খোলা_জানালার_দক্ষিণে #পর্ব_০৯ #লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

0
345

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অভিমান যেন শরীরের শিরায়-উপশিরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনের আলো বিদায় নিয়ে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে কিছু একটা করছিল। রাতে খাবে না বলে দিয়েছে সে। মেয়ের অভিমানের ভাষা বুঝতে বাবার মন এতটুকু সময় নিল না। পরিস্থিতি আমাদের এমন বানিয়ে দেয়। যে-সময় টাতে নিজের মেয়ের থেকে, অন্যের মেয়েকে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। কাল কেও সে নিরুপায় ছিল। মেয়ের ভালোর স্বার্থে মেয়েকে দমিয়ে রাখতে হয়েছে। বাবাদের অল্পতে মাথা গরম করতে নেই। তাদের প্রতিটি কথা বলার পেছনে একটি করে দায়িত্ব থাকে। তাই তাদের এক একটা কথা হিসাব করে বলতে হয়। বাবারা হুটহাট রাগ করতে জানে না। কিন্তু আগলে রাখার ব্যাপারে তাদের তুলনা হয় না৷ ফরিদ রহমান মেহেভীনের কক্ষে আসলো। মেয়ের পাশে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

–অভিমান তো আমার করার কথা! তুই আমার সম্মানের কথা না ভেবে পালিয়েছিস। আবার বিয়েও করেছিস। বাবা-মায়ের কথা একটা বার ভাবলি না। আমাদের সাথে যোগাযোগ না করে, তুই মস্ত বড়ো অন্যায় করেছিস। আমি প্রাপ্তিকে দোষ দিব না। আমি মনে করি দোষ টা তোর। তুই নিজের বাবা-মায়ের থেকে চাচাতো বোনকে বেশি বিশ্বাস করেছিস। আজ আমার সাথে এমন করছিস তো। একদিন ঠিক বুঝবি বাবা কি জিনিস। আমি যদি একবার চোখ বন্ধ করি। তাহলে এখানে একটা দিন টিকতে পারবি না। দেখতে পাবি চেনা মানুষের অচেনা রুপ। সেসব সহ্য করতে পারবি না। তোর পছন্দের চিংড়ি মাছ নিয়ে আসছি। তুই খাসনি বলে আমরা সবাই না খেয়ে বসে আছি। তুই কি চাস আমি না খেয়ে নিদ্রা চলে যাই। বাবার কথায় বুকটা ভারি হয়ে এল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। বাবা থাকবে না কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা নামক বৃক্ষের ছায়া মাথার ওপরে থেকে সরে গেলে, মাথার ওপরের উত্তপ্ত সূর্য খানা সোজা মাথার মগজে এসে অবস্থা করবে। সে কি ব্যথা অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করার মতো নয়। কথা গুলো কল্পনা করলেই সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলে যায়। দেখতে সাতদিন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিতে গাড়ি আসছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা দিগুণ ভাবে বেড়ে চলেছে। মেহেভীনের মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফরিদ রহমান মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিল। মেহেভীন মুগ্ধ নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সত্যি বাবা চরিত্র টা অতুলনীয়। বাবার ব্যাখ্যা করতে গেলে শুরু হবে। কিন্তু শেষ হবে না। এতটাই সুন্দর বাবা নামক বটগাছের ছায়া। মেহেভীন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাইমা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। রুপা আগেই বাসায় চলে আসছে। সকাল থেকে পুরো বাসা পরিষ্কার-পরিছন্ন করেছে সে। মেহেভীন একটু খুঁত খুঁতে ধরনের মেয়ে। তার সবকিছু পরিষ্কার চাই। রুপা সবে মাত্র বসেছিল। তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠলো। এই বুঝি আপা চলে এসেছে। কতদিন পর সে আপাকে দেখবে। মেহেভীনকে না দেখলে রুপার মনের গহীনে অজানা বিষাদ এসে ধরা দেয়। দরজা খুলে মেহেভীনকে দেখে, আবেগে উৎফুল্ল হয়ে পরে রুপা। মেহেভীনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে। রুপার পাগলামি দেখে মেহেভীন হেসে দিল।

–রুপা এবার ছাড় বাহিরে থেকে এসেছি। রাস্তায় কত ধুলাবালির ছিল। আমাকে এখন স্পর্শ করিস না।

–আপা আমার এসবে অভ্যাস আছে। আমার আপনাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। আমার আপনি ছাড়া কে আছে বলেন। আমার পুরো ধরণীটাই হচ্ছে আপনি। আমার এক টুকরো আবেগ আপনি। আমার সুখ, শান্তি, ভালো থাকা, আমার আহ্লাদ করা, আমার শখ পূরন করে দেওয়া, আমার সবকিছু শুধু আপনাকে ঘিরে। এত ভালোবাসা পাওয়ার পরে ভালোবাসার মানুষ টিকে ছাড়া থাকা ভিষণ দুষ্কর আপা। হাসোজ্জল মুখশ্রী খানা মুহুর্তের মধ্যে মলিনতায় ছেয়ে গেল। বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল চঞ্চল হৃদয়। সমস্ত আঁধার ঘনিয়ে ধরলো মেতে ওঠা মস্তিষ্কের আনন্দ গুলোকে। মেহেভীন রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,

–এই যে বিষাদ রাণী! আপনি মাঝে মাঝে বিষাদের শহরে হারিয়ে যান। মনকে এত বিষাদগ্রস্ত করে তুলছেন কেন? আমি কি বিষাদিত হবার মতো কোনো কাজ করেছি। মা অনেক খাবার পাঠিয়েছে। সেগুলো বের কর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মেহেভীন। মা শব্দটা অতি আবেগের মা শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। যে ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। যার মা নেই সে বুঝে ধরনীর বুকে টিকে থাকার কতটা কঠিন। রুপা যেন মেহেভীনের মায়ের রান্না করা খাবারে, নিজের মায়ের ভালোবাসার স্বাদ খুঁজে পেল। এই রান্নার মধ্যে মেয়ের জন্য মায়ের কত ভালোবাসা আছে। ভাবতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত তাহলে তাকে-ও এভাবে রান্না করে খাওয়াত। রুপার আঁখিযুগল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তখনই একটা হাত তার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার ধরল। রুপার তড়িঘড়ি করে অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মেহেভীনকে দেখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করল।

–তোর আপা আছে না। তোর আপা থাকতে তোকে একদম কষ্ট পেতে দিবে না। আমার ভুল হয়েছে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমি একটু ভয়ে ছিলাম। তাই তোকে রেখে গিয়েছিলাম। এরপরে যখন যাব। তখন তোকে নিয়ে যাব। জানি মায়ের কথা স্মরণ করে কষ্ট পাচ্ছিস। আর কয়দিন পরে আমার মা আমার কাছে আসবে। আমার মা অনেক ভালো জানিস। আমার মাকে নিজের মা মনে করবি। আমার অনেক কাজ আছে। কয়টা দিন অনেক ব্যস্ত থাকব। তোকে বলেছিলাম না। বেআইনি ভাবে জমি নিজের নামে নিতে চাইছে। শুধু মাত্র আমার একটা সাইনের জন্য পারছে না। সে আমার ওপরে খুব রাগান্বিত হয়ে আছে বুঝছিস। যেকোনো সময় ক্ষতি করে দিতে পারে। বাসা থেকে একা একা বের হবি না। কিছু লাগলে দারোয়ানকে বলবি। কাউকে না পেলে আমাকে কল দিবি। আমি আসার সময় নিয়ে আসব। আর বেশি কথা বলিস না। চুপচাপ খেয়ে নে আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। মেহেভীন নিজে একবার খাচ্ছে। আরেকটা রুপাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এজন্য মেহেভীনকে রুপা এতটা ভালোবাসে। মেয়েটা এতটা দায়িত্ববান আর যত্নশীল যা দেখে রুপা প্রতিবারই মুগ্ধ হয়। মানুষটার প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই মানুষটা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাহলে কিভাবে সমাজের বুকে সাহস নিয়ে বেঁচে থাকবে। সবাই তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য শেয়াল কুকুরের মতো অত পেতে থাকবে।

মেহেভীন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। তখনই রুপা এসে জানান দিল। জুনায়েদ খান এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। এই লোকটা বাসা পর্যন্ত চলে আসছে। মেহেভীন ভদ্রতা সুলভ রুপাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল। রুপা চা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের নাস্তা নিয়ে এসে সামনে হাজির হলো। জুনায়েদ খান বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলল,

–আমার কথা কি ভুলে গিয়েছেন ম্যাডাম। কতদিন ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সাতটা দিন পাগলের মতো অফিসে গিয়ে আপনাকে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি এভাবে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?

–আমি কোথায় যাব না যাব। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় এটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে যেতে হবে না। আপনি এখানে কি কাজে আসছেন। সেই আলোচনায় আসা যাক।

–আমার বেশি কিছু চাই না ম্যাডাম। আপনি শুধু দলিল টাই সাইন করে দিবেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ম্যাডাম। আপনি সাইন করে দিলে, আপনিও মুক্ত আর আমিও খুশি।

–দেখুন জুনায়েদ আমি আপনাকে আগেও বলেছি। আজকে আবারও বলছি। আপনি যেটা চাইছেন। সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি মেহেভীন কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি। আর এই দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় করব ও না। এটা সব সময় মাথায় রাখবেন। আপনি এবার আমার সামনে থেকে চলে যেতে পারেন।

–আমি জানতাম সোজা কথা শোনার মতো মানুষ আপনি না। তাই আমি আপনাকে রাজি করানোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে আসছি। যেটা দেখলেই আপনার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যাবে। আর বুদ্ধিমানের মতো আপনি সাইন করে দিবেন। কথাগুলো বলে বিলম্ব করল না জুনায়েদ খান। সে একটা টাকার ব্যাগ রাখল মেহেভীনের সামনে। টাকা গুলো দেখে মেহেভীন ক্রোধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। জুনায়েদ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,

–এবার নিশ্চয়ই আপনার কোনো আপত্তি নেই। এখানে একদম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আছে। আপনি যদি চান। তাহলে আপনাকে আরো টাকা দিতে রাজি আছি। আপনি শুধু সাইনটা করে দিন ম্যাডাম। আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

–খোঁজ নিয়ে জেনেছি। আপনার অর্থসম্পদের অভাব নেই। এত অর্থ সম্পদ থাকার পরেও অন্যের জিনিসের প্রতি এত লোভ লালসা কেন? আমাকে জবাব দিন জুনায়েদ খান। সুস্থ অবস্থায় যদি থাকতে চান। তাহলে এখনই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনি পঞ্চাশ লক্ষ কেন পঞ্চম কোটি টাকা দিলেও আমি সাইন করব না। এখনই যদি আমার সামনে থেকে চলে না যান। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে জুনায়েদ খান মেহভীনের পা জড়িয়ে ধরল। সাইন করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। মন গলল না মেহেভীনের সে দারোয়ানকে ডেকে জুনায়েদকে বাসা থেকে বের করে দিল।

চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। জুনায়েদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা তার খাঁ খাঁ করছে। মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ জমেছে মনে। সে মেহেভীনের শেষ দেখে ছাড়বে। কাউকে একটা কল দিয়ে কিছু একটা বলল জুনায়েদ। ওপর পাশ থেকে হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল চারপাশ।

মেহেভীনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা যুবক। চোখে তার শত জনমের ব্যথা। বুকে জমে আছে টুকরো হয়ে যাওয়া হাজারো স্বপ্ন। এলোমেলো কেশগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ে চলেছে। ফুলের মতো চেহারাটা আজ নেশায় জর্জরিত হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে সব সময় হিংস্রতার প্রকাশ পায়। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আছে। মনটা ভালো নেই। যে মানুষ গুলো মনে থাকে, সেই মানুষ গুলোই মনে আঘাত করে। যুবকটি মেহেভীনের ছবির দিকে হিংস্র নয়নে তাকিয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যুবকের। সে ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

–তোমার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে, আমি যেমন জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে যাচ্ছি মেহেভীন। ঠিক এমন করেই তোমার জীবনটা আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিব মেহেভীন। আমার আঁখিযুগলের দিকে কখনো চেয়েছ? যদি চাইতে তাহলে দেখতে এই চোখ কতটা তৃষ্ণা জমে আছে। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা। তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি কতটা আকুল হয়ে থাকতাম। একটু দেখার জন্য কতটা ছটফট করতাম। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে বানিয়েছ চরিত্রহীন। আদরের ছেলেটাকে হতে হয়েছে বাড়ি ছাড়া। আমার প্রতিটি কষ্টের প্রতিশোধ আমি নিব মেহেভীন। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলব। তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আসছি।

চলবে…..

পরের পর্বটি সবার আগে পড়তে পেইজটি ফলো করে সাথে থাকুন👉 গল্পের ভান্ডার

আরো সুন্দর সুন্দর গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হতে ভুলবেন না👉 লেখক-লেখিকার গল্পের ভান্ডার�

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here