#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১২
সন্ধ্যা থেকে চারুর ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ তাই চেয়েও আসতে পারছে না ভেতরে। একা একা মেয়েটা কি করছে কে জানে? মা-চাচীরা দফায় দফায় ডেকে যাচ্ছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারুর এই নিশ্চুপ-নির্বিকার অবস্থা যেন ওদের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তার পাহাড় জমছে বুকে। না জানি, কি করছে মেয়েটা!
বড়’পার ঘরের দরজায় দাড়িয়ে রিংকু – টিংকু। না, আপাকে বিরক্ত করবার কোনো মতলব নেই ওদের। বরং পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তারাও প্রচেষ্টা। অন্যদের মতো এসেই নরম সুরে আপাকে ডাকা, দরজায় টুকটুক শব্দ করা — কোনোটাই ওরা করে নি। নিঃশব্দে দাড়িয়ে আছে দু’জনে। দেয়ালে কান পেতে রিংকু শুনবার চেষ্টা করছে সূক্ষ্ম কোনো আওয়াজ। দীর্ঘক্ষণ হলো এরও কোনো হেলদোল নেই। অধৈর্য হলো টিংকু। ভাইকে ঠেলা মেরে বললো,
— “কি রে? কিছু পেলি? ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে? বড়’পা কাঁদছে নাকি?”
অসহায় শোনায় কণ্ঠ। ওর দ্বিধান্বিত উত্তর,
— “বুঝতে পারছি না। থাম!”
বিরক্ত চোখে রয় টিংকু। একথা খুব সত্য যে, তারা দু’টি ভাই এ বাড়ির সক্কলকেই জ্বালিয়ে ওস্তাদ, চারুও ব্যতিক্রম নয়। বরং বলা চলে, একটু বেশি মোলায়েম আর শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের জন্য চারুকেই ওরা জব্দ করে মজা পায়। চারু’পা ওদের বকে না, মারে না, বড়দের কাছে নালিশও দেয় না। শত দুষ্টুমির বদলে হঠাৎ কানটা মুচড়ে একটু রাগ করে। এরকম মানুষের উপর উপদ্রব না করে ওরা করবে কাকে? তাই তাদের অধিকাংশ বদমায়েশি, দুষ্টুমি, পাকামো করে করা এক্সপেরিমেন্ট তথা অকাজের জন্য চারুই উপযুক্ত। কিন্তু এরসঙ্গে এ-কথাও সত্য যে, দুষ্টুমি করুক আর যাই করুক চারুকে ওরা ভালোবাসে। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওদের করা সকল অপরাধ, সকল দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে গিয়ে এই সত্য, সবচে’ বড় সত্য!
বিরক্তিটা রাগে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না বেশি। জমজকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ত্যক্ত গলায় বলে,
— “সর তো। ঘণ্টা ধরে দাড়িয়ে থাকলেও তুই কিছু বুঝবি না।”
আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে দু’ পা পিছিয়ে যায় রিংকু। রাগ করে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে টিংকু কান পাতলো দেয়ালে। মিনিট দুয়েকের নীরবতার পর একটা মিহি সুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো তার। খুব চিকন সেই সুরের সাথে কান্নার সূক্ষ্ম ধ্বনি! ব্যাপারটা আবিষ্কার করে গভীর বেদনায় বুক ভরে এলো ওর। বড়’পা কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই তার প্রিয় গানের সুর তুলছে ঠোঁটে। আহা রে, কি অসীম কষ্ট তাদের প্রিয় আপার!
ছলছল চোখে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা রিংকুর দিকে ফিরলো। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
— “আপা, খুব কষ্ট পেয়েছে রে। কাঁদছে একা একা!”
কথাটা শুনে আপনাপনিই ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। মুখ কুঁচকে অবরুদ্ধ কান্নাটা আটকে অন্য দিকে ফিরলো রিংকু। বড়’পার জন্য তার বুকটাও পুড়ছে ভীষণ! আপা’টা এত্তো ভালো, তবুও তার এতো দুঃখ কেন?
দু’ ভাই বাষ্পচোখে একে অপরের দিকে চেয়ে, হঠাৎ চটকা ভাঙলো বড় ফুপু আলেয়ার কণ্ঠে,
— “এখানে কি করছিস তোরা? সন্ধ্যাবেলায় পড়া নেই?”
বড় ফুপু প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারনী। পড়ালেখা নিয়ে সবসময়ই জোর দেন ওদের। রাগারাগিও কম করেন না। তাই ওরা একটু ভয়ই পায় তাকে! সমীহও করে।
ফুপুর রাশভারী প্রশ্নের জবাবে ওরা মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে রইলো। উত্তর দিলো না। ফুপু অবশ্য সে অপেক্ষাতেও ছিলেন না; ওদের পড়তে বসবার হুকুম দিয়ে চারুর দরজায় করাঘাত করলেন সরাসরি,
— “চারু মা? দরজা খোল তো।”
কিছুক্ষণের জন্য একটি নারী কণ্ঠের গুনগুন, তারপর সব চুপ! একদম নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। পরপরই চারুর কান্না ভেজা আওয়াজ পাওয়া গেল,
— “তুমি যাও ফুপু। আমি দরজা খুলবো না!”
বড় ফুপু আদর করে ডাকলেন,
— “তা কেন, মা? রাতের খাবার খাবে না? সময় গড়াচ্ছে তো!”
— “আমি আজ খাবো না। তুমি জোর করো না, ফুপু।”
— “আচ্ছা, আচ্ছা। খেতে হবে না। তুমি দরজাটা খোল। বেশিক্ষণ না আমি একটু কথা বলবো মাত্র। একটু?”
আহ্লাদ পেয়েও গললো না মেয়েটা। কান্না ভেজা কণ্ঠ, কিন্তু একটু জেদি,
— “প্লিজ ফুপু! তুমি যাও, না? আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
— “তোমার কষ্টটাও আমার ভালো লাগছে না, চারু। বড় ফুপু ডাকছি, দরজাটা খোল? এবার না খুললে কিন্তু আমি কষ্ট পাবো!”
ভেতর থেকে আর কোনো কথা শোনা যায় না। বড় ফুপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে তাকাতেই রিংকু – টিংকুকে পুনরায় চোখে পড়ে। ইশারায় ওদের চলে যেতে বলেন তিনি। অগত্যা দু’ ভাই মুখ লটকে পা বাড়ায় ঘরের উদ্দেশ্যে। তারপরেই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দোর খুলেই বড় ফুপুকে দেখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চারু। দু হাতে তাকে জড়িয়ে, তার মাতৃ সমতুল্য পরম নির্ভরযোগ্য বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে ছোট্ট শিশুটির মতো, যেমন শৈশবে কাঁদতো!
*******
বাড়ির পরিবেশ গুমোট। বিকেলে এক সঙ্গে সবগুলো ছেলেমেয়ে হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে গেল, এলো কেমন মন খারাপ করে। বড়দের কারোরও মন বিশেষ ভালো নেই। সব নিশ্চুপ – নীরব। অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা!
নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে সৌভিক। মুখোমুখি বন্ধুবর নিখিল বসে, কিন্তু কোনো আলাপ হচ্ছে না। দুজনেই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। একটুপর সৌভিকই প্রথম কথা বললো। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো ওর চিত্ত,
— “নিখিল, সত্যি করে বল তো! ওই শা* বাlটপাlর চারুকে কি কি বলেছে? হার্ট করেছে? আর ওর বৌটা? ঢং করছিস চারুর সামনে?”
‘শা* বাটপার’ বলে গালিটা কাকে দিলো তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি ওর। ঠোঁট বাঁকা করে হাসবার চেষ্টা করলো; বললো,
— “এতো চটছিস কেন? ওরা কিছু বলে নি।”
— “চটব না, মানে? আলবৎ চটবো। শা* শয়**! চারুর মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিলো, আর আমি চুপ করে থাকবো? পারলে, তক্ষুনি একটা ঘুষি মেরে ব্যাটার নাক ফাটিয়ে দিতাম আমি!”
সৌভিক রাগে গজগজ করতে থাকে। নিখিল হাসে। যুক্তি দিয়ে বলে,
— “এখন খুব রাগ দেখাচ্ছিস, ওকে পেলে মারতি। পাস নি, তাই আফসোস! কিন্তু কই, অনুলেখার বিয়েতে যে ও-বাড়ি গেলি তখন তো কিছু বললি না? তোর এত রাগ থাকলে তখন সবার সামনে ওকে পিটাতি?”
কথা সত্য। সৌভিক এখন যতটা ক্ষেপে আছে, রাগ দেখাচ্ছে, হম্বি-তম্বি করছে মাহতাবকে পিটানোর; কিন্তু সেসব আসলে আকাশে ছোঁড়া ফাঁকা গুলির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়। মাহতাবকে সে আগেও সামনে পেয়েছে। কারণে-অকারণে বহুবার দেখা হয়েছে কিন্তু কিছু বলে নি। আজও সেখানে উপস্থিত থাকলে কিছু বলতে পারতো না। হয় তো, ভবিষ্যতেও পারবে না!
সৌভিক নিরুত্তর রয়। চাপা ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু বাহিরে সেটা প্রকাশ করবার সুযোগ পায় না!
বন্ধুর ছেলেমানুষী রাগ দেখে নিখিল মনে মনে হাসে। তারপর হঠাৎ সে নিজেও খুব গম্ভীর হয়ে ওঠে। একটা গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায় পুনর্বার!
সন্ধ্যায় তিস্তা পাড়ে বেড়াতে গিয়ে চারুর সহিত মাহতাব আর তার স্ত্রী মাহিয়ার দেখা হবার ঘটনাটা চারু নিজমুখে কাউকে জানায় নি। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করে ভাইবোনদের আড্ডায় ফেরে। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে ওদের সবার কাছে অনুরোধ করে বাড়ি ফেরার। পুরো ঘটনা না জানায় কেউ দ্বিমত করে নি। কাব্য তার বাইকে করে ছোট বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। চারু ফেরবার পরপরই মাহতাবের কথাটা ভাইবোনদের সবার মাঝে চাউর করে দেয় রিংকু – টিংকু। সে কথা শুনে সবাই মোটামুটি অবাক হয়। খানিক দুঃখবোধ, খানিক ক্রোধ আর খানিক হতাশার আস্তরণ পরে মনে। এই যে অনুর বিয়েটা হলো, কতো আয়োজন, কতো কিছু, সেখানে চারুর সঙ্গে মাহতাবের দেখা হবার সুযোগ ছিল কতগুলো! দেখা হলে, চারু দুঃখ পাবে পরিস্থিতি সামলানো কষ্টকর হবে — সেরকম মানসিক প্রস্তুতি সবার নেয়া ছিল। বলতে গেলে, সেসব ভেবেই ওরা কেউ অনুর বিয়েতে কোনো প্রকার হৈ-চৈ করে নি। এমন কিছু করে নি যাতে মাহতাবের কথা চারুর স্মরণে আসে। অথচ আজ! সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই মাহতাবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চারুর। দেখা হলো সেই অতীতের সঙ্গে, যাকে সে ফেলে এসেছে বহু আগেই! যাকে ফেলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল এতোগুলো দিন, কিন্তু দেখুন, নিয়তির পরিহাস কেমন? আমরা যাদের এড়াতে চাই জীবনে, তারাই আরও বেশি করে জুড়ে বসে!
বৃদ্ধ আহাদ রাজা নিয়মিতই তার পুত্র – পূত্রবধূদের নিয়ে সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর জমান। আগে সেখানে নাতি – নাতনীগুলো যোগ দিলেও, লেখাপড়া আর চাকরির সুবাদে এখন আর কারো এই আসরে থাকা হয় না তেমন। চারুরা যখন বাড়ি ফিরলো তখন হামেশার মতোই বড়রা সবাই একসঙ্গে বসেছেন। মুড়িমাখা চিবনোর কচর-কচর শব্দ আর চায়ের কাপের টুং-টাংয়ে আড্ডা সরগরম। কথাবার্তা চলছে, মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসেও উঠছেন কেউ কেউ। সম্পূর্ণই নিজেদের মতো ছিলেন। কাব্যদের ওরা খেয়াল করে নি। তাই হয় তো অনাহুত প্রসঙ্গটা কখন উঠে ছিল কেউ ঠাহর করতে পারেন না।
বিকেলবেলা অনুর শ্বশুরবাড়ি থেকে কল এসেছিল। বেয়াই-বেয়াইন আজমীর রাজার পরিবারের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। তারই একফাঁকে খবরটা জানান। তাদের বাড়িতে খুশির জোয়ার এসেছে। ছোট ছেলের বিয়ের পরপরই আরও একটা সুসংবাদ তাদের পরিবারকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, বাড়িতে আসছে নতুন সদস্য। কেননা, মাহতাবের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আজ দুপুরেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হয় তারা!
বাড়িতে সন্তান আসছে, এ অবশ্যই খুব ভালো খবর। আনন্দ করা উচিৎ, হৈচৈও শোভা পায়। খুশির ঠেলায় বেয়াইকে কল দিয়ে জানানোও হয় তো যায়; কিন্তু বেয়াই যদি হয় পুত্রের প্রাক্তন শ্বশুর তখন? এই অতি আনন্দের আতিশয্যে ত্বরিতে বেয়াই মশাইকে ফোনকলে মিষ্টি খাবার দাওয়াত দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আসাদ রাজা। অনুর বিয়ে ওই বাড়িতে দেয়া নিয়ে শুরু থেকেই তার ভেটো ছিল, তার প্রধান কারণ মাহতাব ছিল না বরং ও-বাড়ির মানুষগুলোকেও তার ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ। তাদের রুচি, চালচলনের সঙ্গে যেন বেশ ফারাক আছে; সহজ ভাষায় ‘ওদের আচরণ যেন কেমন তর!’— এই ছিল তার অভিমত। অতএব, অনুর শ্বশুরের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে কিছু বলছিলেন সভায়। পরিস্থিতি গরম ছিল, প্রসঙ্গক্রমেই অতীত ইতিহাস টেনে আনা হয়েছিল। ফাঁক তালে কখন যে আলোচনার মধ্যমণি ‘চারু’ এসে হাজির হয়েছে এবং না চেয়েও সবটা ওর কানে গেছে তারা টেরও পায় নি!
চলবে___
#মৌরিন_আহমেদ