মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি #দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #তাহিরাহ্_ইরাজ #অন্তিম_পর্ব ( শেষাংশ )

0
685

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#অন্তিম_পর্ব ( শেষাংশ )

গোপন এক অপারেশন সম্পাদিত হলো। গ্ৰেফতার হলো মেছতা ওয়ালা সে ব্যক্তি। টানা এক সমাপ্ত যন্ত্রণাপ্রদ রিমাণ্ডে ছিল সে। সেনাবাহিনীর দু”র্ধর্ষ পিটুনি ও অ-ত্যাচারে মুখ খুলতে বাধ্য হলো। অর্ধমৃ;ত অবস্থায় জানান দিলো, রুদ্র বর্তমানে সুস্থ। অবস্থান করছে খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যেই স্থানান্তরিত হবে বান্দরবান। ইরহাম জানলো সবই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক গোপন পরিকল্পনা কষে নিলো। বাজি রাখলো নিজের ও পরিবারের প্রাণ।

পরিকল্পনা মোতাবেক সপরিবারে কক্সবাজার এলো ইরহাম। দৃশ্যমান স্বাভাবিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবে গোপনে কড়া নিরাপত্তায় মুড়িয়ে চৌধুরী পরিবার। ইরহাম নিশ্চিত ছিল। হাতের নাগালে তাকে পেয়ে রুদ্রনীল কখনোই মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করবে না। তা-ই হলো। সকলের চোখে ধূলো দিয়ে দিনদুপুরে সমুদ্রতীর হতে অপহ:রণ করলো হৃদি ও ইনায়াকে। আসলেই কি তাই? নাহ্। চৌধুরী নিজে সে সুযোগ করে দিয়েছে। স্ত্রী-বোনের জীবন ঝুঁকিতে রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। মিসেস হৃদি শেখ আজ আর অবলা নারী নয়। স্বামী কর্তৃক আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছে সে। যেকোনো বিপদে আত্মরক্ষা করার প্রাথমিক কৌশলটুকু ঠিক করায়ত্ত্বে। স্বামী মানুষটি এই গোপন পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে কিছুই জানায়নি। শুধুমাত্র রিসোর্ট হতে বেরোনোর পূর্বে অনেকটা সময় ধরে ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে রাখলো। বাহুডোরে আবদ্ধ করে ভরসাযোগ্য সেই কণ্ঠে বললো,

‘ আল্লাহ্ ভরসা হৃদরাণী। ইনশাআল্লাহ্ যা হবে কল্যাণকর হবে। ভয়কে জয় করবে এই আমার বিশ্বাস।’

স্বামীর বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে হৃদি। বিপদের মূহুর্তে ভয় পায়নি। বরং মহান রবের ওপর ভরসা রেখেছে। বিশ্বাস করেছে স্বামীকে। সে নিশ্চয়ই ওদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে না! হ্যাঁ। তাই তো কিছু মুহূর্ত বাদেই ওদের উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেনাবাহিনীর অকুতোভয় বীর সন্তানেরা। অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হলো হৃদি, ইনায়া যুগল। রাহিদ অবশ্য বিপদমুক্ত। সে গিয়েছিল ডাব কিনতে। সে ডাব কিনে ফিরে আসার পূর্বেই ঘটে গেল অঘটন। কক্সবাজার মূল শহর থেকে কিছুটা ভেতর দিকে হৃদি ও ইনায়া অপহৃত ছিল। সেনাবাহিনী ওদের সুস্থ দেহে উদ্ধার করলো। কুপোকাত করলো রুদ্র বাহিনীকে। যা সম্পর্কে অজ্ঞাত স্বয়ং রুদ্রনীল। সে তো ভয়ডর দেখিয়ে, হৃদি ও ইনুর অপহৃত অবস্থার ভিভিও দেখিয়ে ইরহাম’কে হেনস্থা করার ছক কষেছিল। ওদের ইচ্ছা এবং নিজস্ব পরিকল্পনা মোতাবেক শত্রুর সঙ্গ দিলো ইরহাম। প্রথমে গাড়ি অতঃপর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যেই কক্সবাজার হতে বান্দরবান পৌঁছে গেল ইরহাম। পথিমধ্যে হেলিকপ্টারের দেহে সকলের অগোচরে ইরহাম লেপ্টে দিলো Family1st GPS tracker. যার সাহায্যে সুনির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল সেনাবাহিনী। এরপরের ঘটনা কারো অজানা নয়। কিভাবে বধ হলো খন্দকার রুদ্রনীল মল্লিক নামক এক অ:ত্যাচারি জা’লেম।

ঘূর্ণায়মান সময়ের চাকা। পেরিয়েছে দিন, মাস, বছর। অতিবাহিত হয়েছে বছর চার।

হালকা সবুজাভ সে ঘরটি। ঘরের দুই পাশে দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট আকর্ষণীয় নকশার নিরাপদ টেবিল, চেয়ার। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত শিশুতোষ বিভিন্ন চিত্র। ফুটবল, চাঁদ, তারা, সূর্য, ছোট গাছ আঁকা দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে। হরেক রঙের রঙপেন্সিলের চিত্র দেয়ালের নিম্ন ভাগে লেপ্টে। মাঝারি আকৃতির রঙিন বোর্ডে কিছু কাঁচা হাতের ছবি ফুটে রয়েছে। ছোট ছোট চেয়ারগুলোতে বসে প্রায় বিশজন শিশু। সকলের বয়স সাড়ে চার থেকে ছয়ের নিচে। স্কুলে এখন টিফিন পিরিয়ড চলছে। বাচ্চারা যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ছোট ছোট হাত দিয়ে ওদের টিফিন বক্স খুলছে। কারো কারোর খাবারে মেখে যাচ্ছে হাত, মুখ, বুকের ধারে পোশাক। নাস্তা খাচ্ছে তারা। কেউ ওয়াটার বটল মুখে দিয়ে চু চু করে পানি পান করছে। কেউবা ছোট ছোট পায়ে ছুটছে বন্ধুর পিছুপিছু। সকলের ভীড়ে চুপটি করে পূর্ব কোনার দিকে চেয়ারে বসে এক মেয়ে বাচ্চা। গুলুমুলু দেহে জড়িয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম। মসৃণ চুলগুলো দুই ঝুঁটি করে দু’পাশে বাঁধা। ফর্সা মুখখানি কেমন আঁধারে ছেয়ে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে শুকনো তালপাতার সেপাই মতো একটা বাচ্চা ছেলে। কিছু বলছে। আর মিটমিট করে হাসছে। বাচ্চা মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে। লালচে রঙ ছড়িয়ে মুখে। টুপ করে গড়িয়ে পড়বে বুঝি অশ্রুবিন্দু। সহসা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো আরেকটা বাচ্চা কণ্ঠের অস্পষ্ট বুলি,

” তুই ইকানে কি করছিছ? ”

চিকন বাচ্চা ছেলেটা কেমন ভীত হয়ে পড়লো। ভয়ে ভয়ে তাকালো পিছু ঘুরে। ভয় তার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলো। হৃষ্টপুষ্ট শরীরের অধিকারী আগত বাচ্চা ছেলেটা। কোমর ধরে দুই হাত। গোল গোল নভোনীল নেত্রে শাসনের চাহনিতে তাকিয়ে। নাম তার রিহাম। রিহাম চৌধুরী। মিস্টার ইরহাম চৌধুরী ও মিসেস হৃদি শেখের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ভাইকে দেখে চেয়ারে বসে থাকা মাহিকা সাহস পেল। টুকটুকে লাল মুখাবয়ব। আস্তে করে আদুরে গলায় ডেকে উঠলো,

” ভাইয়্যু। ”

আহা! সে ডাক বড় ভাইয়ের হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছালো। রিহাম কোমর হতে হাত নামিয়ে ফেললো। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো বোনের কাছে। আদরের বোনের পিঠে ছোট ছোট হাত বুলিয়ে দিলো। আহ্লাদ মাখা স্বরে বললো,

” কাঁদে না বুনু। ভাইয়্যু আসচি তো। ওকে পিট্টি দেবো। ”

মাহিকা তৎক্ষণাৎ ছোট ছোট দুই হাতে ভাইয়ের ডান হাত আঁকড়ে ধরলো। না বোধক মাথা নেড়ে বললো,

” মা-রে না। পতা। ”

” আচ্চা। মারবো না। আমরা গুড বেবি। আম্মু বলেচে। ”

মাথা নাড়ল মাহিকা। রিহাম ছোট ছোট দাঁত বের করে মিষ্টি হাসলো। তাকালো ওই চিকন ছেলেটার পানে। ছেলেটা সে-ই লেভেলের ভয় পেয়েছে। রিহাম যে চিপায় পেলে ওকে আচ্ছামতো মজা বুঝিয়ে দেবে সে বুঝতে আর বাকি নেই। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে এক দৌড়ে পলায়ন করলো ছেলেটা। রিহাম বোনের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে সে পথে তাকিয়ে। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,

” বেদব বেবি। ”

গোধূলি পূর্ব লগ্ন। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ইনায়া। মাথা আবৃত ঘোমটায়। হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম কফি। তাকিয়ে ওই লালচে কমলা তুলিতে অঙ্কিত অন্তরীক্ষে। অধরকোণে ফুটে তৃপ্তির আভা। শুকরিয়া আদায় করছে মহান রবের। ‘তাকে’ অবশেষে পাঠানোর জন্য। কিছুকাল সেভাবে অতিবাহিত হলো। সহসা পেছন হতে হুড়মুড়িয়ে আগমন হলো রাহিদ নামক বিবাহিত প্রেমিক পুরুষটির। আলতো করে ওর হাত ধরলো। ঘুরিয়ে দাঁড় করালো নিজের পানে। শাসক অবতারে অবতীর্ণ হয়েছে সে। চোখ গরম করে তাকিয়ে।

” তোকে না কতবার নিষেধ করেছি আজানের সময় বাইরে থাকতে নেই? কথা কি তোর কানে যায় না? ”

সারাদিন শেষে মাত্র অফিস হতে ফিরলো। ফিরে এসেই বকুনি! অভিমান হলো মেয়েটার। কফির কাপে আর চুমুক দেয়া হলো না। বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। আস্তে করে স্বামীর হাতের মুঠো হতে নিজ হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। স্ফীত উদর আগলে ধরে প্রবেশ করলো ঘরে। রাহিদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। উফ্। বউটা আবার অভিমান করেছে। বিগত কয়েক মাসে অভিমান আমদানি রপ্তানির পরিমাণ বেশ বেড়েছে। কিছু হলেই অভিমান করে। রাগ করে। আবার আচ্ছামতো আদরও করে। করবেটা কি? বর্তমান পরিস্থিতি যে অমনই। হুটহাট মনমানসিকতা বদলে যায়। ‘সে’ আসছে যে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো রাহিদ। শীঘ্রই মাগরিবের আজান দেবে। এবার ঘরে ফেরা যাক। বউটার অভিমান ভাঙাতে হবে।

বিবাহিত জীবনের পেরিয়েছে কয়েক বসন্ত। অবশেষে আল্লাহ্’র রহমতে আসছে তাদের প্রথম সোনামনি। তাকে আনার প্রচেষ্টা চলছিল কয়েক বসন্ত ধরে। কিন্তু সফলকাম হয়নি রা’নায়া। ইনুর কিছু শারীরিক জটিলতা ছিল। যার জন্য গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। অমনি ভয় পেল ছেলেটা। তার কোনো বাচ্চাকাচ্চা লাগবে না। অর্ধাঙ্গী ঠিক থাকলেই হলো। সুস্থ সবল থাকলেই হলো। লাগবে না কোনো বাচ্চা। তবে এ কথায় সহমত পোষণ করতে পারেনি ইনায়া। সে জানে তার স্বামী বাচ্চাদের ঠিক কতটা পছন্দ করে। হুটহাট চলে যায় ‘ আনন্দাঙ্গন ‘। রিহাম, মাহিকা ওদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়। বেশ বাচ্চাপ্রেমী মানুষটা। সেখানে তাদের নিজের সন্তান হবে না! হাল ছাড়লো না ইনায়া। রবের ইবাদত বন্দেগী এবং সুচিকিৎসা দুই চলমান। অবশেষে বছর কয়েক বাদে মহান রবের অশেষ রহমতে গর্ভে এলো ‘সে’। ওদের প্রথম সন্তান। অপ্রত্যাশিত সে সুসংবাদে কাঁদলো রাহিদ। স্ত্রীকে বুকে আগলে সে কি আবেগপ্রবণ ক্রন্দন! এক বৃদ্ধাশ্রম ও এতিম মাদ্রাসায় সন্তুষ্ট চিত্তে মধ্যাহ্ন ভোজ করালো। চলছে স্ত্রীর খুউব যত্ন খেয়াল। ইনায়া এখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ইনশাআল্লাহ্ কয়েক মাস বাদেই আসবে তাদের প্রথম সন্তান।

প্রায় আধঘন্টার প্রচেষ্টা বাদে অভিমানী কন্যার অভিমান ভঙ্গ হলো। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো রাহিদ। প্রিয়তমা স্ত্রীর অভিমান ভাঙানো যতটা না সহজ, তার চেয়ে কয়েকগুণ জটিল বাবুর আম্মুর অভিমান দূরীকরণ করা। উফ্!

” তুই আজকাল বড় অভিমানী হয়ে গেছিস রে ইনু। ”

চুলের ভাঁজে চুমু এঁকে দিলো রাহিদ। ইনায়া মুচকি হাসলো। হৃদয়কাড়া সে হাসি। স্বামীর বুকে মাথাটা ভালোমতো এলিয়ে দিলো। আহ্লাদে কণ্ঠে বললো,

” হুঁ। তোমার অভিমানিনী। যার প্রতিটি অভিমান জানে তাকে ভেঙে চুরমার করতে রয়েছো তুমি। ”

রাহিদ তৃপ্তিময় হাসলো। বিছানার হেডবোর্ডে ভালোমতো দেহ এলিয়ে দিলো। বুকে টেনে নিলো তার অনাগত সন্তানের মা’কে। হৃদয়ে লুকানো ইনু’কে।

নতুন এক দিনের সূচনা। ‘ মালিহা নারী উন্নয়ন কেন্দ্র ‘… রোজকার কর্মে ব্যস্ত নারীবৃন্দ। দোতলা এ কেন্দ্রটি। নিচতলায় অফিস ঘর ও কর্মস্থল। দোতলায় নারীদের বসবাসের স্থান। নিচতলার একটি ঘরে ব্যস্ত নারীরা সেলাই মেশিন নিয়ে। শব্দ হচ্ছে মেশিনের। চলছে বেশকিছু দক্ষ হাত। বুনন করছে পোশাক। এ পোশাক পৌঁছে যাবে স্থানীয় এক বুটিক হাউসে। সেথায় বিক্রি হবে। আরেকটি ঘরে ছোট ছোট কাঠের ব্লক দিয়ে কাজ চলছে। বস্ত্রে চলছে নানাবিধ নকশার ব্যবহার।

‘মালিহা নারী উন্নয়ন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারীদের জন্য। এ সংস্থা সে সকল নি’র্যাতিত নারীদের আশ্রয় দেয়, যারা পারিবারিক স:হিংসতা, যৌ’তুকের জন্য শারীরিক নির্যা’তন, পরিত্যক্ত, তালাকপ্রাপ্ত, জোরপূর্বক প;তিতাবৃত্তি, ধ;র্ষণ, ফতোয়া, প্রতারণা, পা;চার, অ্যা*সিড পো’ড়ানো এবং অন্যান্য স”হিংসতার মতো বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির শিকার। এই ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থাটির লক্ষ্য হলো নি’র্যাতিত নারীদের সমাজে পূর্ণ মানবিক মর্যাদার সাথে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে পুনর্বাসন করা। তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। সেলাই, কাটিং, বুটিক, ব্লক, আর্ট প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুবিধা তৈরি করে তাদেরকে সে কর্মে নিয়োজিত করা। এ সংস্থায় বসবাসরত নারীরা নিজেদের খরচ নিজেরা চালায়। তাদের তৈরিকৃত পোশাক, হস্তশিল্প, ব্লক-বুটিককৃত বস্ত্র বিক্রি হয়। সে অর্থে তাদের জীবনযাপন স্বচ্ছল ভাবে হয়ে থাকে। আর এই উন্নয়নমূলক অগ্রণী সংস্থার মালকিন মিসেস হৃদি শেখ। সে আজ শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ার রায়হান শেখ কন্যা, সাংসদ ইরহাম চৌধুরী পত্নী কিংবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এজাজ চৌধুরীর পুত্রবধূ নয়। এখন তার নিজস্ব পরিচয় হয়েছে। নারীদের কাছে সে এক অনুপ্রেরণা। আদর্শ। সে অনন্যা। এতগুলো নারীর জন্য হৃদি বড় আপন। তাদের প্রতিটি দোয়ায় ঠাঁই পায় প্রিয় ‘বৌমণি’র নাম। হৃদির নাম।

এ সংস্থাটি হৃদির উদ্যোগে তৈরি। প্রত্যহ জীবনে পথেঘাটে বহু অসহায় নারীকে দেখতো সে। মন খারাপের মেলা বসতো অন্তরে। এক সাংসদ, দেশপ্রেমিকের সহধর্মিণী কিনা! দেশের প্রতি কাজ করে অগাধ টান‌। সেই টান হতে অসহায় নারীদের জন্য কিছু করার প্রবল বাসনা। উদ্যোগ নিলো নারী উন্নয়ন সংস্থা তৈরি করার। তবে এই প্রশংসনীয় কর্মে অর্থ পেল কোথায়? বছর দুই পূর্বে তৈরি হয় এ সংস্থা। সংস্থা তৈরীর জন্য স্বামী মানুষটি ওকে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিলো। আহ্লাদে কণ্ঠে আপত্তি জানালো হৃদি। সে নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চায়। নিজে কোনো ভূমিকা রাখতে চায়। প্রস্তাবটা বেশ পছন্দ হলো এমপি সাহেবের। সে ওকে এক চমৎকার পথ দেখিয়ে দিলো। দেনমোহরের টাকা আজও অব্যবহৃত। হয়নি খরচ করা। সে অর্থ নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখতে পারে। খুশিতে আটখানা হলো হৃদি। চুমু এঁকে দিলো স্বামীর গালে। প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরেছে কিনা। আলতো করে হাসলো ইরহাম। মাঝেমধ্যে ভালো টিপস্ দেয়া যেতেই পারে। যদি বিনিময়ে মেলে বউয়ের অধরের আলতো ছোঁয়া। মুচকি হেসে ইরহাম প্রস্তাব দিলো আরো একটি।

‘ আমি তোমার সংস্থায় ইনভেস্ট করতে চাই। ‘

হৃদি কিছু বলার পূর্বেই,

‘ তুমি তো বিজনেস স্টাডিজ এর স্টুডেন্ট। নিশ্চয়ই মুনাফা চেনো! কি চেনো তো? আমি তোমার প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে চাই। হিসাবকাল শেষে তুমি আমাকে একটা মুনাফা দেবে। আশা করি আপত্তি নেই? ‘

এমন সুন্দর প্রস্তাব। আপত্তি জানাতে ব্যর্থ হলো হৃদি। অবশেষে দেনমোহরের সম্পূর্ণ অর্থ ও স্বামী প্রদত্ত মূলধন নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। আজ ‘ মালিহা নারী উন্নয়ন কেন্দ্র ‘ তে প্রায় ষাট জন নারীর বসবাস। তাদের নিরাপদ আশ্রয় ওই কেন্দ্র। তাদের জীবিকার উৎস ওই কেন্দ্র। ওই কেন্দ্র তাদের ভালোবাসার।

সংস্থা হতে যে অর্থ লাভ হয় তার আশি শতাংশ নারী উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। বাকি বিশ শতাংশ তাদের মিয়া বিবির। মিয়া সাহেব ওরফে ইরহামের সে মুনাফা নামক অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। টাকাটা রয়ে যায় হৃদির কাছে। হৃদি সে-ই অর্থ নিয়ে ছোটে শপিংমল। স্বামীর জন্য গাদাগাদা শুভ্র রঙা আকর্ষণীয় পাঞ্জাবি ক্রয় করে। নিজ অর্থ দিয়ে বাবুদের জামা কেনে। চৌধুরী সাহেবের কাবার্ড খুললে আজ শুধু শুভ্রতার ছড়াছড়ি। ভিন্ন রঙের পোশাক বোধহয় বিলুপ্ত প্রায়। আরো পড়ো বিধবার পোশাক! স্বামীর আমশে মুখশ্রী দেখে মিটিমিটি হাসে হৃদি। স্বামীর সঙ্গে ম্যাচিং করে পোশাক পড়ার চেষ্টা করে। রোজ সকালে একসাথে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বেরোয় তারা। পাঞ্জাবি পড়ুয়া এমপি সাহেব এবং শাড়ি পরিহিতা তার হৃদরাণী। দেখতে লাগে নজরকাড়া। যেন আস্ত এক রাজযোটক!
_

হৃদি নারী উন্নয়ন কেন্দ্রের অফিস ঘরে বসে। পড়নে তার হালকা রঙের শাড়ি। চুল আবৃত হিজাবে। প্রসাধনবিহীন মুখশ্রী। চোখেমুখে এক উজ্জ্বল-উদ্দীপ্ত আভা। আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কথা বলছে কেন্দ্রের দু’জন নারী সদস্যের সঙ্গে। সে কথোপকথনে চুয়ে চুয়ে পড়ছিল ব্যক্তিত্ববান নারীর চারুতা। হৃদি আজ আর সে-ই পুরনো সহজ-সরল, চঞ্চল দুষ্টু মেয়েটি নেই। আজ তার নিজস্ব পরিচয় রয়েছে। দু সন্তানের মা সে। সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর সহধর্মিণী। প্রায় ষাটজন নারীকে নিয়ে গঠিত তার এই ‘ মালিহা নারী উন্নয়ন কেন্দ্র ‘. হৃদি তখন নিজ কর্মে ব্যস্ত। ঘরের বাহিরে অপেক্ষারত রাঈশা। এসেছে বোনের সঙ্গে দেখা করতে। প্রতি সপ্তাহে একবার করে হলেও এ কেন্দ্রে আসার চেষ্টা করে সে। জীবনযু”দ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো নারীদের সঙ্গে সময় কাটায়। প্রশান্তির পবন বয়ে যায় তনুমনে।

রাঈশা দেখেছে। সে নিজে সাক্ষী তার বোনের উত্থান-পতন মিশ্রিত জীবনের। রাঈশা মেয়েটা ভেবেই অবাক হয়ে যায় কতটা পরিবর্তন তার সে-ই ছোট্ট হৃদুর! এককালে এই হৃদি ছিল নরমধরম, দুর্বল, সহজ-সরল। আর বড় চঞ্চল। তাই তো সে-ই তথাকথিত বড় বোনের মতো ডমিনেটিং আচরণ করতো সে। ওকে নিয়ে চিন্তিত থাকতো। সর্বদা মনে হতো সে-ই সঠিক। ছোট বোনটা অবুঝ। বোকা। ও চলতে জানে না। সিদ্ধান্ত নিতে জানে না। ভালোমন্দ বোঝে না। এজন্য নিজস্ব মতামত ওর ওপর চাপিয়ে দিতো। ওকে নিজ সিদ্ধান্তে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সর্বদা বহাল থাকতো। তবে বোঝেনি সে, হৃদি বোকা নয়।‌ বড় বোনের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ওকে বাঁধা দিতো। তাই নীরবে সবটা মেনে নিতো সে। পূর্বের হৃদি প্রতিবাদী ছিল না। অন্যের আবেগ অনুভূতি নিয়ে বেশ সচেতন ছিল। তাই নীরবে মেনে নিতো সব। তবে আজকের হৃদি? আকাশপাতাল তফাৎ। স্বামীর হালাল সান্নিধ্য ও সীমাহীন ভালোবাসা ওকে বদলেছে। জীবনের পাঠ হাতেকলমে শিখিয়েছে। নানাবিধ উত্থান-পতন পেরিয়ে আজকের এই পরিণত হৃদি। রাঈশার আজও মনে পড়ে। আফশোস হয়। কি বোকামিটাই না সে করেছিল! এই ইরহাম চৌধুরীর সঙ্গে বোনের বিয়েতে সে বিন্দুমাত্র রাজি ছিল না। প্রথমত এক রাজনীতিবিদ কখনোই তার নরমধরম বোনের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ নয়‌। ও সুখে থাকবে না সেখানে। দ্বিতীয়ত, তার স্বামী ফাহিম একটা ভালো সম্বন্ধ এনেছিল। পাত্র নিউরোসার্জন। বেশ সুদর্শন। হ্যান্ডসাম ইনকাম। জীবনে সুখী হতে আর কি চাই? তাই তো সে বাবার কাছে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে ধোপে টেকেনি সে আপত্তি। বাবা নিউরো সার্জনকে বাদ দিয়ে রাজনীতিবিদ’কে বেছে নিলো। হায়! কতটা বোকা কাণ্ড ঘটিয়েছিল সে। ভাগ্যিস বাবা তার আপত্তি মেনে নেয়নি। নাহলে তার বোনটার ভাগ্যে এতখানি সুখ, ভালোবাসা থাকতো! আলহামদুলিল্লাহ্! ভালো আছে, সুখে আছে তাদের হৃদু। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিলেমিশেই তো জীবন। সদা প্রাণবন্ত সুখে থাকুক তার বোনটা। এই ওর প্রার্থনা।

রাঈশার ভাবনায় ছেদ পড়লো ‘ আপু ‘ ডাকে। হৃদি দাঁড়িয়ে সম্মুখে। মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো রাঈশা। সালাম বিনিময়ের পর উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো দুই বোন। কুশল বিনিময় হলো। কথা বলতে বলতে তারা অগ্রসর হলো কেন্দ্রের কর্মস্থলে। এখন সেথায় সময় কাটাবে তারা।

‘আনন্দাঙ্গন’. লিভিংরুমে বসেছে এক আনন্দমেলা। ‘ওরা সাতজন’ হয়েছে একত্রিত। কতদিন পর বন্ধুরা একত্রিত হলো। বর্তমানে সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কর্মে। মাস্টার্স শেষে কেউ নিজ ক্যারিয়ার, কেউবা সংসার নিয়ে ব্যস্ত। চাইলেই সেই পুরনো আড্ডা, একসাথে জমায়েত হয়ে ওঠে না। তবে আজও অটুট সেই বন্ধুত্ব। ভাটা পড়েনি একটুও। মাসে অন্তত একবার হলেও তারা সময় করে গেট টুগেদারের আয়োজন করে। প্রত্যেকবার সে আয়োজন একেক বন্ধুর পছন্দসই লোকেশনে হয়ে থাকে। এবারের আয়োজন হৃদির পছন্দমতো আনন্দাঙ্গনে। তাই তো দুপুর নাগাদ চলে এলো সব। ছুটির দিন আজ। রাত অবধি চলবে আড্ডা। অতঃপর নৈশভোজ সেরে বিদায় নেবে তারা। রিহাম ও মাহিকাও সেথায় উপস্থিত। মামাই, খালামনিরা ওদের খুব আদর করে। ওদের ভালোবাসে। সাবু আঙ্কেলটা বেশি ভালো। কত আদর দেয়! চকলেট আইসক্রিম দেয়! খুউব ভালো সে। মাহিকা বসে আফরিনের কোলে। পাশে আফরিনের দু বছর বয়সী মেয়ে বসে ইভার কোলে। রিহাম চুপটি করে বসে নেই। মেঝেতে কার্পেটে বসে রিমোট কন্ট্রোল লাল রঙের গাড়ি চালাচ্ছে। বুম বুম শব্দ করছে মুখ দিয়ে। মাঝেমধ্যে ছুটে গিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছে। মা’কে হামি দিয়ে আবার বসে পড়ে খেলছে। নাদিরা হাসছে এ দেখে। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির চোখেমুখে সে এক আলাদাই উজ্জ্বলতা। বন্ধুমহল এ মুহূর্তে তাদের সাবু বেবি ওরফে সাবিতের পেছনে পড়েছে। হাসিঠাট্টার মধ্যে ওকে লেগ পুল করছে। সাবিত বসে বসে ফুঁ’সছে‌। উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে নাসিকা পথ দিয়ে। ফট করে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে হিসহিসিয়ে বললো,

‘ তোরা একেকটা হারা* ‘

আর দাঁড়ালো না সাবিত। যাওয়ার পূর্বে কাঙ্ক্ষিত নারীকে ঠিক চোখের ইশারা করে গেল। তা লক্ষ্য করে সশব্দে হেসে উঠলো বন্ধুরা। টোন কেটে বলছে,

” ওয়ে ওয়ে ”

মানুষটির একান্ত ইশারা আর উপস্থিত সকলের দুষ্টুমি। লাজে রাঙা হয়ে সে নারী দ্রুত পায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো।

.

ঘরের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পায়চারি করে চলেছে সাবিত। ক্ষ্যা’পা ষাঁড়ের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে। ওদিকে ওই বুদ্ধিহীন নারী এখনো কোন চিপায় লুকিয়ে! সব লাজশরম একবারেই পাচ্ছে নাকি? কিছু তো আজ রাতের জন্য বাকি রাখুক। তপ্ত শ্বাস ফেললো বেচারা। পায়চারি থামিয়ে দাঁড়ালো। ইন্দ্রিয় অনুভব করলো কিছু এক। সেকেন্ড কয়েক বাদে আকস্মিক বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে গেল দরজায়। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে হাত ধরে টেনে নিলো একান্ত মানবীকে। তাকে ঘরে এনেই এক ধাক্কায় বন্ধ করে দিলো দ্বার। নারীর পিঠ ঠেকে বদ্ধ সে দ্বারে। হকচকিয়ে তাকিয়ে সাবিত পানে। সাবিত মিটিমিটি হাসছে। নেচে চলেছে দু ভ্রু। লাজুক কন্যার দু গালে কে যেন মেখে গেল লালিমা। অবনত মায়াবী দৃষ্টি। ডান হাত খামচে ধরে পরিহিত পোশাক। সাবিত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দেখছে স্বীয় অর্ধাঙ্গীকে। বিবাহিত জীবনের দুমাস অতিবাহিত হতে চললো। আজও বউয়ের লজ্জার বহর কমাতে পারলো না সে! অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা! কেমন রোমান্টিক পুরুষ সে, আজও বউয়ের লজ্জা শরম ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলতে পারলো না! হুঁ! স্ত্রীর কোমরের পাশ গলিয়ে দরজায় হাত ঠেকালো সাবিত। দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব অতীব ক্ষীণ। আবেশে সিক্ত তরুণীর শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ বেহাল। সাবিত দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো নৈকট্যে এলো। অধর চাপ বসালো ললাটে। নিমীলিত হলো রায়না’র আঁখিপল্লব। অনুভব করে চলেছে স্বামীর হালাল স্পর্শ। ধুকপুক ধুকপুক করছে হৃৎপিণ্ড।

পুরো পাঁচদিন বাদে মানুষটির সান্নিধ্য পাচ্ছে সে। অফিসিয়াল কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিল সাবিত। ফিরলো আজ সকালে। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে বউ সমেত চলে এলো ‘আনন্দাঙ্গন’। আফটার অল প্রিয় বন্ধুমহলের ডাক পড়েছে যে। দেখতে দেখতে তাদের হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হবার সময় দুই মাস পেরোতে চলেছে। বিয়ের পর তাদের প্রতিটি দিন ছিল আবেগী, মধুরতম। স্বামী মানুষটি কখনো তাকে একলা ছাড়েনি।‌ সদা সর্বদা তার সঙ্গে ছিল। নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে যথাসাধ্য সহায়তা করেছে। তাকে মুড়িয়ে রেখেছে ভালোবাসার চাদরে। দুষ্টু লোক একটা। বান্ধবীর ননদকে কবে কখন পছন্দ করে ফেলেছে কে জানে। মুখ ফুটে ওকে তো একবিন্দুও বলেনি। সোজা ইরু ভাইয়ার কাছে প্রস্তাব। বান্ধবী হৃদি অবধি বাদ। সাবিত বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরে জব করছে। হ্যান্ডসাম স্যালারি। দেখতে সুদর্শন। সর্বোপরি হৃদি’র বন্ধু হিসেবে খুব ভালো করেই রয়েছে চেনাজানা। প্রস্তাবটা ইরহামের পছন্দ হলো। গুরুজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে এই সম্বন্ধে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলো ইরহাম। এরপর? মাত্র এক মাসের মধ্যেই বাজলো বিয়ের সানাই। দুঃখিত। সানাই বাজেনি। ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী মাঝারি আয়োজন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো সাবিত এবং রায়না। সাবিত সাহেব নাকি বউ ছাড়া আজকাল রাতে ঘুমোতে পারছেন না। গা ম্যাজম্যাজ করে। কোলবালিশটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! তাই তো নিজেই লাজশরম বেচে খেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ের তারিখ ঠিক করার অনুরোধ জানালো।‌ এহেন কাণ্ডে হৃদি ও বন্ধুদের সে কি হাসি! শ্যালক রাহিদ তো হো হো করে হাসলো। পিঠ চাপড়ে সাবাশি দিলো।

পুরনো কথা স্মরণ করে লাজে রাঙা রায়না। লহমায় বদলে গেল তার প্রতিক্রিয়া। শিহরিত তনুমন। স্বামীর এলোমেলো পা:গলপারা পরশ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। কর্ণ গহ্বরে পৌঁছাচ্ছে নে-শালো স্বর,

” আই ব্যাডলি মিসড্ ইয়্যু বেবি। ”

” সাবিত! এ-এখন না। সবাই অপেক্ষায়। ”

ঘন শ্বাস ফেলে আকুল স্বরে বললো রায়না। তা শুনলো না প্রিয়তমায় আস’ক্ত পুরুষ। অধরের মা;দকতাময় পরশ ছুঁয়ে চলেছে অবিরাম। বলিষ্ঠ দু হাতে আগলে কোমল তনু। এগিয়ে চলেছে রঙিন বিছানায়। পাঁচদিনের দুরত্ব শেষে আজ একান্ত সঙ্গিনীকে ছাড়তে নারাজ সে। পুরোপুরি না হলেও অল্প সন্তুষ্টি, আদর চাই তার। অবশ্যই চাই। পা”গলাটে পুরুষটিকে বাঁধা দিতে ব্যর্থ হলো রায়না। আবেশে নিমীলিত চক্ষু জোড়া। সে-ও সঙ্গী হলো প্রেমময় সুখের ভেলায়।

তমসাচ্ছন্ন রজনী। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ইরহাম। বক্ষলগ্না হয়ে বসে আদুরে কন্যা মাহিকা। মোবাইলে চলছে শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনকাহিনী। মাহিকা বাবার বুকে মাথা এলিয়ে শুয়ে। মন দিয়ে শুনছে শ্রেষ্ঠ নবীর জীবনী। কখনো কোনো ভারিক্কি শব্দ বা ঘটনা বুঝতে অসুবিধা হলে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছে। মুচকি হেসে মেয়ের সমস্ত কৌতূহল মিটিয়ে দিচ্ছে বাবা ইরহাম। এভাবেই অতিবাহিত হলো অনেকটা সময়। জীবনী সমাপ্ত হলে মোবাইল পাশে রেখে দিলো ইরহাম। মেয়ের ললাটে চুম্বন এঁকে শুধালো,

” আম্মা! কি বুঝলে বলো তো? ”

মাহিকা বাবার বুকের ওপর আরেকটু উঠে শুলো। ছোট ছোট হাতে বাবার প্রশস্ত বুক জড়িয়ে ধরার বৃথা চেষ্টা করে খুশি খুশি বললো,

” নবী ভালো। ”

” হ্যাঁ আম্মা। আমাদের নবী ছিলেন শেষ নবী। শ্রেষ্ঠ নবী উনি। শুনলে না? ওনার পর আর কখনো কোনো নবী আসবেন না। উনিই.. ”

” শেচ নবী। ” বাক্য সম্পূর্ণ করলো মাহিকা।

মুচকি হেসে মেয়ের মসৃণ চুলে হাত বুলিয়ে দিলো ইরহাম,

” হ্যাঁ। শেষ নবী। আমাদের নবীজী.. ”

মেয়েকে নবীজীর জীবনী শোনাচ্ছে ইরহাম। কতক্ষণ বাদে অনুভব করলো নিশ্চুপ কন্যা। বুকে আছড়ে পড়ছে ঘন শ্বাস। ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আলতো করে হাসলো ইরহাম। মেয়ের চুলের ভাঁজে স্নেহপূর্ণ চুমু দিলো। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো হৃদি। কোলে তাদের দুষ্টু ছানা রিহাম। এত রাত হয়েছে। বাবু এখনো জেগে। দাদার সঙ্গে মুক্তিযু;দ্ধের ডকুমেন্টরি দেখছে। কিছুতেই আসবে না। ঘুমাবে না। হৃদি জোরপূর্বক ধরে নিয়ে এসেছে। এজন্য পেঁচামুখ করে বাবু। ঘরে পৌঁছাতেই ফুরুৎ করে মায়ের কোল বেয়ে নেমে গেল। দৌড়ে গেল বাবার কাছে। বাবার কোল ঘেঁষে বসলো। আঁকড়ে ধরলো বাবার শক্তপোক্ত একটি হাত। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

” আব্বু। আমিও বঙ্গোবোন্দু হবো। ”

আধো আধো বুলিতে নিজ ইচ্ছে প্রকাশ করলো বাচ্চা ছেলেটা। চমকিত নেত্রে একে অপরের পানে তাকিয়ে ইরহাম, হৃদি! এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সে-ই শৈশবে এমন করেই তো মা’কে বলেছিল শিশু ইরহাম। আজ বললো তার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তবে কি ইতিহাসের সত্যিই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে! বলবে তা শুধুমাত্র সময়।

সাংসদ ইরহাম আজ আর থেমে নেই। মন কাননে চলছে ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা। বড় কিছু করার অপেক্ষায় সে। বদল হতে চলেছে বুঝি সাংসদ পরিচয়!

ফুরফুরে এক ভোর। শীতলতম হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে ঘরে। হালকা নড়ে উঠছে পর্দা। বিছানায় ঘুমন্ত দুই শিশু। নামাজের স্থানে জায়নামাজে বসে ইরহাম। পড়নে শুভ্র পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। তার বুকে মাথা এলিয়ে বসে হিজাবে আবৃত জীবনসঙ্গিনী হৃদি। দু’জনেই সদ্য সালাত আদায় করেছে। এখন উপভোগ করে চলেছে প্রকৃতির প্রশান্তি। মহান রবে’র অন্যতম সেরা সৌন্দর্য। ভোরের সৌন্দর্য। সঙ্গে অর্ধাঙ্গ। একান্ত সে পুরুষের বক্ষস্থলে মিশে সীমাহীন প্রশান্তি। এক জান্নাতি সুখানুভূতি। আহা! হৃদয়ছোঁয়া সে অনুভূতি! একদা পথভ্রষ্ট ছিল হৃদি শেখ নামক তরুণী। ধর্মের পথে ছিল না সে। ছিল না জীবনের কোনো লক্ষ্য। অতঃপর তার জীবনসঙ্গী রূপে রব পাঠালেন ইরহাম নামক সুপুরুষকে। যার সান্নিধ্যে একটু একটু করে জীবনের মর্ম বুঝলো হৃদি। এলো দ্বীনের পথে। নামাজী হলো। সাওম রাখে সে। শালীনতার সহিত চলাচলের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। জীবনসঙ্গী হোক তো এমনই হোক। যে শুধু ইহকাল নয় বরং পরকালের সঙ্গী হবে। হাতে হাত রেখে ভুল পথ হতে সঠিক পথে চালনা করবে। হৃদি সর্বদা কৃতজ্ঞ এ মানুষটির সহধর্মিণী হতে পেরে। আজ তার জীবনের লক্ষ্য রয়েছে। রয়েছে তার জান্নাতি সুখ- তার স্বামী ও দুই সন্তান। মহান রবের নিকটে অশেষ শুকরিয়া। শুকরিয়া মালিহা মায়ের প্রতি। আল্লাহ্’র পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর বিহীন এ মানুষটি হয়তো তার হতো না। সেদিনের হঠকারিতায় গ্রহণ করা একটি সিদ্ধান্ত আজ হৃদি’র জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। পরম শান্তির কারণ।

হৃদি তৃপ্তিময় হেসে স্বামীর বুকে আরেকটু মিশে গেল। বুকের বাঁ পাশে শুভ্র পাঞ্জাবির ওপরেই ছুঁয়ে দিলো অধরের আলতো পরশ। মৃদু স্বরে বললো,

” জাঝাকাল্লাহু খইরন জনাব, আমার জীবনে এসে আমাকে পূর্ণ করার জন্য। ভালোবাসি আমার বাবুর আব্বু। ”

” তোমাকেও এক আকাশ ভালোবাসা বাবুর আম্মু। তুমি আর আমাদের দুই সন্তান। পূর্ণ করেছো আমায়। দিয়েছো আমায় বেঁচে থাকার কারণ। আমার সুখানুভূতির আরেক কারণ তুমি ও তোমরা। বেরঙিন এই জীবনে চিরস্বাগতম আমার হৃদরাণী। ”

স্ত্রীর ললাটে অধরের পবিত্র স্পর্শটুকু ছুঁয়ে ইরহাম। নিমীলিত তাদের দু’জনেরই আঁখিপল্লব। আবেশিত তনুমন। অনুভব করে চলেছে পরম সুখের মুহূর্তটুকু। মনগহীন হতে আবেগমথিত স্বরে জানান দিচ্ছে,

‘ বিপরীত চরিত্রের দুই সত্তার হালাল বন্ধন
খুনসুটির আড়ালে গড়ে উঠে প্রণয়ের ই’ন্দন।
পরস্পরের পারিপার্শ্বিকতায় একে অপরের মোনামি
আকস্মিক লগ্নে মনের অরণ্যে এলে তুমি! ‘
[ – মোহসিনা রুদ্র ]

•• সমাপ্ত ••

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। আহা! আজ সে-ই অন্তিম লগ্ন। সাড়ে তিন মাসের যাত্রা শেষে বিদায় নিচ্ছে আপনাদের প্রিয় হৃ’হাম, রা’নায়া, চৌধুরী ও শেখ পরিবার। ভিন্নধর্মী এক প্লট নিয়ে উপন্যাসের যাত্রা। প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখতে যাচ্ছি। নার্ভাসনেস ছিল বেশ। উপন্যাসের প্রয়োজনে বহু অজানা জেনেছি, শিখেছি, আপনাদের মাঝে ভিন্ন কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। জানিনা কতটুকু সফল হয়েছি। তবে আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি অপ্রত্যাশিত অফুরন্ত ভালোবাসা! সে ভালোবাসা ও শুভকামনা-দোয়ায় প্রতিনিয়ত সিক্ত এই আমিটা। এভাবেই পাশে থাকবেন তো বন্ধুগণ? ইনশাআল্লাহ্ থাকবেন, সে আশাই করছি। আজ অন্তিম পর্বে আপনাদের সেরা মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু। মন খুলে কমেন্ট করুন। সেরা সাতটি কমেন্ট প্রকাশিত হবে পেইজ ও গ্রুপে। শুকরিয়া পাঠকবৃন্দ! ভালোবাসা অবিরাম। বিদায় নিচ্ছি তবে? আল্লাহ্ হাফিজ। ]

♣️ পাঠক বন্ধুরা….

তাহিরাহ্ ইরাজ এর লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে পোস্ট করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে।

গ্রুপ লিংক 🍁

https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here