ফিরে_আসা ৮ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
619

#ফিরে_আসা

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আরশাদের বাড়ির সল্প দূরে অবস্থান করছে গাড়িটা, হঠাৎ কথার চোখে পড়লো কেএফসির বিশাল আউটলেট। সেই থেকে মেয়েটা জেদ ধরে বসলো সেখানে যাওয়ার। কথা অবিকল বাবার জেদটা পেয়েছে। সেই জেদের কাছে পরাজয় স্বীকার না করার সাধ্য কারও নেই। তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভ করে অরারও খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তাই গাড়িটা পার্ক করে রেখে দুজনে হাত ধরাধরি করে ঢুকে পড়লো সেখানে।

এই গাড়িটা আরশাদের চার নম্বর গাড়ি। তার বাড়ির গ্যারেজে চারটি বিলাসবহুল দামী গাড়ি সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকে। মানুষ যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরো দিনের জন্যে নিজের পোশাক নির্বাচন করে, আরশাদ তেমনি ঘুম থেকে উঠে নির্বাচন করে আজ কোন গাড়িতে করে শুটিংয়ে যাবে।

কেএফসির ভেতরে ঢুকে দুজনে শেষ প্রান্তের একটা টেবিলে বসে পড়লো। চোখের সামনে বাচ্চাদের জন্যে উন্মুক্ত প্লে-গ্রাউন্ড, অথচ কথা লক্ষ্মী মেয়ের মতো অরার গা ঘেঁষে বসে আছে। প্লে-গ্রাউন্ডে অন্যান্য বাচ্চারা গিজগিজ করছে। কথার এতসব মানুষের ভীড়ে খেলতে ভালো লাগে না। সল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অর্ডার চলে এলো।

কথা বার্গারে কামড় দিয়ে কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা অরা, বড় হয়ে তুমি কি নিজের নাম নিজেই রেখেছো?”

মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না অরা। নামের রহস্যের সেই কথোপকথন মেয়েটা এখনো মনে করে বসে আছে?

অরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “উহুঁ।”

“তাহলে কে রেখেছ?”

“তোমার বাবা।”

কথা হতবাক গলায় বলল, “সত্যি? আমার নামও তো বাবা রেখেছে তাই না? আমাদের দুজনেই নামই বাবা রেখেছে। এজন্যেই আমরা বেস্ট ফ্রেন্ডস।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো কথা। অরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিন্দ্য সুন্দর সেই হাসির দিকে। বাচ্চাদের হাসি একেবারে নির্ভেজাল হয় বলেই হয়তো সেই হাসির সৌন্দর্য এতটা উজ্জ্বল। অরা এর আগেও খেয়াল করেছে, কথা যখন হাসে তার চারপাশের সবকিছুই হেসে ওঠে।

রিংটোনের আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেলো অরা। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তার স্যারের নাম। এক মুহূর্তের দেরি না করে তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করলো অরা।

আরশাদ অপরপ্রান্ত থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “কোথায় তোমরা?”

“আমরা কাছাকাছিই আছি স্যার। কথার ক্ষুধা লেগেছিল, তাই ওকে নিয়ে কিএফসিতে এসেছি।”

“বেশি দেরি করবে না, এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে আসছে।”

“জি স্যার।”

“কথা কোথায়? ওকে দাও তো!”

অরা ফোনটা কথার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “বাবা।”

কথা সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা অরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “বাবা! জানো আমি তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ নিয়ে আসছি।”

মুহূর্তেই আরশাদের কণ্ঠস্বর বদলে গেল। গাম্ভীর্যকে সরিয়ে তার স্থান দখল করে নিলো একরাশ মুগ্ধতা। আরশাদ হাসিমুখে বলল, “তাই না-কি? কী সারপ্রাইজ এনেছে আমার প্রিন্সেসটা?”

কথা দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “সেটা তো বলা যাবে না। বলে দিলে আর সারপ্রাইজ হলো কী করে?”

“তাও তো ঠিক। আচ্ছা, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। আমি কিন্তু সাইরপ্রাইজের জন্য বেশিক্ষণ ওয়েট করতে পারবো না।”

“আমি তো তাড়াতাড়িই যেতে চেয়েছিলাম। সব দোষ অরার। এত আস্তে ড্রাইভ করে! তুমি কিন্তু অরাকে খুব করে বকে দেবে!”

কথাটা শুনে কথার চোখের চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল অরা। তার এমন মুখভঙ্গি দেখে আবারও ফিক করে হেসে দিলো কথা।

আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে, বকে দেবো। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় তো, বাবা সেই সকাল থেকে ওয়েট করছে।”

আরশাদের মধ্যে একটা সময়ে অবস্থান করতো হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত একটা মানুষ। সে মানুষটা সকল কিছুর মাঝেও বিচিত্র এক আনন্দ খুঁজে বেড়াতো। প্রতি পদে যে মানুষটার প্রয়োজন হতো নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার।

বহু বছর আগের ঘটনা, সবে আরশাদের প্রথম সিনেমা ‘আষাঢ়ে’ মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই যা বক্স অফিসে করেছে বাজিমাত। ভক্তদের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে আরশাদের ওই একটা সিনেমাই যথেষ্ট ছিল। তবে ‘আষাঢ়ে’ সিনেমাটার শুটিংয়ের সময়ে জনপ্রিয়তার ছিটেফোঁটাও ছিল না তার। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই পারিশ্রমিক হিসেবে আহামরি অঙ্কের টাকা পায়নি। এই ইন্ডাস্ট্রির একটা বাজে নিয়ম হলো নবাগত নায়ক-নায়িকাদের নামমাত্র অঙ্কের পারিশ্রমিক দেওয়া। প্রযোজকদের ধারণা, সিনেমার মুখ্য চরিত্র হিসেবে নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এই অনেক। আবার বেশি টাকা দিতে হবে কেন?

প্রথম সিনেমা মুক্তির পরপর কী যেন মনে করে আরশাদ চলে যায় এক আর্ট গ্যালারিতে। চিত্রকর্মের প্রতি আকর্ষণ তার কোনোকালেই ছিল না। তবুও সেই গ্যালারিতে অদ্ভুত সুন্দর এক পেইন্টিং নজর কাড়ে তার। সেই ছবিতে পর্বত সমান ঢেউয়ের সামনে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। যেন জীবনে চলার পথে যতই বাঁধা-বিপত্তি আসুক না কেন, ঠিক এভাবেই দৃঢ় ভঙ্গিতে মোকাবেলা করে যাবে তাকে। এক দেখায় ছবিটা মনে ধরে যায় আরশাদের। ছবিটা দেখার পর বারবার মনে হতে থাকে, এ পৃথিবীতে যত সৌন্দর্য আছে সব তার দেখা হয়ে গেছে।

সেই ছবি আবার এঁকেছে এ যুগের বিখ্যাত কোনো চিত্রশিল্পী। কাজেই দামটাও বেশ চড়া। আরশাদ সেসব পরোয়া না করে, প্রথম সিনেমা থেকে উপার্জিত সকল অর্থ দিয়ে কিনে ফেলল ছবিটা। পরমুহূর্তেই মনে হলো, বিরাট বোকামি হয়ে গেছে। সকলে তাকে দেখবে সিনেমার পর্দায়, তার বসার ঘরে ঝুলন্ত পেইন্টিং কেউ দেখতে আসবে না। উচিত ছিল টাকাগুলো বুদ্ধি খাটিয়ে খরচ করা। পেইন্টিং কেনার ফলে অর্থের অভাবে পরবর্তী সিনেমার কস্টিউম জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।

নিজের পাগলামির জন্যে সেবারই প্রথম
ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাকে। আরেকবারের কথা, আরশাদের জনপ্রিয়তা তখন একেবারে তুঙ্গে। দেশের আনাচে-কানাচে যে কেউ সিনেমা জগতের অন্যান্য কাউকে না চিনলেও, আরশাদ হককে ঠিকই চেনে। জনপ্রিয়তা তখন এতটাই বেড়ে গেছে আরশাদ রাস্তায় বের হলেই তার চারিদিকে জড়ো হয় শত শত মানুষ।

তবুও এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করে ফেলল আরশাদ। তার প্রিয় ব্যান্ড দল সেবার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কনসার্ট করছে, তাও আবার চিটাগংয়ে। যে ব্যান্ডের গান শুনে আরশাদ বড় হয়েছে, সরাসরি তাদের গান শোনার সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সমস্যা হলো সুপারস্টার আরশাদ কনসার্টে গেলে কেউ আর গান শুনবে না, সকল দর্শক তার পেছনেই পড়ে যাবে।

অ্যাডভেঞ্চারে ভয় না পাওয়া আরশাদ স্কুল জীবনের তিনজন বন্ধুদের নিয়ে কনসার্টের দিন সকাল সকাল প্লেনে করে পৌঁছে গেল চিটাগং। পরিকল্পনা হলো সে কনসার্টে প্রবেশ করবে মাথায় ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক পরে। এমন আবরণ ভেদ করে কারোর চিনতে পারার কথা নয় তাকে।

হলোও ঠিক তাই। আরশাদ ছদ্মবেশে জনসাধারণের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অথচ কেউ তাকে চিনতে পারছে না। চার বন্ধু নিজেদের মতো একটা জায়গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শুরু হলো গানের পর্ব। আনন্দে-উল্লাসে আত্নহারা হয়ে উঠলো আরশাদের সমস্ত অন্তরাত্মা। কোনোদিন ভাবতেও পারেনি নিজের সবথেকে প্রিয় গানগুলো এভাবে সরাসরি শোনার সুযোগ হবে। দীর্ঘ সময় গলা মেলালো শিল্পীদের সঙ্গে, তবুও বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হলো না।

উচ্ছ্বাসে ডুবে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়েছিল আরশাদ। যদিও সঙ্গে সঙ্গে তা ফিরে গিয়েছিল তার চোখে, তবুও যেন বেশ দেরি হয়ে গেছে। অঢেল জনস্রোতের মাঝে কারোর নজরবন্দি হয়ে যায় ওই চোখদুটো। সুপারস্টার আরশাদ হককে চেনার জন্যে তার চোখদুটোই যথেষ্ট।

ব্যস! বেঁধে গেল মহাবিপত্তি। চলন্ত গানের মাঝপথে দর্শকের স্রোত একসঙ্গে অগ্রসর হলো আরশাদের দিকে। এত শত মানুষের ভীড়ে বেচারাকে খুঁজে পাওয়াই যেন দুঃসহ হয়ে উঠেছে। ভক্তরা চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আরশাদকে, কনসার্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সকল সিকিউরিটি গার্ড তাকে বের করে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।

সময় আর পরিস্থিতি যে মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, আরশাদকে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ওই মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে! সবকিছুতেই বাড়তি আনন্দ-উচ্ছ্বাস খুঁজে বেড়ানো আরশাদ নিজের অজান্তেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। একসময়ে ব্যান্ডের গানের জন্যে যে মানুষটা পাগল হয়ে থাকতো, তার আজ পুরো একটা গান শেষ করার ধৈর্য্য নেই। আগে হুটহাট কিছু একটা পছন্দ হলে কিনে ফেললেও, এখন আর সেই ইচ্ছা নেই।

আরশাদের অন্যতম আরেকটি শখ হলো বই পড়া। ক্লাস টেন থেকে শুরু হয়েছে তার বই সংগ্রহের অভ্যাস। সেই থেকে তার সংগ্রহ করা শত শত বই স্থান পেয়েছে বাড়ির বিশাল লাইব্রেরিতে। আগে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও হুটহাট লাইব্রেরি ঢুকে বই নিয়ে বসে পড়তো আরশাদ। এমনও হয়েছে, রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে অথচ তার পড়া শেষ হয়নি। আজ বছর পেরিয়ে গেল সেই আরশাদ নিজের হাতে গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে যায় না।

পৃথিবীর সব কিছুই যেখানে আরশাদকে মুগ্ধ করতে ব্যর্থ, সেখানে তার মুগ্ধতার একমাত্র উৎস কথা। সকল প্রিয় জিনিসের প্রতি আগ্রহ নিস্তেজ হয়ে গেলেও এই একটা মানুষের প্রতি আগ্রহ তার দিন দিন বেড়েই যাবে। কথাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অনুপ্রেরণা।

লম্বা সময় গাড়ির ভেতরে থেকে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে কথার। অরা তাই লেডিস ওয়াশরুমের প্রকান্ড আয়নার সামনে যত্ন নিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে তার চুলগুলো। এই ফাঁকে কখন যে একটা মেয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে কে জানে?

মেয়েটা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “ওহ মাই গড! ও আরশাদ হকের মেয়ে না?”

অরা চমকে উঠে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “জি না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

“আমার ভুল হচ্ছে না। আমি আরশাদের ইনস্টাগ্রামে ওর ছবি দেখেছি। আমি কি ওর সাথে একটা সেলফি তুলতে পারি প্লিজ?”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “না। বাচ্চাটার প্রাইভেসি বলেও তো একটা কথা আছে?”

অপরিচিত সেই মেয়েটি তবুও জোরাজুরির ভঙ্গিতে বলল, “প্লিজ! একটা সেলফি দিয়ে আমার ফলোয়ার বেড়ে যাবে।”

অরা কথা কোলে নিতে নিতে বলল, “আই অ্যাম সরি।”

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে কথাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো অরা। খ্যাতি ব্যাপারটা দূর থেকে বেশ মোহনীয় বলে মনে হয়। তবে খ্যাতির পেতে চাইলে আপন করে নিতে হবে খ্যাতির বিড়ম্বনাকেও। ভক্তদের অঢেল ভালোবাসা পারে একটা মানুষকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে অধিষ্ঠিত করতে। তবে এই ভক্তরাই মাঝে মাঝে ভুলে যায়, সেলিব্রিটি হলেও দিনশেষে তারাও মানুষ। তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন আছে।

গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামলো সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। কথার উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল। অরা গাড়ির দরজা খুলে দিতেই মেয়েটা ছুটে চলে গেল বাড়ির দিকে। এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে কথার অপেক্ষা করছিল আরশাদ। এতগুলো দিন পর মেয়েকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। ক্রমেই বড় হয়ে যাচ্ছে কথা। শৈশব মানবজীবনের শ্রেষ্টতম সময়। অথচ এই সময়টা যেন চোখের পলকে অতিবাহিত হয়ে যায়। কেন যে মানুষের শৈশবটাকে ধরে রাখা যায় না!

বাবাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কথা এক লাফে তার কোলে উঠে পড়লো। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে পূর্ণতা পেল আরশাদের শূণ্য বুকটা।

কথাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরশাদ বলল, “বাবা! আই মিসড ইউ।”

কথা আরশাদের গলা জড়িয়ে বলল, “আই মিসড ইউ টু বাবা। আমি আর কক্ষনো এখান থেকে যাব না, সবসময় তোমার কাছে থাকবো। প্রমিস!”

সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটের কোণে। এই কথাটা ও প্রতিবারই বলে, কিন্তু কয়েকদিন পর মায়ের জন্যে কান্নাকাটি করে ঠিকই চলে যায়।

আরশাদ মেয়ের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলল, “রাস্তায় কোনো কষ্ট হয়নি তো সোনা?”

“উহুঁ!”

ইতোমধ্যেই কথার ব্যাগগুলো নিয়ে আগমন ঘটলো অরার।

আরশাদ বলল, “তুমি এগুলো আনতে গেলে কেন? গার্ডদের বললেই তো হতো।”

অরা হাসিমুখে বলল, “সমস্যা নেই স্যার।”

ব্যাগগুলো রেখে অরা ফিরে এসে বলল, “স্যার একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

“কী সমস্যা?”

“আকরাম সাহেব ফোন করেছিলেন। স্ক্রিপ্টে না-কি কী একটা পরিবর্তন এসেছে। সংশোধন করা স্ক্রিপ্টটা মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

অন্য সময় হলে সামান্য এই বিষয়টা নিয়ে আরশাদ রেগেমেগে একাকার কান্ড ঘটাতো। কথা তার কাছে আছে বলেই হয়তো রাগের লেশমাত্র দেখা গেল না।

আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি জানো উনাকে কী বলতে হবে।”

“জি স্যার।”

একটা সিনেমার শুটিংয়ের মাঝে স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক সময় স্ক্রিপ্টের লেখা অনুযায়ী শুটিংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। আবার, কখনো পরিচালক নিজেই মনে করতে পারেন তার সিনেমার গল্পের সঙ্গে স্ক্রিপ্টের একাংশ বেমানান। তাই কখনো কখনো শুটিংয়ের মাঝপথে স্ক্রিপ্ট সংযোজন করা হয়।

সাধারণ অভিনেতাদের এ বিষয়টা নিয়ে কোনপ্রকার সমস্যা থাকে না। তবে আরশাদের রয়েছে ঘোর আপত্তি। তার কথা, যে স্ক্রিপ্ট পড়ে সে এই সিনেমাটা করতে রাজি হয়েছিল, হুবহু সেই স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী শুটিং শেষ করতে হবে। বিন্দুমাত্র সংযোজন সহ্য করা হবে না।

“স্যার, আরেকটা কথা।”

“কী?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “আপনি কি কথার এডমিশনের ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখবেন?”

আরশাদ কথার মাথার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “না। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি আমার মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেই কেউ সাকসেসফুল হয়ে যায় না। তাই না বাবা?”

কথা কিছু না বুঝেই বাবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে বলল, “হুঁ।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ঠিক আছে স্যার। আমি তাহলে আসি?”

কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “দাঁড়াও অরা! বাবা আমাকে নামাও তো!”

আরশাদ কথাকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই কথা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল অরার কাছে।

অরা হাঁটু গেঁড়ে বসতেই কথা তার কানে ফিসফিস করে বলল, “বাবা কিন্তু পানিশমেন্টের কথা ভুলে গেছে। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলে মনে করিয়ে দিলাম না।”

প্রশস্ত এক হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। এই বাচ্চাটার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত বিশেষ হয়ে থাকে তার কাছে।

আরশাদের বাড়ি থেকে অরার ফ্ল্যাটের দূরত্ব বড়জোর দশ মিনিটের। বাসায় ফিরেই পরনের কোটটা চেয়ারের ওপর রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অরা। সীমার ঘর থেকে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর। ক্লায়েন্টের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলেই যাচ্ছে মেয়েটা।

কয়েক মিনিট বাদে মিটিং শেষ করে সীমা এসে উঁকি দিলো অরার ঘরে।

ধমকের সুরে বলল, “কী রে অরা? ভূতের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছিস কেন? বাইরে থেকে এসে কেউ ফ্রেশ না হয়ে এভাবে পড়ে থাকে?”

অরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে গাজীপুর গিয়েছি, আবার গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসেছি। আমার শরীরে আর একফোঁটাও এনার্জি বাকি নেই। রেস্ট নিতে দে।”

সীমা ঘরে ঢুকে অরার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমি একটা কথা ভেবে পাই না। এতটা পথ তোকে ড্রাইভ করতে হবে কেন? আরশাদের ড্রাইভারকে নিয়ে গেলেই তো পারিস।”

“ড্রাইভারকে আমি নিয়ে গেলে এখানে স্যারের সঙ্গে কে থাকবে?”

“কাউকে থাকতে হবে কেন? এমন তো না যে আরশাদ ড্রাইভ করতে পারে না। ঢাকার মধ্যে কোথাও যেতে হলে নিজে ড্রাইভ করে নেবে।”

অরা সামান্য হেসে বলল, “তোর পাগলামি কথাগুলো আপাতত বন্ধ রাখ তো সীমা। এমনিতেই মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।”

সীমা আহত গলায় বলল, “আমার কোনো শখ নেই তোর সাথে পাগলামি করার। জরুরি একটা কথা বলতে এসেছি, বলা হয়ে গেলেই চলে যাব।”

“বল।”

“পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। তেরো থেকে একুশ তারিখ। এই কটা দিন দয়া করে ছুটি নিয়ে রাখিস।”

“কী যে বলিস সীমা! এতগুলো দিনের জন্যে ছুটি চাওয়া আমাকে মানায় না-কি?”

“মানানোর কী আছে? তোর পরীক্ষা তাই তুই ছুটি নিবি।”

“উহুঁ, সম্ভব নয়। সাতদিন পর আবারও সিনেমার শুটিং শুরু হবে, একটা অ্যাডের শুটিং আছে মাঝখানে। আমি ছুটি নিয়ে বসে থাকলে কী করে চলবে?”

সীমা হতভম্ব স্বরে বলল, “আর পরীক্ষা?”

“পরীক্ষার সময়টুকু কোনমতে ম্যানেজ করে নেবো আর পড়শোনা রাতে করবো।”

সীমা বিরক্ত গলায় বলল, “উফ অরা! তোর মহীয়সী নারীগিরিটা এবার বন্ধ কর তো। সারাদিন কাজ করে এসে কেউ বই নিয়ে বসতে পারে না-কি?”

অরা হাই তুলতে তুলতে বলল, “আমি পারবো, আমার অভ্যাস আছে।”

“যা খুশি কর। আগেই বলে দিচ্ছি, এতসব স্ট্রেসের মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি কিন্তু সেবা করতে পারবো না।”

অরা হেসে বলল, “আচ্ছা, করিস না।”

অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সীমা অন্যরকম গলায় বলল, “এই অরা। কিছু জানতে পারলি?”

“কোন বিষয়ে?”

“আরশাদ আর নওশীনের ডিভোর্সের বিষয়ে!”

অরা থমথমে গলায় বলল, “আবার শুরু করলি? শোন, তাদের ডিভোর্সের রহস্য ভেদ করার কোনো শখ আমার নেই।”

“শখ ঠিকই আছে, তুই স্বীকার করিস না।”

কথাটা সীমা একেবারেই মিথ্যা বলেনি। তিন বছর হয়ে গেল তাদের ডিভোর্সের। অথচ আজও ভক্তরা উদগ্রীব হয়ে থাকে সেই ডিভোর্সের কারণ খুঁজে বের করতে। অরা খুব কাছ থেকে দেখেছিল তাদের। তাদের মধ্যকার দৃঢ় বন্ধনকে। রহস্য ভেদ করার আকাঙ্ক্ষা তাই অরার মধ্যেও নেহায়েত কম নেই।

অরা উঠে বসতে বসতে বলল, “আজ ম্যাম কথায় কথায় বলছিল জানিস, স্যার না-কি আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবতেই পারেনি। তিনিই না-কি প্রথম ডিভোর্সের কথা তুলেছিলেন।”

সীমা চমকে উঠে বলল, “সে কী? আর এই কথাটা আমি এখন জানতে পারছি? তোর উচিত ছিল বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আমাকে জানানো।”

“এখন তো জানলি।”

সীমা চিন্তিত গলায় বলল, “তার মানে মানুষ যা বলে তাই সত্যি? দোষটা আরশাদেরই?”

অরা কিছু একটা ভেবে বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস?”

“কী?”

“কারোই কোনো দোষ নেই। বনিবনা হয়নি তাই আলাদা হয়ে গেছে।”

“শোন অরা, বিয়ে ব্যাপারটা বেশ জটিল। মানুষ তাকেই বিয়ে করে যাকে সে সবথেকে বেশি ভরসা করে, সবথেকে বেশি ভালোবাসে। বনিবনা হলে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, ছেড়ে যায় না। একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই কেউ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়।আমি নিশ্চিত এই ডিভোর্সের পেছনে বিশাল এক রহস্য আছে।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। মনে হয় না, এ জীবনে কোনদিন রহস্যের কালো মেঘ ঘনীভূত হবে তার সামনে। যদি অরা সত্যি সত্যিই কোনোদিন এই ডিভোর্সের প্রকৃত কারণ জানতে পারে তাহলে সবার আগে জানতে হবে সীমাকে। না হলে মেয়েটা কবরে গিয়েও শান্তি দেবে না তাকে।

প্রকান্ড সাইজের অ্যালবামটা খুলে বসেছে আরশাদ। ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অব্দি সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ছবি এখানে রয়েছে। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করার অভ্যাস তার বহু আগেই হারিয়ে গেছে। তবুও কথার জোরাজুরির কাছে পরাজয় স্বীকার করে বের করে এনেছে এই অ্যালবাম। পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা ছবি চোখে পড়লো কথার। কোনো একটা সিনেমার প্রচারে ব্যস্ত আরশাদ। বিশাল মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে মাইক হাতে কী যেন বলছে, তার সামনে ভক্তদের অঢেল স্রোত।

কথা অবাক গলায় বলল, “আচ্ছা বাবা, সবাই তোমাকে এত ভালোবাসে কেন?”

আরশাদ কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, “আমি যে কথার বাবা, এরজন্য।”

কথা একগাল হেসে বলল, “সত্যি?”

“হুঁ, সত্যি! ভালো কথা, আমার সারপ্রাইজটা কোথায়? সারপ্রাইজের লোভ দেখিয়ে নিজেই ভুলে গেছিস?”

কথায় কপালে হাত দিয়ে বলল, “তাই তো। ভুলেই গিয়েছিলাম। দাঁড়াও এক্ষুনি দিচ্ছি, আমার ব্যাগটা খুলে দাও তো বাবা।”

আরশাদ প্রিন্সেস আঁকা ছোট্ট সুটকেসটা খুলতেই কথা কী যেন একটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে পেতেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো অনিন্দ্য সুন্দর হাসি।

কাঙ্ক্ষিত সেই জিনিসটি ভাঁজ করা একটা কাগজ। কথা কাগজটা আরশাদের হাতে ধরিয়ে দিতেই সে কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে ভাঁজ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কাগজে কথার ছোট্ট হাতে আঁকা একটা ছবি। ছবিতে কথা বাবার সাথে ডিজনি ল্যান্ডে বেড়াতে গেছে।

“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

আরশাদ মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল, “অনেক পছন্দ হয়েছে। থ্যাংক ইউ বাবা। তোর ডিজনি ল্যান্ডে যেতে ইচ্ছা করে?”

“হুঁ। জানো বাবা, আমি টিভিতে দেখেছি ডিজনি ল্যান্ডে নীল রঙের ইয়া বড় একটা ক্যাসেল আছে। সেই ক্যাসেলে সিন্ড্রেলা থাকে। একটা হট এয়ার বেলুনও আছে, সেখানে মিকি মাউসের সব ক্যারেক্টাররা থাকে।”

আরশাদ কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে কথার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাই না-কি? তাহলে তো নেক্সট টাইম কথা আর বাবাকে ডিজনি ল্যান্ডে বেড়াতে যেতে হবে।”

কাজের ফাঁকে দীর্ঘ অবসর পেলেই আরশাদ মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে বেড়াতে যায়। এই যেমন গত মাসে, দুজনে বেড়িয়ে এসেছে মালদ্বীপ থেকে। সেখানে জলের নিচের হোটেল দেখে বিস্ময়ের সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে কথার। হোটেলের ভেতরে সে বাবার সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর স্বচ্ছ কাঁচের অপরপ্রান্তে নীলরঙা জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে নানান প্রজাতির মাছ। বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর এই মুহুর্তগুলো কথার সব চাইতে প্রিয়।

ডিজনি ল্যান্ডে যাওয়ার কথা শুনে কথা এক লাফে আরশাদের গলা জড়িয়ে তার গেল চুমু দিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ বাবা, থ্যাংক ইউ। ইউ আর দ্য বেস্ট!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here