#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫
শুভ্র সোফায় পাশাপাশি বসে দু’জনে। মালিহার মনের গহীনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে খুশির কলরব। উনি শাড়ি সামলিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন। একমাত্র পুত্রের হাতে তুলে দিলেন বাগদানের আংটি। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললেন,
” নাও বাপজান। হৃদি মায়ের অনামিকায় পড়িয়ে দাও।”
ইরহাম মায়ের উচ্ছ্বসিত বদনে একপলক তাকিয়ে আংটির দিকে তাকালো। অতঃপর আংটি হাতে ঘুরে বসলো হবু জীবন সঙ্গিনীর পানে। হৃদি ওর বদনেই বিমোহিত নয়নে চেয়ে ছিল। আঁখি জোড়া ছেয়ে যাচ্ছিল অসীম মুগ্ধতায়! সহসা মানুষটি ওর পানে ঘুরে বসতেই থতমত খেল। নত হলো দৃষ্টি। কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছিল! ইশ্! এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিল উনি লক্ষ্য করলে কি ভাবতেন? নিশ্চয়ই ছ্যা চ ড়া ভাবতেন! লজ্জা কি লজ্জা! ইরহাম একপলক ওর মায়াবী মুখখানি অবলোকন করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বাঁ হাতটি বাড়িয়ে দিলো সম্মুখে। ডান হাতে ধরে আংটি। হৃদি আংটি ধরে থাকা পুরুষালি হাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সহসা নাম না জানা অনুভূতিতে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে পাখনা মেলে উড়লো প্রেম পঙ্ক্ষী। র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো কপোলদ্বয়ের কোমল ত্বকে। সে দৃশ্যটুকু খুব সন্নিকট হতে লক্ষ্য করলো মানুষটি। কিঞ্চিৎ ভালোলাগা ছেয়ে গেল কি অন্তঃপুরে! বোধহয় হাঁ। তবে ভেতরকার অবস্থা মোটেও বহিঃপ্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক গম্ভীর রূপেই হবু সঙ্গিনীর অনামিকায় পড়িয়ে দিলো আংটি। নিজস্ব অধিকার বোধ লেপ্টে দিলো আনুষ্ঠানিক ভাবে। মৃদু শিউরে উঠলো মেয়েটির পেলব হাত। পুরুষালি প্রথম ছোঁয়া অঙ্কিত হলো অনামিকায়। করতালির ধ্বনিতে মুখর হলো হল। মালিহার নয়ন জোড়ায় খুশির অশ্রু কণা। হৃদয়ের অভ্যন্তর হতে পুত্র ও হবু পুত্রবধূর জন্য দোয়া করলেন উনি। আর এজাজ সাহেব? কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। নাজরিন ভাতিজির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে চোখের ইশারা করলেন উনি। চাচির সে ইশারা বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়েটির। সে আস্তে ধীরে কোমল হাতটি বাড়িয়ে দিলো। ইরহামের অঙ্গুলিতে আংটি গলিয়ে দেয়া মাত্রই সমাপ্ত হলো বাগদান পর্ব। আরো একবার করতালির ধ্বনিতে মুখরিত হলো চারিপাশ। ইনায়া উৎফুল্ল চিত্তে করতালি দিয়ে উঠলো। অবশেষে হৃদি তার ভাবী হতে চলেছে। ইয়ে!
.
হলের ফাঁকা এক স্থানে আটকা পড়েছে মেয়েটি। ইতিউতি করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। তবে শা’সকের দল মুক্তি দিলে তো? কটমট চাহনিতে তাকিয়ে এক রমণী বলে উঠলো,
” কতবড় বা*টপার ছে ম ড়ি! ভাবা যায়? হুট করে এনগেজমেন্টের দাওয়াত দিলো। হবু বরের নামধাম কি তা তো শত ক্রোশ দূরের কথা। বললোই না। আর এখন এসে দেখি কি? ”
দিয়ার কথার রেশ ধরে ইভা বলে উঠলো,
” ওয়ান অ্যান্ড অনলি ইরহাম চৌধুরী কিনা আমাদের হবু দুলাভাই? ও এম এ! কেউ আমারে হুঁশে আন। আই অ্যাম তো বেহুঁশ। ”
তৎক্ষণাৎ ওর মাথায় গাট্টা মে রে দিলো সাবিত। এতেই তেঁতে উঠলো ইভা।
” শ* পোলা! আমারে মা,রলি ক্যান? ”
সাবিত আপন ভঙ্গিমায় জবাব দিলো,
” মা*রলাম কই? তোরে হুঁশে আনলাম মাত্র। ”
দাঁতে দাঁত চেপে ইভা বললো,
” সেইটা কি আদর কইরা করছোছ? ”
সাবিত তৎক্ষণাৎ জিভ কাটলো,
” ছিঃ ছিঃ ছিঃ। আসতাগফিরুল্লাহ্! আমি এই পেত্নীগো আদর টাদর করে অকালে ম”রতে চাই না। ”
আফরিন ওদের দু’জনকে ধমক দিলো।
” তোরা থামবি? তোদের চক্করে হৃদু কিছু বলতেই পারতাছে না। থাম তো তোরা। ”
নাবিল মুখ খুললো,
” হাঁ হৃদু। এবার চটাপট মুখ খোল। ”
ও মা! হৃদি কোথায়? ওর জায়গা তো শূন্য! স্তব্ধ হয়ে বন্ধুরা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। হঠাৎ নাবিলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো হৃদিতে। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
” ওই তো বা*ন্দরনি। ”
ওরা নাবিলের কথামতো ডানে তাকিয়ে বিহ্বল! হৃদি লাজুক লাজুক মেকি ভাব দেখিয়ে বললো,
” তোদের পুলিশি জেরার চেয়ে উনি বেশি দামী রে। আমায় খুঁজছেন সে-ই কখন থেকে। এখন বরং যাই.. ওনার কাছে। ”
সুরে সুরে ক লাইন মিথ্যা ঝপাঝপ নিঃসরণ করে তড়িৎ সেথা হতে প্রস্থান করলো মেয়েটা। বন্ধুরা তো চমকিত! আফরিন আনমনে বলে উঠলো,
” এনগেজমেন্ট হইতে না হইতেই আমরা এত পর! বিয়ে হইলে কি কইবো? ”
সাবিত অতি দুঃখে জর্জরিত হয়ে সুরেলা জবাব দিলো,
” কে তুই বল.. ”
দিয়া অবাকতার পাশাপাশি বিরক্ত হয়ে বললো,
” তোর এখন গান গাওয়ার মুড উঠছে? ”
” না রে বা*। ওই পেত্নী তহন আমগো দেইখা এইডাই কইবো। তাই বললাম। ”
ভাবনায় পড়ে গেল বন্ধুমহল। আসলেই কি এমনটি হবে!
•
আঁধারে তলিয়ে এ ভুবন। হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। শীতলতম অনুভূতিতে আবিষ্ট তনুমন। বেলকনিতে বেতের তৈরি সিঙ্গেল সোফা। সেথায় বাঁ পায়ের ওপর ডান পা তুলে নবাবী স্টাইলে বসে মেয়েটি। পড়নে লং কুর্তি এবং প্লাজো পাজামা। গলদেশে নামমাত্র জড়িয়ে দোপাট্টা। হালকা হালকা হাওয়ার পরশে নৃত্যে মাতোয়ারা কৃষ্ণবর্ণ কেশ। মায়াবী আঁখি যুগল নিবদ্ধ স্মার্টফোনে। ফেসবুকে মিনিট দুই পূর্বে স্ট্যাটাস দিয়েছে সে ‘ গট এনগেজড্ ‘. সে পোস্টে এখন লাইক, কমেন্টের অবিরাম আগমন। স্কুল হতে শুরু করে ভার্সিটি লাইফের বন্ধুমহল, রিয়েল লাইফের পরিচিতজন, ফেসবুক ফ্রেন্ড… অনেকেই শুভকামনা জানাচ্ছে। কেউ কেউ কমেন্টে জানতে চাইছে এ সত্যি কিনা! নাকি ফান পোস্ট। কোনো কোনো পুরনো ফ্রেন্ড হবু দুলাভাইয়ের ফটো আপলোড করতে বলছে। কেউবা আবার কটূক্তি করে স্বরূপ প্রদর্শন করছে। সে এক রঙবেরঙের বাহারি অবস্থা।
মৃদু হেসে অফলাইনে চলে গেল মেয়েটি। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো অনামিকায়। সেথায় রাতের আঁধারে জ্বলজ্বলে আংটিটি। বিমোহিত নয়নে সেথায় তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত! এ যে জীবনের নব্য এক সূচনা। আরম্ভ হতে চলেছে নতুন এক অধ্যায়। সে অধ্যায় নিয়ে পুরোপুরি জ্ঞাত, সচেতন কি মেয়েটি? বোধহয় না। সে তো তার অন্যতম ক্রাশকে জীবনসঙ্গী রূপে পেয়ে অতি পুলকিত, উচ্ছ্বসিত! সংসার জীবন নিয়ে মোটেও ভাবছে না। এই নিরুদ্বেগ ভাব তার জন্য ভারী পড়তে চলেছে কি? সে তো পুরোপুরি জানেও না বিপরীত দিকে অবস্থিত মানুষটির মনে কি চলছে। সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী দু’জনের পথচলা এক হবে কি করে? কি করে পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আরম্ভ হতে চলেছে তাদের ভালোবাসাময় নতুন সফর! জানা নেই। অপেক্ষা শুধু সময়ের।
মুচকি হেসে মোবাইলের ক্যামেরা অন করলো হৃদি। অনামিকায় জড়িয়ে থাকা আংটির বেশকিছু সুন্দর ফটো ক্যামেরা বন্দী করে নিলো। নিজেও ধরা দিলো ক্যামেরায়। রাতের আঁধারে মোহনীয় কিছু ফটো ক্যাপচার হলো। সে এক মুগ্ধকর দৃশ্য!
•
আদিত্য’র কিরণে উজ্জ্বল বসুন্ধরা। আলিশান এক লিভিংরুম। আভিজাত্য বিরাজমান আনাচে কানাচে। সোফায় আয়েশ করে বসে সফেদ শার্ট এবং কৃষ্ণবর্ণ প্যান্ট পড়ুয়া ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তার কেশে স্বল্প শুভ্র ছাপ। বাকিটা হেয়ার কালারের ছোঁয়ায় লুকায়িত। গলদেশে পরিহিত স্বর্ণের সরু চেইন। বাঁ হাতের আঙুলে দৃশ্যমান দামী আংটি। চেহারায় ভারিক্কি ভাব স্পষ্ট। কুটিলতা যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সোফায় বসে মানুষটি নিজস্ব লোকের সঙ্গে আলাপণে ব্যস্ত। কথোপকথন সমাপ্ত হলে ওনার এক আঙ্গুলের ইশারায় সেথা হতে প্রস্থান করলো সে দু’জন। আর আগমন হলো অল্প বয়সী এক তরুণের। সে তরুণ এসে কেমন দুর্বোধ্য হাসলো।
” নেতাজী! খবর আছে। চৌধুরী বাবু অবশেষে এনগেজমেন্ট করে ফেলছে। সুন্দরী, কচি ললনা। সামলাতে পারেনি মনে হয়। ”
রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠলো বয়স্ক মানুষটির অধর কোণে। গুনগুনিয়ে বলে উঠলেন,
” বিয়ের ফুল ফুটিলো রে। বিয়ের ফুল। ”
•
রিকশা এসে থামলো ভার্সিটি সংলগ্ন সড়কে। রিকশা হতে নেমে এলো হৃদি। ভাড়া পরিশোধ করে কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ গলিয়ে প্রবেশ করলো ভার্সিটিতে। পথিমধ্যে দেখা হলো চেনা পরিচিত কয়েক জনের সঙ্গে। তারা শুভকামনা জানালো নতুন জীবনের জন্য। হৃদি হাসিমুখে তা গ্রহণ করলো। নিজেকে আজ আরো একবার কেমন বিশেষ মনে হচ্ছে। সেলিব্রিটি ফিলিংস অনুভূত হচ্ছে। নিজের ভাবনায় হেসে উঠলো মেয়েটি। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো চিরপরিচিত ডেরার পানে। আকস্মিক পদযুগল থমকে গেল। কর্ণ কুহরে পৌঁছালো…
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। আজকের পর্বটি একটু ছোট হয়েছে। লেখায় মোটেও মন বসছিল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেখা। ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]