#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩৩
খাটিয়ায় শায়িত মায়ের প্রাণহীন দেহটি। শক্ত সামর্থবান পুত্রের ডান কাঁধে মায়ের নিথর দেহের ভর। খাটিয়ার অগ্রভাগ ইরহাম ও রাহিদ দুই ভাইয়ের কাঁধে। পেছনে আরো দু’জন। তন্মধ্যে একজন সম্প্রতি বিপত্নীক এজাজ সাহেব। শুভ্র পোশাকে আচ্ছাদিত তিনি। একদম নিশ্চুপ হয়ে স্ত্রীর খাটিয়া বহন করে পথ চলছেন। ওনার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে রাহিদ নিষেধ করেছিল ভারী খাটিয়া বহন করতে। সে কথায় কর্ণপাত করেননি এজাজ সাহেব। নিঃশব্দে স্ত্রীর ভার শেষবারের মতো কাঁধে বহন করলেন। জীবদ্দশায় তো ওই নারী ওনার থেকে কিছুই পেল না। না ভালোবাসার আলতো পরশ, না একটুখানি যত্নশীল দেখভাল। এখন মৃ ত্যু পরবর্তী মুহূর্তে না হয় শেষবারের মতো আগলে নিলেন। এতে যদি অবহেলা নামক পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়। ক্ষমা করে ওনার কোমলমতি সহধর্মিণী।
চারিদিকে শুভ্রতার আচ্ছাদন। কত লোকজনের আগমন। সাংসদ ইরহাম চৌধুরীর মা এছাড়াও বিশিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এজাজ চৌধুরীর সহধর্মিণীর জানাজা। অসংখ্য লোকের আগমন ঘটেছে। বাড়ির প্রাঙ্গন চেনা অচেনা লোকসমাগমে ভরপুর। জানাযায় অংশ নিয়েছে অগণিত লোকজন। শুভ্র পোশাকে ছেয়ে জানাযা স্থল। তন্মধ্যে এজাজ নামক মানুষটির মনে জমেছে ঘন কৃষ্ণকালো মেঘের আবরণ। দু’দিনেই যেন মানুষটির বয়স অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখে শতবর্ষ বৃদ্ধ মনে হচ্ছে। সদা অহং-দাম্ভিকতা নিয়ে চলা মানুষটির আজ এ কি দুর্দশা! চেনাই মুশকিল। সহধর্মিণীর শোকে একপ্রকার পাথরে পরিণত হয়েছেন উনি। জাগতিক হুঁশ হারিয়ে এক জীবন্ত লা শ। উনি বেঁচে থাকতেই ওনার মরহুমা স্ত্রীর খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরস্থানে। কখনো কল্পনা করেছিলেন এমন নি’র্মম দৃশ্য! ভেবেছিলেন কখনো এই দিনটি এভাবে আসবে! মানুষ ম-রণশীল। প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন মৃ-ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে এতটা বি ভৎ স মৃ-ত্যু! ভাবতেই গা শিউরে ওঠার মতো পরিণতি। চোখে এনে দেয় অশ্রুজল।
ধীরপায়ে কবরস্থানের পানে অগ্রসর হচ্ছে জনসমাগম। কেননা পবিত্র কুরআন শরীফে সুরা মুরসালাতের পঁচিশ-ছাব্বিশ নম্বর আয়াত এবং সুরা মায়েদা’র একত্রিশ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে,
” মৃ-ত ব্যক্তিকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ওপর ফরজে কেফায়া। অনুরূপ মৃ-তদেহ বহন করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ”
মৃ-ত ব্যক্তির খাটিয়া বহন সম্পর্কে ইবনে মাজাহ হাদিসে বর্ণিত রয়েছে,
” মৃ-ত ব্যক্তির খাট চার ব্যক্তি কর্তৃক ওঠানো মুস্তাহাব। উত্তোলনকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সুন্নত হলো মৃ-তদেহ নিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটা। (ইবনে মাজাহ, হাদিস:১৪৬৭) ”
এছাড়াও সকল নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক হাদিস বর্ণিত রয়েছে (আবু দাউদ:২৭৪৫) তে,
” নারীদের সুন্নত কাফন হলো লেফাফা, ইজার, কমিস, ওড়না ও সিনাবন্দ। ”
.
এলো সে-ই বেদনাদায়ক মুহুর্ত। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। শোকের উচ্চ পাহাড়। শেখ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ খননকৃত কবরের পানে। কোমর পরিমাণ কবরের গভীরতা। ইসলামে এটি মুস্তাহাব হিসেবে গণ্য। এরচেয়ে বেশি গভীরতা হলে আরো উত্তম। স্বামী ও একমাত্র পুত্রের হাতে মালিহা নামক এক নির্ভয়ার নিথর দেহটি। পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছে দাফন কার্যের জন্য। মৃ-ত ব্যক্তি নারী হলে তাকে কবরে রাখার সময় পর্দা দেয়া উচিত। সে-ই বিধান মান্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সুপুত্র ইরহাম। আস্তে ধীরে সাবধানী ভঙ্গিতে মায়ের দেহটি কবরে ডান পাশ করে কিবলামুখী রাখা হলো। বড় যত্নশীল সে স্পর্শ। পাছে মায়ের আঘাত না লেগে যায়। মায়ের কাটাছেঁড়া-ক্ষতবিক্ষত দেহে আর কত আঁচড় লাগতে দেবে সে? মন যে সইতে নারাজ। বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। মালিহা মায়ের দেহটি কবরে রাখার সময় ইরহাম ও এজাজ সাহেবের ওষ্ঠাধর একত্রে নড়ে উঠলো। উচ্চারিত হলো,
‘ বিসমিল্লাহি ওয়ালা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ্। ‘
জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে মায়ের দাফন কার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে ইরহাম। এ মুহূর্তে তার ভেতরকার সবটুকু অনুভূতি সম্পূর্ণ অন্তঃশীল। থমথমে মুখশ্রী। চোখে আজ অনুপস্থিত রিমলেস চশমা। র-ক্তলাল নভোনীল দু চোখের সফেদ অংশ। পড়নে শুভ্র পাঞ্জাবি, পাজামা। মাথায় টুপি। পবিত্র লাগছিল দেখতে। মা দেখলে নিশ্চয়ই মৃদু স্বরে আওড়াতো,
‘ মাশাআল্লাহ্! আমার ছেলেটার ওপর কারো বদনজর না পড়ুক। ‘
সেই মা আজ নেই। ইহকালে ওনার সময় শেষ। যাত্রা আরম্ভ পরকালের। আস্তে ধীরে কাঠিন্যতায় মুড়িয়ে নিলো নিজস্ব দুঃখ-বেদনা। একজন গণ্যমান্য হুজুরের নির্দেশনা অনুযায়ী ইরহাম ও রাহিদ মালিহার কবরের ওপরে বাঁশ দিয়ে কবরের মুখ বন্ধ করে দিলো। রাহিদের অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু। এজাজ সাহেব দু হাত দূরে দাঁড়িয়ে। নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ কবরে। বিদায় নিচ্ছে ওনার সহধর্মিণী। এই বুঝি হাওয়ায় ফিসফিসিয়ে শোনা গেল নারী কণ্ঠ,
‘ আল বিদা। এই অবুঝ মহিলা আর কখনো তোমার বিরক্তির কারণ হবে না। এবার ভালো থেকো। সুখে থেকো ইরুর বাবা। ‘
কতটা যন্ত্রণাদায়ক ভাবে সে-ই ধ্বনি প্রবেশ করলো শ্রবণপথে জানা নেই এজাজ সাহেবের। তার সহধর্মিণী বুঝি স্বামীর প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে হারিয়ে গেল! কখনো মিলবে না ক্ষমা! মিলবে কি করে? কখনো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কি? হলেও সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেননি উনি।
‘ আজ চারিদিকে শুধুই আফশোস আর হাহাকার।
লাগে না ভালো আর। ‘
•
রাত পেরিয়ে উজ্জ্বলতম এক নতুন দিনের আগমন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হৃদি। তার শারীরিক অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয়। এই ভালো তো এই মন্দ। হঠাৎ হঠাৎই কেমন আ-ক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে মেয়েটা। ঘর্মাক্ত দেহ। শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ অনিয়ন্ত্রিত। শায়িত অবস্থায় এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুঁড়ে চলেছে। নিজ অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত হয়ে অদৃশ্য কাউকে আঘাত করতে চাইছে। কখনোবা নিজের দ্বারা নিজেই আঘাত পাচ্ছে। শরীর হতে ঝড়ছে লাল তরল। গর্ভাবস্থায় এমন উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা-পাগলামী যথেষ্ট ক্ষতিকারক। এমনিতেই সে এবং গর্ভস্থ দুই সন্তানের অবস্থা নাজুক। চিকিৎসকরা যথাসাধ্য সর্বোচ্চ খেয়াল রাখছেন। আগলে রাখছে ইরহাম ও পরিবারের সদস্যরা। তবুও নিজের দ্বারা নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হৃদি নামক মেয়েটি। যখন সে একটু নিদ্রায় মগ্ন থাকে তখনই শান্ত। জাগ্রত থাকলেই পা:গলামি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। লহু স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে মেয়েটা। দেয়ালে দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিধ্বনিত হয় তার আকুল কণ্ঠস্বর,
” মাহ্! ”
মেয়ের এই করুণ হাল আর সহ্য করতে পারছেন না ফারহানা। চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে মেয়ের বিষাদময় দৈন্যদশা। মাতৃমন তা দেখে ভেঙ্গে চুরমার। স্বামীর বুকে মাথা এলিয়ে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছেন ফারহানা। রায়হান সাহেবের আবেগ আজ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। মেয়ের বাবা হন উনি। বাবাদের দুঃখকষ্ট অধিকাংশ সময় লুকায়িত থাকে। প্রকাশ্যে আর আসে না। তাই তো উনিও পারছেন না ক্রন্দনে দিশেহারা হতে। কারো সান্নিধ্যে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিতে। বাবা নামক এই মানুষটির বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মেয়ের এই করুণ পরিণতি অন্য সবার মতো উনিও সহ্য করতে পারছিলেন না। ফারহানার কান্না, অভিযোগের ভিত্তিতে এক মূহুর্তের জন্য হলেও মস্তিষ্কে কড়া নাড়লো, মেয়েকে এই বিয়েটা দিয়ে ওর জীবনটা নিজের হাতে শেষ করে ফেললেন কি!
.
” আমার মেয়েকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করলে ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো। আশা করি তুমি এতে আপত্তি করবে না। ”
সদ্য এশার সালাত আদায় করে মসজিদ হতে ফিরলো ইরহাম। শুভ্র পোশাক পরিহিত মানুষটি করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে। অগ্রসর হচ্ছে তার হৃদরাণীর কেবিন পানে। সহসা কতগুলো অপ্রত্যাশিত-বিষাক্ত শব্দ যেন কর্ণ গহ্বরে ঠাস করে আঘাত হানলো। হতবিহ্বল নয়নে পিছু ঘুরে তাকালো ইরহাম। দাঁড়িয়ে শাশুড়ি মা এবং বাবা। গম্ভীর মুখশ্রী। কথাটি শাশুড়ি মা ই বলেছেন। এত বি-ষাক্ত শব্দমালা উনি কি করে উচ্চারণ করলেন? উনি কি স্বচক্ষে ওর দুর্দশা দেখতে পাচ্ছেন না? দেখতে পারছেন না ওর ছটফটানি-কাতরতা। তবে কি করে ওকে এত ভ”য়ানক মৃ-ত্যুদণ্ড দিতে পারেন! মা হন উনি। হৃদয়হীনা নন। কয়েকবার শুকনো ঢোক গিললো মানুষটি। সিক্ত হলো ঠোঁট। র’ক্তিম আভা পুনরায় আবির্ভূত দু চোখের সফেদ অংশে। আবেগমথিত দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো ইরহাম,
” মা। আমার বুকের ডান পাশটা খুব বাজেভাবে ক্ষতবিক্ষত। শত টুকরোয় খণ্ডিত। আর বুকের বাঁ পাশে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর ঠাঁই। ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিলে জানবেন, এই আমিটা আর নেই। চিরতরে হারিয়ে গেছে। জীবন্ত এক লা শে পরিণত হয়েছে। যে আমৃ”ত্যু হাহাকার করে যাবে ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে করতে। ”
উচ্চারিত প্রতিটি শব্দমালায় লুকিয়ে ছিল কাতরতা, আকুলতার বহিঃপ্রকাশ। সদা গম্ভীরমুখো স্পষ্টভাষী মানুষটি যেন আজ কোথায় হারিয়ে। চোখেমুখে অসহনীয় বেদনা লুকিয়ে। আগের চেয়েও অত্যধিক চুপচাপ। মা ও স্ত্রীর করুণ হাল সহ্য করে বেঁচে আছে কি করে? রায়হান-ফারহানা দম্পতি আর কিছু বলতে পারলেন না। ছেলেটার ব্যথিত অবস্থা ওনাদেরকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও মেয়ের বাবা-মা হন তো। নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত না করে পারলেন না। ওনারা দু’জন শূন্য চাহনিতে তাকিয়ে ইরহামের গমন পথে। মন্থর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ছেলেটা। বেঁচে থাকার আরেক অবলম্বনের সন্নিকটে।
.
তমসাচ্ছন্ন রজনী। হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলেছে শুভ্র রঙা গাড়িটি। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটেছে চার চাকা। যন্ত্রণায় কাতর হাত দু’টো চেপে বসেছে স্টিয়ারিংয়ে। দু চোখে ঘন কালো মেঘের রাজত্ব। ভেতরকার সবটুকু কষ্ট, গ্লানি পিচঢালা পথে ঢেলে দিচ্ছে যেন। সশব্দে অশ্বগতিতে চলমান শুভ্র রঙা গাড়িটি। যেন ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে যন্ত্রণাকে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুখময় জীবন। কতটা পথ অতিক্রম হলো জানা নেই। হঠাৎই সশব্দে ব্রেক কষে থামলো অশ্বগতি। পিচঢালা পথে চাকার ঘর্ষণে কেমন অদ্ভুত শব্দ ধ্বনিত হলো। রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে ফোর হুইলারটি। হট করে উন্মুক্ত হলো গাড়ির দ্বার। বেরিয়ে এলো দীর্ঘকায় সুঠাম পুরুষটি। অত্যন্ত শ্লথ তার পদযুগল। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলেছে। বিদীর্ণ করে যাচ্ছে আঁধার। কিছুটা পথ অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে পড়লো ইরহাম। গাছপালার সারি দৈ”ত্যকায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। বিপরীতে এই দুঃখে জর্জরিত মানুষটি। কতকাল নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো গাছপালা ভেদ করে তমসায় আবৃত অন্তরীক্ষে। সেথায় আজ অনুপস্থিত চন্দ্র। ওর আঁধারে নিমজ্জিত জীবনটার মতো কালো মেঘে ঢাকা অন্তরীক্ষ। হারিয়েছে সুখপাখি। চোখের তারায় চলমান চিত্রের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবনের কিছু সুখময় অংশ। যার অধিকাংশ জুড়ে শুধুই মা। জন্মদাত্রী মা। জীবনের প্রথম ভালোবাসা, প্রথম শিক্ষক, প্রথম আপনজন। আজ সে জন শায়িত সাড়ে তিন হাত মাটির তলে। মা পা”গলি বউপাখিটা জানেও না চিরবিদায় নিয়েছে মা। তার দাফন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জানবে কি করে? চেতনা অচেতনের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে মেয়েটি। হুঁশজ্ঞান লোপ পেয়েছে। চিকিৎসকদের ভাষ্যে এই দুর্দশা হৃদি এবং ওদের অনাগত সন্তানের জন্য ক্ষতিকর। বড় কোনো বিপদ হতে পারে। সে এবং পরিবারের সদস্যরা কম তো চেষ্টা চালাচ্ছে না। তবুও একই হাল। কোনোরূপ পরিবর্তন নেই।
ওদিকে আদরের ছোট বোনটার বেহাল দশা। থেমে থেমে আহাজারি করে উঠছে। মা মা করুণ কলরবে ভাঙচুর হচ্ছে ঘরে। রাহিদ ও পল্লবী অতি কষ্টে ওকে সামলে রাখছেন। ছোট মেয়েটা আকস্মিক মাতৃবিয়োগ সহ্য করতে পারছে না। অচেতন হবার মতো বিমর্ষ অবস্থা। দাদিও অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। একা হাতে আর কতদিক সামলাবে সে! কেন এভাবে চুপিসারে ফাঁকি দিয়ে পালালো মা! মানুষটির দু চোখ আস্তে আস্তে সিক্ত হতে লাগলো। মা নেই। ফাঁকি দিয়ে হারিয়েছে। এখন কি স্ত্রী সন্তান-ও তাকে ছেড়ে যাবে? এতটাই নীচ-অধম সে! যার সঙ্গে এক জীবন কাটানো সম্ভব নয়! বুকের ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছিল। গলার নিচে জমা অশ্রুর আচ্ছাদন এখন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একদলা কান্না ঘুরপাক খাচ্ছে অন্তঃপুরে। আর কতকাল নিজ আবেগ-অনুভূতি লুকাবে সে! এবার তো নিজেকে খোলসমুক্ত করা উচিত। নাহলে যে ভেতরে মহা বি-স্ফোরণ ঘটবে। মা রা পড়বে সে। আর সহ্য করা গেল না। কণ্ঠনালী ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো গগণবিদারী চিৎকার,
” মা! ”
আকাশ বাতাস কাঁপলো চিৎকারে। রূদ্ধ হলো শ্রবণদ্বার। উড়ে পালালো পাখপাখালি। ধপ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো জমিনে। আন্তঃজ্বালা মেটাতে ব্যস্ত ইরহাম চৌধুরী। দু চোখ ছাপিয়ে নামছে শ্রাবণধারা। ফুলে ফেঁপে উঠছে শিরা। লালাভ রঙে রঙিন নভোনীল চোখের আশপাশ। ভেতরে পু’ড়ে ছাই হচ্ছে বিরহ বেদনা। মা নেই। যে করেই হোক রক্ষা করতে হবে স্ত্রী সন্তানদের। ইনশাআল্লাহ্ আর কোনো আঁচ পড়তে দেবে না ওই কোমল দেহে। রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াবে সে। প্রস্তুত করবে নিজেকে। দেখা যাক এবার কে কোন পন্থায় তাকে পথভ্রষ্ট করে। খেলায় তো সবে মধ্যবিরতি চলছে। এখনো বাকি আরেক ধাপ। সে ধাপে নিজেকে যথাযথ রূপে হাজির করবে চৌধুরী। প্রশিক্ষিত পন্থায় করবে শত্রু কুপোকাত।
•
দু সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিল হৃদি। বাড়ি ফিরেছে এক সপ্তাহের মতো হয়েছে। শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত। তবে মানসিক অবস্থা? তার কথা নাহয় এড়িয়ে যাওয়া যাক। এই দু’টো সপ্তাহ ছিল আনন্দাঙ্গনবাসীর জন্য তাদের জীবনের অন্যতম বিষাদময় অধ্যায়। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টায় জ্বলেছে মন। পু’ড়েছে দেহ। ইংরেজিতে বেশ প্রচলিত একটি বাক্য রয়েছে ‘টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।’ এটি চমৎকার এক সত্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসলেই সকল আঘাত সেরে যাবে। তবে সে আঘাতের কালসিটে দাগ রয়ে যাবে আম-রণ।
হৃদির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ওকে এখন সাইকোথেরাপি দেয়া হচ্ছে। একজন অভিজ্ঞ ও খ্যাতিমান সাইকিয়াট্রিস্ট হৃদির দায়িত্ব নিয়েছেন। ওর মানসিক দুর্দশা দূরীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তন্মধ্যে ইরহামের অনুরোধ রক্ষার্থে এক বিশেষ থেরাপির আয়োজন করা হলো। সম্মোহনী থেরাপি। সে থেরাপির মাধ্যমে সাবধানতা অবলম্বন করে সম্মোহিত করা হলো হৃদি’কে। বেডে শায়িত অন্তঃসত্ত্বা ভারী শরীরটি। বদ্ধ অক্ষিপুট। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। পান থেকে চুন খসলেই সব শেষ। অত্যধিক শান্ত-নীরব সে পরিবেশ। সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো ব-শীভূত হয়ে বেডে শায়িত মেয়েটি। থেরাপি অনুসারে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন সাইকিয়াট্রিস্ট। সম্মোহিত হৃদি লহু স্বরে থেমে থেমে এলোমেলো শব্দে সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। সাইকিয়াট্রিস্ট মনোযোগ সহকারে সবটা শুনছেন। নোট করে নিচ্ছেন। এলোমেলো শব্দের অর্থ উদ্ধার করছেন। এমনিভাবে থেরাপি চলাকালীন সময়ে অকস্মাৎ একটি প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশিত হলো চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। কয়েক হাত দূরত্বেই দাঁড়িয়ে ছিল চৌধুরী। তথ্যটি সুস্পষ্ট রূপে তার কর্ণপাত হলো। গেঁথে গেল মস্তিষ্কে। অধরকোলে ফুটে উঠলো দুর্বোধ্য রেখা।
‘ গেম অন… ‘
চলবে.
[ পাঠকবৃন্দ কি মনে হচ্ছে? কোন চাঞ্চল্যকর তথ্যটি জানতে পেরেছে ইরহাম? কি হতে চলেছে এবার? আপনাদের মূল্যবান মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ সবাইকে তাহিরাহ্ এর পাশে থেকে উৎসাহিত করার জন্য। আসসালামু আলাইকুম। ]
🔸 পাঠক বন্ধুরা….
তাহিরাহ্ ইরাজ এর লেখা গল্প-উপন্যাস সম্পর্কিত ছোট-বড় অনুভূতি ব্যক্তকরণ, গল্প নিয়ে আলোচনা, ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া, রিভিউ প্রদান এবং গল্পের চরিত্র-দৃশ্য নিয়ে পোস্ট করতে জয়েন করুন আমাদের গল্প সংক্রান্ত গ্রুপে।
গ্রুপ লিংক 🍁
https://www.facebook.com/groups/499389245208190/?ref=share