#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩ ( বর্ধিতাংশ )
পাত্রপক্ষ এখনো আনন্দাঙ্গনে অবস্থান করছে। অতিথিদের ভীড় হতে অবশেষে মিললো মুক্তি। মনস্তাপে জর্জরিত মেয়েটি দোতলার করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে। আকস্মিক থমকে গেল পদযুগল। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো এক অবয়ব। তার আকাঙ্ক্ষিত অবয়ব! মুহুর্তের মধ্যেই চোখে জমলো বাষ্প। বেদনা খামচে ধরলো অন্তরে। রাহিদ সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। পূর্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো ওকে। কেমন অদ্ভুত হেসে উঠলো,
” আনারকলি সেজেছিস? তোর সেলিম সাহেব তো দিওয়ানা হয়ে গেছে রে। চোখ ই ফেরাতে পারছিল না। পারবে কি করে? আফটার অল এত সুন্দর রূপে নিজেকে সাজিয়েছিস। লুকিং বিউটিফুল! ”
অন্তরে তখন অ-গ্নিকাণ্ড হচ্ছে। জ্ব’লে ছারখার সব। শুকনো ঢোক গিললো ইনায়া। অবনত হলো বদন (মুখ)। মিহি স্বরে বললো,
” প্রশংসা শেষ? আমি কি এখন যেতে পারি? ”
বক্র হাসির রেখা ফুটে উঠলো ছেলেটির অধরে,
” আরে বাহ্! পেয়ার খতম? দু’দিন আগে তো আমার সামনে আসার জন্য, আমায় একঝলক দেখার জন্য কত কি করতি। একাকী টিএসসি অবধি চলে গিয়েছিলি। আর আজ? সব শেষ? ভোল পাল্টে গেল?”
চোখ তুলে তাকালো ইনায়া। ক্লেশ স্পষ্ট মুখাবয়বে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হেসে বললো,
” আমি তোমার জন্য কি করেছি দেখেছো তাহলে? জানা ছিল না। আমি তো ভেবেছিলাম আমার ক্ষেত্রে তুমি সব দেখেও অন্ধ। ”
” ইনু! ” ধমকে উঠলো রাহিদ। কেন ধমকে উঠলো নিজেও জানে না বোধহয়।
” হাঁ ইনু। আমি এখন আসছি বুঝলে? গা কেমন চিটচিট করছে। একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। একটু পর তো ওনারা চলে যাবেন। তখন বিদায় জানাতে হবে না? ”
ত্যাছড়া হাসলো রাহিদ,
” ভালোই তো। বিয়ে ঠিক হতে না হতেই শ্বশুরবাড়ির জন্য পিরিত উতলে উতলে পড়ছে। ”
ওষ্ঠাধর কামড়ে অশ্রু নিবারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ইনায়া। নত হলো মস্তক। ক্ষীণ স্বরে বললো,
” তাই কি স্বাভাবিক নয়? ওনারাই তো আপনজন হতে চলেছেন। অন্য কেউ তো নয়। ”
আর এক মুহূর্তও নয়। দুরন্ত পায়ে করিডোর ধরে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেল ইনায়া। ওর গমন পথে শূন্য চাহনিতে তাকিয়ে রাহিদ। আকস্মিক শক্তপোক্ত এক ঘু ষি পড়লো দেয়ালে। কঁকিয়ে উঠলো অন্তঃস্থল। তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সব স্বাভাবিক। কেন এমন হচ্ছে তাদের সঙ্গে? কেন?
.
বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত বসূধা। লেডি শার্লক হোমস রূপে অবতীর্ণ হয়েছে মিসেস হৃদি শেখ। পড়নে রাতপোশাক। কালো রঙা গ্লোভসের অন্তরালে ঢাকা পড়েছে দু হাত। দাঁড়িয়ে ডিভান সংলগ্ন। তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে হাতে থাকা এক টুকরো ছোট কাগজে। গোটা গোটা অক্ষরে কালো কালিতে সেথায় লেখা রয়েছে,
‘ আব্বু আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দিও ‘
চিন্তায় পড়ে গেল হৃদি। ভার্সিটিতে মৃ ত্যুবরণ করা জুনিয়র ছেলেটির নাম মুহিত। এ চিরকুটটি কি তবে তারই লেখা? তাই তো মনে হচ্ছে। একদিকে মুহিতের নিথর দেহ পাওয়া গেল। অপরদিকে এই চিরকুট। ক্ষমা চেয়ে। দুটোর মধ্যে কেমন সংযোগের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! আসলেই কি তাই? নাকি সে ভুল ভাবছে? নারী মস্তিষ্ক ভাবনায় ডুবে গেল। একূল ওকূল কত কি ভাবতে লাগলো। আলোক প্রদর্শনীর ন্যায় চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে মুহিতের সঙ্গে প্রতিটি সাক্ষাৎ। কখনো ছেলেটি অপ্রস্তুত অবস্থায়, কখনোবা সিনিয়র ভাই সজীবের সঙ্গে। কোথাও তো গড়বড় রয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায়? সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না। আকস্মিক ওর ছেদ পড়লো ভাবনায়।
” হাতে ওটা কি? ”
পুরুষালি গমগমে স্বরে একপ্রকার আঁতকে উঠলো মেয়েটি। হাত ফসকে পড়ে গেল কাগজটি। ডিভানের নিচে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। বুকে থু থু ছিটানোর ভান করে পিছু ঘুরে তাকালো হৃদি। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,
” আপনি কি মানুষ হাঁ? এভাবে কেউ ভয় দেখায়? ”
বাঁ ভ্রু উঁচু হলো মানুষটির। সামান্য এক প্রশ্নে তার ‘মানুষ’ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! অদ্ভুত!
” আমি দেখাই। ”
” কি? ” হৃদি নিজেই ভুলে গেল প্রশ্ন।
” বললে না ভয় দেখানোর কথা? আমি ভ য় দেখাই। ”
থেমে থেমে কেমন ফিসফিসিয়ে বললো ইরহাম। ভয় জেঁকে বসলো কোমল হৃদয়ে। স্বামী নামক মানুষটি শুভ্র টিশার্ট পড়ে তাকে ভয় দেখাতে চাইছে নাকি? কিন্তু আফসোস! সে ভীতু নয়। তবে ভয় ভয় লাগছে কেন? কেমন ভূতুড়ে হিমশীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। আমতা আমতা করে বললো,
” আ আমি ভয় পাই না। ”
” হুম। হাতে কি ছিল? কি দেখছিলে? ”
হৃদি সত্যিটা বলতে গিয়েও বললো না। হঠাৎ মস্তিষ্কে হানা দিলো দুষ্টু বুদ্ধি। এমপি মহাশয়ের সঙ্গে মশকরা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাই তো হাসি চেপে প্রসন্ন চিত্তে বললো,
” চিঠি। ”
ঈষৎ চমকালো ইরহাম! তার একমাত্র বউয়ের হাতে কিসের চিঠি! ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
” চিঠি? কিসের চিঠি? ”
হৃদি মেকি লজ্জিত হবার ভান করে দু হাত জড়ো করে ফেললো। স্বল্প দুলতে দুলতে মৃদু স্বরে বললো,
” একজন দিয়েছে। ভার্সিটিতে। ”
আ!গ্নেয়গিরির অ-গ্ন্যুৎপাত হলো মস্তিষ্কে। ক্ষে পে গেল অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা। কোনোরূপ নিজেকে সংযত করে প্রশ্ন করলো,
” কে দিয়েছে? ”
কণ্ঠে কেমন তেজ প্রকাশ পাচ্ছে! তা অনুধাবন করে আস্তে ধীরে মুখ তুলে তাকালো হৃদি। আঁতকে উঠলো স্বামীর র’ক্তিম মুখখানা দেখে। ঢাকঢোল বাজতে লাগলো বুকের ভেতর। দ্রুত সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলো সে,
” এই না না। আমি আমি মিথ্যা বলেছি। কেউ চিঠি দেয়নি। ওটা তো.. ”
আর বলা হলো না। লহমায় স্বামীর বলিষ্ঠ বেষ্টনে আবদ্ধ হলো মেয়েটি। গ্লোভস পরিহিত দু হাত ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরলো চওড়া কাঁধ। নভোনীল নয়নে মিলিত হলো ভীতু নয়ন। কটিদেশের কোমল ত্বকে বিঁধে যাচ্ছে স্বামীর ডান হাতের আঙ্গুল। যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও টুঁ শব্দটি করলো না হৃদি। নিঃশব্দে স্বামীর নৈকট্যে দাঁড়িয়ে। তার চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস। নিভু নিভু আঁখি জোড়া। হিসহিসিয়ে নিজস্ব বক্তব্য পেশ করলো ইরহাম,
” পড়তে যাচ্ছো ওখানে। চিঠি নিতে নয়। আর একবার চিঠি নেয়ার কথা উচ্চারণ করলে পা ভেঙ্গে ঘরে রেখে দেবো। বুঝেছো? ”
অপ্রত্যাশিত চমকে অভিভূত হৃদি! কিয়ৎক্ষণ বাদে চমকের রেশ কাটিয়ে মৃদু হেসে রসিকতার স্বরে বললো,
” বাব্বাহ্! এমপি সাহেব দেখছি বেশ জেলাস! ”
গাঢ় হলো বন্ধন। স্বীকারোক্তি পেশ করলো মানুষটি,
” ইয়েস আই অ্যাম। ”
গ্লোভস পরিহিত দু হাত কাঁধ ছাড়িয়ে আস্তে ধীরে স্থাপিত হলো চওড়া পৃষ্ঠে। পেলব হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীকে। তার প্রশস্ত বক্ষপটে এলিয়ে দিলো মাথা। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মিহি স্বরে বলে উঠলো হৃদি,
” ঈ’র্ষাকাতর হতে হবে না এমপি সাহেব। যতদিন বেঁচে আছি হৃদি শুধু আপনারই। আপনার হৃদ দিগন্তের কৃষ্ণবরণ মেঘপুঞ্জ সরিয়ে সেথায় এক চিলতে রোদ হয়ে ঝলমল করবো আম”রণ। ”
সাধারণ কিছু শব্দমালা! তবুও হৃদ জমিনে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো। পুলকিত হলো তনুমন। সঙ্গিনীকে নিজের সনে আগলে নিলো ইরহাম। মেয়েটিকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করামাত্র সকল প্রকার দুশ্চিন্তা-ক্লেশ পলায়ন করে থাকে। অভ্যন্তরে অনুভূত হয় মনমাতানো শীতলতা। সঙ্গিনীর একটুখানি উষ্ণতা তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যেন কার্যকরী টনিকের ন্যায় কাজ করে। ভেতরকার সকল অশান্তি, অস্থিরতা দূরীকরণ হয় স্বয়ংক্রিয় ভাবে। তৃপ্তিকর হাস্য আভায় আরেকটু গাঢ় আলিঙ্গনে নিজের সনে জড়িয়ে নিলো অর্ধাঙ্গীকে। নৈঃশব্দ্যে চক্ষু বুজে দু’জনে উপভোগ করতে লাগলো এ মধুময় মুহুর্ত।
_
ডিভানে বসে ইরহাম। হাতে সে-ই ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। প্রখর চাহনিতে দেখে চলেছে লেখাটি। প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে। মনে মনে আওড়ে চলেছে বারংবার। সম্পূর্ণ মনোযোগ কালো কালিতে লেখা শব্দগুচ্ছে। মানুষটির বাম পাশেই বসে হৃদি। তাকিয়ে স্বামীর মুখপানে। বোঝার চেষ্টা করছে তার মনোভাব। সফল হলো কি? বোধহয় না। তাই আর নিশ্চুপ না থেকে বলে উঠলো,
” আমার মনে হচ্ছে এটা মুহিতের লেখা। ও হয়তো মৃ ত্যু আশঙ্কা করছিল। কিংবা সু-ইসাইড করবে বলে..! না না। দেখে তো সু-ইসাইড মনে হয়নি। ন্যাচারাল ডে থ মনে হচ্ছিল। শরীরের কোথাও কোনোরকম আঘাতের চিহ্ন ছিল না। একদম সাধারণ নিথর দেহ। ”
” কোথায় পেলে এটা? ” কাগজে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে শুধালো ইরহাম।
” লা শ থেকে অল্প দূরে। মাটিতে পড়ে ছিল। হয়তো বাতাসে উড়ে গিয়েছিল কিংবা.. ”
সাবধানী ভঙ্গিতে কাগজটি রাখলো ইরহাম। রুমাল দিয়ে ধরে ছিল কাগজটি। কাগজে ওদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পড়ে গেলে সমস্যা হতে পারে। স্ত্রীর পানে ঘুরে বসলো ইরহাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলো। ভাবনা শেষে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
” কাল একবার পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। এটা পুলিশে দেয়া দরকার। কাজে লাগতে পারে। ”
শুকনো ঢোক গিললো হৃদি। পুলিশের নাম শুনলে সাধারণ বাঙালী ভয় পাবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়! শেষে কিনা যেচে পড়ে পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে! ভীত হয়ে মিহি স্বরে শুধালো,
” আমাকেও যেতে হবে? ”
” হুম। কারণ কাগজটা তুমি পেয়েছো। ওরা হয়তো তোমাকে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করবে। একদম ভয় পাবে না। যা সত্যি তাই বলবে। আর.. ”
পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী হলো পেলব দু হাত। অর্ধাঙ্গীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে চলেছে ইরহাম। হৃদি তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ভয় দূরীকরণ করার। ইনশাআল্লাহ্ সে পারবে। তার অর্ধাঙ্গ থাকবে তো পাশে। অহেতুক ভয় কিসের? সমস্ত ভয় জয় করবে সে যদি পাশে থাকে এ মানুষটি। এ মানুষটি যে আস্ত এক পজিটিভ ভাইবস্ এর ভাণ্ডার। সে থাকতে দুশ্চিন্তা কিসের? তার স্বামী ঠিক সবটা সামলে নেবে। তাকে এবং পরিস্থিতি দুই ই। ভাবতেই প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে গেল অন্তরে। জীবনসঙ্গীর প্রতি এতখানি অগাধ বিশ্বাস কবে জন্ম নিলো! টেরও পেলো না সে কন্যা।
•
পুলিশ স্টেশন। ঘড়ির কাঁটা তখন নির্দেশ করছে সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। প্রায় জনশূন্য পুলিশ স্টেশনটি। মাঝেমধ্যে দু একজন কনস্টেবল কিংবা চা ওয়ালা কিশোর ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে। সহসা শুনশান এ নীরবতা ভেদ করে সেথায় হাজির হলো এক টয়োটা প্রিমিও। আগে পিছে আরো দু’টো গাড়ি। ধূলো উড়িয়ে থামলো টয়োটা প্রিমিও টি। দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেথায় উপস্থিত দু’জন কনস্টেবলের। তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কারা এরা? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। টয়োটা প্রিমিও’র সামনে ও পেছনে দু’টো গাড়ি দাঁড়িয়ে। সে দু গাড়ির দ্বার উন্মোচন করে নেমে এলো কালো পোশাকধারী কয়েকজন। পেশাগত জীবনে তারা পরিচিত বডিগার্ড কিংবা দেহরক্ষী হিসেবে। প্রশিক্ষিত তারা। এমপি সাহেব এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সদা নিয়োজিত। একজন দেহরক্ষী টয়োটা প্রিমিও এর নিকটে পৌঁছে গেল। উন্মুক্ত করে দিলো গাড়ির দ্বার। বৈভব বজায় রেখে গাড়ি হতে নেমে এলো শুভ্র পোশাকে আচ্ছাদিত এমপি ইরহাম। ওপাশের দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো হৃদি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পুলিশ স্টেশনের বাহিরে দণ্ডায়মান দু’জন কনস্টেবল অবাক চিত্তে তাকিয়ে রইল ওদের পানে! স্বামীর বিশ্বস্ত হাতের মুঠোয় বন্দী হলো পেলব হাতটি। নিঃশব্দে মানুষটি তার হাতের স্পর্শে সহধর্মিণীকে প্রদান করলো ভরসা। একত্রে নজরকাড়া লাগছে দুটিকে! কনস্টেবল দু’জন এদের বৈভব-চলনবলন দেখে উপলব্ধি করলো সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ এরা। যেনতেন কেউ নয়। কোনো বড়সড় পরিচয় নিশ্চয়ই লুকিয়ে। ধীরপায়ে ইরহাম ও তার সহধর্মিণী প্রবেশ করলো পুলিশ স্টেশনের অন্দরে। পিছু পিছু দু’জন দেহরক্ষী। বাকিরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দাঁড়িয়ে রইল গাড়ি সংলগ্ন। পুরোটা সময় স্ত্রীর কোমল হাতটি আঁকড়ে ছিল এমপি সাহেব। ছাড়েনি এক মুহুর্তের জন্যও।
পেরিয়ে গেল আধ ঘন্টার মতো। দরকারি কথাবার্তা এবং জবাবদিহিতা সেরে পুলিশ স্টেশন হতে বেরিয়ে এলো ইরহাম, হৃদি। ফোনালাপে লিপ্ত মানুষটির হস্ত ইশারা বুঝে একটি গাড়িতে বসলো হৃদি। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সবচেয়ে দক্ষ দেহরক্ষী। ইরহামের আলতো মাথা নাড়ানো দেখে শব্দহীন অনুমতি পেল দেহরক্ষী টি। ফলস্বরূপ কালো রঙা গাড়িটি রওনা হলো ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর পথে। ইরহাম তখনো ফোনালাপে ব্যস্ত। একজন রক্ষী গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে দাঁড়িয়ে। কথোপকথন চলমান অবস্থায় প্রতিটি পদচারণায় আভিজাত্য বজায় রেখে টয়োটা প্রিমিও-তে বসলো ইরহাম। দ্বার বদ্ধ করে নিজেদের জন্য ব্যবস্থাকৃত গাড়িতে বসলো সে লোকটি। সম্মুখে টয়োটা প্রিমিও পেছনে রক্ষীদের গাড়ি। চলতে আরম্ভ করলো টয়োটা প্রিমিও। গন্তব্য এমপি সাহেবের কর্মস্থল।
ব্যস্ত সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। এসির শীতল পরশে মিলছে শান্তি। মোবাইলে একজনের সঙ্গে আলাপণে লিপ্ত ইরহাম।
” নাম জুনায়েদ। জুনায়েদ শিকদার। ওর পুরো বায়োডাটা আমার চাই। এভ্রি সিঙ্গেল ডিটেলস্। কিছু যেন বাদ না পড়ে। ”
ওপাশ হতে আশ্বস্ত করলো সে জন,
” চিন্তা করবেন না ভাই। ওর পুরো বিন্দুবিসর্গ পেয়ে যাবেন। ”
” তাই যেন হয়। রাখছি। ”
” আসসালামু আলাইকুম ভাই। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো ইরহাম। পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলো মোবাইল। চোখ গেল জানালা গলিয়ে ব্যস্ত শহরে। পথঘাট, অসংখ্য গাড়ি, পথচারীদের পদচারণায় নিবদ্ধ তার চাহনি। অথচ মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অজস্র চিন্তার বহর।
•
আনন্দাঙ্গনে বেডরুমে খাটের একাংশে বসে এজাজ সাহেব। নিরীক্ষণ করে চলেছেন অফিসিয়াল ফাইল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইনায়া। পাশে মালিহা। ক্ষণিকের নীরবতা ভঙ্গ করে ইনায়া মুখ খুললো। ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে বললো,
” বিয়েতে আমি রাজি। ”
ইচ্ছে সত্ত্বেও খুশি হতে পারলেন না মালিহা। ওনার মনে জমলো চিন্তাগুচ্ছ। তবে এজাজ সাহেব? ওনার অধরে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। মেয়ে রাজি হলো তবে! মনে মনে খুশি হলেও শব্দমালায় তা প্রকাশ করলেন না। আস্তে করে শুধু মাথা নাড়লেন। সেথায় দাঁড়ানোর মতো আর ধৈর্যশক্তি অবশিষ্ট রইল না। সত্বর কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল ইনায়া। অক্ষিকোলে জমায়েত অশ্রুবিন্দু পিতা-মাতার অগোচরেই রয়ে গেল।
চলবে.
[ কি হতে চলেছে এবার? ইনায়া তো বিয়েতে মত দিয়ে দিলো। পূর্ণতা পাবে কি রাহিদ, ইনুর অব্যক্ত অনুভূতি? ]