#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৫ [ প্রথমাংশ ]
নিস্তব্ধ নয়ন জোড়া নিবদ্ধ অপারেশন থিয়েটারের লাল রঙা বাতির পানে। অতিবাহিত হয়েছে উদ্বেগ মাখা অনেকটা সময়। এখনো অন্দরে ‘সে’। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝি! কাটাছেঁড়া যে মেয়েটা সইতে পারে না। একফোঁটা রক্ত-ও তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। অথচ বিগত কয়েক মাসে কত কি সহ্য করতে হয়েছে ওকে। কোমল দেহটা আর কত সহ্য করবে! সহ্য সীমা অতিক্রম করলে যে বড় পীড়া হয়। এখনো অন্দরে ‘সে’। সি সেকশন চলছে। চলছে ওদের অনাগত সন্তানদের দুনিয়ায় আনার সর্বশেষ ধাপ। সার্জারির যন্ত্রণাদায়ক প্রহর কাটিয়ে সুস্থ সবল দেহে ফিরে আসুক সে।
‘ ইয়া আল্লাহ্! আমার স্ত্রীকে সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করার তাওফীক দান করো। ওকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল রেখো। আমিন। ‘
প্রচুর অস্থির লাগছিল। একটুও শান্তি মিলছিল না। বুকের ভেতরটা পু’ড়ে যাচ্ছিল। অ-গ্নিকান্ড হচ্ছিল বক্ষ বাগিচায়। চঞ্চল পায়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছিল ইরহাম। দৃষ্টি বারংবার চলে যাচ্ছিল অপারেশন থিয়েটারের দ্বারে। ধীরে ধীরে অসহনীয় দুশ্চিন্তা আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করে ফেললো। চকিতে স্মরণে এলো সমস্ত চিন্তার সমাধান। মহান রবে’র ইবাদত বন্দেগী। যেকোনো সমস্যায়, বিপদে একমাত্র রক্ষাকারী মহান আল্লাহ্। ওনার সীমাহীন ছায়াতলে মিটে যাবে সকল অশান্তি। দূরীকরণ হবে অস্বস্তি। শান্ত হবে এই অশান্ত তনুমন। আর বিলম্ব করলো না ইরহাম। দুশ্চিন্তায় বিধ্ব-স্ত মানুষটি মন্থর গতিতে পা বাড়ালো। গন্তব্য হাসপাতালের প্রার্থনা ঘর। স্ত্রী-সন্তানদের সুস্থতা কামনা করে নফল ইবাদত বন্দেগিতে হবে মশগুল। ওর গমন পথে তাকিয়ে উপস্থিত আপনজন।
__
হৃদির গর্ভকালীন সময়ের ত্রিশ সপ্তাহ চলছিল। মায়ের ইন্তেকালের পর থেকেই অতিবাহিত হচ্ছিল ওর বিভীষিকাময় জীবন। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচুর বিধ্ব-স্ত ছিল মেয়েটি। ওজন বেশ হ্রাস পেয়েছিল। বৃদ্ধি পেয়েছিল বমির প্রকোপ। এছাড়াও ছিল মানসিক অস্থিরতা ও পা:গলামি। পরিবারের সদস্যরা অতি যতনে ওকে আগলে রাখছিল। দুই সপ্তাহ বাদে আট মাসে পড়বে। শেষের এই সময়কাল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অসুস্থ মেয়েটির জন্য চিন্তার কারণ। ইরহাম ও বাড়ির লোকেরা ওকে যথাসাধ্য দেখে রাখছিল। তবে মহান স্রষ্টার ছিল ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা। ফলস্বরূপ সাড়ে সাত মাসেই অকাল প্রসবের উপসর্গ দেখা দিলো।
বিকেল হতেই শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছিল। হাঁসফাঁস করছিল হৃদি। নিজ শরীরে পরিবর্তন অনুভব করতে পারছিল। অজানা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল তনুমন। ওর গর্ভস্থ বাচ্চারা ঠিক আছে তো? মা হয়ে সে নিজ সন্তানদের কোনো ক্ষতি ডেকে আনেনি তো! ভয় পেয়ে গেল হৃদি। কপালে, গালে, গলদেশে জমায়েত হলো স্বেদবিন্দু। কালক্ষেপণ না করে মামীকে বিষয়টি জানালো সে। পল্লবী নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওকে আশ্বস্ত করতে কোমল স্বরে বললেন,
” চিন্তা করো না মা। তুমি একটু এদিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকো। কখনো কখনো ফলস্ পেইন হয়। একটু রেস্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের শিওর হওয়া দরকার। ”
মামীর কথামতো কাত হয়ে শুলো হৃদি। তবে কোনো উত্তম পরিবর্তন হলো না। বরং শারীরিক অবস্থা আরো শোচনীয় হতে লাগলো। এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে শুয়ে। তবুও অকাল প্রসবের উপসর্গ দূরীভূত হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো প্রকট আকার ধারণ করছিল। হৃদির অবস্থা বেশ নাজুক। এতেই ঘাবড়ে গেলেন পল্লবী। রাজেদা খানমের সঙ্গে আলাপ করে নিশ্চিত হলেন এটি ফলস্ পেইন নয়। আসলেই হৃদির প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়েছে।
গোধূলি লগ্ন তখন। কড়া নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষীরা। সম্মুখে, পিছে তাদের তিনটে গাড়ি। মধ্যখানে হৃদি’কে বহনকারী গাড়ি। প্রসব বেদনায় কাতর হৃদি ছটফট করে যাচ্ছিল মামীর কাঁধে মাথা এলিয়ে। পল্লবী অবিরাম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শাড়ির আঁচলে মুছে দিচ্ছেন ঘামে সিক্ত মুখখানি। ইনায়া ওপাশে বসে। ভাবীর হাত ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। দোয়া দরুদ পাঠ করে ফুঁ দিচ্ছে অবিরাম। বেদনায় কঁকিয়ে উঠছে মেয়েটা। দু হাত চেপে বসেছে উদরে। মুখনিঃসৃত হচ্ছে যন্ত্রণা মিশ্রিত ধ্বনি। সামনের সিটে বসে রাহিদ। অনবরত নির্দেশনা দিচ্ছে সাবধানে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হবার জন্য। সে মতোই ধেয়ে যাচ্ছে গাড়িটি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঙ্গ দিচ্ছে দেহরক্ষীরা। তন্মধ্যে বেজে উঠলো রিংটোন। হাতেই ছিল যান্ত্রিক ডিভাইসটি। ত্বরিত কল রিসিভ করলো রাহিদ। কানে ঠেকলো মোবাইল। ওপাশ হতে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে চৌধুরী। সে-ও বেরিয়েছে নিজ কর্মস্থল হতে। সরাসরি আসছে হসপিটাল।
বেদনা ক্লি’ষ্ট অন্তঃস্থল। একান্ত পুরুষের সান্নিধ্য লাভের অভিলাষ জেগেছে অন্তরে। দু চোখে বারিধারা। মুখনিঃসৃত যন্ত্রণার বুলি। খুঁজে বেড়াচ্ছে ‘তাকে’। তাকে একপলক দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চক্ষু জোড়া। মন কাননে ভেসে উঠছে তার নাম… ‘ইরহাম।’ অসহনীয় ব্যথায় চিড়চিড় করছে দেহের নিম্ন ভাগ। বুঁজে গিয়েছে অক্ষিপুট। এই বুঝি ঘনিয়ে এলো মৃ-ত্যু প্রহর। চিরতরে বন্ধ হবে আঁখিপল্লব। চেতনা অচেতনের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল হৃদি। ভয় হচ্ছিল। স্মরণ করে যাচ্ছিল রব’কে।
” আল্লাহ্! রক্ষা করো। ”
সহসা এক পশলা প্রশান্তি আগলে নিলো তাকে। অদৃশ্য ভরসাস্থলে হারালো মন। যাতনায় বিকৃত অধরকোণ ঈষৎ প্রসারিত হলো। কর্ণে ঠেকে যান্ত্রিক ডিভাইসটি। ধরে পল্লবী। ওপাশ হতে শ্রবণপথে পৌঁছাচ্ছে সে-ই প্রিয় কণ্ঠস্বর,
” জানি তুমি পারবে আমরা হৃদহরণী। আল্লাহ্ ভরসা। ”
বেদনাবিধুর মুখখানিতে উজ্জ্বলতা দেখা দিলো। থমকে গেল ক্রন্দন। অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো সে,
” ই-রহাম! ”
.
” কনগ্রাচুলেশন মিস্টার চৌধুরী। ইয়্যু আর ব্লেসড্ উইথ টুইনস্। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। ”
চিকিৎসকের মুখনিঃসৃত সুসংবাদ তড়িৎ বেগে পৌঁছালো কর্ণ গহ্বরে। অফুরন্ত খুশির উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখজুড়ে। সারা জাহানের মালিকের প্রতি শুকরিয়া আদায় করলো ইরহাম। অনুভব করলো দু ফোঁটা নোনাজল অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়তে উদগ্রীব। ছটফট করে চলেছে অক্ষিকোণে। বাবা হয়েছে সে। প্রথমবারের মতো পিতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছে। সে আর হৃদরাণী একা নয়। এসেছে তাদের ভালোবাসার দু’টো অংশ। তাদের সন্তান। অবর্ণনীয় খুশিটুকু কোন পন্থায় প্রকাশ করবে জানা নেই এই সৌম্যরূপী মানুষটির। পাশেই অশ্রুসজল উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা। খুশির ফোয়ারা সিক্ত করে দিচ্ছে তাদের। কিয়ৎক্ষণ সময় নিলো। অন্তরে বহমান চঞ্চলতা সামাল দিয়ে শুকনো ঢোক গিললো ইরহাম। চিকিৎসককে শুধালো,
” আমার স্ত্রী? সে ভালো আছে তো? ”
পরিবর্তিত হলো মুখভঙ্গি। চিকিৎসক বলতে লাগলেন,
” দেখুন মিস্টার চৌধুরী। আপনার ওয়াইফ প্রি ম্যাচিউর দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর ওপর সি সেকশন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই উনি খুব উইক। মিসেস চৌধুরীকে আপাতত অবজারভেশনে রাখা রয়েছে। জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবেন। ”
ফারহানার চোখে জল। নির্দ্বিধায় গড়িয়ে পড়ছে দু গাল বেয়ে। বাকিরাও হতাশ। মনে জমলো কালো মেঘের আস্তরন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাহিদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
” ডক্টর আমরা কি বেবিদের দেখতে পারি? ওদের কখন কোলে নেবো? ”
চিকিৎসক বুঝিয়ে বললেন,
” ওরা দু’জন প্রিটার্ম বেবি। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই জন্মগ্রহণ করেছে। ওদের শারীরিক অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয়। নাজুক। নিবিড় পরিচর্যার জন্য বেবি দু’টোকে এনআইসিইউ’তে রাখা হয়েছে। এখুনি কোলে নেয়া, আদর করা এগুলো সম্ভব নয়। ওদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ওরা এনআইসিইউ’তে থাকবে। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় মায়ের কাছে যাবে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন? বেবি দু’টো খুবই উইক। ওদের ওয়েট, নিউট্রিশন রেট সব লো। কিছু ফিজিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। আশা করছি সময়ের সাথে সাথে ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
অপ্রত্যাশিত ভাবে আগমন এ সুখবরের। তবে একাকী আসেনি সে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নতুন দুঃসংবাদ। ভালো নেই ওদের সন্তান। কষ্টে রয়েছে তারা। জন্মের পর পিতা-মাতার কোল নয়। ওদের ঠাঁই হয়েছে এনআইসিইউ। ইরহামের অন্তরে ধ্বনিত হলো,
‘ ইয়া আল্লাহ্! আমাকে আরো ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করো। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে সুস্থ রেখো। ভালো রেখো। রক্ষা করো ওদের। আমিন। ‘
•
রাজধানী ঢাকার একাংশে তখন জন্মগ্রহণ করেছে দু’টো নতুন প্রাণ। সুখ ও দুঃখের মিশ্রণে তাদের আগমন। অন্যদিকে রাতের গভীরতায় রাজধানীর আরেক অংশে চলছে ভিন্নতর দৃশ্য।
ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছে তখন রাত দু’টোর ঘর পাড় হয়েছে। নিজ কক্ষে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আজগর সাহেব। ঘুমের ঘোরে স্বাস্থ্যবান দেহটি হালকাপাতলা নড়েচড়ে উঠছে। পা দু’টো দৃঢ় রূপে চেপে বসছে বিছানায়। দু হাত আঁকড়ে ধরতে চাইছে কোনো অদৃশ্য সম্বল। বন্ধ চোখের পাতায় ছটফট করছে কৃষ্ণবর্ণ নয়নমণি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শুয়েও ঘামে ভিজে যাচ্ছে দেহ। অনবরত দু পা ও হাত ঘর্ষণ করে চলেছে বিছানা চাদরের আবরণে। হঠাৎই এক তীব্র ঝাঁকুনি। চকিতে নিদ্রা হতে ছিটকে বেরিয়ে এলো লোকটি। উঠে বসলো বিছানায়। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার। ঘামে ভেজা মুখ হা হয়ে খোলা। সেথা হতে হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাসের অস্বাভাবিক চলাচল। আজগর সাহেবের ভীত নয়ন জোড়া স্থির। এদিক ওদিক নাড়াতে ব্যর্থ। অব্যক্ত ভয় জেঁকে বসেছে অন্তরে। রয়েছে। কেউ রয়েছে পাশেই। ডানে নাকি বামে? কোন পাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! অনবরত শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে লোকটা। পানির পিপাসায় গণ্ডস্থল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে হাতের আঙ্গুল। তবে অসাড়ের ন্যায় অনুভূতি জাপটে ধরে। নড়াতে ব্যর্থ হাত-পা। আঙ্গুল। সহসা এক দমকা হাওয়া আঘাত করে গেল কানে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডানে ঘুরে গেল মুখ। এক লহমায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো মুখশ্রীতে। ওই। ওই তো দাঁড়িয়ে সে। বিশালাকৃতির এক অবয়ব। হিং স্র চাহনিতে তাকিয়ে তার পানে। দু চোখ দিয়েই চেপে ধরছে। ধাওয়া করছে হিমশীতল হাওয়া। দুর্বল করে তুলছে সকল ইন্দ্রিয়।
ইন্দ্রিয় দুর্বলতার চাপে পিষ্ট আজগর সাহেব। ঘামে ভেজা মুখখানা ভয়ে র’ক্তিম রূপ ধারণ করেছে। মুখ হা করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন উনি। দু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাড়াতে চাইছেন ওই হিং স্র অবয়বকে। তবে সে অবয়ব নড়লো না একচুল। বরং শ্লথ পায়ে এগিয়ে আসছে ওনার পানে। সে কি বীভৎস-বিকট আকৃতি! একঝলকের দর্শনে হৃৎপিণ্ড ছিটকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে-আতঙ্কে আজগর সাহেব চিৎকার করে চলেছেন। হাত-পা ছুঁড়ে ওটাকে দূর হতে বলছেন। যন্ত্রণায়-পীড়নে ছটফট করছেন। নীলাভ হয়ে আসছে মুখ। বয়স্ক লোকটার তীব্র আর্তনাদ ঘরের মধ্যেই বদ্ধ রইলো। শব্দনিরোধক ঘর হতে বেরোতে পারলো না সেই আতঙ্কিত আর্তনাদ। যন্ত্রণায় মাথার চুল খামচে ধরছেন উনি। চিৎকার করে ভয় হতে মুক্তি চাইছেন। ওই হিং-স্রতা হতে পরিত্রাণ চাইছেন। তবে মিললো না কিছুই। শুধুই ভীতি আর ভীতি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও ঘামে জবজবে শরীর। আকুতিমিনতি করে যাচ্ছেন আজগর সাহেব। তেমনই যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্তে এই বদ্ধ ঘরের বাহির হতে সরে গেল এক মানবছায়া।
•
আঁধারিয়া রজনী। ছিমছাম গোছানো কেবিনটি। বিছানায় শায়িত হৃদি। ওর বাঁ পাশেই টুলে বসে একান্ত পুরুষ। শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাত। মানুষটি স্থির চাহনিতে তাকিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীর পানে। তার সন্তানদের মায়ের পানে। ‘মা’! কতটা অর্থপূর্ণ-মমতাময়ী শব্দ। সারা দুনিয়ায় সকল জীবের সর্বপ্রথম ভরসার স্থল, ভালোবাসার উৎস এই ‘মা’। মা ছাড়া অন্ধকার জগৎ সংসার। যেমন অন্ধকার হয়েছে তাদের সংসার। মা বিহীন তমসাচ্ছন্ন তাদের হাসিখুশি সোনার সংসার। ইরহামের হৃদি আজ মা হয়েছে। প্রথমবারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করেছে। এ দিনটি নিয়ে মা কতটা আগ্রহী ছিল। উৎসুক ছিল। মা-বাবা দু’জনেই এই দিনটি নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। অবর্ণনীয় এক্সাইটেড ছিল তারা। অথচ আজ? মা নেই। দেখে যেতে পারলো না নাতি নাতনিদের। যাদের রক্ষা করতে প্রাণত্যাগ করলো তারা আজ সুষ্ঠুভাবে এসেছে দুনিয়ায়। কিন্তু অসুস্থ। নিবিড় পরিচর্যা চলছে ওই প্লাস্টিকের ঘেরাটোপে। এখনো বাবার কোলে আসার সুযোগ মেলেনি। মায়ের সান্নিধ্য মেলেনি। কেমন নির্দয় রূপে তাদের আগমন! ইরহাম বেদনাময় হাসলো। উঠে দাঁড়ালো আস্তে করে। তবে হাতটি ছাড়লো না। এখনো পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী কোমল হাত। ইরহাম আস্তে ধীরে ঝুঁকে গেল তার জীবনসঙ্গীর পানে। ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গীর ললাটে প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,
” জাঝাকিল্লাহু খায়রান বাবুর আম্মু। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। তোমার অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা। ”
•
স্বাভাবিক সময়ের বেশ পূর্বে জন্মগ্রহণ করা শিশু, যাদের শারীরিক ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে, তাদের পরিচর্যা করার জন্য এই এনআইসিইউ। বিশেষ এ কক্ষে ঘুমন্ত বেশ কিছু শিশু। ইনকিউবেটরে ঘুমন্ত তারা। ইনকিউবেটর হলো পরিষ্কার, শক্ত প্লাস্টিকের দ্বারা ঘেরা ছোট বিছানা। এ ইনকিউবেটরের দেহে কয়েকটি মাঝারি আকারের গর্ত। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য পরিচর্যাকারীরা ইনকিউবেটরের দেহে অবস্থিত এই গর্তের মাধ্যমে শিশুদের যত্ন নেন। ক্ষুদ্রাকৃতির বেশকিছু ইনকিউবেটরে ঘুমিয়ে নবজাতক শিশুরা। ছোট্ট ছোট্ট শরীরে চিকিৎসা সহায়ক যন্ত্র চেপে বসে। নবজাতক, নিষ্পাপ শিশুদের এমন যান্ত্রিক সান্নিধ্যে দেখে হুঁ হুঁ করে উঠলো অন্তর। কোমল মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠলো নিজ আত্মজ-আত্মজাকে দেখে। ওই তো কয়েক হাত দূরত্বে পাশাপাশি দু’টো ইনকিউবেটরে শায়িত ওরা। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র লেপ্টে ছোট্ট দেহে। ঘুমোচ্ছে ওরা। একটুখানি স্বস্তির ঘুম। দুনিয়ায় আসার পূর্বে কম তো সংগ্রাম করেনি। কত কি সয়েছে ওরা। অবশেষে আল্লাহ্’র রহমতে দেখেছে দুনিয়ার আলো। নিজ সন্তানের এই দুরবস্থা কোনো মা ই সহ্য করতে পারে না। হৃদিও পারছিল না। হাসপাতালের পোশাক পরিহিতা মেয়েটি স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো। দু হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীর প্রশস্ত পিঠ। সযতনে ওকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। স্ত্রীর চুলের ভাঁজে ক্ষুদ্র পরশ বুলিয়ে দিলো। তাকালো নিদ্রায় মগ্ন সন্তানদের পানে। চোখে জমলো বাষ্প। জ্ব’লন হচ্ছে অন্তরে। কোনো বাবা-মা’কে তাদের নবজাতক সন্তানকে এই করুণ অবস্থায় দেখতে না হোক। সুস্থ সবল রূপে দুনিয়ায় আসুক সকল সন্তান।
•
অতিবাহিত হয়েছে বেশ কিছু দিন। নাতিশীতোষ্ণ এক সকাল। বিশালাকৃতির আকর্ষণীয় টেবিলে সাজানো হরেক রকমের খাবার। টেবিলের সম্মুখ ভাগে একটি বড় চেয়ার। সেথায় রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আজগর সাহেব। শুকনো মুখশ্রী। চোখের নিচে কালচে ভাব। গত রজনীও কেটেছে নিদ্রাহীন। ক্লান্ত লাগছে শরীর। ঘুম চেপে বসেছে দু চোখে। তবুও কোনোমতে প্রাতরাশ নিচ্ছে সেরে। খাবারে অরুচি ঠেকছে। হচ্ছে বমি বমি ভাব। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিলেন। পানি পান করতে মুখে ঠেকালেন গ্লাস তখনই বেজে উঠলো কলিংবেল। ব্যাঘাত ঘটলো পানি পানে। বিরক্তিতে বিকৃত হলো মুখভঙ্গি। বাম পাশে দাঁড়ানো এক গৃহ পরিচারককে ইশারায় দ্বার উন্মুক্ত করতে বললেন। ইতিবাচক মাথা নেড়ে দরজার পানে অগ্রসর হলো সে গৃহ পরিচারক। নিঃশব্দে উন্মুক্ত হলো সদর দরজা। চমকালো আগন্তুকদের দেখে!
” কে আপনারা? ”
” দুদক! ”
বজ্রপাত হলো আভিজাত্যে ভরপুর সে গৃহে। দুদক এসেছে বাড়ি!
চলবে.
[ কেমন লাগলো চমকপ্রদ পর্বটি? হৃ’হাম এখন সদ্য প্যারেন্টস্। মিষ্টি নিয়ে চলে আসবেন কিন্তু বেবিদের দেখতে। অসুস্থতার জন্য একটু অনিয়মিত পর্ব আসছে। আশা করি পূর্বের ন্যায় নিয়মিত পর্ব পাবেন এখন থেকে। ধন্যবাদ সবাইকে। আসসালামু আলাইকুম। ]