#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৩
” আরে! কেডা আইছে? রাহি নি? ”
রাজেদা খানমের কথায় প্রাণবন্ত হাসলো রাহিদ। এগিয়ে গেল সোফায়। বসে পাশ হতে আলিঙ্গন করলো ওনায়।
” আসসালামু আলাইকুম। হ্যাঁ গো দাদি। তোমার রাহি। কেমন আছো জান? ”
মুখ বাঁকালেন দাদি। তেঁতো স্বরে বললেন,
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। রাখ তো তোর জান প্রাণ। এতবড় দা ম ড়া পোলা! আইজ অবদি কোনো গপ জুটাইতে পারলো না। হ্যায় আবার আমারে জান কয়? ”
সশব্দে হেসে উঠলো রাহিদ। বুড়ির গাল টিপে আদুরে গলায় বললো,
” ওগো জান। ওটা গপ নয় গফ। ”
মুখ ফিরিয়ে পান চিবোতে চিবোতে বললেন উনি,
” একই কথা। গপ গপ। তোরা দুই ভাইই আ কা ই ম্মা। দুনিয়ার সব কামে আছে। কিন্তু মাইয়া মাইনষের বেলায় কাঁচকলা। ছ্যা! ”
হেসে চলেছে রাহিদ। দাদির কাঁধে মাথা এলিয়ে বললো,
” রাগ করে না জান। সময়মতো তোমার সতিন এনে দেবো। এখন মিষ্টি করে হাসো তো একটু। হাসো। ”
” পারতাম না। ” নির্লিপ্ত জবাব রাজেদা খানমের।
ওনার বাচ্চামো উপভোগ করছে রাহিদ। মেতে উঠেছে খুনসুটিতে। কখনো গাল টিপে দিচ্ছে কখনো আঙ্গুলের ভাঁজে গলিয়ে দিচ্ছে আঙ্গুল। সে মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কলেজ পোশাক পরিহিতা কিশোরী। দুরন্ত পায়ে নামছিল সে। দেরী হয়ে গেছে আজ। সহসা তার পদযুগল শ্লথ হলো। উপলব্ধি করলো আকাঙ্ক্ষিত মানবের উপস্থিতি। বন্ধ হয়ে এলো দম। আরম্ভ হলো অন্তর্দাহ। ঝাপসা প্রায় নয়ন জোড়া। ঘন শ্বাস ফেলছে মেয়েটি। প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নিজেকে সামাল দিতে। হঠাৎই দাদির নজরে এলো ইনায়া।
” কি রে বুইন? ওইহানে খাড়াই আছোছ ক্যা? ”
ত্বরিত হুঁশ ফিরে এলো। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ইনায়া। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলো সোফায় বসে থাকা নি-ষ্ঠুর মানবকে।
” দাদি দেরি হয়ে গেছে। আম্মুকে বলো আমি গেলাম। আসসালামু আলাইকুম। ”
একটুও এদিক ওদিক না তাকিয়ে বড় বড় কদম ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ইনায়া। সকলের অলক্ষ্যে ডান হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো অবাধ্য জলকণা। আর রাহিদ! দুর্বোধ্য তার মনোভাব!
•
তমসায় আবৃত বসূধা। জমিনের বুকে দৃশ্যমান মোহনীয় নিশাকরের অংশুমালা! বেডের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে হৃদি। হাতে ‘ শবনম ‘ শিরোনামের জনপ্রিয় প্রেমের উপন্যাস। হৃদয়ছোঁয়া প্রেমগাঁথা হাতের মুঠোয়। তবুও তাতে ধ্যান নেই মেয়েটির। তার বিশ্বাসঘা”তক নয়ন জোড়া বারংবার চলে যাচ্ছে দরজায়। অপেক্ষায় একজনের। কিন্তু দেখা নেই সেই নির্দয় মানবের। কে জানে কখন ফিরবে। দেশের সেবা করতে করতে তার তো হুঁশ-জ্ঞান সব লোপ পায়। ভুলে যায় বাড়ি ফেরার কথা। তার যে এক রূপসী বউ রয়েছে, অপেক্ষার প্রহর গোনে সে কি জানে! জানে না। জানলে এমন নি-ষ্ঠুরতা দেখাতে পারতো না। কাঁপতো বুক। অভিমানী কন্যার হৃদয়ে বেদনার সুর বেজে উঠলো। আঁধার হলো মানসপট। জোরপূর্বক বইয়ের পাতায় ধ্যানমগ্ন হতে চাইলো। তবে এলো না সফলতা। সবসময় সর্বক্ষেত্রে জোর যে খাটে না। মানসিক অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলে ভয়ঙ্ক”রভাবে। যেমনটি এই মুহূর্তে হৃদির সাথে হচ্ছে। এলোমেলো ভাবনার গহীনে তলিয়ে গেল রমণী। অতিবাহিত হলো অগুণতি মুহূর্ত। কিয়ৎক্ষণ বাদে চেতনা ফিরলো আকস্মিক এক কাণ্ডে!
শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দু’টো হাতে বেষ্টিত হলো নির্মেদ কটি। কোলে মুখ লুকালো সে জন। শিহরিত রমণীর হাত ফসকে বিছানার আবরণে পড়ে গেল ‘ শবনম ‘ শিরোনামের বই। আরেকটু সান্নিধ্যে এলো মানুষটি। অবর্ণনীয় আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। চোখ নামিয়ে তাকালো হৃদি। কোলে শয্যা গ্রহণ করেছে শ্রান্ত মানুষটি। উদোম দেহ। স্বল্প ভেজা চুলে এখনো জলকণার অস্তিত্ব। মানুষটি ঘরে ফিরলো কখন আর ফ্রেশ হলোইবা কখন! সে ভাবনা হটে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে মেয়েটি। দু মাসের কিছুটা বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে স্বামী নামক মানুষটির সনে দিনকে দিন বেড়েছে দূরত্ব। ভুলে গিয়েছে কাছে আসার টক-ঝাল-মিষ্টি মুহুর্ত গুলো। আজ এতগুলো দিন বাদে মানুষটি তার সান্নিধ্যে। কোলে গুঁজে মুখ। আবেগের বহিঃপ্রকাশ হলো অক্ষিকোলে। র’ক্তিমা ছেয়ে চোখের সফেদ অংশে। হঠাৎই হাতের কোমল ত্বকে স্বামীর স্পর্শ অনুভব করলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো হৃদি। মানুষটি আস্তে ধীরে ওর হাতটি আঁকড়ে ধরলো। ছুঁয়ে দিলো নিজের চুল। ক্লান্ত মিশ্রিত স্বরে আকুলতা প্রকাশ করলো,
” ব্যথা হচ্ছে খুব। একটুখানি স্বস্তি এনে দেবে জান? ”
প্রথমবারের মতন এমন আকুলতা! আদুরে স্বরে সম্বোধন। আবেগী রমণী নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। অক্ষি গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু বিন্দু। আস্তে ধীরে একাকী ইতিবাচক মাথা নাড়ল মেয়েটি। চিকন চিকন পাঁচটে পেলব আঙ্গুল গলিয়ে দিলো মসৃণ কেশে। একটুখানি বল প্রয়োগ করে টেনে দিতে লাগলো চুল। কখনোবা নরম পাঁচটি আঙ্গুল বুলিয়ে চলেছে মাথার তেলোয়। নিষ্ঠার সহিত সে কর্মে লিপ্ত হৃদি। আরাম পেয়ে নিমীলিত হলো ক্লান্ত মানুষটির অক্ষিপুট। মুখাবয়ব ছুঁলো অর্ধাঙ্গীর উদরের ত্বক। তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস আঁকাআঁকি করে চলেছে সেথায়। শিউরে উঠছে কোমলাঙ্গ। কম্পিত হাত। ভুলে গেল অভিমানের সুপ্ত ভাষাশৈলী। স্বামীর আরামে মগ্ন হলো মন। পেরিয়ে গেল কিছু মুহূর্ত। ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ টের পেল হৃদি। একটুখানি ঝুঁকে তাকালো গম্ভীর মুখপানে। নিশ্চিত হলো নিদ্রায় তলিয়ে মানুষটি। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো! না জানি কখন থেকে অভুক্ত! তপ্ত শ্বাস ফেলে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সে। সরলো না একটুও। লিপ্ত রইলো পতি সেবায়। ওড়নার একাংশ ছুঁয়ে আস্তে ধীরে শুষে নিতে লাগলো জলকণা। মুছে দিচ্ছে স্বল্প সিক্ত চুল। ঘুমিয়ে মানুষটি। টেরও পেলো না অর্ধাঙ্গীর আদুরে সেবার একটুখানি ঝলক!
•
ননদ ভাবী যুগল উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। দুজনের অধরেই খুশির ছোঁয়া। ইনায়ার কণ্ঠে আলিঙ্গন মুক্ত হলো হৃদি, রায়না।
” রায়নাপু’কে পেলেই ভাবী আমাকে ভুলে যায়। হুহ্! ”
মেকি অভিমানে সশব্দে হেসে উঠলো হৃদি, রায়না। হৃদি এবং তার ননদিনী আজ এসেছে রায়নাদের বাসায়। পল্লবীর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে বিয়ের পর এ প্রথমবার আগমন। নিঃসন্দেহে বেশ এক্সাইটেড হৃদি। রায়না হাসিমুখে ভাবীকে পুনরায় একপেশে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো।
” বাজে কথা বলবি না ইনু। ভাবী তো সারাক্ষণ তোর কাছেই থাকে। আমি আর পাই কোথায়? যখন পাই একটু ধরলেই তুই ক্ষে পে যাস। হিংসুটে কোথাকার। হুহ্। ”
ইনায়া মুখ ফুলিয়ে ভাবীকে আরেক পাশ হতে আলিঙ্গন করলো। দৃঢ় স্বরে বললো,
” আমি হিংসুটে নই। ভাবীর ভালোবাসায় দিওয়ানা একজন। ”
সমস্বরে হেসে উঠলো হৃদি এবং রায়না। হৃদি দুষ্টু স্বরে বললো,
” স্যরি নন্দিনী। তোমার এই দিওয়ানাপান, ভালুপাশা গ্রহণ করতে পারলাম না। আই হ্যাভ মাই জামাই। ”
ইনায়া হেসে ভাবীকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা বড় ভাবী পা গ লী হয়ে গেছে! রায়না ভাবীকে ছেড়ে বললো,
” হেই ভাবী! সে-ই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো। বসো বসো। ইনু বস। ”
রায়নার কথায় মৃদু হেসে সোফায় পাশাপাশি বসলো হৃদি, ইনায়া। রায়না ওদের সোফার হাতলে বসে। হৃদি এদিক ওদিক তাকিয়ে শুধালো,
” এই রায়ু! মামি কোথায় গো? ”
” আসছে। ”
মৃদু স্বরে বললো রায়না। তখন তার অভিব্যক্তি একটু হলেও পরিবর্তিত হলো কি!
.
মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেছেন পল্লবী। মমতাময়ী রূপে ভাগ্নে বধূ, ভাগ্নির জন্য বিশাল আয়োজন করেছেন। টেবিলে রকমারি খাবারের সমারোহ। কোনটা রেখে কোনটা খাবে দ্বিধায় ভুগছে মেয়েরা। হৃদি বোকা বোকা হেসে বললো,
” মামি! এ-তকিছু করেছো। ক্যামনে কি খাবো? দেখেই তো পেট অর্ধেক ভর্তি। ”
উনি ক্ষীণ হাসলেন। মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন,
” কিছু তো করতে পারি না মা। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি একটু না হয় করি? ”
হৃদি মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলো এক মায়ের মমতাময়ী রূপ। মুচকি হাসলো সে।
” ঠিক আছে। অল্প অল্প করে নিচ্ছি। রাগ করো না যেন? ”
পল্লবী হেসে ওর প্লেটে পোলাও বেড়ে দিতে লাগলেন। ইনায়া বললো,
” মামি আমাকেও দাও। ”
প্লেট বাড়িয়ে দিলো রায়নাও। সে-ও বললো,
” আমাকেও দাও। ”
ওদের মুখপানে তাকিয়ে আবেগী হয়ে পড়ছেন পল্লবী। ভেজা কণ্ঠে বললেন,
” দিচ্ছি বাবা। ”
নিঃশব্দে হাসলো তিন জন। ওদের হাসিমুখ দেখে পল্লবীর নয়নে জল।
.
ভোজন পর্ব সেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। অগ্রসর হলো বেসিনের ধারে। চালু করলো কল। জলধারায় ধৌত হতে লাগলো হাত। হ্যান্ডওয়াশ মেখে হাতের এঁটো ভাব দূরীকরণ করতে লাগলো মেয়েটি। হাত ধৌত করে তোয়ালে মুছে নিলো হাত। পা বাড়ালো লিভিং রুমের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে একটি কক্ষের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ চমকালো! ঘুরে তাকালো ডান পাশে স্বল্প ভিড়িয়ে রাখা ঘরে। অল্প ফাঁক গলিয়ে অবিশ্বাস্য চাহনিতে অবলোকন করলো অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি! এ কি দেখছে সে!
চলবে.
[ মাথা ব্যথায় জর্জরিত অবস্থা। রাতে স্বস্তি পেয়ে অল্প সময়ে এতটুকুই লিখতে পারলাম। ছোট্ট পর্ব। কি দেখলো হৃদি? কোনোরূপ আন্দাজ? ওহ্ হাঁ। অভাবনীয় চমক থাকছে আগামী পর্বে। কি হতে পারে সেটি? হুঁ? ]