#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১২
অব্যক্ত হতাশা প্রকাশ করলো হৃদি। হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো স্বামীর পানে। হকচকিয়ে গেল তার চাহনির তীক্ষ্ণতা উপলব্ধি করে। একটু আগেই না কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন! এখন ক্ষ্যা পা ষাঁড়ের মতো লুক নিয়ে আছেন কেন? গলা শুকিয়ে গেল হৃদির। ভয় জমলো মনে। চোখের তারা চঞ্চল। শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো। মানুষটা এমন করে তাকিয়ে কেন! আস্তে আস্তে সরতে সরতে স্বামীর পেশিবহুল বাহু হতে সরে হাতের কবজি বরাবর পৌঁছে গেল মেয়েটি। আকস্মিক মাথা তুলে ওর পানে ঝুঁকে গেল ইরহাম। তাতেই ফুরুৎ হৃদির প্রাণপাখিটা। ক্ষীণ দূরত্ব দু’জনার মধ্যে। একে অপরের শ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছে। স্বামীর মুখপানে নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে হৃদি। ওর ভীতিকর অভিব্যক্তি অগ্রাহ্য করে চোখে চোখ রাখলো ইরহাম। খানিক বাদে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
” দেশীয় ক্রাশ সিয়াম, জোভান, তাহসান, সাকিব আল হাসান, ইমরান, আয়মান সাদিক, ইরহাম চৌধুরী? ”
ঘোর কেটে গেল। দ্রুততার সহিত ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। হাঁ। ওরাই। অতঃপর হুঁশ ফিরে আসা মাত্রই ভয়ের চোটে নেতিবাচক মাথা নাড়ল,
” না না। কেউ নেই। বিশ্বাস করুন। শুধুমাত্র স্বামী আছে। ক্রাশ ম্রাশ সব বাদ। ”
শব্দগুচ্ছ এলোমেলো হয়ে পড়ছে। গলা এত শুকিয়ে আসছে কেন? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে কি! এখন এই রাতদুপুরে বাহিরে পানি পাবে কোথায়? কিংবা পেলেও পানি খেতে যাবে কি করে? দ্যাখো কেমন চোখের চাহনিতেই মোড়াল সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। উফ্! দমবন্ধকর অবস্থা। হঠাৎ কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো গুরুগম্ভীর আদেশ,
” হৃদির মনের ঘরে বসত করবে শুধু একজন। এই আমিটা। তার অর্ধাঙ্গ। এই আমি বিহীন অন্য কাউকে তোমার মনের ঘরে সামান্য ঢুঁ মা-রার অনুমতি অবধি দেইনি। না কখনো দেবো। বুঝেছো মেয়ে? ”
বিহ্বল রমণী ডুবে ওই নভোনীল শান্ত গভীর চোখে! চোখের অতল গহ্বরে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে সে। ফিরে আসার বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। সে চায়। চিরতরে হারিয়ে যেতে চায় ওই চোখের মায়াজালে। একান্ত বন্দিনী হয়ে থাকতে চায় এই গোমড়ামুখো মানুষটির বক্ষপিঞ্জরে। থাকবে সেথায় চিরকাল সুখময় স্মৃতির মাঝে। ভাবনার বহিঃপ্রকাশ চোখেমুখে হলো। উজ্জ্বল হলো বদন। ঝলমলে হেসে পেলব দু হাতে স্বামীর গলা ধরলো জড়িয়ে। হাতের আলতো ছোঁয়ায় একটুখানি কাছে টেনে নিলো গম্ভীর মুখ। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে ইরহাম। নয়নে নয়ন স্থির রেখে হৃদি কোমল কণ্ঠে বললো,
” স্বামী মহাশয়! অহেতুক বিচলিত হবেন না। এই আমিটা শুধু আপনারই। এ পৃথিবীতে এসেছি আপনার অর্ধাঙ্গী রূপে। অন্য কারোর নয়। বিশ্বাস করুন। এই মনের ঘরে বসত করে একটিমাত্র নাম। ইরহাম! আপনার নাম। ”
হৃদি ঘুচিয়ে ফেললো মধ্যকার ব্যবধান। উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিলো একান্ত পুরুষের ডান কপোলে। গাঢ় সে ছোঁয়া! লহমায় অশান্ত মানুষটি শান্ত হলো। ভালোলাগার পর্বত গড়ে উঠলো অন্তরে। পুরুষালি দু হাতের অভেদ্য বলয়ে আবদ্ধ হলো মেয়েটি। ললাটে সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে এক গভীর চুমু অঙ্কন করলো মানুষটি। ফিসফিসিয়ে আওড়ালো মনের অরণ্যে লুকায়িত শব্দমালা,
” আমার হৃদয়ের রাণী। সমস্ত যন্ত্রণার উপশম। মনের প্রশান্ত আকাশে এক টুকরো সোনা রোদ। থাকবে তো আজীবন হৃদরাণী হয়ে আমার? ”
আবেগের আতিশয্যে অক্ষিকোল ভিজে উঠলো। নিঃশব্দে বলছে চোখ। নড়ছে ঠোঁট। শব্দভাণ্ডার শূন্য প্রায়। কিছু বলতে অপারগ হৃদি দু হাতে স্বামীকে আলিঙ্গন করে সুখের অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। ইরহাম দেখলো। উপলব্ধি করলো সবই। তৃপ্তিময় হেসে সঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরলো। মুখ লুকালো ডান কাঁধে। নিভৃতে সেথায় অঙ্কন করলো ক্ষুদ্র এক পরশ। হালকা কেঁপে উঠলো কোমল সত্তা। শীতাংশু(চাঁদ) দেখলো এ অন্তরস্পর্শী ভালোবাসাময় প্রহর। লাজে মুখ লুকালো মেঘের ডানায়।
_
ইরহাম চৌধুরী। শৈশব হতেই বুদ্ধিদীপ্ত, পরোপকারী এক সত্তা। অন্যের উপকারে শৈশব হতেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে সে। হয়তো তখন ছোট ছিল। পুরোপুরি অন্যের উপকার করতে ব্যর্থ। তবুও যথাসম্ভব চেষ্টা করতো। বন্ধুদের কাছে সে ছিল ‘ প্রকৃত বন্ধু ‘ যে বন্ধু বিপদের সময় হাতটি ছেড়ে পালিয়ে যায় না। বরং শক্ত করে আঁকড়ে ভরসা জোগায় ‘ আমি আছি তো ‘। সময়ের পরিক্রমায় বড় হতে লাগলো ইরহাম নামের ছেলেটি। দেশমাতৃকার সেবা করার অদম্য অভিলাষ লুকিয়ে মনে। বেছে নিলো রাজনৈতিক জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা তরুণ ইরহাম জড়িয়ে পড়েছিল ছাত্র রাজনীতিতে। ঢাবির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে বেশ কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছিল সে। নজর কাড়লো ক্ষ”মতাশালী রাজনৈতিক দলটির। অতঃপর ধীরে ধীরে সগৌরবে জায়গা করে নিলো সে দলে। বর্তমানে তার দল বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। সরকার গঠন করেছে ‘খন্দকার আজগর মল্লিক’ এর দল। বরাবরই দেশের সেবায় নিয়োজিত ইরহাম। রাজনৈতিক জীবনে ওতপ্রোতভাবে ছিল জড়িয়ে। জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসার মতো অনুভূতির জায়গা দেয়নি। পরিচিত জনের কাছে সে ছিল কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। যাকে চেনা, ভালোমতো জানা ছিল দুষ্কর। জটিল। এমন করেই প্রেম ভালোবাসা বিহীন কাটলো জীবনের ঊনত্রিশ বসন্ত। অতঃপর মায়ের তরফ থেকে মানসিক চাপ। আর কতকাল একা থাকবে! এবার বিয়ে করো। অনিচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও লাভ হলো না। পাত্রী দেখা শুরু হলো। বেশ কয়েকজনকে দেখতে গেলেন মালিহা, ইনায়া এমনকি রাজেদা খানম। পছন্দ হলো না। তারা ইরুর সাথে বেমানান। ইরহাম তো কখনোই পাত্রী দেখতে যায়নি। বরাবরই ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।
একদিন ভণ্ডুল হলো সমস্ত পরিকল্পনা। কোনোরূপ অযুহাত দেখিয়ে লাভ হলো না। অপ্রসন্ন চিত্তে পাত্রী দেখতে গেল। মনমেজাজ ঠিক ছিল না। কিছুটা দেরি করেই গেল ইরহাম। গিয়ে দেখলো এবারকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাত্রী বেশে বসে হৃদি শেখ নামক এক ললনা। যে এক দেখাতেই তার মা ও বোনের মন জয় করে নিয়েছে। আশ্চর্যজনক! একান্তে কথা বলতে পাঠানো হলো দু’জনকে। প্রথম দেখাতেই অভাবনী রূপে হাজির হলো মেয়েটা। একাকী বকবক করে গেল কত কি। প্রথম দেখাতেই মেয়েটার প্রতি কেমন বিরূপ ধারণা জন্ম নিল। তবে অপছন্দ করতে নারাজ হৃদয়। জানা নেই কেন অদ্ভুত কথা বলে উঠলো ইরহাম। পেশ করলো অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব। বিয়েটা যদি হয়েই যায় তবে আপত্তি নেই তার। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে হৃদি কখনোই স্ত্রীর অধিকার দেখাতে পারবে না। এক ঘরে থেকেও অজানা আগন্তুকের ন্যায় থাকবে তারা। কখনোই একে অপরের ওপর অধিকার দেখাতে পারবে না। তারা নামমাত্র স্বামী স্ত্রী। বাস্তবে কোনোরূপ সম্পর্কের প্রগাঢ়তা থাকবে না। এমন প্রস্তাবে যারপরানাই অবাক হয়েছিল হৃদি! তবে কটূক্তি করেনি কোনো। নিশ্চুপ ছিল ক্ষণিকের জন্য। অতঃপর তারা সকলের মাঝে যোগদান করলো।
প্রথম প্রথম চমকালেও হৃদি এ সম্বন্ধ ঠিক হলে আপত্তি করেনি। চঞ্চল মেয়েটা জীবনে প্রথমবারের মতো আবেগের বশবর্তী হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিল। যে সিদ্ধান্ত তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারতো। রায়হান সাহেব। বাবা তার ডানপিটে স্বভাবে অতি চিন্তিত। এছাড়াও বিয়ের বয়স হয়েছে। বেশ কিছু প্রস্তাব রয়েছে হাতে। তাদের মধ্যে মেয়েটার নজর কাড়লো অন্যতম ক্রাশ ইরহাম। রাজনীতিতে জড়িত সুদর্শন পুরুষ! বিয়ে তো জীবনে কাউকে না কাউকে করতেই হবে। এছাড়াও ভাল্লাগে না পড়াশোনা। এরচেয়ে বিয়ে করাই উত্তম। পাত্রটা ইরহাম চৌধুরী হলে মন্দ কি? চমৎকার হবে! কোনোরূপ ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা ব্যতিত বিয়েতে সম্মতি জানালো হৃদি। ইরহাম কি বলেছে না বলেছে তাতে কিছু এসে যায় না। সে-ও সংসার করার জন্য নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলছে না। জীবনে বহুত সময় আছে। একসময় ঠিক হয়ে যাবে সব। কল্প জগৎকে প্রাধান্য দেয়া মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি নামক দ্বিতীয় বাড়ির আশায় দিন গুনছিল। যে বাড়িতে মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে বেড়াবে সে। থাকবে না বাবার শাসন, মায়ের নিষেধাজ্ঞা। বিরাজ করবে শুধু সুখ আর সুখ। ভাগ্যক্রমে ইরহাম পত্নী হলো হৃদি। ভাবনায় আসেওনি জীবন এত সহজ নয়। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তে গোটা জীবনটা তছনছ হয়ে যেতে পারতো। সৌভাগ্যবতী সে! তাই তো ভুল সিদ্ধান্তে পেয়ে গেল সঠিক মানুষটিকে।
বিবাহ সম্পর্কিত অদ্ভুত প্রস্তাব পেশ করে ইরহামের মন বলছিল আপত্তি জানাবে হৃদি। তীব্র প্রতিবাদ করবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। অজান্তে মনোক্ষুণ্ন হলো মানুষটির। হৃদি কি তবে অন্য সব ইঁচড়েপাকা, গায়ে পড়া মেয়েদের মতো! মেয়েটির ওপর সুপ্ত ক্ষো ভ জন্ম নিলো। বিয়েশাদী নিয়ে মোটেও আগ্রহী নয় ইরহাম। কিন্তু মা ও বোন হৃদিকে দেখে অভিভূত! মালিহার পৈতৃক নিবাস সিলেট। সেখানকার মেয়ে হৃদি কেননা রায়হান সাহেবের গ্রামের বাড়ি সিলেট। এক অদ্ভুত মায়ায় হৃদির সনে জড়িয়ে পড়লেন মালিহা। ইরহাম দেখলো। আনমনে কোনোরূপ বাঁধা দিলো না। যা হওয়ার হোক। বিয়ে নামক ‘সুন্নাত’ পালন করার সময় বুঝি হয়েই গিয়েছে। বিয়ের আয়োজন আরম্ভ হলো। একদিন মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠালো হবু স্ত্রীকে। বিয়েটা না করতে সতর্ক করলো। মেয়েটি খুদেবার্তা দেখেও নাদেখা করলো। যথাসময়ে হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হলো ইরহাম ও হৃদি নামক অপরিচিত দু’জন। অতঃপর মনে লুকায়িত অসন্তোষের ফলস্বরূপ, প্রথম দেখায় পেশকৃত প্রস্তাব অনুযায়ী ইরহাম সম্পূর্ণ নিস্পৃহ আচরণ শুরু করলো। চরমভাবে অবাক হলো বিপরীতে থাকা মেয়েটির প্রতিক্রিয়া দেখে! হৃদিও কেমন আচরণ করছে। স্বামী নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। নিজের মতো থাকছে। জীবনটা উপভোগ করছে। সহ্য হলো না তা। অপছন্দের মেয়েটির ওপর এক অধিকারবোধ জন্ম নিলো। যে অধিকারবোধ হতে ছিঁড়ে ফেললো বউয়ের ক্রাশদের ফটো। শৈশব হতেই নিজের জিনিস নিয়ে যথেষ্ট পসেসিভ ইরহাম। যা তার, শুধুমাত্র তার। সেখানে তার একমাত্র বউয়ের মনে অন্য পুরুষের আনাগোনা! অসম্ভব। সব ছিঁড়ে ফেললো। তার বউয়ের মনে থাকবে শুধু একটি চিত্র। ইরহাম!
এরপরের পথচলা সকলের জানা। কেমন করে এই অপছন্দনীয় মেয়েটা হয়ে উঠলো ইরহাম নামক এক দুর্বোধ্য পুরুষের হৃদয়ের রাণী। মেয়েটির সরলতা, মিশুকে স্বভাব, শ্বশুরবাড়ির সকলের প্রিয় হয়ে ওঠা… মন ছুঁয়ে গেল! অজান্তেই মানুষটি ভুলে যেতে লাগলো নিজের পেশকৃত অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব। টের পেল বউয়ের ক্রাশ লিস্টে রয়েছে তার নামটিও। পুলকিত হলো মন। সময়ের পরিক্রমায় হালাল সঙ্গিনী হয়ে উঠলো তার হৃদরাণী! তাদের টক-ঝাল-মিষ্টি পথচলা এখানেই নয় শেষ। বাকি আরো অনেকখানি।
•
গাজীপুর ভ্রমণের আজ দ্বিতীয় দিন। স্বামীর সঙ্গে কাটলো স্মরণীয় এক দিন। ঘুরলো দিনের অর্ধ ভাগ। টুকটাক কেনাকাটা করলো। লং ড্রাইভে সীমাহীন পথে হারালো তারা। হৃদি বিমোহিত হলো স্বামীর নয়া অবতারে! মানুষটির ভালোবাসায়, যত্নবান রূপে আরো একবার নিজেকে হারিয়ে ফেললো মেয়েটি। জীবন এত সুন্দর কেন! কেন ভালোবাসা নামক অনুভূতি হৃদয় জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে! এ কেমন মন কেমনের মিষ্টি যন্ত্রণা! স্মরণীয় এই ভ্রমণে হালাল কপোত-কপোতীর অগোচরে রয়ে গেল এক অজ্ঞাত ব্যক্তি এবং তার তীক্ষ্ণ চাহনি! যে কিনা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তাদের অনুসরণ করে চলেছে।
.
নিকষকৃষ্ণ রজনী। বিছানায় আধশোয়া হয়ে মানুষটি। অপেক্ষায় তার সঙ্গিনীর। নৈশ পরিচর্যা সেরে বিছানার ধারে শ্লথ গতিতে অগ্রসর হলো হৃদি। চোখেমুখে লাজুকতার বন্যা! স্বামীর চোখে একরাশ নে-শার আভাস! আহ্বান ভালোবাসার বাহারি রঙে বিলীন হবার। পাশে এসে বসলো মেয়েটি। ধুকপুকানি বর্ধিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। আলগোছে স্ত্রীকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। বিগত দিবার চেয়েও মধুরতম কাটলো এ রজনী। একে অপরের উষ্ণতায় হারিয়ে গেল তারা। নিশাকরের অংশুমালা মুড়িয়ে নিলো মোহনীয় চাদরে!
•
তিন দিন তিন রাতের সফর সেরে চিরপরিচিত শহরে ফিরে এলো ইরহাম, হৃদি যুগল। সাথে নিয়ে এলো মধুর, স্মরণীয় কিছু স্মৃতি। জীবনের কোন এক সময়ে স্মৃতির পাতা হাতড়ে স্মরণ করবে তা। একে অপরের চোখে চোখ রেখে তৃপ্তিময় হাসবে। ফিরে যাবে সুমধুর স্মৃতিতে! ঢাকা ফিরে এসে আরম্ভ হলো সে-ই ব্যস্ত জীবন। ইরহাম তার রাজনৈতিক জীবনে। হৃদি ব্যস্ত সংসারে। তন্মধ্যে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত বিদায় লগ্ন।
ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর ঘরে। মমতাময়ী মা’কে আলিঙ্গন করে কেঁদে চলেছে মেয়েটি। মালিহার চোখে জমে অশ্রু। উনিও নিঃশব্দ ক্রন্দনে লিপ্ত। মা ও মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে আবেগতাড়িত। হৃদি ও ইরহাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হৃদির চোখেও অশ্রুর ভীড়। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনটি। এমন করে সে-ও তো আপন নীড় ত্যাগ করে নতুন জীবনে পদার্পণ করেছিল। কেঁদেছিল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে। সকলে একে একে বিদায় জানিয়েছিল তাকে। আজ তেমনই এক বেদনাময় মুহূর্তে দিশেহারা ইনু। বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করতে চলেছে। কাঁদছে খুব। আপন নীড়, আপনজন ছেড়ে যাওয়া সহজ নয় যে। বড্ড কষ্টকর। চুরমার করে দেয় বুকের ভেতর। আলতো করে নোনাজল মুছে নিলো হৃদি। অধর প্রসারিত করে এগিয়ে গেল ইনুর পানে।
” ইনু! কাঁদে না সোনা। একটু শান্ত হও। ”
মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে হৃদি। ভাবীর আদুরে কণ্ঠে ইনু মা’কে ছেড়ে ভাবীকে আলিঙ্গন করলো। সে যে ভাবী অন্ত প্রাণ। এ বাড়িতে এত এত স্মৃতি। মা, ভাবী, দাদির সঙ্গে খুনসুটি। গম্ভীর বাবা ও ভাইকে ভয়ে সামলে চলা। বাড়ির আনাচে কানাচে তার দুরন্তপনার ছোঁয়া। ভাবীর আগমনে মেয়েটা খোলস ত্যাগ করে বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আজ থেকে সবটার সমাপ্তি। ঠাঁই হবে নতুন নীড়ে। সেথায় থাকবে শুধু দু’জন। সে এবং তার স্বামী। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো ইনায়া। হৃদি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে। সে কাঁদলে কি করে হবে! ইনুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এগিয়ে এলো ইরহাম। মা ও বোনকে ঠিক সামলিয়ে নিলো। চোখের ইশারায় শান্ত করলো স্ত্রীকে। হৃদি ইশারাটুকু বুঝে নিলো। মুছে ফেললো অশ্রুবিন্দু।
ইনায়া আবেগী বদনে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। জড়তা সংকোচে পারলো না বাবার বুকে মাথা রেখে একটুখানি কাঁদতে। তার দোয়া নিতে। এজাজ সাহেব নীরবে দেখে গেলেন। কি ভেবে যেন হঠাৎই স্নেহশীল হাতটি স্থাপন করলেন মেয়ের মাথায়। চমকালো সকলে! ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো ইনায়া। ত্বরিত নিজেকে সামলিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন উনি। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন। মালিহা ও রাজেদা খানম ইনুকে অনেক উপদেশ দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের সামলানোর বৃথা প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। দুঃখে কাতর ইনু ভাইয়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। কাঠিন্যতা ভীড় করেছে ইরহামের মুখে। ভেতরকার অনুভূতি সম্পূর্ণ লুকায়িত। বোনের মাথায় বারকয়েক স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলো। আদরের বোনের হাতটি তুলে দিলো ভাই রাহিদের হাতে। রাহিদ সকলকে আশ্বস্ত করলো। এবার যে বিধায় লগ্ন। স্বামীর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে গেল ইনু। কাঁদতে লাগলো সশব্দে। পা-গলী মেয়েটিকে নিয়ে এরা যাবে কোথায়? কি করে সামলাবে? এ পুরো আবেগঘন এক পরিবেশ!
চলবে.
[ অতীতের সমাপ্তি আসন্ন। আজকের বেশ বড় পর্বটি নিয়ে দু লাইন মন্তব্য আশা করছি পাঠকবৃন্দ। ]
📌 আসসালামু আলাইকুম পাঠক বন্ধুরা….
লেখিকার লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে মতামত পেশ করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে…
গ্রুপ লিংক 🍁
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share