#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৮
উত্তাল বাংলার রাজধানী। ঢাবি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষার্থীদের অগ্নি সমাগম। চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ। অপরাধীদের জোরদার শাস্তির দাবি জানাচ্ছে তারা। মুখে মুখে একটাই রব,
” অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ”
” ওরা আমাদের হাসিফ ভাইকে মা রতে চেয়েছে? ওদের কাউকে ছাড়বো না। প্রত্যেকটার ফাঁ সি চাই। ”
” দেশে এসব কি চলছে? প্রথমে এক প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট মুহিত। এখন আমাদের হাসিফ ভাই। আর কত প্রাণ কেড়ে নেবে ওরা? কবে থামবে এই মৃ ত্যুখেলা? কবে? জবাব চাই। ”
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক উপস্থিত ঘটনাস্থলে। তপ্ত রৌদ্রের আঁচ পুড়িয়ে দিচ্ছে গাত্র। তবুও থেমে নেই তরুণ প্রজন্ম। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ঢাবি’র। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হাসিফ ভাইয়ের তরে হাজির হয়েছে। বাকিরা হৃদির ভার্সিটির। অর্থাৎ মুহিতের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করতে উপস্থিত হয়েছে। জনসমাগমস্থলে উত্তপ্ততা বিরাজমান। অগ্রণী শিক্ষার্থীরা ছেড়ে কথা বলছে না। জোরালো শব্দে বিচার চাইছে। দেশীয় এক জনপ্রিয় চ্যানেলের সাংবাদিক এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আন্দোলনরত এক ছাত্রের সম্মুখে। সে ছাত্র ঘর্মাক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে। তবুও তেজ বিদ্যমান রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মাইকের সামনে ক্ষি প্ত ভঙ্গিমায় আঙ্গুল শাসিয়ে বলে চলেছে,
” ওরা অমানুষ। ড্রা গ দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ জনগণকে বোধবুদ্ধিহীন করে তুলছে। মে রে ফেলতে চাইছে। যে বা যারা এই পাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে তাদের অবস্থা শোচনীয়। ওই মুহিত কিংবা আমাদের হাসিফ ভাইয়ের মতো প্রাণ সংকটাপন্ন। ”
ডান পাশ হতে এক ছাত্র এগিয়ে এলো। মাইকে মুখ ঠেকিয়ে তেজদীপ্ত স্বরে বলতে লাগলো,
” আমাদের হাসিফ ভাই সৎ লোক। সে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। প্রমাণ জোগাড় করেছিল। এতেই কু!ত্তা পা”গল হলো ওরা। মে রে ফেলার পরিকল্পনা করলো। ”
বাম পাশ থেকে আরেকজন মাইক ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষোভ মিশ্র স্বরে বলতে লাগলো,
” ওই আজগর। খন্দকার আজগর মল্লিক লোকটা সুবিধার না। ঝানু মাল। এসবের পিছনে ওর ছেলেপুলেরা জড়িত। কে বলতে পারে মূল কাণ্ডারি হয়তো সে নিজেই। আমরা এই অন্যায়ের বিচার চাই। আমাদের হাসিফ ভাইয়ের দেহ থেকে ওরা যত ফোঁটা র-ক্ত ঝড়িয়েছে সে প্রতি ফোঁটা র:ক্তের বিচার চাই। ”
এ ছাত্ররা একাকী নয়। এই উত্তপ্ত জন সমাগমে উপস্থিত আরেক ঢাবিয়ান, স্বয়ং রাহিদ। হ্যাঁ। এই বিক্ষোভের অন্যতম মূল কাণ্ডারি রাহিদ। সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষী রেখে ওরা শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিচার চাইছে। নির্ভীক চিত্তে অপরাধীদের অপরাধ চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে তুলে ধরছে। তন্মধ্যে সাবেক মন্ত্রী আজগর সাহেবও অন্তর্ভুক্ত। ওনাকে ছেড়ে বলছে না কেউ। জানামতে সকল অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছে শিক্ষার্থীবৃন্দ। আকস্মিক এই বিক্ষোভ কর্মসূচি রাজধানীর বুকে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। নড়েচড়ে বসলো উর্ধ্বতন মহল। দেশের জনগণের মনে চিন্তার উপদ্রব বেড়ে গেল। যারা অবগত ছিল না তারাও এখন আজগর সাহেবকে সন্দেহ করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো কে প্রকৃত অপরাধী। নিঃসন্দেহে এই তোলপাড় দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো। আধুনিক প্রযুক্তির যুগ এটি। দুই হাজার তেইশ সাল। বাতাসের বেগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো এই বিক্ষোভ সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম পরিচিত মুখ, ছাত্র নেতা হাসিফ। দু!র্বৃত্তদের হা`মলায় সে এখন আহত। পরশু রাতে র-ক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নিজ বাসভবন হতে উদ্ধার করা হয়েছে। এ মুহূর্তে জীবন মৃ;ত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে ছেলেটা। চিকিৎসা চলছে শহরের নামকরা এক হাসপাতালে। এতেই গর্জে উঠলো ঢাবি। অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা দ্বিধাহীন চিত্তে, নির্ভীক রূপে ‘ রাজু ভাস্কর্য ‘ এর সামনে দলবেঁধে হাজির হলো। দিনভর চললো বিক্ষোভ। ঢাবি সংলগ্ন পথেঘাটে হলো মিছিল। অকুতোভয় হু ঙ্কা র প্রতিটি শব্দমালায়। সংবাদ মাধ্যমে সবটাই ক্যামেরাবন্দী হলো। এ আন্দোলন জানলো সারা দেশ। উন্মুক্ত হলো ভাবনার দ্বার। ন্যায় অন্যায়ের লড়াইয়ে লিপ্ত বিবেক। কে হবে বিজয়ী?
.
খন্দকার আজগর মল্লিকের বেহুঁশ হবার উপক্রম। যে সে ব্যক্তি নয় ক্ষে”পেছে বাংলার ছাত্রসমাজ। বায়ান্ন হতে অদ্যাপি বড় ভ-য়ঙ্কর রূপে দেখা দিয়েছে ছাত্ররা। সে ভোলেনি বায়ান্নর সে-ই ভাষা আন্দোলন। নির্ভীক চিত্তে কি করে দেহের প্রতি ফোঁটা র ক্ত বিসর্জন দিয়েছে রফিক, শফিক, জব্বর, বরকত প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা পূর্ব লড়াই যে এখান থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং সে আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য এসেছিল বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে সমাবেশে যোগদান করেছিল। অবশেষে এলো সে-ই ভ-য়ানক দিন। করুণ আর্তনাদ। অকল্পনীয় পরিণতি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গু:লিবর্ষণে কিছু ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তেইশে ফেব্রুয়ারি সারা রাত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে কাজ করেছিল। যা ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ যুক্ত করা হয়েছিল যাতে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। একাত্তর বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল সে ভাষা আন্দোলন। তখনো জন্মগ্রহণ করেনি আজগর। তাতে কি হয়েছে? সে কি শোনেনি সে-ই টগবগে র-ক্তাক্ত লড়াইয়ের কাহিনী? শুনেছে বহুবার।
শুধুই কি ভাষা আন্দোলন! নাহ্! একাত্তরের র:ক্তক্ষয়ী যু-দ্ধেও প্রাণ বাজি রেখে লড়েছিল ছাত্র সমাজ। আজ দুই হাজার তেইশ চলছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে ঢাবিয়ান। অদম্য ছাত্রসমাজ। এত সহজে কি মিলবে ছাড়? এ অনাকাঙ্ক্ষিত তোলপাড় বয়ে আনলো কোন অশনিসংকেত? কি হতে চলেছে শীঘ্র? অন্ত এক পাপের সাম্রাজ্য?
ষাটোর্ধ্ব আজগর সাহেবের র ক্তচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। ধুকপুক ধুকপুক করে স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও ঘেমে যাচ্ছে গাত্র। ছটফটে ভঙ্গিতে বেড সাইড টেবিলের ওপর হাত বাড়ালেন। খপ করে ধরলেন গ্লাস। মুখের সামনে গ্লাস এনেও চরমভাবে হতাশ হলেন। পানিশূন্য আজ গ্লাস। ডানে তাকালেন। বেড সাইড টেবিলে শূন্য জগ অবস্থিত। আজ অসময়ে মিলছে না একফোঁটা জল। ক্ষোভে-তোপে কাঁচের গ্লাসটি সম্মুখে ছুঁড়ে ফেললেন। নির্দয় রূপে মেঝেতে আছড়ে পড়লো গ্লাস। ঘর জুড়ে ধ্বনিত হলো কাঁচের ঝনঝনানি আওয়াজ। যত্রতত্র ছিটকে পড়লো টুকরো টুকরো কাঁচ। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে ষাটোর্ধ্ব আজগর। ফেটে যাচ্ছে মস্তিষ্ক। অকস্মাৎ বিরক্তিকর শব্দ করে বেজে উঠলো রিংটোন। অসহ্যকর মুখশ্রী করে লেটেস্ট ভার্সনের আইফোনটি আঁকড়ে ধরলেন আজগর সাহেব। কলার আইডি না দেখেই রিসিভ করলেন। বিশ্রী গালমন্দ উপহার দেয়ার পূর্বেই ভড়কে গেল অন্তর। যেন কাঁচবিদ্ধ হলো কর্ণ গহ্বরে। উত্তপ্ত লাভায় আবৃত হলো দেহ। ঝ ল সে গেল অবয়ব। ওপাশ হতে শ্রবণ হলো সে-ই অভাবনীয় নির্মম-নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর,
” ইয়্যু ব্লা-ডি ডাফার। আ’ম কামিং… ”
প্রায় বছর তিন বাদে স্বদেশের মাটিতে পদার্পণ করতে চলেছে রুদ্রনীল! এ সংবাদে কেন খুশি পারছেন না আজগর? এ যে ধ্বংসয:জ্ঞ প্রলয়ের শুরুয়াত! অনাসৃষ্টিকারী বিপদের ভয়ানক বার্তা!
.
টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। সপরিবারে আজ রাজু ভাস্কর্যে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলন দেখছে হৃদি ও চৌধুরী পরিবার। যথারীতি অনুপস্থিত একমাত্র ইরহাম। সোফায় বসে চার মাসের গর্ভবতী হৃদি। স্বল্প স্ফীত উদর। আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদটি সে-ও দেখলো। মুহিত হ-ত্যাকাণ্ড! সাথে ছাত্রনেতা হাসিফের জন্য অকুতোভয় বিক্ষোভ। ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাহিদ ভাইয়া। এতগুলো চাপ একসাথে সইতে নারাজ দেহ। সহসা নিঃশ্বাসে দুর্বলতা দেখা দিলো। ঘামের অস্তিত্ব গোটা মুখজুড়ে। ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। কেমন ছটফটানি অনুভূত হচ্ছে। আঁধার ঘনিয়ে আসছে দু চোখের পর্দায়। মালিহা স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে। চিন্তিত বদনে শাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎ নজরবন্দী হলো পুত্রবধূ হৃদির ছটফটানি। দ্রুত পায়ে ছুটে এলেন উনি। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে শুধোলেন,
” ও মা! কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করছে? ”
হৃদি কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু রুদ্ধ কণ্ঠনালী। প্রচুর ঘাম ছুটেছে। ঝাঁপসা প্রায় আঁখি যুগল। মালিহা শঙ্কিত হৃদয়ে পানি আনতে ছুটে যাচ্ছিলেন। তখনই গ্লাস হাতে ছুটে এলেন এজাজ সাহেব। হৃদির মুখের সামনে গ্লাস ধরলেন। অসীম স্বস্তির উপাদান সম্মুখে উপস্থিত। তৎক্ষণাৎ কম্পিত হাতে আঁকড়ে ধরলো গ্লাস। তড়িঘড়ি করে পানি পান করলো হৃদি। মিললো তবে স্বস্তি। মালিহা সস্নেহে ওকে সোফায় হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন। মেয়েটির দু চোখ আস্তে ধীরে বুঁজে গেল। স্বাভাবিক ভাবে চলছে শ্বাস প্রশ্বাস। অনুভূত হচ্ছে আরাম। এজাজ সাহেব গ্লাস হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে কপট রাগ দেখালেন,
” টিভিতে ওসব ছাইপাশ দেখার কি খুব দরকার ছিল? ভুলে যেয়ো না এখন তুমি একা নও। তোমার মাঝে আরো একজন বেড়ে উঠছে। ইয়্যু হ্যাভ টু বি কেয়ারফুল। ”
মালিহা বিমোহিত হলেন স্বামীর আচরণে! বাদ গেলেন না বৃদ্ধা রাজেদা খানম-ও। এজাজ সাহেবের বর্তমান পরিবর্তন নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো। প্রচুর বদলে গিয়েছে মানুষটি। দাদু হতে চলেছে সে। অনাগত নাতি বা নাতনির জন্য কত খেয়াল! নিত্যদিন কিছু না কিছু ক্রয় করে বাড়ি ফিরছে। পুষ্টিকর খাদ্য, অনাগত বংশধরের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির বালিশ, বিছানা, ডায়াপার, খেলনা আরো কত কি। মালিহা মুচকি হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। খেয়াল দিলেন পুত্রবধূর পানে। হৃদি অস্বস্তির মাঝেও মৃদু হাসলো। মুদিত চক্ষু। মিহি স্বরে থেমে থেমে বললো,
” শুকরিয়া পাপা! ”
এজাজ সাহেব চমকালেন! কেমন অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে ওনায়। পুত্রবধূর চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। সন্তানের মুখনিঃসৃত শুকরিয়া এ যে ওনার জন্য অপ্রত্যাশিত। স্বপ্নের। ছলছল চোখে সেথা হতে প্রস্থান করলেন মানুষটি। হৃদি ও মালিহা একে অপরের পানে মৃদু হাস্য বদনে তাকিয়ে।
•
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আঁধারে তলিয়ে ধরিত্রী। এয়ারপোর্টের এক্সিট ডোর পেরিয়ে বের হলো এক দীর্ঘদেহী মানব। পড়নে ভদ্রলোকের ন্যায় সাহেবি পোশাক। কৃষ্ণবর্ণ স্যুট-বুট। ঈষৎ লম্বা কেশ আজ হেয়ারব্যান্ডে খোঁপা করা। মুখাবয়বে অতুলনীয় কঠোরতা। দু চোখে ক্রোধের ম-রণঘাতী অনল। জমিনের বুকে নির্দয় রূপে পা ফেলে হেঁটে চলেছে রুদ্রনীল। সঙ্গী রূপে পালোয়ান মতো দেখতে দেহরক্ষীবৃন্দ। বিমানবন্দর চত্বরে এলো মানুষটি। অপেক্ষায় এক কালো রঙা বিএমডব্লিউ সিরিজ সেভেন এর গাড়ি। রুদ্রনীল সন্নিকটে পৌঁছাতেই তৎক্ষণাৎ কার ডোর উন্মুক্ত করে দিলো এক দেহরক্ষী। স্বমহিমা বজায় রেখে গাড়িতে বসলো রুদ্র। বদ্ধ হলো কার ডোর। বিন্দুমাত্র বিলম্ব বিনা চলতে আরম্ভ করলো গাড়িটি। পরপর চারটে গাড়ি বিমানবন্দর চত্বর ত্যাগ করলো। বাংলার মাটিতে আগমন হলো এক ধ্বং-সাত্মক দা:নবের!
.
ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছে তখন রাত দশটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। লিভিংরুম এরিয়া পেরিয়ে দোতলায় অগ্রসর হচ্ছে ইরহাম। কানে সংযুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ওয়্যারলেস ইয়ারবাড। ওপাশ হতে শোনা যাচ্ছে,
” ভাইয়া তুমি একদম নিশ্চিন্তে থাকো। সিচুয়েশন পুরোপুরি আমাদের কন্ট্রোলে। ওপরমহল মাথা ফাটিয়েও কিছু করতে পারছে না। ”
সিঁড়ি ভেঙ্গে ঊর্ধ্বগামী মানুষটি। রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,
” নিদার (neither) দে শ্যুড ডু। ”
” হ্যাঁ। স্টুডেন্টস্ পাওয়ার তো চেনে না! এবার অস্থিমজ্জায় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ”
সর্বশেষ সিঁড়ি পেরিয়ে ইরহাম শুধালো,
” হাসিফের কি কন্ডিশন? ”
” যেমন থাকার কথা। ”
দুর্বোধ্য রেখা ফুটে উঠলো অধরকোলে। করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটি। পার্শ্ববর্তী দেয়াল অবধি পাত্তা পেল না। সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনালাপে। একপর্যায়ে রাহিদ কিছুটা সময় নিয়ে থামলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
” ভাইয়া? রুদ্রনীল ইজ ব্যাক। ”
” সো দ্য ক্রুয়েলম্যান ফাইনালি অ্যাপিয়ার্ড? ”
নিঃশব্দে হাসলো রাহিদ,
” হুম। নি-ষ্ঠুর দানবটা হাজির। আসতে যে হতোই। ফাঁদে পড়েছে যে বাপ। ”
” ইয়াহ্। ”
” এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল। ”
রাহিদ আত্মবিশ্বাসী। সাথে রয়েছে যে ইরহাম ভাই। আলাপণে সমাপ্তি টেনে বললো মানুষটি,
” ওকে ফাইন রাহিদ। এখন ফ্যামিলি টাইম। রাখছি। কিপ মি আপডেটেড। আল্লাহ্ হাফিজ। ”
সালাম দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবার পূর্বে ইরহামের কর্ণপাত হলো তৃপ্তিময় শব্দমালা,
” ইয়্যু চেঞ্জড্ অ্যা লট ভাইয়া। ”
.
‘ গর্ভস্থ শিশুর পড়ার সুবিধাগুলি তাদের জন্মের আগেই শুরু হতে পারে। গর্ভাবস্থার প্রায় আঠারো সপ্তাহের মধ্যে শিশু তাদের প্রথম শব্দ শুনতে শুরু করবে এবং কণ্ঠস্বর চিনতে সক্ষম হওয়ার জন্য পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে তাদের শ্রবণশক্তি দ্রুত বিকাশ লাভ করবে। গর্ভবতী মা যখন তার অনাগত শিশুর সাথে কথা বলে এবং পড়ে, তখন ইতিমধ্যেই তাদের সাথে একটি বন্ধনের অভিজ্ঞতা আরম্ভ হয়। গর্ভাবস্থায়, শিশুর মস্তিষ্ক দ্রুত বিকাশ করে এবং ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। এটি একটি কারণ যে আপনার গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, আপনার গর্ভে থাকা শিশুকে কিছু পড়িয়ে শোনানো, তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে উৎসাহিত করে এবং প্রাথমিক সাক্ষরতা দক্ষতা এবং ভাষার বিকাশকে উৎসাহিত করতে পারে। আপনার শিশুর জন্মের পর তাকে পড়ার সময় সাক্ষরতার দক্ষতা বিকশিত হতে থাকে। একটি শিশু কথা বলতে সক্ষম না হলেও, তারা তাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে শিখছে। আপনি যখন তাদের কাছে পড়েন, আপনি তাদের সংখ্যা, অক্ষর, রঙ এবং আকারের মত ধারণা বুঝতে সাহায্য করছেন; তারা কীভাবে যোগাযোগ করতে হয় এবং তাদের শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে হয় তা শিখছে। সমস্ত শিশু ভিন্নভাবে শেখে কিন্তু Nemours Reading BrightStart থেকে গবেষণা দেখায় যে বাচ্চাদের প্রায়শই পড়া হয়, তারা দুই বছর বয়সে বেশি শব্দ বলতে পারে। ‘
গুগলে একটি আর্টিকেলে উপরোক্ত তথ্যসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে রাখা বালিশ। সেথায় দেহ এলিয়ে বসে হৃদি। মনোযোগ সহকারে পুরোটা আর্টিকেল পড়লো। কনসিভ করার পর থেকে হৃদির এই অভ্যেস তৈরি হয়েছে। রোজ বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ছে। জ্ঞান অর্জন করছে। গর্ভকালীন আদেশ নিষেধ মান্য করার চেষ্টা করছে। প্রথমবারের মতো মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চলেছে। সম্পূর্ণ চেষ্টা করে চলেছে তার অবহেলা কিংবা সংকীর্ণ জ্ঞানের জন্য অনাগত সন্তান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ফারহানা ও মালিহা মেয়ের এমনতর সিদ্ধান্তে বেশ প্রসন্ন। সেদিনের ছোট মেয়েটি আজ আর ছোট নেই। মা হতে চলেছে যে। আল্লাহ্ প্রদত্ত বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে শিখেছে। সন্তানের ভালোমন্দ বিবেচনা করে প্রতিটি কদম ফেলছে। হৃদির নিকটে এখন তার ভালোলাগা, মন্দলাগার ঊর্ধ্বে সন্তানের সুস্থতা। নিরাপদ থাকা। মায়েরা এমনই হয়। বড় নিঃস্বার্থ। মমতাময়ী। স্নেহের ভাণ্ডার।
হৃদি যখন আর্টিকেল পড়ায় ব্যস্ত সে মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো এমপি সাহেব। হাতঘড়ি খুলতে খুলতে মৃদু রসিকতার স্বরে শুধালো,
” কি? নিউ আর্টিকেল মুখস্থ করা হচ্ছে? ”
একান্ত মানুষটির কণ্ঠস্বর পৌঁছালো কর্ণ গহ্বর। শান্ত হলো অশান্ত চিত্ত। উজ্জ্বল বদনে দরজা বরাবর তাকালো মেয়েটি। ওই তো দাঁড়িয়ে তার ইহকাল-পরকালের সঙ্গী। তার ভালোবাসার মানুষ। ইরহাম। স্ত্রীর পানে তাকিয়ে মুচকি হাসি উপহার দিলো ইরহাম। বেলাশেষে এতগুলো ঘন্টার দূরত্ব বাদে শুধুমাত্র একটি মুচকি হাসি। ঘা য়ে ল হলো কোমল সত্তা। মোহিত হলো নয়ন। তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের মাধ্যমে স্বল্প পরিমাণ বুঝিয়ে মানুষটি মিহি স্বরে বললো,
” আর একটুখানি অপেক্ষা। এখুনি আসছি। ”
বিলম্ব না করে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে অগ্রসর হলো ইরহাম। হৃদি মুচকি হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মোবাইল রাখলো বালিশে পাশে। অনুভব করছে তপ্ত হয়েছে দু গাল। বিবাহিত জীবনের এক বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো কোথা থেকে আসে এত লাজ! আসবে না? লজ্জা যে নারীর ভূষণ। একান্ত ভূষণ।
কিয়ৎক্ষণ বাদে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো ইরহাম। তোয়ালে দিয়ে মুছে নিচ্ছে সিক্ত কেশ। চোখেমুখে লেপ্টে বিন্দু বিন্দু জল। আরো একবার একান্ত পুরুষে হারালো মন। ঈর্ষান্বিত হলো মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকা প্রতি ফোঁটা জলে। নির্মম পন্থায় সে জলকণা মুছে দিতে উদগ্রীব হলো পেলব দু হাত। কিন্তু ব্যর্থতা জাপ্টে আষ্টেপৃষ্ঠে। জোরপূর্বক দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি। সে রাগ করেছে। ওই জলকণার ওপর। তার সরাসরি উপস্থিতিতে কি করে লেপ্টে রইলো তার ব্যক্তিগত-একান্ত পুরুষের সনে! হুঁ? জানা নেই অবান্তর প্রশ্নের উত্তর। ইরহাম যথাস্থানে তোয়ালে রেখে বিছানায় অগ্রসর হলো। এলো পরম শান্তির স্থানে। আলতো করে মাথা রেখে শুলো স্ত্রীর উরুর ওপর। হৃদির ওলটপালট ভাবনায় ছেদ পড়লো। মুচকি হেসে তাকালো স্বামীর পানে। এই ঈর্ষা এই আবার মুগ্ধতা! স্বামী নামক মানুষটি তখন হাত বুলিয়ে চলেছে অর্ধাঙ্গিনীর স্বল্প স্ফীত উদরে। বারকয়েক সেথায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে অনাগত সন্তানের প্রতি স্নেহের বহিঃপ্রকাশ করলো।
” দিনটি কেমন কাটলো আমাদের বাবু ও তার আম্মুর?”
চলবে.
[ বিশাল বড় একটি পর্ব। সুন্দর মন্তব্য চাই কিন্তু। আজকের পর্বে বেশকিছু তথ্য ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত এবং সমস্ত ঘটনাবলি কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। আশা করি ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করবেন 💚 ]
◾ গল্প সংক্রান্ত মতামত পেশ করার জন্য জয়েন করুন আমাদের গ্রুপে…
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share