িকার সঙ্গে আমি কাজ করবো না। ডিরেক্টরকে বলো নতুন নায়িকা জোগাড় করতে।” তবে আরশাদ যে এতটা কঠিন কথা বলবে এটা ছিল তার ধারণার বাইরে।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে অরার চোখ পড়ল নায়িকা মেহেরীনের দিকে। বেচারির চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠতে শুরু করেছে। যদিও তাকে বেচারি বলা ঠিক হচ্ছে না। ক্যারিয়ারে ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে আরশাদকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল সে। অথচ সেই সিঁড়িটাই যে তাকে টেনে ফেলে দিতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না তার।

অরার ভাবনামগ্ন মুখ দেখে আরশাদ উঁচু গলায় বলল, “নাও!”

সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরে পেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো অরা। অচেনা কারোর সঙ্গে অরার পরিচয়পর্ব শুরুই হয় নিজের বিচিত্র এই নামটার অর্থ বোঝাতে বোঝাতে। এই নামটা তার বাবা-মায়ের দেওয়া নয়, তাদের কোনো স্মৃতিই নিজের কাছে রাখেনি অরা। বিচিত্র এই নামটার রহস্য যথাসময়ে উন্মোচিত হবে।

দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ভঙ্গিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অরা। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তার স্যারের মেজাজ যখন তুঙ্গস্পর্শী হয়, তখনই এমন অনুভব হয় তার। রাগের বশে হুটহাট একেকটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আরশাদ। আর সেই ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব যেন অরারই।

চার বছর হলো আরশাদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য পেয়েছে অরা, তার ম্যানেজার হিসেবে। আরশাদ নারীজাতিকে সহ্য করতে পারে না। তবুও বহুকষ্টে এই মেয়েটা সহ্য করে নেয়। কারণ একটাই, তার মতো বুদ্ধিমতী এবং দক্ষ ম্যানেজার আরশাদ এ জীবনে পায়নি, ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আরশাদের কর্মক্ষেত্রের যাবতীয় বিষয়গুলো ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্ব তার। শুধু কর্মক্ষেত্রই নয়, আপাদমস্তক মানুষটাকেও মাঝেমধ্যে ম্যানেজ করতে হয়। যেমনটা আজ করতে হবে।

আরশাদের মেজাজকে ম্যানেজ করার একটাই উপায় – তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো, না যে না মেলানো। যা বলছে তা মেনে চলা। তারা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে কক্সবাজারের এক রিসোর্টে। আজ আরশাদের পরবর্তী সিনেমা ‘শেষ বিকেল’ শুটিংয়ের প্রথম দিন। কক্সবাজারে সিনেমার অল্প কিছু দৃশ্য ধারণ করা হবে, তবুও এখান থেকে কেন শুটিং শুরু করা হয়েছে কে জানে।

রিসোর্ট থেকে বেরিয়েই অরার চোখ পড়ল সাগরের দিকে। বিচের পাড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সাগর দেখছে আরশাদের ড্রাইভার জহির। লোকটা এখানে আসা মাত্রই গায়ে হওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসবই আরশাদের পাগলামি। কক্সবাজারের মতো জায়গায় নিজের গাড়িতে ঘোরার কী আছে কে জানে? তবুও আরশাদ ঢাকা থেকে গাড়িসহ আস্ত ড্রাইভারকে তুলে এনেছে।

অরা উঁচু গলায় ডাকল, “জহির ভাই!”

ড্রাইভার জহির সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো রিসোর্টের দিকে। একপ্রকার দৌঁড়ে অরার সামনে এসে বলল, “কী হইছে আফা?”

“স্যার বাইরে যাবেন, গাড়ি বের করেন।”

জহির অবাক গলায় বলল, “এই সময়ে স্যার আবার কই যাইবো?”

অরা বিরক্ত গলায় বলল, “সেটা আমি কী করে জানবো? আপনি গাড়ি বের করেন তো!”

একটা শুটিং ইউনিট বিচিত্র সব মানুষের আনাগোনায় ভরপুর। মানুষ ব্যস্ত নিজ নিজ কাজ নিয়ে। তার ওপরে সিনেমায় যদি থাকে আরশাদের মতো বিরাট সেলিব্রিটি, তবে ইউনিটের লোকসংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ইউনিটের লোকজনের ব্যস্ততা আপাতত রিসোর্টের রান্নাঘরকে ঘিরে। রান্নাঘরে লাইট করা হচ্ছে। পর্দায় আমরা যে দৃশ্য দেখি তা ধারণ করতে যে শুধু একটা ক্যামেরার প্রয়োজন হয় এমনটা হয়। দৃশ্য ধারণের পূর্বে যথাযথ আলোকসজ্জা করা হয়। এজন্যেই পর্দায় দুনিয়াটা এত চকচকে।

পরবর্তী শটটা সম্ভবত রান্নাঘরেই নেওয়া হবে। লাইট করা শেষ হলেই ডাক পড়বে নায়ক-নায়িকার। অরার ভাবতেই খারাপ লাগছে এতগুলো মানুষের ব্যস্ততা নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে যাবে, শুধুমাত্র আরশাদের একটা সিদ্ধান্তের কারণে।

অরা ছোট ছোট পা ফেলে আবারও ফিরে গেল সেই বারান্দায়। মেহেরীনকে আপাতত কোথায় দেখা যাচ্ছে না। নির্ঘাত ভয়ে কেটে পড়েছে। আরশাদ ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।

অরা লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলে দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “স্যার আসবো?”

আরশাদ গম্ভীর স্বরে বলল, “হুঁ।”

“জহির ভাই গাড়ি বের করেছে।”

আরশাদ মাথা নেড়ে বলল, “আমার ডিসিশনটা ডিরেক্টরকে জানিয়েছ?”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “না স্যার।”

আরশাদ প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “এটাও আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? ননসেন্স! এতগুলো বছরে কিচ্ছু শিখতে পারলে না। এমন ম্যানেজার দিয়ে আমার কাজ নেই। ইউ আর ফায়ার্ড ফ্রম নেক্সট মান্থ।”

অরা চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। আরশাদের এসব ধমকাধমকি তার কাছে ডাল-ভাতের সমতুল্য। চাকরির শুরু থেকে অগণিত বার শুনে এসেছে, “ইউ আর ফায়ার্ড ফ্রম নেক্সট মান্থ।” সেই নেক্সট মান্থ যে কবে আসবে কে জানে?

আরশাদ নিজেকে সামলে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি এই সিনেমা থেকে সরে দাঁড়ালে প্রোডিউসারের কত টাকা ক্ষতি হতে পারে?”

“স্যার… সবমিলিয়ে পনেরো-বিশ লাখ টাকা।”

“প্রোডিউসারের নামে পঁচিশ লাখ টাকার চেক রেডি করো।”

“এখনই?”

প্রতিউত্তরে আরশাদ কিছুই বলল না। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। এই দৃষ্টিই উত্তর হিসেবে যথেষ্ট। অরা আবারও বেরিয়ে গেল। ফিরে এল মিনিট দশেক পর পঁচিশ লাখ টাকার চেক আর কলম নিয়ে। আরশাদ পরপর দুইবার মনোযোগ সহকারে চেকটার ওপরে চোখ বুলিয়ে সাইন করে দিলো।

চেক অরার হাতে দিয়ে বলল, “এটা ডিরেক্টরকে দিয়ে বলবে আমি আর এই ফিল্মে কাজ করছি না। আমাকে রাজি করানোর কোনপ্রকার চেষ্টা যাতে না করে। আমি আজই ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। তুমি তাকে চেকটা দিয়ে ফিরে এলে আমি বের হবো।”

অরা অসহায় ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো। একেকটা অকাজ আরশাদ করবে আর মানুষের কাছে গিয়ে অপ্রিয় সত্যগুলো বলতে হবে তাকে। কোনো মানে হয়?

ডিরেক্টর আকরাম হোসেন রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লাইটিংয়ের নির্দেশনা দিচ্ছেন। লাইটিং তার মন মতো হচ্ছে না বলেই যাকে পাচ্ছেন তাকে ধমকাচ্ছেন। তবে অরা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আরশাদ হোকের ম্যানেজারের সামনে কাউকে ধমকানোর প্রশ্নই ওঠে না।

অরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আকরাম হড়বড় করে বললেন, “পাঁচ মিনিটের মধ্যে শট রেডি হয়ে যাবে আপু। স্যারকে বলুন প্লিজ আরেকটু ওয়েট করতে।”

অরা মৃদু হেসে বলল, “আকরাম সাহেব আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

“শটের পরে বলি আপু?”

অরা বিড়বিড় করে বলল, “শটই হবে না, আর শটের পরে!”

“জি আপু?”

“কিছু না। আসলে কথাটা এখনই বলতে হবে, খুব আর্জেন্ট।”

আকরাম বেচারা বিরস মুখে অরার সঙ্গে ডাইনিং রুমে এসে বসলেন। বড় বড় নায়কদের নিয়ে ছবি বানানোর এই এক সমস্যা। তারা একেকবার একেক মানুষের মাধ্যমে বিরক্ত করে। একবার নায়কের ড্রেস ডিজাইনার এসে বলবে, “দেখেন তো বসকে কোন কস্টিউম দিবো?” একবার নায়কের সিকিউরিটি গার্ড এসে বলবে, “এইখানে শুটিং করা যাবে না, পাবলিক এসে ভীড় জমাবে।” এখন আবার এই ম্যানেজার কেনো এসেছে কে জানে?

অরা যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল, “মন শক্ত করুন আকরাম সাহেব। আপনাকে একটা খারাপ সংবাদ দিতে যাচ্ছি।”

মুহূর্তেই আকরামের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেল। তিনি ভীত গলায় বললেন, “খারাপ সংবাদ?”

“জি। স্যার এই ফিল্মে আর কাজ করবেন না।”

আকরাম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন অরার দিকে। বারবার কিছু একটা বলতে চাইছেন, বলতে পারছেন না। বিস্ময়ের সাথে সাথে আর চোখেমুখে আরেকটা জিনিসের আনাগোনা স্পষ্ট, ভয়।

বহুকষ্টে নিজেকে সামলে আকরাম বললেন, “আপু, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আরশাদ ভাই হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? আজ সকালেও তো ফুরফুরে মেজাজে শট দিলেন।”

অরা ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল, “সেটা তো আমি বলতে পারবো না। স্যার বলেছেন, এই যা খরচ হয়েছে পুরোটাই আপনার প্রোডিউসারকে পুষিয়ে দেবেন। ইন ফ্যাক্ট, পঁচিশ লাখের এই চেকটা উনি সাইন করে দিয়েছেন।”

আকরাম চেকটার দিকে একবার শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। বেচারার হতাশার কারণটা স্বাভাবিক। যদিও আরশাদের সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার কারণে তার আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না, তবে যে ক্ষতি হবে সেটা তার থেকেও বেশি। আরশাদ একবার যেই সিনেমা থেকে সরে দাঁড়ায়, সেই সিনেমা ভবিষ্যতে কেউ দেখবে না। সিনেমা ভালো হলেও দর্শক জোরপূর্বক সমালোচনা করবে।

আকরাম অসহায় গলায় বললেন, “আমি একবার উনার সাথে গিয়ে কথা বলি?”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “ভুলেও না! স্যার অনেক রেগে আছেন। আপনাকে উনার সামনে যেতে নিষেধ করেছেন।”

“কী এমন হলো আপু? যার কারণে ভাই আর সিনেমাই করবেন না?”

অরা চিন্তায় পড়ে গেল। সে যা দেখেছে তা কি এই ডিরেক্টরকে বলা উচিত হবে? অবশ্যই না, কারণ অরা যা দেখেছে, অন্যায়ভাবে দেখেছে। তবে চোখের সামনে বেচারার এতবড় ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। তার থেকেও বড় কথা আরশাদের পাগলামির কারণে পঁচিশ লাখ টাকা এভাবে জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না।

অরা সামান্য কেশে বলল, “আমি তো ঠিক বলতে পারবো না আকরাম সাহেব। তবে দেখছিলাম স্যার নায়িকার সঙ্গে কথা বলছেন। তার সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই স্যারের মেজাজ তুঙ্গে।”

আকরাম আক্ষেপের স্বরে বললেন, “আমি জানতাম এমনটাই হবে! এই নায়িকা অতি বদ, সুযোগ পেলেই হিরোদের সঙ্গে লাইন মারতে চায়। আমি তো এই মেয়েকে ফিল্মে নিতেই চাইনি, প্রোডিউসারের জোরাজুরিতে নিয়েছি। নির্ঘাত প্রোডিউসারের সঙ্গেও লাইন মেরেছিল।”

অরা চুপ করে রইলো।

আকরাম অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, “আমি এখন কী করি আপু? আরশাদ ভাই সিনেমাটা না করলে আমার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি একটু উনাকে বোঝাবেন প্লিজ?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই মুহূর্তে স্যারকে কেউ বোঝাতে পারবে না। আপনি আপাতত এই চেকটা রেখে দিন। স্যারের মেজাজ ঠিক হলে তিনি নিজেই আপনাকে ফোন করবেন।”

আকরামের চোখেমুখে আশার আলো ঝলমল করছে। তবুও কিঞ্চিৎ শঙ্কিত গলায় বললেন, “আর যদি না করেন?”

অরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “তাহলে আপনার কাছে চেকটা আছেই।”

অরা ফিরে এলো সেই বারান্দায়। আরশাদ এখনো ঠোঁটের মাঝে সিগারেট চেপে বসে আছে। এই লোকটার অজস্র বদভ্যাসের মধ্যে একটা হলো এই সিগারেট। বারান্দাটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে, চোখে মেলে তাকানোটাও যেন দুঃসহ।

তবুও আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “বলেছ?”

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “জি স্যার।”

আরশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “ভেরি গুড।”

আরশাদ রিসোর্টের মূল দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অরা তার পিছু নিয়ে বলল, “আপনি আজ সত্যিই ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন স্যার?”

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁ।”

“কিন্তু আমি তো ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখিনি। কাল গেলে ভালো হতো না?”

আরশাদ রাগী কণ্ঠে বলল, “তোমাকে একবারও বলেছি আমি ফ্লাইটে যাবো?”

অরা ভীত গলায় বলল, “তাহলে?”

“নিজেই ড্রাইভ করে যাবো।”

অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কী সাংঘাতিক! আরশাদের ড্রাইভিং মোটেও সুবিধার নয়। একবার গাজীপুর থেকে গাড়ী চালিয়ে ঢাকায় আসছিল আরশাদ। পথে প্রকান্ড এক গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট করে। অগ্যতা পনেরো হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয় দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টারকে। আর সেই মানুষ কিনা ড্রাইভ করে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরতে চাইছে। আটকাতে হবে, যে করেই হোক আরশাদকে আটকে হবে।

আরশাদ ইতোমধ্যেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। অরা মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল।

জানালায় উঁকি দিয়ে বলল, “স্যার আপনি তো চলেও যাচ্ছেন, তাই আমিও আর এখানে থেকে কী করবো? আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবেন?”

শুটিং সেট এই রিসোর্টে করা হলেও আরশাদ এখানে থাকছে না। তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এক পাঁচ তারকা হোটেলে। আরশাদ বাদেও তার টিমের বাকি সদস্যরা সেখানে রয়েছে।

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “ওঠো!”

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এর আগেও আরশাদের শুটিংয়ের সুবাদে বহুবার কক্সবাজারে এসেছে অরা। তবে প্রতিবারই নতুনভাবে মুগ্ধ হয় জায়গাটার মোহে। প্রকৃতি যেন নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে এই স্থানটিকে। একপাশে সবুজে ঘেরা বিশাল পাহাড়, আরেক পাশে ডুবন্ত সূর্যটাকে বুকে দিয়ে বয়ে চলা সুবিশাল সমুদ্র। মাঝপথে চলছে গাড়ি।

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে না-কি মন এমনিতেই শান্ত হয়ে ওঠে। আরশাদের মধ্যে অবশ্য যে লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। রিয়ার ভিউ মিররে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ক্রুদ্ধমূর্তি ধারণ করা মুখটা। রেগে গেলে আরশাদের নাকটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এই রাগ নিয়ে না-কি সে ঢাকা পর্যন্ত ড্রাইভ করবে!

অরা ইতস্তত করে বলল, “একটা কথা বলি স্যার?”

আরশাদ গম্ভীর স্বর বজায় রেখে বলল, “হুঁ।”

“কথা ফোন করেছিল।”

মুহূর্তেই আরশাদের মুখের আদল বদলে গেল। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও হয়তো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। রেগে গেলে আরশাদের চোখে বিচিত্র এক কাঠিন্য এসে ভর করে। নিমিষেই সেই তা সরে গিয়ে জায়গা করে নিলো স্বাভাবিকতা।

আরশাদ উদগ্রীব গলায় বলল, “কখন?”

“যখন আকরাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তখন। আপনার ফোন বন্ধ পেয়ে আমাকে কল করেছে।”

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “আগে বলবে না? এতক্ষণ পর মনে পড়লো?”

অরা নিচু গলায় বলল, “সরি স্যার।”

অরার প্রতি জমা রাগটা আপাতত অপ্রকাশিত রেখে আরশাদ বলল, “কী বলছে কথা?”

“এখানকার মার্কেটে না-কি এক ধরনের শামুক পাওয়া যায়। কেউ চাইলে দোকানদাররা সেই শামুকে নাম বা অন্যকিছু খোদাই করে লিখে দেয়। কথা বলেছে বড় দেখে একটা শামুকে আপনার আর তার নাম খোদাই করে নিয়ে যেতে।”

আরশাদের ঠোঁটের কোণে অতি সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। খালি চোখে সেই হাসি দেখা না গেলেও অরা দেখতে পাচ্ছে। কে বলবে এই মানুষটাই কয়েক মিনিট আগে রাগে ক্রুব্ধমূর্তি ধারণ করেছিল।

আরশাদ বলল, “তুমি চেনো সেই মার্কেট?”

“জি চিনি। এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা।”

তাসমিয়া হক কথা, আরশাদের একমাত্র মেয়ে। আরশাদ হয়তো মানুষ হিসেবে একেবারে নিখুঁত নয়, অভিনেতা হিসেবেও নয়। তবে বাবা হিসেবে একেবারে একশোতে একশো। কথাকে ঘিরেই যেন ঘোরে তার পৃথিবী। সর্বক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকা এই মানুষটার ঠোঁটেও প্রচ্ছন্ন হাসি এসে জড়ো হয় কথার উপস্থিতিতে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই একটা মানুষই আরশাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

কালো কাঁচ ঘেরা গাড়ির মধ্যে বসে আরশাদ। অরাই মার্কেটে গিয়ে শামুকে নাম খোদাই করাচ্ছে। আরশাদ এই মুহূর্তে মার্কেটে নেমে পড়লে রক্ষা নেই। সুপারস্টার আরশাদ হক সাধারণ মার্কেটে এসে শামুক কিনছে এই দৃশ্য এক পলক দেখার জন্যে জড়ো হবে শতশত মানুষ।

প্রায় আধ ঘন্টা পর অরা গাড়িতে ফিরে। গাঢ় খয়েরী রঙের বেশ বড় একটা শামুক তার হাতে।

জিনিসটা আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখুন তো স্যার, কেমন হয়েছে!”

আরশাদ প্রবল আগ্রহ নিয়ে হাতে নিলো শামুকটা। ইংরেজি অক্ষরে খোদাই করে লেখা, ‘বাবা এন্ড কথা’। আরশাদ মুগ্ধ চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাত বোলালো মেয়ের নামের ওপর।

হঠাৎ কী যেন মনে করে আরশাদ বলল, “কথা পছন্দ করবে তো?”

অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “অবশ্যই করবে। আপনার দেওয়া কোনোকিছুই তার অপছন্দ হয় না।”

আরশাদের সমস্ত মনোযোগ আবারও ফিরে গেল শামুকটার দিকে।

অরা ভয়ে ভয়ে বলল, “একটা রিকুয়েস্ট করবো স্যার?”

“কী রিকুয়েস্ট?”

অরা মিনতির সুরে বলল, “আজ এতটা পথ একা একা ড্রাইভ করে ঢাকায় না ফিরলে হয় না?”

আরশাদ কয়েক মুহূর্ত অরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হয়।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here