ফিরে_আসা ৫

0
599

#ফিরে_আসা

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আজ সকাল সকাল আরশাদ বলল, “অরা, তোমাকে আজ থাকতে হবে না। তুমি গিয়ে কথাকে নিয়ে এসো।”

সেই থেকে বিরস হয়ে আসে অরার মুখভঙ্গি। বিরস মুখেই ড্রাইভ করে যাচ্ছে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। গাজীপুরের কিছুটা আগে আরশাদের একটা বাংলো বাড়ি রয়েছে। ডিভোর্সের পর থেকে কথাকে নিয়ে নওশীন সেখানেই থাকে। ঢাকা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতেই না-কি এই নির্জনতাকে আবাস হিসেবে বেছে নেওয়া তার। তবে আরশাদ মনে করে ভিন্ন কিছু। আরশাদের ধারণা মেয়েকে তার থেকে দূরে রাখতেই গাজীপুরে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নওশীন।

কারণ যেটাই হোক, ও বাড়িতে যেতে একেবারেই ভালো লাগে না অরার। নওশীন অযথা দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে যাবে। সবগুলো প্রশ্নই আরশাদকে ঘিরে। ডিভোর্সের পর থেকে আজ পর্যন্ত আরশাদের মুখে ‘নওশীন’ নামটা উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। নওশীন সেদিক থেকে একেবারেই বিপরীত। তার সকল কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু যেন আরশাদ।

সমস্যাটা হলো, আরশাদের কড়া নির্দেশ কিছুতেই নওশীনের সঙ্গে অযথা আলাপ করা যাবে না। তার বিষয়ে তো একেবারেই নয়। অরা চাইলেই নওশীনকে এড়িয়ে যেতে পারে না। মুখের ওপর বলে দিতে পারে না, “স্যারকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। তিনি উত্তর দিতে নিষেধ করেছেন।” কারণ অরার এই চাকরি পাওয়ার পেছনে নওশীনের বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। চার বছর আগে আরশাদ যখন নিজের জন্যে দক্ষ ম্যানেজার খুঁজতে ব্যস্ত ছিল, এই নওশীনই তাকে অরার খোঁজ দেয়।

গাজীপুরের এই বাংলোটা ইটের তৈরি। সামনে বিশাল এক বাগান। বাগানের কেন্দ্রবিন্দু সুইমিং পুল। অনেক শখ করে বাড়িটা তৈরি করেছিল আরশাদ। আগে প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে চলে আসতো এখানে। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় ডুবে থাকতো সকলে। অথচ সেই আরশাদ আজ এ বাড়িতে পা রাখার কথাও কল্পনা করতে পারে না।

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো নওশীন। এই মানুষটাকে অরা যতবারই দেখে, ততবারই মুগ্ধ হয়। কবিরা তাদের লেখায় কোনো অপরূপ সুন্দর মূর্তির বর্ণনা যেভাবে করে, নওশীন অবিকল তেমন। বড় বড় চোখ, বাঁশের কঞ্চির মতো নাক, ঝকঝকে সাদা দাঁত। সমগ্র চেহারায় বিচিত্র এক শান্ত-সুশ্রী ভাব। একবার তার মুখটার দিকে তাকালে হাজার পরিশ্রান্ত কেউও অবসাদমুক্ত হয়ে উঠতে পারে। একমাত্র এই নারীর অভাবেই বোধ হয় এখনো বিশ্বসুন্দরীর মুকুট অর্জন থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। সুপারস্টার আরশাদ হক যার প্রেমে পড়েছিল তাকে তো এতটা সুন্দরী হতেই হবে।

নওশীন প্রশস্ত এক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “তোমার অপেক্ষাই করছিলাম অরা। কথা যখন থেকে শুনেছে তুমি আসবে, তখন থেকে পাগল হয়ে আছে।”

অরা ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হাসি মুখে বলল, “কোথায় উনি?”

“তুমি বেশ দেরি করে ফেলেছো। উনি তোমার অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।”

অরা ব্যস্ত হয়ে বলল, “আই অ্যাম সো সরি, বেশি দেরি করে ফেলেছি না?”

নওশীনের আবারও তার বিখ্যাত হাসি হেসে বলল, “একদমই না, ঠিক সময়েই এসেছ। কফি খাবে তো?”

“আজ থাক ম্যাম, অন্য আরেকদিন খাবো। এমনিতেই অনেক দেরি…”

অরাকে থামিয়ে দিয়ে নওশীন মিষ্টি গলায় বলল, “আজ কোনো কথা শুনছি না। এর আগের দিনও এমন করেছিলে। তুমি কফি খাও এই ফাঁকে কথা আরেকটু ঘুমিয়ে নিক।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। কী মিষ্টি করে কথা বলে নওশীন! আরশাদ কী করে এমন মিষ্টভাষী একটা মেয়েকে সহ্য করতে পারে না কে জানে?

এ বাড়ির বসার ঘরটা বেশ ছিমছাম-গোছানো। জায়গায় জায়গায় অনেকগুলো পুরনো দিনের অ্যান্টিক শোপিস। নওশীনের অন্যতম শখ অ্যান্টিক শোপিস সংগ্রহ করা। আরশাদ এখন ঢাকায় যে বাড়িতে থাকে, ওই বাড়িটাও আগে ভর্তি হয়ে ছিল এ ধরনের শোপিসে। ডিভোর্সের পর সে নিজেকে ওগুলোকে ভেঙে গুঁড়ো করেছে।

মনের অজান্তেই অরার চোখ পড়লো দেয়ালে পাশাপাশি ঝুলতে থাকা দুটি বিশাল সাইজের ছবির দিকে। প্রথম ছবিতে নওশীন এবং ছোট্ট কথা। নওশীন যখন প্রথমবারের মতো মেয়েকে কোলে নিয়েছিল তখনকার ছবি। দ্বিতীয় ছবিতে পুরস্কার হাতে হাসৌজ্বল নওশীন। সে একজন অভিনেত্রী, আগে ছিল তবে এখন আর নেই বললেই চলে।

নওশীনের ক্যারিয়ার শুরু হয় ফ্লপ সিনেমা দিয়ে। পরপর তিনটি সিনেমা ফ্লপের পর তার ক্যারিয়ার যখন হুমকির সম্মুখীন, ঠিক তখনই স্বপ্নের মতো তার আছে আসে ‘আয়না’ সিনেমাটির প্রস্তাব। তাও আবার আরশাদের মতো সেলিব্রিটির বিপরীতে। আরশাদের নাম শুনে এক মুহুর্তও দেরি করেনি নওশীন, সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয় সিনেমাটির প্রস্তাব। ফলস্বরূপ, নওশীন পেয়ে যায় তার ক্যারিয়ারের প্রথম সফল সিনেমা, ভক্তদের অঢেল ভালোবাসা আর বেশখানিক পুরষ্কার।

‘আয়না’ সিনেমার শুটিং সেটে আরশাদ বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয়নি তাকে। শটের সময়ে ভেতরকার সকল অনুভূতি দিয়ে তার সঙ্গে অভিনয় করলে, ডিরেক্টর কাট বলার সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে। সেলিব্রিটিরা এমনই, নবাগত কিংবা সল্পপরিচিত কোনো নায়িকাকে পাত্তা দেবে না এটাই স্বাভাবিক। পাত্তা না পেলেও শুটিংয়ের প্রথম দিনেই আরশাদের মোহ আষ্টেপৃষ্টে ধরে নওশীনকে। প্রতিটা মুহূর্তে আর মন উসখুস করতো কোনো না কোনো ভাবে আরশাদকে মুগ্ধ করতে। শুটিংয়ের চৌত্রিশ দিনের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে মুগ্ধ করতে সফল হয়নি নওশীন।

তবে মুগ্ধ করার জন্যে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় তাকে। শুটিং শেষ হবার দুমাসের মাথায় রিলিজ পায় সিনেমা। প্রিমিয়ার শোতে উপস্থিত ছিলো পরিচালক, কলা-কুশলীসহ সিনেমার সকল অভিনয়শিল্পীরা।

সিনেমা শেষ হলে আরশাদ নিজে এসে তার কাছে বলেছিল, “You did a pretty good job.”

সেই সিনেমায় অভিনয়ের জন্যে আরও বহু মানুষের কাছে বহু প্রশংসা পেয়েছিল নওশীন। তার অভিনয়ের প্রশংসা করে পত্রিকার কলামে লেখা হয়েছে লাইনের পর লাইন। তবে আরশাদের ওই এক লাইন প্রশংসার কাছে সেসব যেন কিছুই নয়।

কোনো এক জুটির সিনেমা হিট হবে, কিন্তু তাদের নিয়ে দ্বিতীয় সিনেমা তৈরি হবে না এটা তো হতে পারে না। ‘আয়না’ সিনেমাটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানই আরশাদ-নওশীনকে নিয়ে দ্বিতীয় সিনেমার ঘোষণা করলো, সিনেমার নাম ‘প্রহর’। তাদের প্রেমটা মূলত শুরু হয় সেই সিনেমার সেটেই।

আজকের নারীবিদ্বেষী আরশাদের সঙ্গে তখনকার আরশাদের কোনো মিল নেই। সেই আরশাদ তখন মনে করতে প্রকৃতি নারী-পুরুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে সমান করে। পৃথিবীর উন্নয়নে দুজনেরই সমান অবদান। নারী-পুরুষের পার্থক্য তো কেবল মানুষের তৈরি। সেই মানুষটা আজ হঠাৎ এতটা বদলে গেল কী করে কে জানে!

একসঙ্গে প্রথম সিনেমার শুটিংয়ের সময় আরশাদ নওশীনকে কোনপ্রকার পাত্তা না দিলেও, দ্বিতীয় সিনেমার সেটে সব কেমন পাল্টে গেল। নওশীনের পাত্তা পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকতো আরশাদ। সারাদিন একসঙ্গে শুটিং সেটে কাটালেও বাড়ি ফিরে নওশীনের ফোন পাওয়ার জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনতো। যে দিনগুলোতে শুটিং থাকতো না, সেই দিনগুলোতে দুজনে ঘুরে বেড়াতো দূর-দূরান্তে।ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলোও হয়ে উঠতো তাদের উদযাপনের কারণ।

প্রথম দেখায় নওশীন আরশাদের প্রেমে পড়েছিল ঠিকই, তবে আরশাদ কখনো তার প্রেমে পড়েনি। ভালোবেসেছিল তাকে। প্রেম ব্যাপারটা ক্ষণস্থায়ী। মোহাগ্রস্থ হলে মানুষ প্রেমে পড়ে। মোহ কেটে গেলে প্রেমও অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটা জোরালো। একবার কাউকে ভালোবাসলে সহজে সেই অনুভূতি থেকে নিস্তার মেলে না।

‘প্রহর’ সিনেমাটা রিজিলের আগের দিন রাতে হুট করে নওশীনের কাছে ফোন আসে আরশাদের।

নওশীন ফোনটা রিসিভ করতেই আরশাদ হড়বড় করে বলে, “এই তুমি আমাকে বিয়ে করবে?”

এমনিতেই বেচারি সারাদিন সিনেমার প্রচার করে ক্লান্ত। তার ওপরে এমন কথা শুনে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়ে নওশীন।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “মানে?”

“মানে বলতে পারবো না। বিয়ে করতে চাইলে হ্যাঁ বলো, না করতে চাইলে না বলো। করবে?”

আরশাদের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ঝোঁকের মাথায় নওশীন বলে দেয়, “হ্যাঁ করবো।”

“তাহলে বাইরে এসো। আমি তোমার বাসার নিচে ওয়েট করছি।”

আরশাদের সবকিছুতেই অতিরিক্ত পাগলামি। তার পাগলামির মাঝেই সেদিন রাতে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। পরদিন সদ্যমুক্তি প্রাপ্ত সিনেমার থেকেও বেশি আলোচনা হয় পর্দার জুটির সত্যিকারের জুটি হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে।

বিয়ের পর খুব একটা সিনেমা করা হয়নি নওশীনের। আরশাদের বিপরীতে একটা সিনেমা করেছিল আরেকটা করেছিল নারীকেন্দ্রিক। কাজকে খুব একটা প্রাধান্য না দিয়ে সংসারী হয়ে উঠতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। এরপর কথা এলো, জীবনটা হয়ে উঠলো আরও রঙিন। আরও আনন্দময়। আরশাদ হাজার ব্যস্ততার মাঝে থাকলেও পরিবারই ছিল তার সর্বপ্রথম প্রাধান্য।

বিয়ের চারটি বছর দুজনের জন্যেই ছিল জাদুর মতো। জাদুকর যখন জাদু দেখায়, চোখের সামনে অবিশ্বাস্য সুন্দর সব কান্ড ঘটে। মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না সেগুলো সত্যিই ঘটছে। তাদের জীবনটা ছিল ঠিক তেমনই। কোনো কিছুর কমতি ছিল না আরশাদের, দিনশেষে মনের মাঝে বিচিত্র এক পরিতৃপ্তি অনুভূত হতো। মনে হতো এই পৃথিবীতে তার থেকে সুখী কেউ নেই, বেঁচে থাকাটাই যেন সার্থক।

তবে সেই সুখের জীবন যে ঝড়ের পূর্বের শান্ত আবহাওয়া ছিল, কে জানত! একদিন আচমকা এই সুন্দর জীবনে আসে প্রকান্ড কুৎসিত এক ঝড়। লণ্ডভণ্ড করে দেয় সাজানো-গোছানো জীবনটাকে। পৃথিবীতে কাটানো একেকটি দিন যেখানে সার্থক মনে হতো, সেখানে আজ কেবল বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে বেড়ায় আরশাদ।

আরশাদ এবং নওশীনের ডিভোর্স আজও রহস্যে ঘেরা। এই দুজন ছাড়া কেউই জানে না ডিভোর্সের বিচ্ছেদের কারণ। গণমাধ্যম থেকে বহুবার তাদের কাছে কারণটি জানতে চাওয়া হয়েছে। আরশাদ প্রতিবার সে প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও নওশীন বলেছে, “দুজনেই সম্মতিতেই আমরা আলাদা হয়ে গেছি।”

দুজনের সম্মতিতে এক হওয়া যায়, তবে আলাদা হওয়া যায় কিনা কে জানে? নওশীনের এই উত্তর ভক্তমহলের বেশির ভাগেরই বিশ্বাস হয়নি।

দুটো কফির মগ হাতে ফিরে এলো নওশীন। একটা কাপ অরার সমানে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “দেখো তো চিনি ঠিক আছে কিনা?”

অরা কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে বলল, “পারফেক্ট!”

নওশীনের অরার বিপরীতের সোফাটায় বসতে বসতে স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোমাদের শুটিং কেমন চলছে?”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। এই ভয়টাই করছিল এতক্ষণ ধরে। শুরু হতে যাচ্ছে নওশীনের প্রশ্নপর্ব।

অরা বলল, “ভালো চলছে ম্যাম।”

নওশীন মজার ছলে বলল, “আকরাম ভাই অনেক গুণী ডিরেক্টর। আমার একেবারে প্রথম সিনেমাটার ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। পঁচিশ লাখ টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল সিনেমাটা। আর আয় করে সবমিলিয়ে চার লাখ। বেচারা লস খেয়ে আর দ্বিতীয়বার আমাকে সিনেমায় নেওয়ার আমাকে সিনেমায় নিতে সাহস পায়নি।”

“আপনার আর অভিনয় করতে ইচ্ছা হয় না ম্যাম?”

“হয় তো। মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছা হয়, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন এ জীবনে কোনদিন শুটিং সেটের মুখোমুখি না হই।”

কথার মাঝেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠলো নওশীন। তবে মুহূর্তেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে কৌতূহলী গলায় বলল, “ভালো কথা, হঠাৎ করে সিনেমার নায়িকা বদলে গেল কেন? আগে তো শুনেছিলাম মেহেরীন কাজ করছে।”

অরা স্বভাবসুলভ হেসে বলল, “সেটা তো বলতে পারবো না ম্যাম। সম্ভবত প্রোডিউসারের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয়েছিল।”

“কোনো মানে হয়? একটা মেয়েকে সিনেমার আশা দেখিয়ে শেষ মুহূর্তে বাদ দিয়ে দেবে? এটা তো একজন অ্যাক্টরের ওপর অন্যায়। শাদ এটা মেনে নিলো কী করে?”

বড়লোকদের ঢংয়ের মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না অরা। অমন কুৎসিত ডিভোর্সের পরও আরশাদকে শাদ ডাকতে হবে কেন কে জানে? ভাগ্যিস আরশাদ বিষয়টা জানে না। জানলে নির্ঘাত তুলকালাম কান্ড ঘটাতো।

নওশীন অন্যরকম গলায় বলল, “শাদ ভালো আছে?”

“জি ম্যাম, স্যার ভালো আছেন।”

“কথার অ্যাডমিশনের ব্যাপারটা জানিয়েছিলে ওকে?”

কথা গাজীপুরের একটা কিন্ডারগর্টেনেই আপাতত শিক্ষাজীবন শুরু করেছে। তবে নওশীনের ইচ্ছা আগামী বছর থেকে তাকে ঢাকার নামী-দামী একটি প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবে। সেই স্কুলের করা নিয়ম, ভর্তির আগে অবশ্যই বাবা-মায়ের ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। বাবা-মা পাশ করলে দ্বিতীয় ধাপে সন্তানের ইন্টারভিউ।

ডিভোর্স হয়ে গেলেও এই সত্যি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আরশাদ এবং নওশীন কথার বাবা-মা। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক যেমনই থাক, ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ দিলে তো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না।
তবে আরশাদের এতে ঘোর আপত্তি। পরিষ্কার গলায় অরাকে জানিয়ে দিয়েছে, “স্কুলে পড়বে বাচ্চা, ইন্টারভিউ বাবা-মায়ের নেওয়া হবে কেন? যে স্কুলের নিয়ম-কানুনই ঠিক নেই সেই স্কুলের আমার মেয়ের পড়ার দরকার নেই।”

এমন কড়া কথা নওশীনকে জানিয়ে কাজ নেই। বেচারি শুধু শুধু কষ্ট পাবে।

অরা কিছু একটা ভেবে জড়সড় কণ্ঠে বলল, “বলেছিলাম ম্যাম। কিন্তু স্যার ইন্টারভিউয়ের জন্যে সময় করে উঠতে পারবেন না।”

নওশীন মেকি হাসি দিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো বলিনি কোনদিন ইন্টারভিউ দিতে হবে।”

অরা চুপ করে রইল।

নওশীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “ও আমাকে সহ্য করতে পারে না তাইনা?”

“না ম্যাম, আসলে…”

“অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। আমি চাইলেই পারতাম আমার জীবন থেকে ওকে একেবারেই সরিয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। শুধুমাত্র কথার জন্যে আমার জীবনটা ওর জীবনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। অতীতে যা হয়েছে, হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম সব ভুলে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে। অন্যান্য বাচ্চারা বড় হয় বাবা-মা দুজনের মাঝেই। আমার মেয়েটা তাহলে কী দোষ করেছে? ও কেন বাবা-মায়ের এমন তিক্ত সম্পর্ক দেখে বড় হবে।”

অরা কিছুই বলছে না। থ মেরে বসে আছে। আজ হঠাৎ নওশীন এসব কথা বলছে কেন? সে কী কোনোভাবে চাইছে, অরার মাধ্যমে এই কথাগুলো আরশাদের কাছে পৌঁছে যাক?
নওশীনের চোখদুটো ছলছল করছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়তে পারে অবাধ্য অশ্রুধারা।

নওশীন আঁচলে দিয়ে সাবধানে চোখের জল আড়াল করে বলল, “আমি জানি শাদ কেন আমাকে সহ্য করতে পারে না। কাগজে-কলমে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স হলেও প্রকৃতপক্ষে আমিই প্রথম ডিভোর্সের কথা তুলেছিলাম। ও হয়তো ভাবতেও পারেনি আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। আমার কী-ই বা করার ছিল অরা? আমার কাছে ডিভোর্স ছাড়া অন্য কোনো উপায়…”

“অরা!”

নওশীনের কথার মাঝে বাঁধ সাধলো মিষ্টি এক কণ্ঠস্বর, কথার কণ্ঠস্বর। ঘুম ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়েই তার চোখ পড়ে বসার ঘরে বসে থাকা তার অন্যতম প্রিয় মানুষটার দিকে। কথা গুটি গুটি পায়ে ছুটে এলো অরার দিকে। এক মুহুর্তও অপচয় না করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অরার ঠোঁটেও প্রশস্ত হয়ে ফুটে উঠেছে উজ্জ্বল এক হাসির রেখা।

বাবা-মায়ের ডিভোর্সের সময়টায় কথার বয়স ছিল আড়াই বছর। বিচ্ছেদের কঠিনতম ওই সময়টায় দুজনেই মানসিকভাবে স্বাভাবিক ছিল না। সন্তানের প্রতি সকল মনোযোগ যেন উঠেই গিয়েছিল। ওই সময়টায় তিন মাস কথাকে নিজ দায়িত্বে সামলেছিল অরা। যদিও তা ম্যানেজারের দায়িত্বে পড়ে না। কিন্তু ওই যে, মেয়েমানুষের মন। একটা দেবশিশু বিনা অপরাধে অবহেলায় পড়ে আছে – মানতে পারেনি সেই মন।

সেই থেকে কথা ও অরার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। কথা মনে করে, বড়রা সবাই পচা। সারাক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থাকে আর কঠিন কঠিন কথা বলে। বড়রা আবার কার্টুনও পছন্দ করে না। তবে অরা মোটেই তেমন নয়। সে তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলে, খেলা করে। তার থেকেও বড় কথা অরা কার্টুনের সকল চরিত্রদের চেনে।

কথা অরাকে জাপটে ধরেই আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, “তুমি অনেক পচা অরা, আমি তোমার সাথে কথা বলবো না।”

অরা অবাক গলায় বলল, “কেন? আমি কী করেছি?”

“এতদিন পর এসেছ কেন? প্রতিদিন আসতে পারো না তুমি? প্রতিদিন আমাকে একা একা স্পঞ্জবব দেখতে হয়।”

“আহারে! এরজন্যে রাগ করেছে আমার কথাটা? আচ্ছা দাঁড়াও, তোমাকে এক্ষুনি খুশি করে দিচ্ছি।”

অরা কথাকে ছেড়ে হ্যান্ডব্যাগটা খুলে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কথাও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ব্যাগের দিকে। নিমিষেই বেরিয়ে গেল কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা, কক্সবাজার থেকে কেনা সেই শামুক।

অরা মুচকি হেসে শামুকটা বাড়িয়ে দিলো কথার দিকে। মুহূর্তেই রাগ-টাগ উবে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেয়েটার চোখমুখ। কথা চোখ বড় বড় করে অনেকটা সময় তাকিয়ে রইল শামুকের ওপর খোদাই করা অক্ষরগুলোর দিকে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা তো বাবার গিফট। বাবার গিফট দিয়ে তুমি আমাকে খুশি করছো কেন?”

অরা এবং নওশীন দুজনেই ফিক করে হেসে ফেলল।

নওশীন হাসতে হাসতেই বলল, “আমার মেয়ের সঙ্গে বুদ্ধিতে পারবে না অরা। নিজের গিফট নিয়ে এসে রাগ ভাঙাও।”

অরা হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি রেডি হয়ে এসো। ঢাকায় গিয়েই আমার গিফটটা পেয়ে যাবে।”

কথা ব্যস্ত হয়ে মায়ের সঙ্গে তৈরি হতে চলে গেল। আগামীকাল থেকে দীর্ঘ সাতটি দিন আরশাদের কোনো শুটিং নেই। পরবর্তী সিনেমা নিয়ে কয়েকটা মিটিং থাকলেও সেগুলো ক্যানসেল করা হয়েছে। এই সাতটা দিন কথা বাবার কাছে থাকবে। এই নিয়ে তার উৎসাহের সীমা নেই। উৎফুল্ল ভঙ্গিতে মায়ের সঙ্গে ব্যাগ গোছাচ্ছে সে। নওশীন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যাগে রাখার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছে কথার কারণে। মেয়েটা বারবার ব্যাগটা ভর্তি করে ফেলছে হাবিজাবি সব খেলনা দিয়ে।

কথার ব্যাগগুলো বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড গাড়িতে তুলে রেখেছে। কথাও ইতোমধ্যে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়েছে। আজ তার পরনে সিন্ড্রেলার ড্রেস। সে বাবার প্রিন্সেস তো, তাই বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলেই প্রিন্সেসের পোশাক পরে যায়।

নওশীন অরার কাঁধে হাত রেখে বলল, “সাবধানে নিয়ে যেও অরা। কথা কিন্তু ইদানিং বেশ বিচ্ছু হয়েছে। সারাপথ খুব জ্বালাবে, কিছু মনে করো না।”

“কী যে বলেন ম্যাম! আমি ওকে নতুন দেখছি?”

“আরেকটা কথা অরা, শাদের সাথে প্লিজ আরেকবার এডমিশনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বোলো। ওই স্কুলে একবার চান্স পেলে কথার জীবনটাই বদলে যাবে।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “জি ম্যাম, বলবো।”

জানালার ফাঁক দিয়ে মায়ের দিকে হাত নাড়ছে। যদিও বাবার সঙ্গে দেখা করবে বলে তার আনন্দের সীমা নেই, তবুও মায়ের জন্যে মন কেমন করাটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বাড়িতে বেড়ে ওঠে। মা বকলে বাবার কাছে যায় বিচার নিয়ে, বাবা বকলে মায়ের কাছে।

সকলের কাছে যা অস্বাভাবিক, তাই কথার জন্যে স্বাভাবিক। হয়তো সে কোনোদিনও জানবে না আর দশটা স্বাভাবিক সন্তান কীভাবে বেড়ে ওঠে। একটা সময়ে যখন জানবে, তখন কষ্টে তার মনটা বিষিয়ে উঠবে। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতির জন্যে বেচারি নিজেকেও দোষারোপ করতে পারে। কোনো মানে হয়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here