#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৮ [ কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর কাছাকাছি। রাতভর নে”শা করে গভীর নিদ্রায় শায়িত নরেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী নরেনের কাছে বেলা হয় দুপুর একটা, দুইটা নাগাদ। নিশাচর প্রাণীর ন্যায় রাত জেগে দিনের বেলা ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। নিজের ঘরে এ মুহূর্তে সে ব্যতীত আর কেউ নেই। ঘরের দরজা বন্ধ কিন্তু অর্ধ উন্মুক্ত জানালা। সূর্যের কিরণ অবলীলায় প্রবেশ করছে ঘরে। হঠাৎই ঘুমে ব্যাঘাত। দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ। এত জোরে শব্দ হচ্ছে যে পুরো ঘর কেঁপে উঠছে। ঘুমন্ত স্নায়ু লম্ফ দিয়ে জাগ্রত হলো। ত্বরিত ঘুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো নরেন। আকস্মিক কাণ্ডে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছে সারা শরীর। ঝাপসা চোখে সব হযবরল দেখছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। বি”ষযন্ত্রনা হচ্ছে বুঝি! কিয়ৎক্ষণ বাদে একটুখানি ধাতস্থ হয়ে বি শ্রী গালমন্দ করলো সে। রাতের নে শা এখনো কাটেনি। বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। টালমাটাল পদযুগল। হেলেদুলে দরজার কাছে গেল নরেন। নাহলে দরজায় অত্যাধিক আঘাতে তার দুই রুমের বাসা উড়ে যাবে বুঝি। নে শায় আচ্ছন্ন নরেন দরজা খুলতে না খুলতেই বুক বরাবর জোরসে এক লা থ। ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাওয়া কাগজের ন্যায় কয়েক কদম দূরে ছিটকে পড়লো নরেন। মেঝেতে পড়ে শরীরে আঘাত পেল। ক্রো-ধান্বিত চাহনিতে তাকালো দরজা বরাবর। কার এতবড় বুকের পাটা তাকে লা থ মা-রে! হতবিহ্বল হলো দোরগোড়ায় দণ্ডায়মান, পুলিশের পোশাক পড়ুয়া এসপি তাঈফকে দেখে!
” পু লি শ! ”
হ্যাঁ। এসপি তাঈফ ই তাকে লা থ মে-রেছে। নরেন অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে! পুলিশ! পুলিশ কি করছে এখানে! এখানকার ঠিকানাই বা পেল কোথায়? কোন অপরাধের দায়ে আজ তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পুলিশ। জানা নেই। ঝাপসা চোখ দু’টো হালকা জ্ব’লছে। ঘেমে যাচ্ছে নে-শায় টালমাটাল শরীর। সহসা মন্থর পায়ে দরজার বাঁ পাশে সরে দাঁড়ালো তাঈফ। তার জায়গা দখল করে হাজির হলো চৌধুরী। ইরহাম চৌধুরী। শুভ্র পোশাক পরিহিত মানুষটির অন্তরে আজ নেই শান্তিপূর্ণ ভাব। নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে অপরিমেয় আ-ক্রমণাত্মক কাঠিন্যতা। মুষ্টিবদ্ধ পেশিবহুল দু হাত। সবুজাভ রগ দৃশ্যমান চামড়ার আবরণে। এই বুঝি চামড়া চিঁ’ড়ে বেরিয়ে আসবে। সুঠামদেহী লম্বা চওড়া মানুষটির অপ্রত্যাশিত অবয়বে হকচকিয়ে গেল নরেন! সে চিনেছে ইরহামকে। মানুষটির অনাকাঙ্ক্ষিত নয়া অবতারে কম্পিত অভ্যন্তর। চৌধুরীর এ কি নয়া রূপ! লহমায় ধ্বং স করে দেবে সব। ছাড়বে না কাউকে। হলোও তাই। মাত্র কয়েক মিনিট। নে-শাগ্ৰস্থ নরেনকে সামান্য কৌশল অবলম্বন করে বাজেভাবে কুপোকাত করে ফেললো ইরহাম।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’জনে। ইরহামের শক্তপোক্ত লৌহসম হাত চেপে বসেছে নরেনের ঘাড়ে। একদম সন্নিকটে দু’টো মুখ। বিপরীতে দণ্ডায়মান মানুষটির চক্ষুদ্বয় হতে নিঃসৃত বহ্নি শিখায় জ্ব’লেপুড়ে ছারখার নরেন। টলে উঠছে দেহ। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মৃ ত্যু। আজ বুঝি নেই নিস্তার। দ্বিতীয়বারের মতো শুধালো ইরহাম। অত্যন্ত শীতলতম স্বর। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সকল লোমকূপ।
” কোথায় পাঠিয়েছিস ওকে? ”
” জা-নি-না। ”
এলোমেলো স্বরে বললো নরেন। ঘাড়ের ওপর আরো চেপে বসলো শক্তপোক্ত হাত। হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবে কি? ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো নরেন। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় একই প্রশ্ন করলো ইরহাম। নরেন ভয়ে কিংবা আত্মগ্লানিতে কিছু বলতে যাচ্ছিল। অকস্মাৎ ভণ্ডুল হলো সব। ধীরলয়ে দুই বার ঈষৎ কেঁপে উঠলো শরীর। উল্টে যাবার উপক্রম চক্ষুদ্বয়। ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারালো শরীর। মাথা লুটিয়ে পড়লো ইরহামের ডান কাঁধ বরাবর।
” হেই! ”
শঙ্কিত ইরহাম নরেনের গালে চাপড় মে রে ডাকতে লাগলো। কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ এ কি হয়ে গেল? ত্বরিত অর্ধ উন্মুক্ত জানালায় তাকিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটলো তাঈফ এবং দু’জন পুলিশ অফিসার। যখন সবটা বোধগম্য হলো তখন ইতিমধ্যে সব হাতের নাগালের বাইরে। নরেনের পিঠ চুঁয়ে র’ক্তিম তরল গড়িয়ে পড়ছে। দু দু’টো বু:লেট বি দ্ধ হয়েছে পিঠে। জানালা হতে কেউ গু লি করেছে। সাইলেন্সার যুক্ত
পি স্ত ল। তাই ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্বে, ইরহাম নামক মানুষটির কানের কাছে নরেন বেদনাময় ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু বললো,
” প-দ! ”
এই শেষ। আর বলা হলো না। পরলোকগমন করলো নরেন। চোখের সামনে একজনের মৃ ত্যু। মৃ ত্যুর পূর্বে বলা অদ্ভুত ফিসফিসিয়ে বার্তা। এ কোন সর্বনা’শা তুফানের ইঙ্গিত! শত্রুপক্ষ জানতো তাদের আজকের এই আগমন। তাই তো হৃদি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলার পূর্বেই নরেন’কে প্রাণে মে রে দিলো। এটা নিশ্চিত যে হৃদির অ-পহরণের পেছনে বাগেরহাটের হিন্দু ধর্মাবলম্বী নরেন দায়ী। সে-ই করেছিল হৃদি’কে
কি ড ন্যা প। একবিন্দু আশার আলো দেখা দিয়েও হারিয়ে গেল। হতাশা ঘিরে ফেললো আষ্টেপৃষ্ঠে। আস্তে ধীরে নরেনের নিথর দেহ মেঝেতে শুয়ে দিলো ইরহাম। তার পরিহিত শুভ্র পাঞ্জাবিতে এক অপরাধীর র ক্ত লেপ্টে। চোখের সামনে দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন ঘটে গেল। কিচ্ছুটি করতে পারলো না সে। ব্যর্থ চৌধুরী। নিজের স্ত্রীকে সুরক্ষা করতে ব্যর্থ। ব্যর্থ কারোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। অসীম ব্যর্থতায় নিষ্পিষ্ট ইরহাম দু হাতে মসৃণ চুল খামচে ধরলো। ধপ করে বসে পড়লো একটি কাঠের চেয়ারে। চশমার অন্তরাল হতে দুঃখময় চোখে তাকিয়ে রইলো নিথর দেহে।
” প। দ। মৃ ত্যুর আগে কি বলতে চাইছিল নরেন? ইয়া আল্লাহ্! রহম করো। ”
_
তাঈফ তৎক্ষণাৎ বাড়ির বাইরে ছুটে গিয়েও ব্যর্থ হলো। কালো পোশাকধারী অজ্ঞাত দু-র্বৃত্ত ততক্ষণে সঙ্গীর বাইকে চড়ে ছুটেছে অজানার পথে। বাইকের নম্বর প্লেটে আঁকিবুঁকি করা। বোঝাই যাচ্ছে নকল নাম্বার। রাগে মাটিতে পা ঠুকলো তাঈফ।
” শিট! শিট! ”
•
” নেতাজী! কাম হইয়া গেছে। ”
ওপাশ থেকে মিললো কাঙ্ক্ষিত খুশির সংবাদ। প্রসন্ন হলেন আজগর সাহেব। অধরে ফুটে উঠলো শয়তানি হাসি। সাবাশি জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। স্টাডি টেবিলের ওপর যান্ত্রিক ডিভাইসটি রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন টেবিলে রাখা ল্যাপটপে। উজ্জ্বল বদনে ল্যাপটপের পর্দায় উপস্থিত মানুষটিকে বললেন,
” গেম ওভার। নরেন ইজ নো মোর। ”
আজগর সাহেব ওপাশ হতে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া পেলেন না। এহেন কাণ্ডে ঈষৎ চমকালেন। ‘সে’ অমন নিশ্চুপ কেন? খুশি নয় এ সংবাদে? কি চলছে তার মনে? সে কি খুব বেশিই ক্রু-দ্ধ! নাকি অতি খুশিতে বাকশূন্য! দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট। ‘সে’ অতি খুশিতে আত্মহারা হবার মতো জীব নয়। সে তো…! ওনার অন্তরে লুকায়িত ভাবনাকে সঠিক প্রমাণ করে আকস্মিক রুদ্রনীল নিজ ল্যাপটপ বরাবর ঝুঁকে এলো। অতি সন্নিকটে এখন মুখাবয়ব। ভয় হানা দিলো বয়স্ক মানুষটির অন্তরে। যেন যান্ত্রিক পর্দা ভেদ করে যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে দা-নবটি। ওপাশ হতে শোনা গেল হিসহিস ধ্বনি মিশ্রিত কণ্ঠস্বর,
” প্রথমবার ভুল করেছো মাফ করে দিলাম। দ্বিতীয়বার এই একই ভুল তোমার ম-রণের কারণ হতে পারে। রিমেম্বার ইট। ”
বিষাদময় আভা ছড়িয়ে পড়লো আজগর সাহেবের মুখে। আনম্র লহু স্বরে বলে উঠলেন,
” তোমার বাবা হই রুদ্র। ”
তাচ্ছিল্য করে হাসলো রুদ্রনীল। অতঃপর গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে আদেশ সূচক ভঙ্গিমায় বললো,
” বাপ মাই ফুট। লিসেন কাল সন্ধ্যা নাগাদ চল্লিশটা মেয়েকে বাই সি(sea) শ্রীলঙ্কা পাঠাবে। সেখান থেকে ইউরোপীয়ান কান্ট্রি। কোনো মিস্টেক যেন না হয়। এলস্.. ”
অপূর্ণ বাক্যটি বুঝে গেলেন আজগর সাহেব। চল্লিশটা মেয়ে পা-চার হতে চলেছে। দুই কোটি টাকার ডিল। সবচেয়ে দামী মা’ল তো ওই ইরহাম পত্নী। ওকে বিক্রি করেই মিলবে বাংলাদেশী অর্থমূল্যে দশ লাখ টাকার বেশি। অর্থের লো ভে চকচক করে উঠলো দু চোখ। উজ্জ্বল হলো মুখ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের বিষাদ এখন হাওয়ায় মিশে। আজগর সাহেব দ্রুততার সহিত বললেন,
” না না বুঝেছি। সব প্লান মাফিক হবে। তুমি চিন্তা করো না। ওই চৌধুরী যতই ডানা ঝাপটাঝাপটি করুক না কেন কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর বউ অধরাই রয়ে যাবে। নাকের ডগা দিয়ে ফুরুৎ। ”
বাপ বেটা একত্রে জ”ঘন্যতম হাসিতে সংক্রমিত হলো। অতঃপর অপরাধ জগতের আরো কিছু বিষয়াদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণ হলো। আধ ঘন্টা বাদে বিচ্ছিন্ন হলো ভার্চুয়াল সংযোগ। উচ্ছ্বসিত বদনে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন আজগর সাহেব। বিড়বিড় করে আওড়ালেন,
” চৌধুরী তুই তো শেষ। আমার এত ক্ষতি করে ভালো থাকবি তা কি করে হয়? সব শেষ। সব। ধুকে ধুকে ম-রবি তুই। এ আমার প্রতিশ্রুতি। ”
চক্ষু বন্ধ করলেন আজগর সাহেব। বড় শ্বাস ফেলে মশগুল হলেন ভাবনায়। চুনোপুঁটি চৌধুরীর জন্য ওনার এখন অবধি কম ক্ষতি হয়নি। একের পর এক কুকর্মে ব্যঘাত। দেশসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া ইরহাম চৌধুরী। পুরোদমে মা:দক বিরোধী অভিযান শুরু করেছে গত বছর হতে। এতেই আজগর সাহেবের চরম ক্ষতি আরম্ভ। ওনাদের কুকর্মের অন্যতম মূল অংশ মা:দকদ্রব্য। বিভিন্ন পন্থায় দেশে বিদেশে মা:দক সরবরাহ করেন। তন্মধ্যে সবচেয়ে কার্যকারী উপায় হলো সমুদ্র পথে এবং ট্রেনে করে। বেশ কয়েকমাস পূর্বের কথা…
আঁধারিয়া রজনী। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। আঁধার চিড়ে সরু রেলপথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটি দীর্ঘকায় ট্রেন। ট্রেনে স্বল্প কিছু যাত্রী এবং অসংখ্য মালামাল। একটি বগিতে চারজন বসে। পরিবারের সদস্য তারা। স্বামী স্ত্রী এবং বৃদ্ধ পিতা সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা। বৃদ্ধ মানুষটি বগির একটি সিটে শয্যাশায়ী। বয়সের ভারে নুয়ে দেহ। ওনার বিপরীত দিকে স্বামী স্ত্রী বসে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা পাশের সারির সিটে বসে পত্রিকা পড়ছে। অন্ধকারের মাঝে চলমান তাদের বহনকারী ট্রেন। এরা কারা? সাধারণ আমজনতা? ট্রেনের যাত্রী? উঁহু। সম্পূর্ণ ভুল। সাধারণ জনগণের বেশে এরা একেকজন অপরাধী। মা:দক পা-চারকারী। এরা দুর্দান্ত চতুরতার সহিত ট্রেন মাধ্যমে দেশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে মা-দক সরবরাহ করে থাকে। একটা দু’টো করে কয়েকটি স্টেশন অতিক্রম হলো। চতুর্থ স্টেশনে এসে থামলো ট্রেনটি। বেশকিছু সাধারণ যাত্রী নেমে গেল। আর মাত্র দু’টো স্টেশন বাকি। সারা ট্রেনে মাত্র নয় দশজন যাত্রী অবশিষ্ট। ভিন্ন ভিন্ন বগিতে বসে তারা। কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। কেউ মোবাইলে মগ্ন। কেউবা আলাপচারিতায় লিপ্ত। সবই তাদের অভিনয়। কুটিলতা। অবশিষ্ট এ কয়েকজন যাত্রীর ছদ্মবেশে অপরাধী। ট্রেন দাঁড়িয়ে স্টেশনে। যেকোনো মুহূর্তে চলতে আরম্ভ করবে। যে মূহুর্তে ট্রেন চলতে আরম্ভ করবে ঠিক তখনই ভেতরে প্রবেশ করলো কয়েকজন। নৈশকালীন সময়ে তাদের আকস্মিক উপস্থিতি বড় ভূতুড়ে লাগলো। কেমন গা ছমছম পরিবেশ। বগিতে থাকা কয়েকজন ছদ্মবেশী অপরাধী নতুন লোকের আগমনে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগলো। চিনতেও পারলো না এই নতুন আগন্তুকের দল, পেশাগত জীবনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। তন্মধ্যে চলতে আরম্ভ করেছে ট্রেনটি। নতুন উদিত আটজন কোনো নির্দিষ্ট সিটে বসলো না। বরং এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। হাঁটতে লাগলো এদিক ওদিক। তীক্ষ্ণ তাদের চাহনি। যে চাহনিতে ভীতসন্ত্রস্ত হলো পূর্ব হতে উপস্থিত যাত্রীবৃন্দ অর্থাৎ অপরাধীরা। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত।
অতঃপর একসময় কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়ে আরম্ভ হলো দু পক্ষের লড়াই। মা:দকবিরোধী অভিযান। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল অপরাধীরা। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বরূপে ফিরে এলো। করতে লাগলো পাল্টা আঘাত। ঘুটঘুটে আঁধারে চলমান র ক্তক্ষয়ী খেলা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ক্ষুদ্র বগির ভেতরে গোঙানির শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। র ক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ট্রেনের আসন। দু পক্ষের পরপর কয়েকটি দেহ নিথর রূপে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। চলমান রইলো সে শত্রু শত্রু খেলা। আঁধারিয়া রজনীতে বিপদ ঘনিয়ে এলো! আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বনাম পা:চারকারী। লড়াই চলমান। ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত সরু লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে ট্রেনটি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ছোটোখাটো এক মৃ*ত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে যেন। দুই পক্ষের বেশকিছু সদস্য আহত, নিহত হলো। অবশেষে এলো আকাঙ্ক্ষিত সফলতা। ট্রেনের সিটের নিম্ন ভাগ, বার্থ, ওয়াশরুম, ছদ্মবেশী যাত্রীদের নকল মালপত্র হতে দেশী বিদেশী প্রায় পঁচিশ লাখ টাকার মা:দকদ্রব্য উদ্ধার হলো। গ্রেফতার হলো কয়েকজন পা:চারকারী। কেউবা চলন্ত ট্রেন হতে লাফ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পলায়ন করলো।
আজগর সাহেব খবর পেলেন ওই অপ্রত্যাশিত মা:দক বিরোধী অভিযানে ইরহামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সে নিপুণতার সহিত সহায়তা করেছে। কিন্তু কিভাবে, কোন পন্থায় করেছে আজও ওনার অজানা। বহু চেষ্টা করেও জানতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নির্বাচনী লড়াইয়ে ইরহাম ওনায় পরাজিত করেছে। তৃতীয়ত, ওনার প্রেরিত দু-র্বৃত্তদের রাতের অন্ধকারে চরমভাবে ধরাশায়ী করে মৃ-ত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। এছাড়াও কিছুদিন পূর্বে সংসদে বিল পাশ করে ওনার এক ধূর্ত পরিকল্পনা ধুলিসাৎ করেছে। আরো কত কি উপায়ে ওনার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছে ওই চৌধুরী। দু’দিনের চুনোপুঁটি! সে কিনা খন্দকার আজগর মল্লিক’কে টেক্কা দেয়! কতবড় স্পর্ধা! এছাড়া ওই ইরহাম পত্নী! ওটাও কম নয়। ঠিক স্বামীর ভাও পেয়েছে। মুহিত কেসে কিভাবে জড়িয়ে পড়লো!
__
ভার্সিটির প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট মুহিত। ভর্তি হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সিনিয়র ভাইদের কু প্ররোচনায় নে-শাগ্ৰস্থ হয়ে পড়লো। ভার্সিটিতে গোপন একটি চক্র রয়েছে। টাকার লো ভে তারা সহজ-সরল শিক্ষার্থীদের মা:দকে আসক্ত করে তোলে। চতুর্থ বর্ষের সজীব এই চক্রের মূল হোতা। আজগর সাহেবের বেআইনী দলের হয়ে কাজ করে। মা:দক সরবরাহ করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের নিকটে। অল্প সময়ের মধ্যেই মা:দকাসক্ত হয়ে পড়ে ওরা। এতেই তাদের মুনাফা। টাকা আর টাকা। মুহিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রথম প্রথম হাতখরচের টাকা দিয়ে মা:দকের মূল্য জোগান দিতে পারলেও পরবর্তীতে আর পারলো না। আর্থিক সংকটে পড়ে নে শার অভাবে পা-গলপ্রায় অবস্থা। সজীব কিছুতেই বিনামূল্যে মা:দকদ্রব্য দেবে না। মা:দকাসক্ত একজন যখন হঠাৎ করে নে শা হতে দূরে চলে যায় সে সহ্য করতে পারে না। জীবন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। শরীর অস্থির। মানসিক চাপ, যন্ত্রণা ঘিরে ফেলে আষ্টেপৃষ্ঠে। খিটখিটে মেজাজ। বেসামাল চালচলন। চোখের সফেদ অংশ র-ক্তলাল। মুহিতও তার ব্যতিক্রম নয়। বাড়ি থেকে ঘনঘন টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর সজীব বিনামূল্যে নে শাদ্রব্য দেবে না। মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল। বারকয়েক ঝামেলা হলো সজীবের সঙ্গে। এমনিতেই শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। নিজেকে পা’গল পা’গল লাগছে। নে-শার অভাবে একদিন ভার্সিটি করিডোরে কেমন উ-ন্মাদনা আরম্ভ করে দিলো মুহিত। সজীব বাধ্য হয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভার্সিটির শুনশান এক জায়গায়। চলতি পথে তা দেখে নিলো হৃদি। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে কিছু বুঝতে পারলো না। সজীব সেদিন কোনরকম বুঝিয়েসুজিয়ে ছেলেটাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
মুহিত দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। পা’গলামি করছিল নে-শার জন্য। বাড়িতে একসময় মা-বাবা এসব টের পেয়ে গেল। অশান্তি হলো ঘরে। মা-বাবা খুব কষ্ট পেলেন। বকলেন। প্রথমবারের মতো ছেলের গায়ে হাত তুললেন বাবা। চরমভাবে মানসিক অস্থিরতার শিকার মুহিত। কয়েকবার হু’মকি দিলো সজীবকে, নে-শার ব্যবস্থা না করে দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সমস্ত কুকর্ম জানিয়ে দেবে। দু’দিনের এক ছোকড়ার জন্য আজগর সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। অবশেষে আদেশ দিলেন একে মে রে ফেলার। উটকো ঝামেলা সমূলে উৎপাটন করা উচিত।
সেদিনও বাড়িতে বেশ ঝামেলা হলো। পা:গলপ্রায় মুহিত মানসিক অবসাদে ভুগছে। নে-শার অভাবে দুর্দশা। ঘরেবাইরে রোজ অশান্তি। ঝামেলা। সিদ্ধান্ত নিলো আত্মহ-ত্যা করবে। অন্ত হবে সকল সমস্যার। সে-ই মতো একটা নির্দিষ্ট দিন নির্বাচন করলো। ভার্সিটির নীরব শুনশান এক জায়গা বেছে নিলো আ-ত্মহননের জন্য। কম্পিত হাতে কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে ছোট্ট চিরকুট লিখলো। তবে তার দুর্ভাগ্য। সেথায় মৃ ত্যুদূত রূপে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাজির হলো সজীব ও এক সিনিয়র ভাই। মিষ্টি কথার জা:দুতে ছলেবলে কৌশলে মুহিতকে মানিয়ে নিলো সজীব। ওর হাতে তুলে দিলো তরল দ্রব্য। নে-শাজাতীয় দ্রব্যের অন্তরালে যা হৃদক্রিয়া উত্তেজক ড্রা গ। এতদিন পর মা-দকের স্বাদ! আহ্! লো ভ সংবরণ করতে পারলো না। মৃ ত্যু চিন্তা ভুলে সরল মনে এতদিন পর নে শা করলো মুহিত। হাত ফসকে বাতাসে উড়ে গেল সু-ইসাইড নোট। আনন্দিত চিত্তে কম্পিত হাতে নিজের অজান্তেই বরণ করে নিলো মৃ ত্যু। হৃদক্রিয়া উত্তেজক ড্রা গ টি ওর হৃদযন্ত্র সইতে পারলো না। হাত ফসকে পড়ে গেল তরল পদার্থের সিসি। বুকে অসহনীয়-অসহ্যকর ব্যথার আনাগোনা। তীব্র শ্বাসকষ্টে পানি বিহীন জলজ প্রাণীর ন্যায় ছটফটানি। শ্বাস প্রশ্বাসের চলাচল অত্যন্ত করুণ। ঘোলা হয়ে আসছে দু চোখ। ডান হাতে শক্ত করে হৃৎপিণ্ড বরাবর বুকের চামড়া চেপে ধরলো। ঘোলাটে চোখে দেখলো বে-ইমানের হাসিমুখ। ওরা। ওরা ওকে এ কি দিলো? মে-রে ফেলছে ওকে। মৃ ত্যু যন্ত্রণা এত্ত কষ্টদায়ক! সে তো একটু আগেও স্বেচ্ছায় ম-রতে চেয়েছিল। শুধু বি-ষ কেনা বাকি। তবে কেন এখন বাঁচার এত আকাঙ্ক্ষা? কেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে মা-বাবার মুখখানি। উহ্! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ভেতরে যেন এক গ্যালন এ;সিড জ্ব’লেপুড়ে সব ছারখার করে দিচ্ছে। আর নাহ্। সইতে নারাজ শরীর। আস্তে ধীরে বুজে আসছে আঁখি পল্লব। টালমাটাল পদযুগল ধীরে ধীরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো এক তরতাজা দেহ। ওষ্ঠাধরের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে এলো ফেনাযুক্ত শ্লেষ্মা। একসময় ধীরে ধীরে মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়লো মুহিত। হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃ ত্যুবরণ। সজীব বক্র হেসে পকেট হতে রুমাল বের করলো। হাঁটু গেড়ে বসলো নিথর দেহের পাশে। ঘৃণিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সাবধানী ভঙ্গিতে মুহিতের মুখে লেগে থাকা শ্লেষ্মা মুছে দিলো। এবার দেখতে একদম ঠিকঠাক লাগছে। স্বাভাবিক
মৃ ত্যু। বিন্দুমাত্র ঝামেলা নেই। প্রসন্ন চিত্তে সজীব তরল পদার্থের সিসি হাতে উঠে দাঁড়ালো। সেথা হতে প্রস্থান করলো ওরা দু’জন। দিনেদুপুরে ঠাণ্ডা মাথায় এক তরুণ শিক্ষার্থীর খু ন হলো। অবুঝ পাখপাখালি ব্যতীত জানলো না কেউই।
ফরেনসিক বিভাগে নিজস্ব লোক রয়েছে। তাই অতি সহজেই সবটা নিয়ন্ত্রনে আনলেন আজগর সাহেব। মুহিতের মৃ ত্যু স্বাভাবিক মৃ ত্যু বলে গণ্য হলো। বিপত্তি দেখা দিলো হৃ’হামের জন্য। অপ্রত্যাশিত ভাবে হৃদি পেল সে-ই সু-ইসাইড নোট। ইরহামের সঙ্গে গেল পুলিশ স্টেশন। কাগজটা জমা দিয়ে নিজের জানা খুঁটিনাটি সকল তথ্য জানালো। হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট নিশ্চিত করলো সু:ইসাইড নোটে ওটা মুহিতেরই হাতের লেখা। এছাড়াও হৃদি জানালো ও কয়েকবার সন্দেহজনক ভাবে সজীব ভাইয়ের সঙ্গে মুহিতকে দেখেছে। ওর বলা ছোট ছোট তথ্য কেসে মোড় ঘুরিয়ে দিলো। এ পৃথিবীতে সকলে খারাপ নয়। আজও রয়েছে ভালো মানুষের অস্তিত্ব। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা নতুন করে তদন্ত শুরু হলো। এতেই আজগর সাহেবের মাথায় হাত। রুদ্রনীল ফোন করলো গোয়া হতে। ওনার সঙ্গে রাগারাগী করলো বোকামির জন্য।
ব্যাস। ক্ষে’পে গেলেন আজগর সাহেব। আদেশ প্রদান করলেন ইরহাম পত্নীকে তুলে ফেলার। এক ঢিলে কয়েক পাখি ম-রবে। হঠকারিতার জন্য শাস্তি পাবে হৃদি। বউ ছাড়া মানসিকভাবে বিধ্ব-স্ত হয়ে পড়বে ইরহাম। সহজেই দুর্বল শত্রুকে পরাস্ত করা যাবে। নিজের হাতে শাস্তি দেবেন ওই চৌধুরীকে। এমনতর বেশকিছু মনোরঞ্জক পরিকল্পনা আজগর সাহেবের। তবে সে ভাবনায় বিধিবাম। থেমে নেই ইরহাম চৌধুরী। নতুন উদ্যমে তার হৃদরাণীর খোঁজ করে চলেছে। ইনশাআল্লাহ্ ধরা দেবে সফলতা।
আচ্ছা জোঁক তো। একবার ধরলে ছাড়ার নামগন্ধ নেই। চৌধুরীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন আজগর সাহেব। বিড়বিড় করে উঠলেন,
” হ*তচ্ছাড়া। ”
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। ২৬০০+ শব্দের বিশাল বড় একটি পর্ব দিলাম আজ। এ পর্বে দু’টো র’হস্য উন্মোচন হলো। ট্রেনের ঘটনাটি প্রথম পরিচ্ছেদের দশ ও এগারো পর্বে উল্লেখ ছিল। ভুলে গেলে একবার পড়ে নিতে পারেন। আর দ্বিতীয়ত মুহিত রহস্য। আশা করি দু’টো বিষয় আপনাদের কাছে খোলাসা হয়েছে। কোনোরূপ প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানাবেন কিন্তু। ওহ্ হ্যাঁ। আগামী পর্বে থাকছে উত্তেজনাময় ধামাকা। বি প্রিপেয়ার্ড। পাঠকবৃন্দ আপাতত আমি ইনকোর্স পরীক্ষার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। তাই আগামী কিছুদিন অনিয়মিত নতুন পর্ব আসবে। ইনশাআল্লাহ্ একদিন পরপর নতুন পর্ব পাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]