ফিরে_আসা ৬+৭

0
597

#ফিরে_আসা
৬+৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

স্বাভাবিক গতিতে ড্রাইভ করছে অরা। কথা তার ঠিক পাশে বসেই জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। অরার ড্রাইভিংয়ের ওপর ভরসা করা যায়। আরশাদের মতো গাড়িকে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করার প্রবণতা তার মাঝে নেই। তার ওপরে রাস্তায়ও খুব একটা যানজট দেখা যাচ্ছে না।

অরা রিয়ার ভিউ মিররের মাঝে লক্ষ করলো কথাকে। সেই তখন থেকে মুখটা ভার করে বসে আছে মেয়েটা।

অরা আদুরে গলায় বলল, “কী ব্যাপার ম্যাডাম? মুড অফ না-কি আপনার?”

কথা গাল ফুলিয়ে বলল, “হুঁ।”

অরা হতবাক গলায় বলল, “সেকি? প্রিন্সেস কথার হঠাৎ মুড অফ কেন?”

“তোমার জন্য!”

“আমার জন্যে? আমি আবার কী করলাম?”

“তোমার জন্য মিস আমাকে বকা দিয়েছে। বাবাকে বলবো তোমাকে কঠিন একটা পানিশমেন্ট দিতে।”

অরা ভড়কে ভড়কে গিয়ে বলল, “ওয়েট ওয়েট! আমার জন্যে মিস তোমাকে বকা দেবে কী করে? তোমার মিস কী আমাকে চেনে?”

কথা ভেংচি কেটে বলল, “বলবো না!”

“তাহলে আমিও কোনো পানিশমেন্ট নিচ্ছি না।”

কথা এবার অরার দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল, “আমার ইংলিশ স্টোরি বুকে রেড রাইডিং হুডের গল্প আছে। তুমি গল্পটা জানো?”

“হ্যাঁ জানি।”

“ওই গল্পের এক জায়গায় লেখা আছে অরা। A U R A, অরা। এটাই তো তোমার নাম, তাই না?”

“হ্যাঁ। কেন বলো তো?”

“আর দেখো মিস বলল অরা মানে আভা। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, না মিস। অরা তো আমার বাবার ম্যানেজার। মিস আমার বকা দিয়ে বসিয়ে রাখলো।”

অরা ফিক করে হেসে ফেলল।

কথা আহত গলায় বলল, “এই তুমি হাসছো কেন? হাসির কারণে এখন তোমার পানিশমেন্ট ডাবল।”

“আচ্ছা বাবা সরি। এবার আমার কথাটা শোনো?”

“কী কথা?”

“মিস কিন্তু ঠিকই বলেছিলেন কথা। অরা মানে হলো আভা।”

“কীভাবে?”

“সিন্ড্রেলার আশেপাশে সব কেমন চকচক করে দেখেছো?”

“হুঁ।”

“ওটাই সিন্ড্রেলার অরা। আবার সানসেটের সময়ে আকাশে সূর্যের আশপাশে সব কেমন লাল লাল দেখায় না?”

“হুঁ।”

“সেটা হলো সূর্যের অরা।”

কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তাভাবনার মাঝে কাটিয়ে কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আই অ্যাম কনফিউজ। তোমার নাম কী? অরা না-কি আভা?”

অরা সামান্য হেসে বলল, “আমার নাম অরাই। কিন্তু নামের অর্থ আভা। আমাদের সবার নামেরই একটা অর্থ আছে।”

“সত্যি? তাহলে আমার নামের অর্থ কী?”

অরা কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, “তোমার নামের অর্থ আবার কী হবে? কথা মানে কথা।”

কথা ঠোঁট উল্টে বলল, “তোমার নামের এত সুন্দর অর্থ আছে আর আমার নামের নেই?”

“কে বলেছে নেই? তোমার নামটা কত ইমপরটেন্ট জানো? আমরা প্রতিদিন কত কথা বলি? কথা না বলে তো আমরা থাকতেই পারবো না। সবার সব কথার মাঝে তোমার নামটা লুকিয়ে আছে।”

কথার ভার হয়ে থাকা মুখটা নিমিষেই সতেজ হয়ে উঠলো। উজ্জ্বল হাসির রেখায় চকচক করে উঠলো আর মুখটা।

হাসিটা ঠোঁটে রেখেই কথা বলল, “তোমার নামটা কত কুল অরা! এই নাম কে রেখেছে? তোমার বাবা না-কি মা?”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “কেউ না।”

“সেটা কী করে? তুমিই তো বলেছিলে ছোটবেলায় বাবা অথবা মা বাচ্চাদের নাম রাখে?”

“বলেছিলাম না-কি? সেটা সত্যি। আমার বাবা ছোটবেলায় আমার একটা নাম রেখেছিল। কিন্তু বড় হয়ে আমি সেই নামটা বদলে ফেলেছি।”

কথা বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে বলল, “বড় হয়ে নাম বদলানো যায়?”

“যায় তো।”

“আমিও বদলাতে পারবো?”

“পারবে। কিন্তু তুমি বদলাবে কেন কথা? তোমার নামটা তো এমনিতেই অনেক সুন্দর।”

“আচ্ছা অরা, ছোটবেলায় তোমার নাম কী ছিল?”

প্রশ্নটায় কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল অরা। তীব্র বর্ষণের সময় একের পর এক জলের ফোঁটা যেমন প্রচন্ড গতিতে আছড়ে পড়ে ধরণীর বুকে, ঠিক সেই গতিতে চোখের সমানে দিয়ে বয়ে গেল একের পর এক দৃশ্য, একের পর এক স্মৃতি।

কথা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “ও অরা! বলো না!”

অরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “কী বলবো সোনা?”

“ছোটবেলায় তোমার নাম কী ছিল?”

অরা বিড়বিড় করে বলল, “আখিতারা বানু।”

আখিতারা নামের ওই মেয়েটার সঙ্গে আজকের অরার তিলপরিমাণ মিল নেই। সেই মেয়েটা ছিল ভীতু প্রকৃতির, চুপচাপ অন্যায় সয়ে যাওয়া প্রকৃতির। যার অন্তরাত্মা ছিল জরতায় পরিপূর্ণ। মুখ খুলে কথা বললেও যাকে শাস্তির ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো।

সিরাজগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি গ্রামে বেড়ে ওঠা অরার। মাটির তৈরি ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল বসবাস তার। বাবা হাফিজ মিয়া ছিলেন সামান্য এক মুচি। বাজারে মানুষের জুতা সেলাই করে যেটুকু অর্থ উপার্জন করতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। শৈশবটা তাই আখির কেটে যায় দারিদ্রের মাঝেই। ঈদে নতুন জামা হিসেবে যা পেত তা ছিল কেবলমাত্র গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ের পুরনো জামা। মাসে-দুমাসে একবার যে ভালো খাবার জুটতো তাও ছিল অন্যের দান করা ছদকার মুরগি।

এমন দারিদ্রের মাঝেও লেখাপড়ার প্রতি অরার ছিল তীব্র আকর্ষণ। মেধাবী ছাত্রী ছিল বলেই হয়তো প্রতি পরীক্ষায় সকলের থেকে বেশি নম্বর পাওয়া তার নেশা হয়ে দাঁড়ায়। তার পড়াশোনা নিয়ে হাফিজ মিয়ার ছিল ঘোর আপত্তি। দুবেলা ঠিক মতো ভাতের যোগান দিতেই যাকে হিমশিম খেতে হয় সে আবার মেয়ের স্কুলের বেতন দেবে কোত্থেকে? এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হেড স্যার নিজেই একদিন ডেকে পাঠান তাকে। স্পষ্ট বলে দেন, যতদিন পর্যন্ত অরা এমন ভালো রেজাল্ট করে যাবে, ততদিন কোনপ্রকার বেতন দিতে হবে না তাকে। ব্যস! এরপর থেকে অন্তত পড়াশোনা হুমকির মুখে পড়ার দুশ্চিন্তা করতে হয়নি তাকে।

তবে জীবন থেকে দুশ্চিন্তা নামক বিষয়টা যে একেবারেই উবে গিয়েছিল তাও নয়। তার মা আকলিমা খাতুনের সারাবছরই কোনো না কোনো অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকতো। ডাক্তার দেখানোর সাধ্য নেই, কবিরাজের কাছে ঝাড়-ফুক করিয়েও লাভ হয়নি। তার ওপরে আবার অরার বয়স যখন আট বছর, দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি।

এই সময়টাতে না-কি বেশি বেশি পুষ্টিযুক্ত খাবার, ফলমূল খেতে হয়। অথচ আকলিমার বেশির ভাগ দিনই কাটতো অনাহারে। অরা অতটুকু বয়সেও যথাসাধ্য চেষ্টা করতো মায়ের সেবা করতে। গা কাঁপিয়ে জ্বর এলে মাথায় পানি দেওয়া, কপালে হাত বুলিয়ে দেওয়া, মুড়ি মাখিয়ে খাইয়ে দেওয়া – যতটুকু পারতো, করতো।

তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে আকলিমার শরীর। একটু পর পর মাথা ঘুরে পড়ে যেতেন, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি করে সব উগলে দিতেন। হাফিজ মিয়াকে অবশ্য একবার বলেছিলেন ডাক্তার দেখানোর কথা। তিনি খ্যাঁক করে উঠে বলেছিলেন, “বাচ্ছা-গাচ্ছা আল্লাহর দান। উনিই দেইখা রাখবেন, ডাক্তার লাগবো কোন কামে?”

নয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই একদিন আচমকা আকলিমার প্রসব ব্যাথা ওঠে। টানা পাঁচ ঘণ্টা প্রকৃতির সঙ্গে কঠোর লড়ায়েই পর তিনি জন্ম দেন ফুটফুটে এক পুত্রসন্তানের, তবে মৃত। পুত্রশোকে কাতর হয়ে আকলিমার দুর্বল শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন এই কঠিন সময়ে স্বামীকে পাশে পাবেন। তবে দেখা গেল ঠিক উল্টো চিত্র। মৃত পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে হাফিজ মিয়া দিনরাত ভর্ৎসনা করে গেলেন তাকে।

ভাইয়ের মৃত্যুর ঠিক দুইদিন পর, মধ্যরাতে মায়ের পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট অরা। আকলিমা হঠাৎ তাক ঘুম থেকে ডেকে তুলে কাতর স্বরে বলল, “মা গো, তুমি অনেক লক্ষ্মী মাইয়া। এইরকম লক্ষ্মী হইয়াই থাইকো। বাপজানরে বেশি ত্যক্ত কইরো না। আমি গেলাম।”

এমন কঠিন কঠিন কথা বোঝার বয়স তখনও হয়নি অরার। ফ্যালফ্যাল করে কিছু সময় তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মুখটা খুলে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা কেড়ে নিয়ে গেল তার একমাত্র আশ্রয়টুকু।

মায়ের মৃত্যুর পর একেবারেই বদলে গেল অরা। সারাক্ষণ গুটিয়ে রাখতো নিজেকে। মনে করতো, মায়ের চলে যাওয়ার পেছনে দোষটা একমাত্র তারই। সে আরেকটু দেখাশোনা করলেই হয়তো বেঁচে যেত মা।

এদিকে হাফিজ মিয়ার আয়ের পথ যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষের কাছে এমনিতেই অর্থ-কড়ির অভাব। তার ওপরে আবার জুতা সেলাই করানো যেন একপ্রকার বিলাসিতা।

গ্রামে তখন নির্বাচনের সময়। চেয়ারম্যান পদের জন্যে দুই প্রার্থী দিনরাত এক করে প্রচারে ব্যস্ত। হাফিজ মিয়া কাজকর্ম বন্ধ করে তৎকালীন চেয়ারম্যানের পেছনে পড়লেন। সারাদিন কেবল চেয়ারম্যানের পিছে ঘুরঘুর করতেন, প্রচারণামূলক লিফলেট বিলি করতেন, উঁচু গলায় স্লোগান হাকতেন। তার কাজেকর্মে চেয়ারম্যান সাহেবও মুগ্ধ হলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করা মাত্রই হাফিজ মিয়াকে তার বাড়ির দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

বেতন তেমন আহামরি কিছু নয়, তবে মুচির কাজ করে যা পেতেন তার থেকে অন্তত ভালো। ক্রমেই দিন ফিরতে লাগলো হাফিজ মিয়ার। মাটির ঘরে টিনের ছাদ বসালেন, নিজে পালন করার জন্যে বেশ খানিক হাস-মুরগিও কিনলেন। তার থেকেও বড় কথা, গ্রামের সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করলেন।

সৎ মা আয়েশা বেগমের আগমনে জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল অরার। বিয়ে করে এ বাড়িতে আসা মাত্রই অরা হয়ে উঠলো আয়েশার চোখের বিষ। অন্যান্য আর দশটা সৎ মায়ের মতো তিনিও বকাঝকা ব্যতীত কথা বলতে পারতেন না অরার সাথে। সংসারের ছোট থেকে বড় সকল কাজ করাতেন ছোট্ট ওই মেয়েটাকে দিয়েই। সামান্য পান থেকে চুন খসলে তীব্র অপমানে বিষিয়ে ফেলতেন অরার ছোট্ট হৃদয়কে।

এক পর্যায়ে আয়েশা সকল সীমা অতিক্রম করে অরার গায়ে হাত তুলতে শুরু করলেন। তার সবথেকে প্রিয় কাজ, তিনবেলা হাতের কাছে যা পাবেন তাই দিয়ে মারবেন। কখনো ঝাড়ু, কখনো স্যান্ডেল, কখনো গরম তেলে ডুবানো খুন্তি। অরার দিনটাই শুরু হতো সৎ মায়ের মারের অপেক্ষায়। আধঘন্টার মতো অনবরত মার খেয়ে তারপরেই স্কুলে যাবে। স্কুল থেকে ফিরে আবার সেই একই নিয়মে মার খাবে। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আগের তুলনায় সচ্ছল হলেও দুবেলা দুমুঠো ভাত তার কখনোই জোটেনি। ছোট ছোট ভুলের জন্যে আয়েশা প্রায়ই খেতে দিতেন না তাকে।

অরার বয়স তখন কত হবে? তেরো কী চৌদ্দ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো বয়স তার হয়েছে। তবুও চুপ মেরে পড়ে থাকতো এক কোণে। সবটাই তার নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল মেয়েটা। হাফিজ মিয়া এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। তার চোখের সামনে বহুবার মার খেয়েছে অরা। প্রথম প্রথম বাবার কাছে বিচার দিতে যেত অরা। তিনি হাই তুলে বলেছেন, “বলদ মাইয়া, নতুন মার সাথে মানায়ে চলতে পারস না?”

সেই থেকে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায় অরা। কী হবে প্রতিবাদ করে? কাউকেই তো দিনশেষে পাশে পাচ্ছে না।

বিয়ের পরপর তিন বছরে তিন পুত্রসন্তানের জন্ম দেন আয়েশা। দরিদ্র পরিবারে এমনিতেই পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়াটা কোনো নারীর জন্যে বিশাল সার্থকতা। হাফিজ মিয়ার কাছে দ্বিতীয় স্ত্রীর কদর বহুগুণ বেড়ে গেল। একই সঙ্গে বেড়ে গেল অরার প্রতি অবহেলা।

ছোট ছোট ভাইগুলোর দেখাশোনায় অরার সমস্ত দিন পার হয়ে যেত। আয়েশা বাচ্চাদের তার কাছে রেখে চলে যেতেন পাশের বাড়িতে সিরিয়াল দেখতে। অরা মনে মনে কেবল একটাই প্রার্থনা করত, বাচ্চাগুলো যেন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের ঘুম ছাড়া অরার কোনপ্রকার অবসরের অবকাশ নেই।

এতসব ঝামেলার মাঝে স্কুলে যাওয়া একেবারেই কমে যায় তার। তবুও পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে থাকেনি অরা। দিনভর সংসারের কাজ আর ভাইদের সামলানোর পর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, তখন চুপিচুপি বই নিয়ে বসতো সে। মনে সারাক্ষণ ভয় – এই বুঝি নতুন মা জেগে গেল। এই বুঝি শুরু হলো তার নির্মম অত্যাচার।

ভাগ্যিস কোনো রাতে জেগে যায়নি। এভাবেই হাজার বাঁধা পেরিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয় অরা। পরীক্ষার পুরো সময়টাতেও এমন রাত জেগে জেগে পড়তে হয়েছে তাকে। সৌভাগ্যবশত কোনো কষ্টই বিফলে যায়নি। পরীক্ষায় অনবদ্য রেজাল্টের পাশাপশি পেয়ে যায় মেধাবৃত্তি। বৃত্তির টাকা আর হেড স্যারের সহযোগিতায় অরা কলেজে ভর্তি হয়ে যায়।

কলেজের ভর্তির ব্যাপারটা বাড়ির কাউকে বুঝতে দেয়নি। জানিয়েছে, এসএসসিতে ফেল করেছে বলে আবারও ক্লাস টেনে থাকতে হবে। এমনিতেও তার পড়াশোনার ব্যাপারে বরাবরই ঘোর আপত্তি ছিল হাফিজ মিয়ার। মেয়েমানুষকে আবার এত পড়ালেখা করতে হবে কেন? কোনোভাবে যদি বুঝে ফেলতেন অরার কলেজে পড়ার ব্যাপারটা তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলতেন।

কলেজের দুটো বছর কোনোক্রমে পার হয়ে গেলেও শেষ রক্ষা আর হলো না। এইচএসসি পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই বিষয়টা জানতে পারেন হাফিজ মিয়া। তার ক্রোধের সঙ্গে যুক্ত হয় আয়েশার অত্যাচার। খুন্তি দিয়ে মারতে মারতে অরাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তিনি।

অরা যে বিষয়টাতে খুব মর্মাহত হয়েছিল তাও নয়, মনে মনে বরং খুশিই হয়েছিল। পরীক্ষার কয়েকটা দিন নির্বিঘ্নে কাটানো যাবে। তার আশ্রয় জুটলো রাইসা নামের এক বান্ধবীর বাড়িতে। রাইসার মা মলিনা বেগম অত্যন্ত আন্তরিক প্রকৃতির নারী। যে কটা দিন অরা তার কাছে ছিল, মনে হয়েছিল যেন মায়ের আদরে ছেয়ে আছে তার অন্তরাত্মা।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই হঠাৎ রাইসাদের বাড়িতে আগমন ঘটে হাফিজ মিয়া এবং আয়েশা বেগমের। আয়েশা বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অরাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। হাফিজ মিয়ার চোখদুটোও ছলছল করছে। এই বুঝি টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।

হাফিজ মিয়া অরার মাথায় হাত রেখে অনুতপ্ত
স্বরে বললেন, “মা রে আমার বুক খালি কইরা তুই অন্যখানে আয়া পড়লি? তোরে ছাড়া আমি বাঁচি কেমনে?”

কৃতজ্ঞতায় সজল হয়ে ওঠে অরার চোখদুটোও। এতদিনে অবশেষে তার অভাব উপলব্ধি করতে পেরেছে তারা। আজকের পর থেকে আর কোনো কষ্ট থাকবে না তার জীবনে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ কান্নাকাটি পর্ব শেষে বাড়ি ফিরে এলো অরা।

সুখের দিনের আশা সম্ভবত দুরাশা। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অরা টের পেয়ে যায়, এই কতগুলো দিনে তার অভাব বিন্দুমাত্র অনুভব করেনি হাফিজ মিয়া। তাকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য একটাই, তাকে বিয়ে দেওয়া। আয়েশা বেগম পান চিবোতে চিবোতে পাত্রের গুণগান গেয়ে বললেন, “বুঝলি আখি, তোর জামাই বিশাল বড়লোক। মেলা ধানি জমি আছে, গঞ্জে না-কি একটা হোটেলও আছে। ভাতের হোটেল। তোর রান্ধনের ভেজাল নাই। তিন বেলা হোটেল থেইকা খাওন আসবো। তুই যে বাড়িতে থাকবি, সেইডা জামাইর নিজের বাড়ি। পাকা বাড়ি, তোর বাপের মতো টিনের ঘর না। একটাই ঝামেলা, জামাইর বয়স একটু বেশি। এই ধর চল্লিশ-পঞ্চাশ। তাতে কী হইছে? বুড়া জামাইয়ের অনেক সুবিধা আছে। দেখবি তোরে সোনা সোনা কইরা রাখবো।”

অরার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। যে মেয়েটা ছোট্ট এই গ্রামে হাজার দারিদ্রতার মাঝেও দেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে কী করে পারবে বৃদ্ধ একটা লোককে বিয়ে করে ঘর-সংসার সাজাতে?

এই প্রথমবারের মতো বুকে সাহস সঞ্চয় করে করে অরা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কম্পিত স্বরে বলল, “আমি বিয়া করমু না।”

তৎক্ষণাৎ হাফিজ মিয়া মেয়ের গালে প্রচন্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, “বেদ্দব মাইয়া! বিয়া করবি না মানে? কাইলকাই তোর বিয়া। দুই দিন ঘরের বাইরে থাইকা পাঙ্খা গজাইছে না? মাইয়ামানুষের পাঙ্খা থাকন ভালো না।”

মেয়েমানুষের পাখা গজাবে কী করে? তাদের জন্মই তো হয় অদৃশ্য দুটো পাখা নিয়ে। এজন্যেই মেয়েমানুষ একবার ওড়ার সংকল্প করলে বাঁধা দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।

অরাকে টেনে-হিঁচড়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হলো বাড়ির পেছন দিকের ঘরটাকে। বাড়িজুড়ে উৎসবের আমেজ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রঙিন কাগজ দিয়ে ঘর সাজাচ্ছে, কম বয়সী মেয়েরা একে অপরের হাত রাঙিয়ে দিচ্ছে মেহেদীর লালে। ব্যান্ডপার্টিকে খবর দেওয়া হয়েছে। অনবরত বাজনা বাজিয়েই যাচ্ছে তারা।

এসবই করা হয়েছে সোবহানউদ্দিনের খরচে। সোবহানউদ্দিনের পাশের গ্রামের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। টাকার গরমে যেন মাটিতেই পা পড়ে না তার। অরার এইচএসসি পরীক্ষার সিট পড়েছিল তার গ্রামের। নিয়মিত যাওয়া-আসায় মেয়েটাকে চোখে পড়ে তার। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। আর দেরি না করে মেয়েটার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন বিয়ের প্রস্তাব। সম্পত্তির লোভে দিশেহারা হয়ে হাফিজ মিয়াও লুফে নেন সেই প্রস্তাব।

চিরকাল অন্যায় সহ্য করে আসা অরার ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙেছে। অদৃশ্য ডানা দুটো মেলে আকাশে উড়ে বেড়ানোর সংকল্পে স্থির হয়ে আছে তার মন। রাতের দিকে শুরু হলো ব্যান্ডপার্টির বাজনা। এদিকে বদ্ধ ঘরে অরা অতিষ্ট হয়ে পড়েছে মুক্তির আশায়। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ঘরে ভেতরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ চোখ পড়লো জিনিসটার দিকে।

এঘরের বিছানার একটা পায়া ভেঙে গেছে বহু আগেই। নড়বড়ে বিছানাটা সমতল করে রাখার জন্যে হাফিজ মিয়া ভেঙে যাওয়া পায়াটির নিচে এক টুকরো ইট রেখে দেয়। অরা তার দুর্বল শরীরে বহু কষ্টে টেনে বের করলো সেই ইটের টুকরো।

এরপর আর কী! ঘরের ভেতর থেকে তালা বরাবর অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে অরা। মনের মাঝে একরাশ ভয়। যদি ইটের শব্দে কেউ এদিকে চলে আসে? যদি নতুন মা কোনোভাবে বুঝে যায় সে পালানোর চেষ্টা করছে? রাগে-ক্ষোভে নির্ঘাত মেরে ফেলবে তাকে। তবুও কোনোকিছুর পরোয়া না করে সাবধানে আঘাত করে গেল অরা।

ঘন্টা দেড়েক পর ধপ করে একটা শব্দ ভেসে এলো ঘরের বাইরে থেকে। দরজার ফাঁক থেকে অরা ভয়ে ভয়ে দেখলো, তালাটা ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। হাজার যন্ত্রণার মাঝেও বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে।

সকলে বাড়ির সামনের দিকটায় গানে বুঁদ হয়ে আছে। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অরা ছুটে চলে যায় পুকুরের কাছে। পুকুরটা বাড়ির পেছন দিকে। সে ঘরটাতে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল তার ঠিক মুখোমুখি। অরা সাত-পাঁচ না ভেবে ঝুপ করে ঝাঁপ দিলো পুকুরে।

অমাবশ্যার ঘুটঘুটে রাতে পুকুরে সাঁতার কাটা সহজ ব্যাপার নয়। ভয়ে সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠার কথা। তবুও নির্ভয়ে পুকুর পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে পৌঁছে গেল। যে মেয়েটা অমন ক্রুর জীবন ছেড়ে আসার সাহস করেছে, তার আবার অন্ধকারে ভয় কীসের?

ওপাড়েই রাইসাদের বাড়ি, অরা এক নিঃশ্বাসে ছুটে গেল সেখানে। রাইসার মা মলিনা বেগম সবটাই শুনলেন। অরাকে তিনি সন্তানের স্নেহ দিয়েছেন, মেয়েটা বিপদে পড়ে তার কাছে এসেছে। তিনি কী পারেন তাকে দূরে ঠেলে দিতে?

মলিনা বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, “মা গো, তোমারে এই গেরামে রাখা যাবে না। তোমার বাপে ঠিকই খুঁইজা বাইর করবো। কালকে ভোরে তোমারে নিয়া আমি ঢাকায় যাবো। ওইখানেই ভালো একটা ব্যবস্থা কইরা দিবো ইনশাল্লাহ।”

এই প্রথম কেউ অরার বিশ্বাস ভাঙেনি। পরদিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই মলিনা বেগম অরার হাত ধরে ছুটে গেলেন বাসস্টেশনের দিকে। খারাপ মানুষগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে অবশেষে ঢাকায় এসে পৌঁছালো তারা।

আগে কোনদিন ঢাকায় আসেনি অরা। শহরের চাকচিক্য সমন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না তার। এখানকার যানজট, ব্যস্ততা সবকিছুই যেন গভীরভাবে আকর্ষিত করলো তাকে। তবে প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভালোই ঝামেলা পোহাতে হয় মলিনা বেগমকে। বড় গলায় বলেছিলেন, মেয়েটাকে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু এই শহরের সকল কিছুই অজানা তার।

অরা চিরকাল বহু যন্ত্রণা সহ্য করে এসেছে বলেই হয়তো প্রকৃতি আর যন্ত্রণা দিলো না তাকে। দিনকয়েক বাদে মলিনা বেগম আচমকা খোঁজ পেয়ে যান তার এক দুঃসম্পর্কের ভাই খসরুর। খসরু ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। অরার বিপদের কথা তাকে খুলে বলতেই সে খোঁজ দেয় এই শহরের সবথেকে বিখ্যাত এতিমখানার।

সন্তানের বাবা-মা দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে না-কি তাকে ‘এতিম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। মা তো বহুকাল আগেই চলে গেছে। তবে বাবা তো আছে। তবুও নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে তাকে পা বাড়াতে হলো এতিমখানার দিকে। এতিম নয় বলেই হয়তো এতিমখানার লোকেরা প্রথম দিকে অরাকে রাখতে চায়নি তাদের সঙ্গে। তবে তার অসীম সাহসীকতার গল্প শুনে আর দূরে ঠেলে দিতে পারেনি।

অরার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই করা হলো। বিনিময়ে তাকে দেওয়া হয় একটা কাজ। এতিমখানার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজ। কষ্টে জর্জরিত জীবনে নিমিষেই এসে উপস্থিত হলো আলোর ঝলকানি। নতুন মায়ের অত্যাচারের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকা মেয়েটা নতুন করে বাঁচতে শিখলো, নতুন করে হাসতে শিখলো। ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই হয়ে উঠলো তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা না করে অরা প্রতি বিকেলে পড়াতে লাগলো তাদের।

সেলিব্রিটিদের এক বদভ্যাস হলো লোক দেখিয়ে জনহিতকর কাজ করা। ভিক্ষুকে ভিক্ষা দিলেই সামনে থাকতে হবে ডজনখানিক ক্যামেরা। তাদের ধারণা এতে ভক্তদের ভালোবাসা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। অরা এই এতিমখানায় স্থায়ী হওয়ার ছয় মাসের মাথায় একদিন হুট করে বেশ কিছু সংবাদিক নিয়ে আগমন ঘটে বিখ্যাত নায়িকা নওশীন হকের।

নওশীন পুরো এতিমখানাটা ঘুরে ঘুরে দেখছে, বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, তাদের নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে, খেলনা দিয়ে খেলা করছে – প্রতিটিই মুহূর্তই হলো ক্যামেরাবন্দী। এসবের মাঝেই হঠাৎ নওশীনের চোখদুটো গিয়ে স্থির হলো কোণার দিকের একটা ঘরে। কমবয়সী একটা মেয়ে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াচ্ছে। বাচ্চারাও পড়ার তাল তাল মেলাচ্ছে। এতটুকু একটা মেয়েকে এতিমখানায় শিক্ষিকা হিসেবে দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না নওশীনের। নিতান্ত কৌতূহলের বশে মেয়েটার সম্পর্কে আগ্রহ জাগে তার মনে। আগ্রহ নিবারণ করতে এগিয়ে এলেন এতিমখানার মালিক নিজেই।

মেয়েটার অতীতের ইতিহাস জেনে কয়েক মুহূর্ত থ মেরে বসে থাকে নওশীন। পরিবার একটা মানুষের সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ আশ্রয়। অথচ পরিবারের কাছেই এমন বঞ্চনার শিকার হয়েছে মেয়েটা? মিনিট কয়েকের জন্যে ক্যামেরাগুলো থেকে আড়াল করে নিলো নিজেকে। আড়ালে অতি দ্রুত কতগুলো ফোন কল সারলো। সবশেষে এতিমখানার মালিককে বলল, “ওই মেয়েটাকে ডেকে পাঠান। ওর সঙ্গে কথা আছে।”

নায়িকা ডেকে পাঠিয়েছে শোনার পর থেকেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো অরার। জীবনে কখনো হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি সে। গ্রামে থাকতে পাশের বাড়ির টিভিতে হাতে গোনা কয়েকটা সিনেমা দেখলেও, এ সমন্ধে বেশি কিছু জানা নেই তার। এই নায়িকা তাকে ডেকেছে কেন কে জানে? সিনেমা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না তো? প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে দিতে না পারলে কি তাকে বের করে দেওয়া হবে এখান থেকে? মনে এমন হাজারো ভয় জড়ো করে অরা গিয়ে দাঁড়ালো নওশীনের সামনে।

নওশীন হাসি মুখে বলল, “তোমার নামটা যেন কী?”

“আখিতারা বানু।”

“আখিতারা, তুমি কী আমার হাজবেন্ডকে চেনো?”

অরা প্রবল আতঙ্কে অস্থির হয়ে না-সূচক মাথা নাড়লো। যেন তার স্বামীকে না চেনাকে বিরাট অন্যায়।

নওশীন হাসি হাসি গলায় বলল, “আমার হাজবেন্ড আরশাদ হক। এদেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার। বেশ কয়েকদিন ধরেই আমরা ওর জন্যে নতুন ম্যানেজার খুঁজছি। কাউকেই পছন্দ হচ্ছিল না, আজ তোমাকে একবার দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। তোমার ব্যাপারে সবটাই শুনেছি আখিতারা। একা একটা মেয়ে বিপদে পড়েছো বলে দয়া করে এই অফারটা করছি না। আমার ধারণা সঠিক ট্রেনিং পেলে তুমি আরশাদের যোগ্য ম্যানেজার হয়ে উঠবে। করবে চাকরিটা?”

অরা বেশ অনেকটা সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল নওশীনের দিকে। সুপারস্টার, ম্যানেজার, ট্রেনিং – শব্দগুলো মাথার দুই ফুট ওপর দিয়ে চলে গেল।

নীরবতা ভঙ্গ করে এতিমখানার মালিক দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন, “করবে না মানে? অবশ্যই করবে। এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না-কি? ম্যাডাম, আপনি ওকে নিয়ে যান।”

সেদিনের পর থেকে জীবনটা ৩৬০° কোণে মোড় নেয়। শুরু হয়ে যায় অরার ট্রেনিং জীবন। আরশাদের ম্যানেজার হওয়ার মত যোগ্যতা তার তখনো নেই। দীর্ঘদিন সময় নিয়ে
তাকে ঘাড় সোজা করে হাঁটতে শেখানো হলো, শুদ্ধ বাংলা শেখানো হলো, আদব-কায়দা শেখানো হলো, ড্রাইভিং শেখানো হলো, স্পোকেন ইংলিশের দুটো কোর্সও করানো হলো। চিরায়িত সালোয়ার কামিজ ছেড়ে আপন করে নিলো শার্ট-প্যান্ট আর কোট। আরশাদের তৎকালীন ম্যানেজার ফারুক সাহেব নিজ হাতে ম্যানেজারের সমস্ত কাজ শিখিয়ে দেয় তাকে। এভাবেই মাস তিনেকের মাঝে আখিতারা বানু হয়ে উঠলো আফরোজা অরা।

নতুন জীবনে অরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেল যে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভুলতে বসার উপক্রম। খারাপ দিকটাই শুধু ভুলেছে অরা। সে মানুষগুলো তার জীবনে এসেছিল দেবদূতের মতো তাদের ক্ষণিকের জন্যেও ভোলেনি। মলিনা খালার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তার। মাসে মাসে তাকে কিছু টাকা পাঠানোর পাশাপাশি যেকোনো বিপদে-আপদে এগিয়ে যায় অরা। মলিনা বেগম এখন আর সেই গ্রামে থাকেন না। তাই পরিবার নামক ওই বস্তুর কোনো খোঁজও নেই তার কাছে। এছাড়াও অরা সময়-সুযোগ পেলেই ছুটে যায় এতিমখানার ওই বাচ্চাগুলোর কাছে। সকলে এখন বেশ বড় হয়ে গেলেও তাদের আখি আপাকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।

তবে নওশীনের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা এ জীবনেও শেষ হবে না। ওই মানুষটার কারণেই আজ এই চমৎকার জীবনের অধিকারী অরা। ডিভোর্সের পর আরশাদ পরিষ্কার গলায় জানিয়ে দিয়েছিল, নওশীনকে এড়িয়ে চলতে, ‘ম্যাম’ সম্বোধন না করতে। চাকরি জীবনে আরশাদের এই একটা মাত্র নির্দেশ অমান্য করেছে অরা। নওশীনকে অসম্মান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে চিরকাল অরার ‘ম্যাম’ হয়েই থাকবে।

অতীতের চিন্তাগুলো মস্তিকে জড়ো হওয়ায় হাঁপিয়ে উঠেছে অরা। গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে পাশে থাকা পানির বোতলটায় চুমুক দিলো। মনের অজান্তেই তার চোখ পড়লো ঘুমন্ত কথার নিষ্পাপ মুখটার দিকে।
সাত-পাঁচ কথার মাঝে মেয়েটা সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে!

এই মেয়েটার সঙ্গে অরার শৈশবের কোনো সাদৃশ্য নেই, আবার যেন অদ্ভুত এক সাদৃশ্য আছে। কথা তার এই ছোট্ট জীবনে বাবা-মা হিসেবে পেয়েছে চমৎকার দুজন মানুষকে। কথার জন্যে তার বাবা-মায়ের কেউই প্রাণ দিয়ে দিতে রাজি। পূর্ণতার মাঝেও যেন বিরাট এক অপূর্ণতা। সুখী পরিবার কাকে বলে এই মেয়েটা তা জানে না। অন্যদিকে অরা তার শৈশবে একটা পরিবার পেলেও পায়নি বাবা-মায়ের ছায়াটুকু।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here