এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_২৩

0
302

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২৩

রাত্রি নয়টা। খাবার ঘরে পরিবেশনের সময় আজ স্ত্রীকে দেখে নি মাহাদ। সারাদিন অফিসে পার করে বাড়ি ফিরবার পর যেটুকু সময় সে পায়, সেটুকুর পুরোটাই প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে সে। অফিস থেকে ফিরে প্রথম শরবতের গ্লাস হাতে একঝলক দেখা দেয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোবার পূর্ব পর্যন্ত ওর সঙ্গ পেতে চায় ব্যাকুল মন। রোজকার নিয়মে তাইই হয়। প্রতিটা মুহূর্তে অনু পাশে থাকে বটে, তবে আজ কেন যেন ব্যতিক্রম হয়েছে! আর অনুর দেখা পায় নি সে। এক লহমার জন্যও নয়! তবে মা – ভাবির কাছ থেকে শুনেছে অনেক অনেক কিছু! সকালের ঘটনা থেকে বিগত দিনগুলোর অনেক কিছুই সেসবের মধ্যে ছিল!
অন্ধকার ঘরে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে অনু। জানুয়ারির রাতের শীতালু বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বাইরে কুয়াশা। অনু উদাস চোখে চেয়ে আছে সেদিকে। হঠাৎ অনুভব করলো দু’টি বরফ ঠাণ্ডা হাত পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে, নির্মেদ কোমড়ে বিচরণ চলছে এলোমেলো। উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে কাঁধে। ক্ষণিকের জন্য শিউরে উঠলেও স্বামীকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওর। নিজের দুহাত দিয়ে হাত আটকে দিলো মাহাদের। চট করে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। চোখ রাখলো চোখে। মাহাদ কোমল সুরে বললো,
— “কি হয়েছে অনু? এতক্ষণ ছিলে না কেন ঘরে?”
কি ছিল ওর কণ্ঠে? জাদুর ছোঁয়া? অনু আহ্লাদে গলে গেল যেন। অন্যদিকে ফিরে অভিমানী সুর তুললো,
— “আমার খেয়াল এ-বাড়ির কয়জন রাখে? যে যাবো?”
মাহাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এভাবে বলছ কেন? কিছু হয়েছে?”
— “ন্যাকামো করো না। এ-বাড়ির লোকজনের যা স্বভাব! ওরা এতক্ষণে তোমায় কিছু না বলে আছে?”
কপট রাগ দেখালো অনু। বাহুডোর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালালো। মাহাদ ছাড়লো না। শক্ত-পোক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নিলো ওকে। সারাদিন এতো ঝক্কি পোহানোর পর বাড়ি ফিরে এসব ঝামেলা তার ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে। এখন রেগে কিছু বললে কথা কাটাকাটি হবে। অশান্তি বাড়বে। তাই শান্ত হয়ে বললো,
— “শুনেছি আমি। কিন্তু সেটা এক পাক্ষিক। বিচার তো এভাবে হবে না। তোমার পক্ষের কথাও তো শোনা উচিৎ। ঠাণ্ডা মাথায় বলো?”
অনু সরে যেতে যেতে বললো,
— “থাক। শুনতে হবে না। যা জেনেছ, তাই নিয়েই থাকো। আমি নতুন করে কিছু বলবো না।”
— “কেন?”
বড্ডো করুণ শোনাল। অনুর একরোখা উত্তর,
— “এমনিই। তোমার বিচার করার প্রয়োজন, তুমি একপক্ষ শুনেই করো। আমি কিছু বলতে চাই না।”
মেয়েটা রেগে আছে। বোঝা যাচ্ছে। মাহাদ উদাস হয়ে কি যেন ভাবলো। সংসার মানেই কি এতো ঝুট-ঝামেলা? সে তো ভেবেছিল, সংসার মানে অনেক ভালো কিছু। স্বামী-স্ত্রীতে মিলেমিশে থাকা। যাদের মধ্যে প্রেম থাকে, একে – অপরকে বুঝবার ক্ষমতা থাকে, বিশ্বাস থাকে— সবচেয়ে বড় কথা ভালবাসা থাকে!
কিছু সময় পর মুখ খুললো সে। আশ্চর্য শীতল সুরে বললো,
— “যা যা শুনেছি, তাই যদি আসল ঘটনা হয়; তবে তোমাকে আমি সাপোর্ট করতে পারি না অনু। সংসার কখনো একার চেষ্টায় সুন্দর হয় না। সবাই মিলেমিশে থাকলে, একত্রে চেষ্টা করলে, তবেই একটা সুন্দর জীবন হয়। আনন্দপূর্ণ জীবন হয়। এখানে কেউ তোমার পর নয়। সবাই আপন। তুমি যেমন আমার কাছে প্রিয়, এরাও আমার তেমনই প্রিয়। আর আমাকে বিয়ে করে তুমি এই মানুষগুলোকে নিজের আপন হিসেবে পেয়েছ। তাদের হাসিমুখে গ্রহণ করো। কোনো মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নেই। সবাই ছোটখাটো দোষ আছে। সেগুলো নিয়ে দুঃখ পেয় না। একে-অন্যকে খুঁচিও না। আমি জানি তুমি একটু রাগী। কিন্তু সেটাকে সংবরণ করো। অশান্তি বাড়িও না। কাউকে অযথা হিংসে…”
বিদ্যুৎ বেগে ফিরে আসে অনুলেখা। চোখে একপলের জন্য ঝিলিক দিয়ে গেল রাগের ফুল্কি। মাহাদের মুখোমুখি এসে দাড়াল সে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
— “আমি হিংসা করি? আমি অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করি? এতবড় কথা তুমি বলতে পারলে? পারলে?”
মাহাদ সংগোপনে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
— “আমি সেভাবে বলি নি, অনু। ভুল বুঝ না। আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি—”
ওকে শেষ করতে দিলো না অনু। চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে,
— “কি বুঝাতে চেয়েছ তুমি? আমি বুঝি না? তোমরা সবাই একই রকম। নিজেদের ভুল ধরবে না! অন্যেরটা ধরে টানাটানি করবে। তোমাকে বিশ্বাস করে, তোমার উপর ভরসা করে, এই বাড়িতে এসেছি আমি। কোথায় তুমি আমার সাথ দেবে, না— বিয়ের আগে খুব দরদ দেখানো গিয়েছিল। এখন সেসব হাওয়া, না? বুঝি তো— বোকা না আমি। এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সস্তা পেয়েছ—”
ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। পেছনে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো মাহাদ। সে কি বলতে চেয়েছিল, আর কি হলো? আশ্চর্য!
____

সবে কেবিন থেকে বেরিয়েছে সৌভিক, পেছন থেকে নিখিলের গলা ভেসে এলো,
— “দোস্ত, দাড়া!”
ওর দাড়াবার ইচ্ছে ছিল না। উপেক্ষা করে চলে যাওয়াতেই মন ছিল।তবুও কি যেন ভেবে দাড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি সমস্যা?”
ত্বরিৎ পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসলো নিখিল। চট জলদি বললো,
— “তোর সঙ্গে কথা আছে আমার, চল!”
— “কোথায়? আর কেন?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওর কাঁধ চাপড়ে নিখিলের প্রত্যুত্তর,
— “ক্যান্টিনে। বললাম না, কথা আছে? চল!”
নিজের মতো বলেই পা বাড়ালো। সৌভিক ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো ওর দিকে। একটু এগিয়ে নিখিল যখন ফিরে তাকালো, তখন বললো,
— “আমার কাজ আছে। সময় নেই। আমি যাব না।”
কণ্ঠে তিক্ততা মিশে। নিখিল ততোধিক শান্ত সুরে বললো,
— “পাক্কা আধ ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক, সৌভিক! আই থিঙ্ক ইট’স এনাফ। আর তোর কোনো কাজ নেই। এমনিও আজ হাফ ডে নিয়েছিস। জানি আমি!”
সৌভিক এবার একটু রাগই হলো। ওর সব ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে কেন? কীসের এতো খবরদারি নিখিলের? বাঁকা চোখে তাকালো,
— “নজরদারি করছিস?”
নিখিল হাসলো,
— “সেটা করতে যাবো কেন? কারো উপর নজরদারি করার অভ্যাস আমার নেই। হাফ ডে নেয়ার বদৌলতে তোর বাদবাকি কাজ আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। তাই জানি সব।”
সৌভিক কিছু বললো না আর। চুপ করে রইলো। নিখিল কিছুক্ষণ সময় দিলো ওকে। এগোতে এগোতে বললো,
— “ক্যাফে নির্ঝরে চল্। কফিতে সিপ দিতে দিতে আলাপটা সারছি!”

কফি এসে গেছে। ধোঁয়া ওঠা গনগনে গরম কাপে একের পর এক চুমুক বসিয়ে যাচ্ছে সৌভিক। নিশ্চল-নির্বিকারে। এক ফাঁকে আড়চোখে নিখিলকে দেখে নিলো। সেও নিশ্চুপ। কুচকুচে কালো আলকাতরা রঙের কফির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। সিপ তুলছে না, কিন্তু চেহারা গম্ভীর। সম্ভবত কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, নিক। সৌভিক বাঁধা দেবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিখিল মুখ না খুললে কিছু বলবে না। একটা বাক্য এমনকি শব্দও নয়!
কিয়ৎক্ষণ পর নিখিল কথা শুরু করলো। ফার্স্ট বলে উইকেট নেয়ার জন্য বলকে ঠিক যেভাবে হিট্ করা উচিৎ, সেভাবেই মোক্ষম কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো বন্ধুবরের উদ্দেশ্যে,
— “আই নৌ, চারু ইজ ইয়্যুর লাভ। বাট আনফরচুনেটলি, সে তোর হয় নি। তুই ওকে ভালোবাসিস, ব্যাপারটা সম্ভবত সে জানেও না। তাই না?”
চট করে মুখ তুলে তাকালো সৌভিক। কাপে পরবর্তী চুমুক বসাতে উদ্যত হওয়া ঠোঁট দু’টো ঝুলে গেল তৎক্ষণাৎ। বিস্ময়াহত চাউনিতে অনিমেষ চেয়ে রইলো ইয়ারি দোস্তের পানে।
নিখিল পুনর্বার হাসলো,
— “আমি জানি, তুই অবাক হচ্ছিস। এটা ভেবে যে যেকথা কেউ জানলো না আমি কি করে জানলাম? শোন, তোর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ত্ব। তাই তোর আচরণ কোন ক্ষেত্রে কেমন হতে পারে সেটা আমি জানি। চারুকে ভালোবাসিস বলেই ওকে নিয়ে তুই ওভার পজেসিভ। যেটা তোর অন্য বোনদের ক্ষেত্রে নেই। স্বভাবতই তুই মিশুক ছেলে, কেয়ারিং ম্যান। কিন্তু চারুর প্রতি তোর কেয়ারিং অনেক বেশি। ওর জন্য অনেক বেশি কনসার্ন তোর! সবই খেয়ালই করি—”
— “সবই যদি জেনে থাকিস তবে, ওর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালি কেন? কেন বন্ধুর ভালোবাসাকে নিজের দিকে টানতে গেলি?”
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সৌভিক। রাগে ওর শরীর জ্বলছে, দাউ দাউ অনলের ধারালো শিখা মন – মস্তিষ্কের ভেতর!
নিখিল রাগলো না। বরং ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো,
— “কারণটা খুব সহজ, সৌভিক। তুই ওকে ভালোবাসিস এ-কথা আমি জানতাম না। সেক্ষেত্রে আমার ফল করা কি দোষের? দেখ, চারু ইজ অ্যা ভেরি প্রীটি গার্ল। অভিয়াসলি অ্যাট্রাক্টিভ অ্যান্ড সুইট। আরেকটা ওয়ার্ড বলতে মন চাইছে, কিন্তু তুই ওর ভাই বলেই বলছি না। কটু শোনাবে। বাট বন্ধু হিসেবে…”
নিখিল দুষ্টু হাসলো। রাগ করলো সৌভিক,
— “আমাকে চেঁতাস না, প্লিজ! আমি জানি না কি করে ফেলবো!”
— “ওকে, ওকে। ক্ষেপে যাস না। দেখ, চারুর এতো এতো গুণ থাকার পর ওকে দেখে প্রেমে পড়ে যাওয়া কি অসম্ভব কিছু! এমনকি ভালোবেসে ফেলা? আমি ঠিক ভালোবেসেই ফেললাম। সঙ্গে বিয়ের পরিকল্পনাও চলে এলো মাথায়। তখন তোর ভাবনা মাথায় এলো। তুই ছেলে ভালো, তোদের ফ্যামিলি ভালো। বন্ধুর ছোট বোনকে প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ভেবেই তোকে বলতে গেলাম, আর তুই? তখনই আমি বুঝতে পারি, ব্যাপারে ঘাপলা আছে। তোর অনুভূতি আছে ওর প্রতি!”
— “কিন্তু—”
— “আমাকে কথাটা শেষ করতে দে?”
— “কর।”
নিখিল শ্বাস ফেলে পুনরায় শুরু করলো,
— “চারুর অক্ষমতা, বিশ্রী অতীত — এগুলো কোনটা নিয়েই আমার মাথা ব্যথা ছিল না, সৌভিক। আমি সবটা মেনে নিতে পারি, নিয়েছিও। এতে তোর সমস্যা হওয়ার কথা না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক চলছে। তুই সবই জানিস। কিন্তু সব জেনেও তুই এরকম কেন করছিস? শুধু ওকে ভালোবাসিস বলে? কিন্তু তুই তো এতদিন কিছু বলিস নি? তাহলে? নাকি তুই চাস, চারু সারাজীবন দুঃখী দুঃখী মুখ করে তোদের বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকুক? ভুলে যাক সমস্ত সুখ, স্বপ্ন-আহ্লাদ?”
— “বাজে বকবি না একদম। আমি এমনটা চাই না মোটেও!”
— “তবে তুই কি চাস?”
নিখিলের প্রচন্ড চিৎকারে কেঁপে উঠলো পুরো কফিশপটা। উঁচু গলার স্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে বারবার কানে বাজতে লাগলো সৌভিকের। আশেপাশে চেয়ে দেখল, সকলেই হতভম্ব চোখে দেখছে ওদের!
নিখিল নিঃশ্বাস ফেললো। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে হঠাৎ। সত্যিই সে ওকে বুঝতে পারছে না। কি চায়, সৌভিক? কি চায়?
একটুপর সৌভিক বললো,
— “আমি তখন সদ্য ভার্সিটিতে যাই। সারাজীবনের বেড়ে ওঠা প্রিয় বাড়ি, প্রিয় আঙিনা ছেড়ে হলে উঠেছি। অবাধ স্বাধীনতা আমার দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে। আশেপাশের রঙিন পৃথিবী দেখছি। মনটা উড়ু উড়ু করছে। নতুন জগৎটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো। মনে হলো, ইসস, এত্ত সুন্দর সবকিছু! কিন্তু প্রায় মাসখানেক থাকবার পর এই রঙিন দুনিয়াটা হঠাৎ করেই আমার ভীষণ অসহ্য ঠেকলো। আমি ধীরে ধীরে অনুধাবন করলাম, এখানে আমার মন টিকছে না। যান্ত্রিক শহরের চাকচিক্য, পশ লাইফ স্টাইল — আমায় ক্ষণিকের জন্য আকর্ষণ করেছিল। আমার মন এখানে ভালো নেই। শূণ্য বুক জুড়ে আমার হাহাকার। কেননা এখানে ভালোবাসা নেই!
আমি ফিরতে চাইলাম, কিন্তু ফেরা হলো না! যে পাখি পিঞ্জর ছাড়ে একবার, তার যে আর ফেরা হয় না!
সেবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সেখানককার সবকিছুকেই আমার খুব ভালো লাগলো। মা-বাবা, চাচা-চাচী, ভাইবোন — সবাইকেই। আর বিশেষ করে ভালো লাগলো কাকে, জানিস? চারু! ভার্সিটিতে আমার অনেক অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল; তুই জানিস সেটা। কিন্তু তাদের কাউকেই আমার ভালো লাগতো না। কারণ চারু। ওর মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, নম্র-ভদ্র মেয়েকে ছেড়ে অন্যদের কেন ভালো লাগবে? ওর প্রতি অনুভুতির শুরু আমার ঠিক কখন থেকে, আমি জানি না। তবে সেবার ঈদের ছুটিতে গিয়েই আমি টের পাই আমার ভালোবাসা চারু।
আমি গোপনে গোপনে ভালোবাসতে থাকি। চারুকে প্রাণভরে দেখি, মনে মনে কতশত কল্পনা করি! এসব কিছুই ওকে বলি নি। পাছে অবজ্ঞা করে দূরে থেকে দেয়? আমি অপেক্ষা করি সময়ের। যেদিন চাকরী পাবো, সেদিন বড় আব্বাকে বলবো। তার মেয়ের হাত চাইবো…”
এ পর্যায়ে নিখিল মৃদু কণ্ঠে শুধালো,
— “তবে করলি না কেন?”
— “সুযোগ হয় নি।
— “মাস্টার্সের ছাত্র আমি তখন। ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা। কিন্তু কি যেন এক ঝামেলায় যাওয়া হলো না। কিছুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ফোনটা নষ্ট হয়েছিল। তার মাস খানেক পরেই সম্ভবত পুজোর ছুটি ছিল। সেই ছুটিতে বাড়ি যাবো, মা ফোন করে বললো ওরা আসছে। তখনই জানতে পারি, চারুর বিয়ের কথা। কেনাকাটা করতে ঢাকা আসছে সবাই। ওই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দেখানো উচিত ছিল আমি জানি না। বালির বাঁধের মত ঝুরঝুর করে পড়ে গিয়েছিল আমার সমস্ত স্বপ্ন, সাধ-আহ্লাদ!
ওরা সবাই ঢাকায় এলো। হৈচৈ হুল্লোড়! কি আনন্দ সবার চোখেমুখে। চারুকে একবার জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি খুশি?’
মেয়েটা লজ্জায় মাথা নোয়ালো। কষ্টে বুক ফেটে গেল আমার। আমি দাদুর কাছে ধর্না দিলাম। আকুল হয়ে নিজের মনের কথা বললাম। দাদু গম্ভীর হয়ে জানালো, আমি যা ভাবছি তা সম্ভব নয়। চারুর আংটি বদল হয়েছে আগের মাসে, বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক। এতদিন ধরে তারা পাত্র দেখেছে, কথাবার্তা হয়েছে, এখন কি করে—
তাছাড়া আত্মীয়ে-আত্মীয়ে সম্পর্কটা বাড়ির লোকজন ভালো চোখে দেখবে না। এসব কথা উঠলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝামেলা হতে পারে। দাদুর এতবছরের আগলে রাখা এই সংসার! ঠুনকো কারণে তিনি ভাঙতে দেবেন না।
চারুর তো মাহতাবকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। সে নাকি খুশিই ছিল। তাহলে?
দাদুর কাছে ব্যর্থ হয়ে আমি মা’র কাছে ছুটলাম। তার ছোট ছেলে আমি, অতি আদরের। কিন্তু সেই আদরের ছেলের একটিমাত্র আবদার তিনিও রাখলেন না। বড় চাচীর সঙ্গে তাঁর কি রেষারেষি আছে, বড় চাচীর মেয়েকে ছেলের বৌ করতে তিনি নারাজ। ঘরের মেয়ে, মেয়ে হিসেবেই নাকি মানায়। বৌ হিসেবে মানা যায় না!
সবদিক দিয়ে আমায় নিরাশ হতে হলো। সেই ছুটিতেই চারু বিয়ে করে মাহতাবদের সঙ্গে চলে গেল শ্বশুরবাড়িতে!”
— “তারপর? তারপর দু’ বছর পর আবার তোর কাছে সুযোগ আসে। তুই তখনো চারুকে নিজের করে নিতে পারতি!”
সৌভিক একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেললো। কফির কাপে শেষ চুমুকটা বসিয়ে বললো,
— “চারুর সংসার হলো না। মাহতাব ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। বাড়ি ফিরে চারু খুব ভেঙে পড়েছিল। আমি সময় দিচ্ছিলাম ওকে। নতুন করে সবটা সাজাতে চেয়েছিলাম। আমি জানি এবারও পরিবার আমার বিপক্ষে যাবে। ছ’ মাস আগে মা আমার বিয়ের কথা তুলেছিল। আমি চারুর কথা বলতেই উনি আবারও নারাজ হলেন। রাগারাগি করলেন। নাতি – নাতনির মুখ তিনি দেখতে চান। আগে তাও যেটুকু মেনে নেয়ার সম্ভবনা ছিল, সব কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার বিয়ের প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিলেন। আমিও রাগ করে ঢাকায় ফিরলাম। তারপর বাড়ি যাওয়া হয় নি।
এবার তোকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, অনুর বিয়ে খেতে। এরমধ্যে…”
নিখিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে আসলেই বুঝতে পারছে না এখানে কার দোষ বেশি! কিংবা কার দোষ কম!
কোনোমতে বললো,
— “আমি সত্যিই জানতাম না, সৌভিক। জানলে নিজের প্রিয় বন্ধুর ভালোবাসাকে আমি কেড়ে নিতাম না। কিন্তু এখন আমি কি করবো, বল তো? আমি চারুকে ভালোবাসি। যতটুকু বুঝি, সেও আমাকে। তুই কেন আগে কিছু বললি না? কেন সময়কে বিশ্বাস করলি? এই সময় যে তোকে আগেও ধোঁকা দিয়েছিল!”

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here