ভালোবাসার_ফোড়ন_২ #মিমি_মুসকান #পর্ব_১৬

0
384

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৬

নিচে আসার পর’ই মিতু আপু আর মুন্নি আপুর কিছু কথাবার্তা কানে এলো আমার। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছি! মুন্নি আপু বলছে,

“কি দরকার ছিল এতো আদিখ্যেতা করার। আমরা নিজেরাই তো কতো কষ্ট করে চলি!

মিতু আপু বলল,
“তুই কি বলছিস এসব!

“বুঝতে পারছো না নাকি, এতো দরদ কিসের তোমার নিহা’র ওপর।

“বাচ্চা একটা মেয়ে, তুই এভাবে কেন বলছিস।

“এভাবেই বলবো। আমার খাবারে নজর দেয় কেন?

“নজর কোথায় দিল। তুই কি পুরোটা খাবি নাকি।

“হ্যাঁ পুরোটাই খাবো, পুরোটাই নিজে খাওয়ার জন্য কিনেছি। এতো দান দরদি করতে পারবো না।

“আজব তো এভাবে কেন বলছিস। একটু পর’ই চলে আসবে ও।

“আসুক আর শুনুক! অন্যের থেকে নিয়ে খেতে পারবে শুনতে পারবে না নাকি। শুধু সুবিধা খোঁজে কিভাবে অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়া যায়। এদের কাজ’ই হলো পরগাছার মতো অন্যের টা খেয়ে বেঁচে থাকা। সবসময় অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়ার চিন্তা ভাবনা। নিজের তো মুরদ নেই আবার আসছে!

“ও কি প্রতিদিন খায় নাকি!

“একদিন দিলেই প্রতিদিন খেতে চাইবে বুঝলে তুমি!

“মুন্নি অনেক হয়েছে চুপ কর তুই! সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না।

“কি বললে তুমি, বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমাকে কথা শুনাচ্ছো তুমি!

“হ্যাঁ বলছি, আর শুনতে না চাইলে নিজের খাবার নিজে খা!

“কেমন নির্লজ্জ মেয়ে একটা! এমন মেয়ে কখনো দেখি নি আমি।

“মুন্নি চুপ করতে বলছি!

“পারবো না গো আপু চুপ করতে, কষ্ট করে কাজ করে খাই। এর ভাগ অন্যকে দিতে গেলে আমার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। আর এতোই যখন খাওয়ার শখ নিজে কিনে খেতে পারে না নাকি। কাজ তো ঠিক করে, টাকাও তো পায়।

“এত যদি হিসেব করে চলতে চাস তাহলে নিজের রান্না এরপর থেকে তুইই করে নিস। আমি আর পারবো না তোর রান্না করতে!

“তুমি তো দেখছি…
অতঃপর চুপ হয়ে গেল। কারন আমি ঘরে এসে পড়েছি তাই সে চুপ হয়ে গেল। মুন্নি আপু ভাতের থালা নিয়ে খাটের উপর উঠে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল বেশ রেগে আছে আমার উপর। আমাকে সহ্য করতে পারতো না সে আমি জানতাম। কিন্তু এতোটা এটা জানতাম না।

মিতু আপু আমাকে ভাতের থালা টা দিয়ে বলল,

“কখন তো গেলি আসতে কি এতো সময় লাগে নাকি, ভাত তো ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে যাচ্ছে!

“আপু আমি খাবো না!

“কি বললি খাবি না কেনো?

“আমার ভাত গুলোতে পানি দিয়েছি সেই দুপুরে এখন না খেলে নষ্ট হয়ে যাবে। সেগুলো’ই খাবো আমি!

“ওহ। আচ্ছা তাহলে একটু চিংড়ি ভর্তা নে, তুই তো তখন খেতে চাইলি!

আমি মুচকি হেসে বলি,
“না গো আপু, যেটার সামর্থ্য নেই তা না খাওয়াই ভালো আমার জন্য!

আমার কথা শুনে আপু চুপ হয়ে আমরা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটা মলিন, হয়তো ভাবছে আমি তাদের সব কথা শুনেছি। কিন্তু তার’ই বা কি করার। যদি মুন্নি আপু কথা গুলো তো সত্যি’ই ছিল। মুন্নি আপুর দিকে তাকালাম। সে নিজের মনেই খেয়ে চলেছে।‌ মনে মনে হয়তো খুশি কারন তার ভাগের খাবার আমি খাই নি!
আমি হেসে পাতিল থেকে ভাত নিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। দুপুরে আলু ভাজি দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। সেই আলু ভাজি এখনো আছে কিছু। আমি সেগুলোই দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। মুন্নি আপুর প্রতিটা কথা কানে বাজছিল আমার। খাবার জন্য এমন খোঁটা শুনবো কখনো ভাবি নি। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ভাতের থালায়। আমি দ্রুত চোখ মুছে তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নিলাম।
.
প্রতিদিন’ই ভার্সিটিতে যাচ্ছি, যদিও অনেক ভয়ে ভয়ে থাকি সারাটিক্ষণ! কখন যে নিতি এসে বোমা ফাটাবে জানি না! এই ভয়ে আহিয়ান, আকাশ ওদের কারো সাথেই কোন কথা বলি না আমি। যা হয়েছে অনেক হয়েছে। আমাকে এই ভার্সিটিতে’ই পড়তে হবে। উল্টা পাল্টা কিছু হয়ে গেল তখন কিছু করার থাকবে না আমার। পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে যাবে। এতো বড় রিস্ক নিতে রাজি না আমি।

দেখতে দেখতে পরিক্ষার দিন এগিয়ে আসছে।‌ পড়ছি তো মন দিয়েই কিন্তু সেই সাথে টাকাও জোগাড় করতে হবে। টাকাটা অবশ্য জোগাড় করেই রেখেছি! আজ সেটা জমা দিতে হবে।

সকালে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে! ব্যাগ টা শক্ত করে ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কারন হলো আমার ব্যাগে টাকা। জানি বেশি টাকা না কিন্তু আমার কাছে আজ সেটা লাখ টাকার সমান! এটা খুব কষ্ট করে রোজগার করে জমিয়েছি! কথায় আছে”টাকাই সব”! ব্যাপারটা নিজে একা থাকার পর খুব ভালো ভাবে বুঝেছি!

ভার্সিটিতে এসে ইতি কে খুঁজছি! হঠাৎ করেই ধাক্কা খেলাম কারো সঙ্গে! আমার ব্যাগ টা হাত থেকে পড়ে গেল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো নিতি কিন্তু না এটা অন্য মেয়ে ছিল। মেয়েটা আমাকে সরি বলে ব্যাগ টা উঠিয়ে দিল।

অতঃপর কাউন্টারে চলে গেলাম টাকা জমা দিতে। সেখানেই এসেই আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম, ব্যাগে কোন টাকা নেই!এটা কি করে হতে পারে। টাকা তো আমি ব্যাগেই জমা রেখেছিলাম। কোথায় গেলো টাকা।

আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। পুরো শরীর কাঁপছে! টাকা না পেলে পরিক্ষা দিতে পারবো না আমি। টাকা গুলো যে খুব দরকার আমার। আমি দৌড়ে বার হয়ে আবারো সেই রাস্তায় হাঁটা। আশা একটাই যদি টাকা গুলো ফেরত পাই।‌ কিন্তু পেলাম না!

যেখানে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছিলাম আবারো সেখানেই এলাম। অনেক খুঁজলাম কিন্তু টাকা পেলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছে এখন আমার। দিনের পর দিন এতো কষ্ট করে জমানো টাকা এভাবে কোথায় হারিয়ে গেল। কি হবে এখন! পরিক্ষা কি করে দেবো আমি!

ক্যাম্পাসে এসে বসে রইলাম! খুব কান্না পাচ্ছে এখন। জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই মনে হলো পাশে কেউ বসল। আমি ‌পাশে তাকাতেই চমকে গেলাম! নিতি হেসে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর মুখের হাসি আমার শরীরে যেন কাটার মতো বিঁধছে। কিছু আছে এই হাসির মাঝে। আমাকে উপহাস করছে সে।

খেয়াল করলাম টিনা আর আনিকাও এসে পাশে দাঁড়াল। হঠাৎ টিনা বলে উঠে,
“কি ব্যাপার নিহা! এখানে বসে আছো যে!

আনিকা বলে উঠে,
“মন খারাপ নাকি!

নিতি বলে উঠে,
“কিছু কি হারিয়ে গেছে!

নিতি’র কথায় দ্বিতীয় বারের মতো চমকে উঠলাম! কেন জানি মনে হচ্ছে টাকা টা হয়তো নিতি’ই নিয়েছে। টিনা বলে উঠে,

“কি হারাবে তুই কিসের কথা বলছিস!

নিতি হেসে বলল,
“না মানে দেখে মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে গেছে তাই মন খারাপ করে বসে আছে। তাই নাকি নিহা!

আমি তাদের কথার কোন উত্তর দিলাম না। মাথা নিচু করে রইলাম। নিতি আমার কানের কাছে চুল গুলো গুঁজে দিয়ে বলতে লাগলো,

“প্রথমেই বলেছিলাম নিজের যোগ্যতার মাঝে‌ থাকো কিন্তু তুমি শুনলে না। এখন যখন কথা শুনো নি তাহলে ফল তো ভোগ করতেই হবে!

আমার চোখ ভরে উঠছিল। নিতি হেসে আমার গাল দুটো চেপে ধরে বলে,
“আমাকে দিয়ে সরি বলানো না! নিতি কে দিয়ে, এতোই কি সোজা নাকি। কি ভেবেছো আমি চুপ হয়ে থাকবো কিছু বলবো না। ( অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে ) তুমি ভাবতেও পারছো না আমি কি কি করতে পারি!

নিতি’র কথা শুনে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। আনিকা হেসে উঠে বলল,

“ইশ বেচারা কষ্ট পাচ্ছে নিতি এভাবে বলিস না।

“ওর কষ্ট তো এখন শুরু! আমার আহি’র দিকে হাত বাড়িয়েছে ও। এতো সহজে কি ছেড়ে দেবো নাকি।

আমি কিছু বলতে যাবো নিতি উঠে গিয়ে বলল,
“আমার মাঝে সিমপ্যাথি’র আশা করো না। এটা আহি কে মানায় আমায় না। তোমার মতো মেয়ে শুধু পারো ছেলেদের মন গলাতে। আর টাকা হাতাতে। খুব ভালো করে আমি চিনি তোমাদের!

টিনা মুখ বিকৃত করে বলে,
“উফফ এসব মেয়ে আমাদের ভার্সিটিতে কেন আসে বুঝি না।

আমি উঠে চলে যেতে নিলাম। তখন আনিকা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“যে যেখানে তাকে সেখানেই মানায়।‌ তোমার মতো মেয়ে মাটিতে থাকার কথা। সেখানেই থাকো না শুধু শুধু আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখলে তো ধপাস করে তো পড়তেই হবে!

বলেই তারা হেসে চলে গেল। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারা ওই মেয়েটা, যার সাথে আমি ধাক্কা খেলাম সেই মেয়ের সাথে হাইফাই দিচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছিল তখন আমার। সব ভুলটাই আমার। একদম উচিত হয় নি সেদিন আহিয়ানের সাথে ভার্সিটিতে আসা। কেন এলাম আমি সেদিন কেন? যদি জানতাম নিতি কে দিয়ে সরি বলাবে তাহলে আমি কখনোই আসতাম না।

রাগে ক্ষোভে কাঁদতে কাঁদতে বের হচ্ছিলাম ভার্সিটি
থেকে। গেটের সামনে এসেই দেখা হলো ইতি’র সাথে। আমাকে কাঁদতে দেখে ছুটে এলো সে। তার পিছু পিছু আহিয়ান, আকাশ ভাইয়া তারা সবাই আসছিল। আমাকে কাঁদতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। ইতি এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“কি হয়েছে নিহা! কাদছিস কেন?

আমি চোখ মুছে বললাম,
“কিছু না!

“কিছু না হলে কাঁদছিলি কেন?

আমি আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তেমন কিছু না শুধু নিজের কাজের পরিণতি পেলাম।
বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম!

ইতি পেছন থেকে ডাকছিল কিন্তু আমার কোন ইচ্ছে ছিল না ওর সাথে কথা বলার। আকাশে মেঘ জমেছে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। দমকা হাওয়ায় বইছে! গেট দিয়ে বের হতে যাবো হুট করেই কেউ আমার হাত ধরল। আমি থমকে গেলাম। চিনতে কষ্ট হলো না এটা আহিয়ান। আমি তবুও তাকিয়ে দেখলাম এটা আহিয়ান। তাকে দেখেই বেশ রাগ উঠছিল আমার। শুধু মনে হচ্ছিল যা হয়েছে সব কিছু উনার কারনেই হয়েছে। কঠিন গলায় বললাম,

“হাত ছাড়ুন আমার!

উনি শান্ত ভাবেই বললেন,
“কি হয়েছে!

“আপনি আমার হাত ছাড়ুন!

“আগে কি হয়েছে সেটা বলো, নিতি আবার কিছু বলেছে তোমাকে!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম। চোখের পানি মুছে বলে উঠি,

“হুম বলেছে, অনেক কিছু বলেছে, তো! এখন আপনি কি করবেন? আবারো যাবেন আর তাকে বললেন সরি বলতে। আচ্ছা আপনার কি কোন ধারনা আছে আপনার এই বোকামির কারনে আমাকে কতোটা সাফার করতে হয়। আমি কেন আসেন বলুন তো আমার জীবনে। আপনি কেন বুঝতে পারেন না আমার জীবনে যতটা উলোটপালোট হয় তা আপনার কারনেই হয়।‌ আপনি দায়ী হন আমার জীবনটা তোলপাড় করার জন্য। কে বলেছিল আপনাকে সেদিন নিতি আপু কে দিয়ে সরি বলানোর জন্য।‌ বলেছিলাম আমি একবারও। আমার কোন দরকার নেই এসবের। আমি যেমন আছি ঠিক আছি। দরকার নেই কারো দয়ার, কারো অনুগ্রহের। একা চলতে পারি আমি। দয়া করে আমার জন্য আর কিছু করবেন না আপনি, কিছু না। আমার জীবন আমি ঠিক দেখে নিতে পারবো!

বলেই বের হয়ে চলে এলাম। কথাগুলো আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে’ই বলেছিলাম। দেখলাম উনি বেশ শান্ত ভাবেই আমার কথা গুলো শুনছিল।
না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আকাশে মেঘ গর্জন করছে এখনি শুরু হবে বৃষ্টি।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝড়তে লাগল। আমি কাঁদছি আর বৃষ্টিতে ভিজছি। বোকার মতো বার বার চোখের পানি মুছছি! একদম কাকভেজা আমি কিন্তু তবুও বৃষ্টি থেকে পালানোর কোন চেষ্টা করছিলাম না। ভিজেছিলাম,‌শুধু ভিজেছিলাম।‌

ভিজতে ভিজতে চলে এলাম পার্কে! কেউ নেই পার্কে, বৃষ্টির কারনে সবাই চলে গেছে। আমি বৃষ্টির মাঝে এসে বেঞ্চে হাঁটু গেঁড়ে বসে রইলাম আর কাঁদতে লাগলাম। যতক্ষন বৃষ্টি ছিল ততক্ষণ’ই কাঁদছিলাম। অতঃপর বৃষ্টি থামার পর থম বেড়ে বসে রইলাম!

স্থির হয়ে বসে ছিলাম, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর’ই বাতাসের কারনে শরীর শিউরে উঠছে,‌কাপছে! চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে! তবুও বসে ছিলাম।

হঠাৎ মনে হলো ইতি’র গলার আওয়াজ পেলাম। ঝাপসা ঝাপসা চোখে সামনে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ইতি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি তাকে দেখা মাত্রই ঢলে পড়লাম তার দিকে। অতঃপর আর কিছু মনে নেই আমার!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here