#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৩
” ওয়েলকাম টু আওয়া’র হোম মিসেস রাহিদ! ”
নতুন গৃহ। আপন নীড়। অশ্রুসজল নয়নে ঘুরে ঘুরে নতুন বাসাটির ড্রয়িংরুম দেখছিল ইনায়া। তখনই কর্ণপাত হলো পুরুষালি কণ্ঠস্বর। তার স্বামীর কণ্ঠস্বর। চকিতে পিছু ঘুরে তাকালো ইনু। দু হাত দুই দিকে প্রসারিত করে স্বল্প ঝুঁকে রাহিদ। হাস্যবদনে নতুন গৃহে আপন অর্ধাঙ্গীকে উষ্ণ স্বাগত জানাচ্ছে। মেয়েটির চোখে জল ঠোঁটে খুশির ছোঁয়া। হৃদয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস। এমন এক মুহুর্ত সত্যিই তার তাকদীরে ছিল! আজ সে এবং তার স্বামী নতুন ঘরে। স্বামী নামক মানুষটি সুখপূর্ণ প্রাণবন্ত রূপে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এমন একটি দৃশ্য কি তার স্বপ্নে এসে বহুবার ধরা দেয়নি? দিয়েছে তো। আজ স্বপ্ন যেন সত্যি হলো। খুশি ধরা দিলো মনের দোরগোড়ায়। দু হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো ইনায়া। দাঁড়ালো আরেকদিকে পিঠ করে। রাহিদের উজ্জ্বল মুখখানা অকস্মাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তার ইনু কাঁদছে! চঞ্চল পায়ে স্ত্রীর পানে এগিয়ে গেল রাহিদ। ক্রন্দনরত মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আবদ্ধ করে নিলো বাহুবন্ধনে। ললাট কার্নিশে অধর দাবিয়ে রেখে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,
” কাঁদে না সোনা। হশশ! একটু থাম। শান্ত হ। ইনু। শান্ত হ সোনা। এটা স্বপ্ন নয়। সত্যি। পিওর ট্রুথ। আর না। দুঃখ পালিয়েছে। এখন শুধু সুখের সময়। ”
ক্রন্দনে লিপ্ত মেয়েটি অভিমানের পাহাড় গুঁড়িয়ে জাপটে ধরলো আপনজনকে। মাথা এলিয়ে দিলো বুকের বাঁ পাশে। হৃৎপিণ্ড বরাবর। পেলব দু হাত স্থাপিত চওড়া পৃষ্ঠে। ওর ক্রন্দন ধ্বনি চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে সে জনের হৃৎযন্ত্র। রূদ্ধ হয়ে আসছে শ্বাস-প্রশ্বাস। নিজের সবটুকু স্নেহ একত্রিত করে ইনুকে আগলে নিলো রাহিদ। আজই এর শেষ। আজকের পর এই মায়াবী কন্যার দু চোখে বিনা কারণে অশ্রুজল জমতে দেবে না সে। এ তার নিজেকে নিজের প্রতিশ্রুতি।
•
সময়ের চাকা অবিরাম চলতে থাকে। থামে না কারোর বিন্দুমাত্র আবদারে। চলমান এ সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে অতিবাহিত হলো একমাস। বদলে গেছে কত কি। ইনায়া এখন রাহিদের ঘরণী। গড়ে উঠেছে তাদের ছোট্ট সংসার। তবে একপাক্ষিক অভিমান এখনো চলমান। যদিওবা স্বামী নামক মানুষটির ছোটোখাটো যত্ন, ভিন্ন অবতারে অভিমান এখন নেই বললেই চলে। তবে তা অপ্রকাশ্য রয়ে গেছে। রাহিদের দৃষ্টিতে ইনুর অভিমান একটুও কমেনি। বরং এখনো কঠিন হৃদয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। হৃদয়ের দোরগোড়ায় বরফ জমেছে কি! এত কিসের কাঠিন্যতা! জানা নেই রাহিদের। তবে সে নিজের তরফ থেকে সবটুকু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ্ সফলতা একদিন না একদিন ধরা দেবেই। অন্যদিকে ‘ আনন্দাঙ্গন। ‘ ইনায়ার অনুপস্থিতিতে বাড়িটা কেমন নির্বাক হয়ে ছিল। সব থেকেও যেন নেই। ইরহাম যথারীতি নিজ কর্মে ব্যস্ত। এজাজ সাহেব চুপচাপ। অফিসিয়াল কার্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। বাড়িতে এখন শুধু তিনটে জীব। হৃদি, মালিহা এবং রাজেদা খানম। এদের সঙ্গেই সময় কাটে হৃদির। বড্ড মিস্ করে তার আদুরে ননদকে। ইনু বিহীন কেমন যেন রষকষহীন সময় কাটে। পুরো বাড়িতে একাকী তরুণী সে। মা ও দাদি রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ভাবেই তারা বয়সে বড়। একটা জেনারেশন গ্যাপ রয়েছে। কেমন একটা শূন্যতা রয়েই যায়। ওদিকে স্বামী নামক মানুষটিও ব্যস্ত। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে। ফেরে রাত্রি বেলা। আগে তো ননদ ছিল। তার সঙ্গে সময় কেটে যেতো। আজকাল এই নিঃসঙ্গতা বড় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কেমন অসহনীয় লাগে। তবুও বাড়ির বউ হিসেবে সকল দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে হৃদি। আগে হয়তো বাড়ির বউ হয়েও নিস্প্রভ ছিল। এখন তেমনটি নেই। প্রায়শ নিজেই টুকটাক রান্না করে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি তাদের খেয়াল রাখে। তাদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে দায়িত্বরত। সব মিলিয়ে চলছে দিনকাল।
•
তমসাচ্ছন্ন কক্ষ। আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়েছেন আজগর সাহেব। নিমীলিত আঁখি পল্লব। বড় শান্ত মুখশ্রী। এ যেন প্রলয় সৃষ্টিকারী কোনো ঝড় ওঠার পূর্বাভাস। তছনছ করে দেবে সব। ছিন্নভিন্ন হবে কারোর সুখের নীড়। ওনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কয়েকজন চ্যা লা। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তারা। কি করে বলবে সত্যিটা! নেতাজী কি ক্রু-দ্ধ হবেন না! কোনোমতে একজন মৃদু স্বরে ভীতসন্ত্রস্ত বদনে বলে উঠলো,
” নেতাজী! মুহিত কেসে এবার প্যাঁচ লাগতাছে। পুলিশ আরো কিছু ক্লু পাইছে। সন্দেহ করতাছে এইটা সাধারণ মৃ-ত্যু না। ভেতরে গণ্ডগোল আছে। ”
আরামকেদারায় শায়িত মানুষটির আরামে ব্যঘাত ঘটলো। শক্ত হলো পেশি। কাঠিন্যতা ভীড় জমালো মুখের আনাচে কানাচে। সহসা আঁধার চিরে কর্ণপাত হলো ভ য় ঙ্ক র স্বরে এক আদেশ বার্তা,
” অনেক হয়েছে। আর নয়। তুলে ফেল ওটাকে। ”
চমকালো ওনার চ্যা”লারা! কার কথা বলছেন নেতাজী! মুখ ফসকে একজন জিজ্ঞেস করে উঠলো,
” কাকে? হৃদি শেখ? ”
বলেই মুখে হাত চাপা দিলো। ভয়ে আঁতকে উঠলো অন্তঃস্থল। এ কি করলো সে? নেতার মুখের ওপর প্রশ্ন! তবে ভাগ্যক্রমে আতঙ্কিত হবার মতো কিছুই ঘটলো না। আঁখি বুঁজে আজগর সাহেব আপনমনে বলে উঠলেন,
” চৌধুরীর হৃদয় রাণী! আর মাত্র ক’দিন। যত পারো উড়ে নাও। শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে মাটিতে। ”
ওষ্ঠপুটে লেপ্টে ক্রুর হাসির রেখা। ওনার লুকায়িত আদেশ নির্দ্বিধায় অনুধাবন করতে পারলো শিষ্যরা। নি-ষ্ঠুর এই আদেশ নির্দ্বিধায় মান্য করার পণ করলো তারা। অপেক্ষা শুধুমাত্র সঠিক সময়ের। অতঃপর…!
•
রবি’র ঝলমলে কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। নিদ্রায় তলিয়ে হৃদি। তাকে সাপের ন্যায় পেঁচিয়ে এক সুঠামদেহ। ফজরের সালাত আদায় করে দু’জনেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে সাত নির্দেশ করছে। সহসা বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটি কর্কশ ধ্বনিতে বিরক্ত করতে লাগলো। অ্যালার্ম বেজে চলেছে। বিরক্তিকর ধ্বনিতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। অস্বস্তিতে কুঁচকে গেল চোখমুখ। আস্তে ধীরে আঁখি পল্লব মেলে তাকালো হৃদি। ডান হাত পৌঁছে গেল বালিশের পাশে। হাতের নাগালে মিললো মোবাইল। মুখের সামনে মোবাইল এনে ঘুমকাতুরে চোখে তাকালো মেয়েটা। আঙ্গুল ছুঁয়ে বন্ধ করলো অ্যালার্ম। পূর্বের জায়গায় রেখে দিলো মোবাইলটি। ডান হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠাধর আড়াল করে হাই তুললো। নড়তে গিয়ে অনুভব করতে পারলো চরম অস্বস্তি। কোমল দেহ যেন চাপা পড়েছে কয়েক মণ ওজনের নিচে। দমবন্ধকর অবস্থা। হাঁসফাঁস করে বামে মুখ নিলো সে। লহমায় অস্বস্তি কেটে গিয়ে মোহগ্ৰস্থ হলো! চোখের তারায় বন্দী হলো স্বামীর ঘুমন্ত অবয়ব। কেমন শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ বদনে ঘুমিয়ে সে। পেশিবহুল দু হাতে পেঁচিয়ে তাকে। ভারী একটি পা উঠিয়ে ওর দু পা আঁটকে। নড়াচড়া দুষ্কর। গত রাতে সীমাহীন মধুর যাতনা দেয়া মানুষটি এখন যেন অবুঝ শিশুতে রূপান্তরিত হয়েছে। কে বলবে বিগত রাতে এ মানুষটি ছিল প্রিয়তমায় উ-ন্মাদ। মা তা ল। এখন কেমন সাপের মতো পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। আলগা করে ধরলে বুঝি হারিয়ে যাবে।
অধর প্রসারিত হলো হৃদির। তার গলদেশে মাথা এলিয়ে ঘুমন্ত মানব। হৃদি মুখ নামিয়ে ওষ্ঠ চাপ বসালো স্বামীর চুলের ভাঁজে। লহমায় টনটনে ব্যথা অনুভূত হলো ওষ্ঠাধরে। গত রাতের যন্ত্রণা এখনো ছাপ ফেলে রেখেছে। আজ দিনভর খাওয়া-দাওয়ায় যন্ত্রণা হতে চলেছে! কেউ দেখলে কি ভাববে? হুঁ? আস্ত এক ভ্যাম্পায়ার! ফিক করে হেসে উঠলো হৃদি। ভ্যাম্পায়ার রূপী এমপি সাহেব। কেমন লাগবে দেখতে! হাসি চেপে স্বামীকে নড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো মেয়েটি। এমন বলিষ্ঠদেহী একজনকে সরানো ওর মতো শুঁটকি মাছের কর্ম নয়। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিহি স্বরে ডেকেও চলেছে। তাতে কি হয়েছে? সাপ এবার জোঁকের মতন আঁকড়ে ঘুমাতে লাগলো। ফোঁস করে শ্বাস ফেললো হৃদি। স্বেচ্ছায় কেউ সরতে না চাইলে তাকে সরানো মুশকিল। অসম্ভব। কিইবা করার? স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে রইলো হৃদি। সময় সচেতন মানুষটা ঠিক একটু পরেই উঠে পড়বে। দেশসেবা করতে হবে না! চকিতে চমকালো মেয়েটা! গলদেশে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর্দ্র পরশ। ঘুম থেকে উঠেই আবারো দুষ্টুমি আরম্ভ করেছে! মিথ্যে বিরক্তি প্রকাশ করলো হৃদি। তাতে কি হয়েছে?
” ছটফট করে না জান। দশটা মিনিট একটু আদর করতে দাও। ”
মা*দকতাপূর্ণ আবদারে ব`শীভূত হলো হৃদি! প্রিয়তমায় বিভোর মানুষটি ঠিক তাকে আগলে নিলো। অল্প সময়ের জন্য একে অপরেতে হারালো তারা। হাতে সময় কম। অন্যথায় এমপি সাহেব এত সহজে ছেড়ে দেয়ার লোক নয়।
.
সকালটি শুরু হয়েছিল স্বামী সান্নিধ্যে। এক মিষ্টি সূচনা। দিনটা কেমন ফুরফুরে মেজাজে কাটলো। বিকালে গেল নাদিরা’র বাড়িতে। বন্ধুরা মিলে গ্রুপ স্টাডি করতে। আফরিন আসলো বেশ দেরি করে। বেচারি মেয়েটিকে দেখলেই কেমন দুঃখ হয় হৃদির। দুই বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিল আফরিন। বছর গড়াতে না গড়াতেই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো। সে ঘরে এখন একটা বোন রয়েছে। সৎ বোন। আচরণ করেও সৎ বোনের মতো। সে যতই আপন ভাবুক না কেন সৎ মা ও বোন তাকে কখনো আপন ভাবতে পারেনি। কয়েক বছর আগে বাবা ইন্তেকাল করেছে। এরপর শুরু হলো আফরিনের আসল লড়াই। টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছে। নেহাৎ বাড়িটা বাবার নামে এবং ওয়ারিশ হিসেবে ওর নাম রয়েছে। নয়তো কবেই গৃহছাড়া হতে হতো! প্রতিনিয়ত ওকে কটূক্তি শুনতে হয় মা ও বোনের। তবুও নিজ সম্মান বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে মেয়েটা। আর মাত্র বছর দুই। কোনোমতে অনার্স শেষ করেই ওই ধ্বং-সপুরী ত্যাগ করবে। তেমনটাই পরিকল্পনা। ওরা বন্ধুরা আফরিনের সঙ্গেই আছে। সর্বদা বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে আগলে রাখে। বন্ধুত্বের ধর্ম ই তো এটি। একে অপরের তরে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো হৃদি। আফরিন এসে বসলো ওর পাশে। সকলে মিলে মনোনিবেশ করলো পড়ালেখায়। সাথে খুনসুটি তো রয়েছেই।
.
গ্রুপ স্টাডি শেষে আড্ডাবাজি হলো। বিকেল গড়িয়ে নামলো সন্ধ্যা। আঁধারে তলিয়ে ধরিত্রী। নাদিরা বন্ধুদের বিদায় জানালো। বাড়ির বাইরে এসে বিচ্ছিন্ন হলো ওদের পথ। হৃদি গিয়ে বসলো গাড়িতে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাথে রয়েছে তিনজন দেহরক্ষী। একজন চালকের পাশে বসে। বাকি দু’জন বাইকে করে সঙ্গ দিচ্ছে। এমপি পত্নী সে। এছাড়াও মুহিত কেসে এখন পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তা জোরদার করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি চলছে ঢাকার ব্যস্ত সড়ক ধরে। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই…
চলবে.
[ বর্ধিতাংশ আসবে কাল। বন্ধুগণ, কোনো দৃশ্য বুঝতে অসুবিধা হলে কমেন্ট করে জানাবেন কিন্তু। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। আসসালামু আলাইকুম। ]