#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
তৃতীয় পর্ব
রাত সাড়ে ১০ টার কিছুক্ষণ পর বাসায় এসে পৌঁছায় মৃত্তিকা, তানজিম আর ইমতিয়াজ। তানজিম সোজা নিজের রুমে চলে যায়। বোনদের চলে যাওয়া আর মায়ের অসুস্থতা এই বাচ্চা ছেলেটাকেও অসুস্থ করে দিচ্ছে। বয়স আর কত হবে? মাত্রই তো ১৯ ছেড়ে ২০ এ গেল। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, এ সময়টা অন্যদের মতো হাসি-আনন্দে যাচ্ছে না ওর।
ইমতিয়াজ রুমে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে আসে। মৃত্তিকাকে বলল,
“লোকটা কে ছিল?”
মৃত্তিকা প্লেট ধুয়ে এনে টেবিলে রাখছিলো। ইমতিয়াজের কথায় থমকে যায়। মৃত্তিকার নিরবতায় ইমতিয়াজের কৌতুহল বাড়ে।
“আমার বাবা উনি।”
কথাটা শুনে ইমতিয়াজ ছোটখাটো ধা°ক্কা খায়। বাবা হয়ে মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার কিভাবে সম্ভব।
“আপনার বাবা?”
“দেখুন, উনাকে নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইছি না।”
ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা পিছু ডেকে বলল,
“আপনি তো দুপুরেও খাননি, এখন খেয়ে নিন। আমি ডিম ভেজে আনছি।”
ইমতিয়াজ কিছু বলে না, রুমে চলে যায়। তাহমিনা প্রতিরাতে ওকে খাইয়ে দিতো। ক্লান্ত হয়ে অফিসে থেকে ফিরে দেখতো তাহমিনা খাবার সাজিয়ে রেখেছে। একপ্লেটে দুজনে খেতে বসতো। গত দেড়বছরে এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বিছানায় শুয়ে পড়লো ইমতিয়াজ। একটা হাত মেলে দিয়েছে। এই হাতের উপর তাহমিনা শুয়ে পড়তো। তারপর ধীরে ধীরে কাছে চলে আসতো দুজনে। ওর বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতো ওর মিনা, ওর দুষ্টুমির স্পর্শগুলোতে লজ্জায় মুখ লুকাতো।
ও অনুভব করছে তাহমিনা এসে ওর হাতের উপর শুয়েছে।
“আমার তাজ, খাবে না? আমিও তো খাইনি।”
“মিনা।”
লাফ দিয়ে উঠে বসে ইমতিয়াজ। তাহমিনার ডাকা “আমার তাজ” কথাটা যে শুনেছে ও।
“ভাইয়া, কি হয়েছে?”
জোরে চিৎকার করায় তানজিম এসে হাজির হয়েছে। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“কিছু না।”
“ভাইয়া, খেতে আসুন।”
শেষ পর্যন্ত খেতে যায় ইমতিয়াজ। তার মিনা যে তাকে খেতে বলেছে। মনের ভুলটাকে জোরপূর্বক সত্য বলে ধরে নিলো।
খাবার টেবিলে বসে তানজিম বলল,
“আপু, কালকে একটু আমার সাথে ভার্সিটিতে যেতে পারবে? আমার এইচএসসির মার্কশীট জমা দেয়া হয় নাই।”
“কালই?”
“হুম, না দিলে ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে।”
মৃত্তিকা আর কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ বলল,
“আমি নিয়ে যাবো।”
______________________________________
“জুহাইব আজকে টিকেট নিয়ে এসেছে, বাবা। আগামী সপ্তাহে আমরা চলে যাবো।”
আফরোজার কথায় আব্বাস সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“চলে তো যেতেই হয়। এই পৃথিবীর নিয়মই তো এটা।”
আফরোজা এসে বাবার কাছে বসে বলল,
“বাবা প্লিজ, এভাবে হায়°হু°তাশ করো না। আমার কষ্ট হয়।”
আব্বাস সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। এই মেয়েটাই তাকে প্রথম বাবা ডাক শুনিয়েছিল, আধো আধো বুলির সেই ডাক আব্বাস সাহেব ভুলেননি। এখন মেয়ে বড় হয়েছে তাই নিজের সংসারে যেতেই হবে।
আফরোজার কপালে চুমো দিয়ে বলল,
“আহনাফের অবস্থাটা দেখেছিস? ওকে কিভাবে সামলে রাখবো আমি?”
“চিন্তা করো না তুমি। আহনাফ নিজেই সামলে থাকবে।”
আফরোজা কিছুক্ষণ আহনাফের ঘরের দরজার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“যে ছেলেটা দায়িত্বের খাতিরে এরকম মানসিক অবস্থায় কলেজে যেতে পারে, সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না।”
“হুম, তাই যেন হয়।”
আহনাফ নিজের ঘরেই আছে। কলেজ থেকে এসে এখানে পড়েছে তো পড়েছেই। মানসিক অবস্থার সাথে শারিরীক অবস্থাও খারাপ, হুট করে ঠান্ডা লেগে গেছে, হালকা জ্ব°রও আছে বোধহয়।
আফরোজা ওর ঘরে আসলো। এতোক্ষণ চোখ খুলে রাখলেও শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করলো আহনাফ। কপালে হাত দিয়ে জ্ব°র বুঝতে পারলো আফরোজা। জল প°ট্টি দিলো, শরীর মুছে দিলো, কিন্তু আহনাফ উঠলো না। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, জেগে থাকা মানুষকে তো আর জাগানো যায় না।
কপালে ভেজা রুমালটা দিয়ে আফরোজা নিজের রুমে চলে আসলো। প্রচন্ড খারাপ লাগছে ভাইয়ের জন্য, কান্নাও পাচ্ছে। বাবা-ভাইকে এ অবস্থায় ফেলে দূর ইউরোপে থাকতে পারবে ও? দম ব°ন্ধ হয়ে যাবে তো।
জুহাইব ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিল। আফরোজাকে দেখে ল্যাপটপ রেখে দিলো। আফরোজা ওর পাশে বসতেই বলল,
“আশকিম (আমার ভালোবাসা)?”
আফরোজা অসহায় চোখে তাকালো। জুহাইব ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
আফরোজা জুহাইবের বুকে মাথা রেখে বলল,
“আমি দেশে থাকি? তুমি বরং চলে যাও। বাবা আর আহনাফকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না।”
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে ফেলে সে। জুহাইব ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর অবস্থাটা বুঝতে পারছে। মেয়েটা যে কাঁদছে সে অনুভূতিটাও হলো তার।
আফরোজারা মাথা তুলে ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“ঠিক আছে, তুমি থাকো। (একটু থেমে) একা একা ফিরতে পারবে তো?”
“খুব পারবো।”
কান্না ভেজা চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। জুহাইব ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“পরে আমার জন্য কাঁদলে কিন্তু আসতে পারবো না। যা আদর আছে এখনি করে দাও।”
জুহাইবের কথায় হেসে ওর বুকে একটা মা°ই°র দিলো আফরোজা। এই লোকও পারে, শুধু অসময়ে প্রেম জেগে উঠে। আফরোজা উঠে যেতে নিলে জুহাইব ওকে টেনে কাছে নিয়ে আসে, আফরোজাও এতে সম্মত হয়।
ভোর ৫ টা,
নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াত করছে সারাহ্। হঠাৎ একটা বি°ক°ট শব্দে চমকে উঠে। কালরাত থেকে বেশ কয়েকবার এমন শব্দ হয়েছে। সামিহা সবেমাত্র বিছানা নিয়েছিল, লাফিয়ে উঠে বসে সেও।
“পুরো রাত ঘুম হয়নি এই শব্দে, এখন আবার কেন?”
সারাহ্ কোরআন বন্ধ করে রেখে বি°র°ক্তি নিয়ে বেরিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর সাহেবের রুমের সামনে গিয়ে বলল,
“বাবা।”
এক ডাকেই জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে এলেন। হয়তো বের হওয়ার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নার্গিস পারভিনও বেরিয়ে এলেন। সারাহ্ বলল,
“উপরের তলায় রাত থেকে এতো সাউন্ড হচ্ছে কেন? বাড়িঘর ভে°ঙ্গে ফেলবে নাকি?”
“দেখছি আমি।”
জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। সারাহ্ সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জাহাঙ্গীর সাহেব প্রথমে দারোয়ানকে বিষয়টা জানালেন। তারপর উপরের তলায় ওদের ফ্ল্যাটের বরাবর ফ্ল্যাটে গেলেন।
বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পর মধ্যবয়সী এক লোক এসে দরজা খুলল। ক°র্ক°শ কন্ঠে বলল,
“কি চাই?”
জাহাঙ্গীর সাহেব কিছু বলার আগেই দারোয়ান বলল,
“শরীফ সাহেব, আপনার বাসায় নাকি শব্দ হচ্ছে?”
শরীফ চেঁচিয়ে উঠে,
“তো হচ্ছে, আমার বাসায় হচ্ছে। উনার সমস্যা কি?”
“নিচের ফ্ল্যাটে শব্দ যাচ্ছে, আমাদের অসুবিধা হয়।”
জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় শরীফ সোজা জবাব দিলো,
“তো বাসা ছেড়ে দেন। চলে যান অন্য কোথাও।”
মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। জাহাঙ্গীর সাহেব প্রচন্ড বি°র°ক্ত হলেন। ন্যূনতম ভদ্রতা নেই লোকটার।
শরীফ কাল বাসায় এসেই রাগে জিনিসপত্র ভা°ঙ°চু°র করছে। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কথা বলে, হঠাৎ করে চেঁ°চামেচি করে আর অতিরিক্ত রাগটুকু ফার্নিচার আর ঘরের ছোটখাটো জিনিসপত্রের উপর ঝাড়তেছে। রাগটা কি মৃত্তিকার উপর নাকি ইমতিয়াজের উপর তা সে নিজেও জানে না।
জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় এসে বললেন,
“ফালতু এক লোক থাকে।”
সারাহ্ উৎ°ক°ন্ঠা নিয়ে বলল,
“কি বলেছে বাবা?”
“বলেছে ডিস্টার্ব হলে বাসা ছেড়ে চলে যাও।”
“কি? এভাবেও কেউ বলে?”
নার্গিস পারভিন বললেন,
“বাদ দাও, যা খুশি হোক। একটু রয়েসয়ে যাবো, তাও এই অসভ্য মানুষটার সাথে আর দেখা করারই দরকার নেই।”
“হ্যাঁ, আম্মু ঠিক বলেছে।”
মাকে সমর্থন করে বলল সারাহ্।
______________________________________
ফজরের নামাজটা মসজিদে পড়ে ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটছে ইমতিয়াজ। কতবার ভোরে তাহমিনাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে, অথচ আজ এমন একা হয়ে গেছে সে।
ওদের বিয়েটাতেও একটা নাটকীয়তা ছিল। ব্যাচেলার বাসার এতিম ছেলেটা তো জানে বাবা-মায়েরা মেয়ের জন্য সবসময় পারফেক্ট একজন ছেলে চায়, যা ইমতিয়াজ নয়। এজন্য বিয়ে নিয়ে ভাবতেই চায়নি সে, কখনো কাউকে পছন্দ হলেও অনুভূতিকে পাত্তা দেয়নি।
ইমতিয়াজের এক বন্ধুর বাবার সাথে লুৎফর রহমান মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজে এসেছিলেন। অবাকের পাল্লা ভারী হয়েছিল ইমতিয়াজের। বাবা-মা ছাড়া টিউশন আর পার্ট টাইম জব করে নিজের অনার্সটুকু শেষ করেছিল সে। মাস্টার্স করার ইচ্ছা থাকলেও করা হয়নি। ছোটখাটো চাকরি করা ইমতিয়াজ যেদিন তাহমিনাকে বিয়ে করে সেদিন লুৎফর সাহেবের অনুরোধে তাদের সাথেই থাকতে শুরু করে সে।
লুৎফর সাহেব মেয়ের জন্য সাধারণ একটা ছেলে চেয়েছিলেন, কেন এমন ইচ্ছা ছিল তা আজও জানা হয়নি ইমতিয়াজের।
ধীরে ধীরে মেয়ের জামাই থেকে বাড়ির ছেলে হয়ে উঠে সে, বড় ছেলে। ঘটনা তো বেশিদিন আগের নয়, ১৮ কি ১৯ মাস হবে।
প্রথম যখন তাহমিনা নিজের মধ্যে আরেকটা নতুন অস্তিত্ব খুঁজে পায় তখন সর্বপ্রথম ইমতিয়াজকেই জানায়। সেদিনের মুহূর্তগুলো ভুলে যাওয়ার নয়।
ইমতিয়াজের হাতটা নিজের উদরে রেখে তাহমিনা বলেছিল,
“তোমার জন্য আরেকটা ভালোবাসা আসছে।”
“পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দাও মিনা।”
“আমার তাজ, সবাই জানবে।”
ছি°ন্ন°বিচ্ছি°ন্ন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরায় লা°থি দিয়ে ইমতিয়াজ। টুকরাটা কিছুদূর গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে থেমে যায়। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সে আবারো হাঁটতে থাকে।
______________________________________
সকাল দশটায় ঘুম ভাঙে আহনাফের। জ্ব°রের তীব্রতা বেড়েছে, শরীরে কাঁ°পুনি হচ্ছে৷ ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে উঠার ইচ্ছা হলেও শরীরটা সায় দিলো না।
আফরোজা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে।
“আপু, এখন..”
আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই আফরোজা রেগে বলে,
“১০৪ ডিগ্রি জ্ব°র নিয়ে পড়ে আছো আর আমি এখানে কেন সেটা জানতে চাচ্ছো?”
আহনাফ চুপ করে। আজকের ক্লাস মিস হয়েছে, কিছুদিন পর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট এক্সাম শুরু হবে আর ও এখন ক্লাসে যেতে পারলো না।
আফরোজা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“একটু বাঁকা হয়ে শুয়ে পড়, মাথায় পানি দিয়ে দিই।”
আহনাফ প্রতিবাদ করে না। বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আফরোজা ওর মাথায় পানি ঢালছে।
ভার্সিটিতে থাকতে একবার এমন জ্ব°র হয়েছিল আহনাফের৷ তাহসিনার কি ব°কাটাই না খেয়েছিল সেদিন। তারপর তাহসিনা ওর রুমে এসে ওকে খাইয়ে দিলো, মাথায় পানি দিয়ে গা মুছে দিলো।
ঘটনাগুলো আজও পুরোনো মনে হয় না। এইতো সেদিনের ঘটনা যেন সব। আহনাফ চোখ বন্ধ করে, ওই মানুষটা আর আসবে না এটা ভাবতেই পারছে না সে। ভুলে যাওয়া কি এতো সহজ?
“তুই কাঁদছিস?”
আফরোজার কথায় চমকে উঠে আহনাফ। কখন ওর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়েছে তা ও নিজেই জানে না।
আফরোজা কিছু না বলে বেরিয়ে চলে যায়। কান্না যে তারও পাচ্ছে, কিন্তু ভাইয়ের সামনে কাঁদবে না সে। জুহাইব রুম থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে আফরোজাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে যায়। জুহাইবকে দেখে কান্নার রে°শটা বাড়ে আফরোজার।
_____________________________________
কিছু বই কিনতে নীলক্ষেত এসেছে সারাহ্। সকাল সকাল এসেছে যেন জ্যাম না পড়ে, তবুও ঢাকা বলে কথা। জ্যামে, গরমে অ°স্থির হয়ে উঠেছে।
কয়েক দোকান খুঁজে ওর পছন্দমতো কিছু বই পেল। মূলত চাকরির প্রস্তুতির বই কিনতে এসেছে সে। বইগুলো নিয়ে কা°টাবন রোড ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যায় একটু একা ঘুরাঘুরি করবে বলে।
রিকশা নিয়ে চলে গেল দোয়েল চত্বর। সেখানে রিকশা থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। সামিহার ডিপার্টমেন্টটাও এখানে, গণিত বিভাগে ভর্তি হয়েছে সে।
কেন্দ্রীয় শ°হী°দ মিনারের কাছে এসে রাস্তা পার হওয়ার সময় রাস্তার মাঝেই ব্যাগ ছিঁ°ড়ে বইগুলো মাটিতে পড়ে যায়। সারাহ্ হাঁটু গেড়ে বসে তাড়াহুড়ো করে বইগুলো তুলতে লাগলো। মাঝরাস্তায় এমন ঘটনায় রেগে গেছে সে। আশেপাশে এতো এতো মানুষ ওকে দেখছে।
হঠাৎ মানুষের চেঁ°চামেচি অনুসরণ করে তাকিয়ে মাত্রই বাঁক নেয়া মাইক্রোবাসটা ওর দিকেই আসছে। উঠে দাঁড়াতেই তড়িৎ গতিতে কেউ এসে ওকে ছি°টকে নিয়ে ফেললো একপাশে। শক্ত কং°ক্রি°টের ফুটপাতে বেশ ভালোই ব্য°থা পেয়েছে সারাহ্, সাথের লোকটাও বোধহয় আরো ব্য°থা পেয়েছে।
সারাহ্ উঠে বসলো, চশমাটা খুলে কোথায় পড়েছে খুঁজে পাচ্ছে না। অনবরত হাতড়াচ্ছে সে, লোকটা ওর হাতে চশমাটা দিয়ে ধ°ম°কের সুরে বলল,
“চশমা পড়েও চোখে দেখেন না?”
মাইক্রোবাসটাও থেমেছে। ড্রাইভার নেমে এসে ওকে বলল,
“এখানে গাড়ি মোড় নেয় জানেন না? এমনে রাস্তায় কেউ বসে থাকে?”
ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে জামা কাপড় ঝাড়তে থাকে। সারাহ্-কে বাঁচানো এই লোকটা ইমতিয়াজই। তানজিমকে নিয়ে ভার্সিটিতে এসেছে, ডিপার্টমেন্টের বাইরে এসে সারাহ্-কে এ অবস্থায় দেখে বাঁচানোর জন্য ম°রিয়া হয়ে উঠে সে। না জানি কোথায় কার মেয়ে, কার স্ত্রী বা কার বোন চলে যায়।
সারাহ্ উঠে দাঁড়ায়। তাৎক্ষণিক এক ঘটনায় সে বেশ লজ্জা পেল। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। ইমতিয়াজ সারাহ্-র বইগুলো তুলে এনে ওর সামনে রেখে বলল,
“এই কয়টা বইয়ের জন্য জীবন দিয়েন না। বেঁচে থাকলে বই জীবনে বহুত পড়তে পারবেন।”
ইমতিয়াজ চলে গেল। ধীরে ধীরে ভীড়টাও কমতে থাকলো। সারাহ্ বইগুলো তুলতে তুলতে আবারো তাকালো অচেনা লোকটির দিকে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁ°কিতে ফেলে দিলো কেউ একজন অথচ ও থ্যাংকস জানানোর সময়টুকুও পেল না।
বইগুলো কোনোরকম নিয়ে দৌড়ে ইমতিয়াজের পিছুপিছু গেল সারাহ্।
“শুনুন, এক্সকিউজ মি, এইযে হিরো। (একটু থেমে) এই যে একটু আগে ফুটপাতে পড়ে গেছিলেন ওর ভাইয়া।”
ইমতিয়াজ ফিরে তাকালো। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“জি, আমাকে কিছু বলছেন?”
সারাহ্ হাঁ°পাতে হাঁ°পাতে বলল,
“হ্যাঁ, কখন থেকে ডাকছি।”
“কেন?”
“থ্যাংক ইউ, আমাকে বাঁচানোর জন্য। আজকাল কারো জন্য কেউ এমন করে না।”
ইমতিয়াজ আলতো হাসলো। বলল,
“যখন তার কেউ থাকে না, ভালোবাসাগুলো মাঝরাস্তায় বিলীন হয় তখন হয়তো মানুষ এমনই করে।”
সারাহ্ অবাক হয় ইমতিয়াজের কথায়। মাথামু°ণ্ডু খুঁজে পায়না, অর্থটাও বুঝতে পারে না। ইমতিয়াজ চলে গেল, সারাহ্ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
চলবে……