#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১+২
#সাহেদা আক্তার
জীবনে প্রথম ক্রাশ খাইলাম এক পোলারে দেইখা। পাশের বাসায় নতুন উঠেছে। মা আর ছেলে কথা বলতে আসছিলো। আমি কাকের মতো গান গেয়ে সবে মাত্র গোসল থেকে বের হইসি তখনই বসার রুম থেকে ডাক পড়ল। আম্মা সারাক্ষণ ডাকে। খাইতে গেলে ডাকে, ফোন টিপতে গেলে ডাকে, গোসল করতে গেলে ডাকে। ডাকের শেষ নাই। আমি তো মনে করলাম এখনও হুদাই ডাকতেসে। ওড়না ছাড়া চলে গেলাম। গিয়েই টাসকি খাইলাম। মা ছেলে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি তো ভাবলাম মাটিটা একটু ফাঁক হইতো। ঢুইকা পড়তাম। যা হোক, মাটিতে না ঢুকে আপাতত এক দৌঁড়ে রুমে ঢুকলাম। ইস রে, একেবারে ফালুদা হয়ে গেলাম। আম্মা আবার ডাক দিল। এবার ওড়না পরে শালীন হয়েই বের হলাম। আমি যাইতেই আম্মা বলল, সালাম দে। পাশের বাসার আন্টি।
– আসসালামু আলাইকুম।
আন্টি থেকে চোখ আপনাআপনি ক্রাশের উপর পড়ল। আহা! কি মুখ! ঠিক যেন চেরি ফল। এ্যাঁ! হঠাৎ কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, আন্টি, ওনাকে কি কেউ মেরেছে? ছেলে কথা শুনে আমার দিকে বেকুবের মতো তাকালো। আন্টি হেসে বললেন, কেন?
– গাল গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন চেরি ফল।
আম্মা আমার কথা শুনে মনে হয় ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠেছিল। আমি আর কিছু বললাম না। কারণ ততক্ষণে আমার নিজের গালই চেরি ফল হয়ে গেছে। যাগ্গে। সেই হল প্রথম দেখা।
তারপর রোজ সকালে দেখা হতো স্কুলে যাওয়ার সময়। আমার স্কুল আটটায়। তার কলেজ নয়টায়। সে বের হতো সাড়ে আটটায়। আমিও তক্কে তক্কে থাকতাম। দরজার কাচে চোখ লাগিয়ে রাখতাম। কখন বের হবে। আম্মা চিল্লাই বলতো, তুই কি স্কুল যাবি?
– এই তো বের হচ্ছি।
যেই না সে দরজা খুলত, আমিও দরজা খুলে বের হতাম। ফলে চোখাচোখি। আহা, কি এক অনুভূতি!!!! সে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেলতো। তারপর আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতো। আমিও পিছু পিছু বের হতাম। ও সাইকেলে চড়ে চলে যেতো আর আমি রিকশাকে ডাক দিতাম, এই খালি…… আহা খালি তো আমার মন! প্রেমহীন ভালোবাসা হীন খালি এই হূদয় পূর্ণ করো তোমার ভালোবাসায়!!!!
তবে এই ভালোবাসা বেশিদিন টিকলো না। একদিন আম্মা আব্বাকে বলেই ফেললো, আপনি একদিন ছোঁয়ার স্কুলে যাইয়েন তো।
– কেন?
– জেনে আসিয়েন তো স্কুল কি এক ঘন্টা পিছালো কি না। প্রায় দেখি মেয়ে সাড়ে আটটায় বের হয়।
ব্যাস!!!! আমার সব খালি হূদয়ে আম্মা পানি ঢেলে পূর্ণ করে দিল। আমি আগের মতো সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য বের হতে লাগলাম। মাঝে এক সপ্তাহ আর দেখা নাই।
.
.
.
.
ছুটির দিনেও আম্মার অত্যাচার থেকে রেহাই নাই। শুক্রবার আম্মা আমাকে দিয়ে এক গাদা কাপড় ধোয়াইলো। কি আরামের একটা ঘুম দিতেসিলাম। ক্রাশের লগে আমার বিয়া। আমি কবুল বলে দিসি, সে দুইবার কবুল বলল, শেষ বারে এসে কইল, ছোঁয়া তুই উঠবি না পানি ঢালমু। আমি বেকুবের মতো ক্রাশের দিকে তাকাই কই, কি কও জামাই। বোধ করি স্বপ্নের কথা বাস্তবে বলে ফেলেছিলাম। তার ফলে আজকে কানটা মনে হয় দেড় হাত লম্বা হয়ে ঝুলছে। যাই হোক, আম্মা ছাদে পাঠাইলো কাপড় নিয়া। এইটা আমার বড়ো বিরক্ত লাগে। একগাদা কাপড় ধুইলেই দোতলা বেয়ে পাঁচতলার ছাদে যাইতে হয়। আমার মতো শুকনা মেয়ে মাসে এমন ব্যায়াম করলে তো আমসি হয়ে যাবো। তখন হালকা বাতাসেই উইড়া গিয়া উগান্ডায় পড়মু। হায় রে!!! কি কষ্ট!!!!! তবু সকল কষ্ট বুকে পাথর চাইপা ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠতে উঠতে নিজেকে বাপ্পারাজের মতো দুঃখী লাগতেছিল। তাই মনের দুঃখে নিজে গান বানাই নিজেই কম্পোজ করে গাইতে লাগলাম-
”হায়রে দুঃখের সাগরের জীবন
কাপড় রোদে দিতে ছাদে যাওন
আর ভালা লাগে না।”
গাইতেসি আর কাপড় মেলতেসি। নিজের গান শুইনা নিজেরই কান্দন চলে আসতেছিলো। কিন্তু কিছু একটা দেখে সত্যিই খুশিতে কান্দন চলে আসলো। মনে মনে কইলাম, লাভ ইউ আম্মা। চোখের সামনে ক্রাশ আমার দিকে টাসকি খাইয়া খাঁড়াই আছে। তারে দেইখা এক মুহুর্ত ভাবলাম, সে কি আমার কোকিল কন্ঠ শুইনা ফেলল!!! যাগ্গে, শুনলে শুনসে। বৌয়ের কন্ঠ কেমন তা তো জামাইর জানা দরকার। তাই না! আমি গুন গুন করতে করতে কাপড় মেলতেসি আর সে মনোযোগ সহকারে ফোন টিপতেসে। আমি একই কাপড় কুঁচকাইতেসি, মেলতেসি আর তার দিকে তাকাই আছি। তার হুঁশ নাই। আমারও হুঁশ নাই যে এতক্ষণে খালি একটা বিছানার চাদর মেলসি। পাশ দিয়ে একটা কাক কা কা করে উড়ে যাইতেই হুঁশ হলো। তখন দ্রুত কাপড় সব মেলে দিয়া চলে আসতেছিলাম, সে আমারে পেছন থেকে মধুর স্বরে ডাকল, শুনুন।
কন্ঠ শুনে মনে লাড্ডু ফুটল৷ আহা!!! কি কন্ঠ!? গলা তো নয় যেন মধুর ঝর্ণা!!! আমি নিরীহ প্রাণীর মতো তার দিকে তাকালাম। সে কাছে এসে বলল, আমরা আসলে ওয়াই ফাই নিতে চাচ্ছিলাম। তখন আঙ্কেল মানে আপনার আব্বু বললেন যে আপনাদের রাউটারটা ইউজ করতে। আঙ্কেলকে পাসওয়ার্ডের কথা বলতেই উনি বললেন পাসওয়ার্ড নাকি আপনি জানেন। তাই ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ডটা যদি দিতেন।
তার মধুর কন্ঠে আমার মাথায় তখনই সব দুষ্ট বুদ্ধি হাত পা ছুড়ে নাচতে নাচতে আসলো। ইচ্ছে করতেসে একটা ডিংকাচিকা নাচ দেই। কিন্তু ক্রাশের সামনে নাচাটা ঠিক হইবো না তাই নিজেকে সংযত করে বললাম, দিবো, কিন্তু আপনাকে কাছে আসতে হবে। সে আমার দিকে সন্ধিহান চোখে তাকিয়ে বলল, কেন? আমি চোরা চোরা ভাব নিয়ে বললাম, কেউ পাসওয়ার্ড শুনলে ভুল ভাবতে পারে। সে সোজা সরলের মতো বলল, এতে ভুল ভাবার কি আছে। পাসওয়ার্ডই তো চাইছি।
– আপনি সত্যিই চান আমি জনসম্মুখে বলি? আচ্ছা আপনি যখন চান তখন বলছি। I love you.
সে শোনার সাথে সাথে শক খেল। যেন আমি তারে কারেন্টের তারে প্যাঁচাই প্লাগে কানেকশান দিয়ে দিসি। সে বলল, কি? আমি মনে মনে বললাম, বয়রা হয়ে গেল নাকি!? আমি চিৎকার করে বললাম, I love you. সে আবারও আমারে প্রশ্ন করসে, I love you? তখনই যত বিপত্তি বাজলো। নিপার মা কাপড় শুকাড় দিতে আসছিলো। আমাদের আই লাভ ইউর চক্কর শুনে সেও একবার চরকির মতো চক্কর খেয়ে ‘ খালাম্মা গো’ কইতে কইতে চলে গেল। আমরা তার চিৎকারেই ভয় পেয়ে গেলাম। নিপার মা আমার ক্রাশের ঘরে কাম করে। ফলে একান ওকান হইতে সময় বেশি নাই। আমি দৌঁড়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম। ঘরে ডুকতেই আম্মা চিক্কুর দিয়া কইল, কখন পাঠাইছি দুই খান কাপড় দিতে। তাতেই এক ঘন্টা লাগাইসে। আমার আম্মার কথায় হুঁশ নাই। আইসা আমিও সমান তালে চিল্লাই কইতেসি, আম্মা তোমার ফোন কই?
– ক্যান?
– কাম আছে। তাড়াতাড়ি, সময় বেশি নাই।
আমার হাব ভাব দেইখা আম্মা আমার থেকেও অস্থির হইয়া কইল, কি হইসে। এমন ছটফট করতেসোস ক্যান? আমার এখন কান দেয়ার সময় নাই। আগে ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করমু তারপর সব। নইলে একেবারে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।
আমি স্বস্তি হয়ে ফোনটা রাখতে না রাখতেই দরজার কলিং বেলের শব্দ। আম্মা এসে দরজা খুলতেই উঁকি দিয়ে দেখি ক্রাশের আম্মা বাইরে খাঁড়াই আছে। আমি তো সরমে শেষ। আইজকা ছলেবলে কৌশলে মনের কথা বইলা ফেললাম ক্রাশ রে। ওমা!!! ক্রাশও দেখি দাঁড়াই আছে লগে। আমি তো ডাবল সরমে পইড়া গেলাম। আম্মা ওনাদের ভেতরে আইসা বসতে বলল। আমি মনে মনে ডিংকাচিকা নাচতেসি এমন সময় আম্মার ডাক। আমি ধোঁয়া নিমপাতার মতো মুখ করে সবার সামনে দাঁড়াইলাম। ক্রাশ আমারে কইল, আপনি আমাকে যে পাসওয়ার্ড দিয়েছেন ওটা ভুল। আমি মনে মনে বললাম, হালা, বৌরে কেউ আপনি কয়? তোরে ভালোবাসার কতা কইসি। তওবা তওবা। শালা না জামাই। আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, আরে আর্ধেক শুনলে তো ভুল হবেই। আমি তো শুধু I love you বলে ফেলসি। ওটা সত্যি।
আন্টি একবার আমার আর একবার ছেলের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। আমার ক্রাশের দুই নাম্বার আত্মাটাও মনে হয় আমার কথা শুইনা আকাশে উড়াল দিলো। আম্মা আমার কান ধইরা কইল, মশকরা করিস? আমি কইলাম, আম্মু, আমি পুরা পাসওয়ার্ড দেওয়ার আগেই তো নিপা খালা এমন চিৎকার দিয়ে নিচে চলে এল। আমিও ভয় পেয়ে চলে এসেছি। আম্মা আরো জোরে কান মলে দিয়ে বলল, তাইলে পাসওয়ার্ড কি?
– আ…… কানটা ছাড়ো বলছি। I love you abbu.
ক্রাশ সাথে সাথে মোবাইলে পাসওয়ার্ড লিখে নিল। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফুটল। দুই আত্মা আবার তার দেহে প্রবেশ করল। সে মুখে হাসি টেনে বলল, ওয়াই ফাই কানেকশন হয়েছে আন্টি। ওনার কথা শুনেই যেন সবার প্রাণে পানি ফিরল। আন্টি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_২
আমি মনে মনে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ বলে লাভ নাই। এই পেত্মী থেকে আপনার পোলার মুক্তি নাই। ক্রাশ যেদিকে তাকাইবে, এই ছোঁয়াকে দেখিতে পাইবে।
আন্টি কিছুক্ষণ গল্প করেই চলে গেল। আমি নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে ফ্যানের ঘোরা দেখতেসি আর ভাবতেসি ফ্যান সব সময় ডান থেকে বামে ঘোরে কেন? আম্মা খাইতে ডাকল। আমি খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। তখন কানে এল আম্মা আব্বাকে আজকের ঘটনা তার কথার রঙে রঞ্জিত করে শুনাইতেসে। তার বর্ণনা শুনে আমি মুরগীর ঠ্যাং চাবাইতেসি আর মাথা চাপড়াইতেসি। হায়রে জননী!!!! এ কি করলা? আম্মা সব শেষে এটা যুক্ত করল যে, তোমার মেয়ের ভীমরতি হইসে? নইলে এমনভাবে কেউ পাসওয়ার্ড বলে? ব্যাপারটা কেমন সন্দেহজনক না?
– কেন?
– তোমার মেয়ের মাথায় যে বুদ্ধি ধরে তাতে সে কেমনে অর্ধেক পাসওয়ার্ড বলে, তাও আবার একটা ছেলেকে!? তোমার মেয়ের মতি গতি ভালা না। উঠতি বয়স। নাহ্, তুমি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দাও।
– আচ্ছা।
আমি রুমে বসে বসে শুনতেসি আর মনে মনে চিল্লাইতেসি এটা তুমি কি কইলা আব্বা? তুমি রাজি হইয়া গেলা!!!! তোমার মেয়ে তার হবু জামাইরে ভালোবাসার কথা কওনে তোমরা এত বড় শাস্তি দিতে পারো না। আমি রুম থেকে চিল্লাই কইলাম, আম্মা আজকে কি লবণ মুরগী দি রানসো? আম্মাও চিল্লাই কইল, ভালো না লাগলে নিজে রাইন্দা খাও। আমি মনের দুঃখে আরেকটা ঠ্যাং আইনা চিবাইতে লাগলাম। আম্মা পিছন থেকে খোঁচা দিয়ে কইল, লবণ না বেশি তাহলে রাতে শুধু তরকারি দিয়ে ভাত খাইস। কথাটা শুনে মনের দুঃখ এক লাফে দশ গুন হইয়া গেল। সেই দুঃখে হাড্ডি গুলা এমনভাবে চিবাইলাম যে বিলাই দেখি কইব, কোন রাক্ষস আজকে মুরগী খাইসে, আমাদের জন্য হাড্ডিটা পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখে নাই। শেষ পর্যন্ত আব্বা ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করছে কি না আর জানতে পারলাম না। কারণ আমার নিজের কোনো ফোন নাই।
.
.
.
.
রোজ বিকালে ক্রাশ মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাইতো। আমি ক্রিকেট একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু তার ঠেলায় ক্রিকেট এত ভালোবেসে ফেললাম যে নিজেই বাচ্চাদের একটা ব্যাট বল কিইনা নিয়ে চলে আসলাম দোকান থেকে। এখন প্রত্যেকদিন আমার একই কাজ। সকালে স্কুল, বিকালে ব্যাট বল আর রাতে পড়াশোনা। এই তিন নিয়াই আপাতত আমার সংসার। তারে নিয়া ডাইরিতে হাজার কথা লিখা পুরাই ফেলসি। এটাও লিখসি যে বিয়ার পরে ক্রিকেট টিম বানামু। লাইনটার কথা মনে কইরা নিজেই লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসি। ভাবি আমার ক্রাশ জানলে কি কইব!!! একদিন বিকালে ব্যাট বল পাশে রাইখা বিছানায় শুইসি আর ছাদের দিকে তাকাই মুচকি মুচকি হাসতেসি। কোন ফাঁকে এটা আম্মার চোখে পড়ছে খেয়াল নাই। সাথে সাথে আম্মা রাতে আব্বারে কইল, শোনো, তোমার মাইয়া প্রেম করে। আব্বা চোখ কপালে তুলে বললেন, কি বলো!? আমি রুম থেকে আম্মার কথা শুনে চিৎকার দিয়া কইলাম, আম্মু, আজকে নাকি জবার একটা স্পেশাল পার্ট দিবো। আটটা বাজি গেসে। তুমি দেখবা নাকি আমি ডিস এ্যান্টেনা কাইটা দিমু? এই টনিকেই কাজ হইল। আম্মা মুখ বন্ধ কইরা রিমোট খুঁজতে লাগল। কারণ আমি যখন বলসি ডিস এ্যান্টেনা কেটে দিমু, তো কথা না শুনলে তাই করমু। এই নিয়ে দুই বার এমন হইসে। আব্বাকে অনেক বলে আম্মা লোক আনাই ঠিক করাইসে। এইবারও হইলে ডিস লোকদের কাছে লজ্জার আর শেষ থাকবো না। তাই কোনো কথা না শুনলে এই টোটকা রেডি রাখি। যাহা এক ফোঁটাই যথেষ্ট।
আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। সামনে বই খোলা। কিন্তু আমার মন মৌমাছির মতো ক্রাশ নামক ফুলে ঘুরে বেড়াইতেসে আর মধু সংগ্রহ করে বলতেসে, আর আছে মধু? আজ আমি হাঁড়ি ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে মৌচাক বানাবো। ফুলও হেসে আমাকে একগাদা মধু দিয়া কইল, লও সখি, এই মধু শুধু তোমার জন্যই জমাই রাখসি। আমিও সেই মধু নিয়া মৌচাকে রাখসি এমন সময় কে যেন ঢিল মারল মৌচাকে। তাকিয়ে দেখি আব্বা দরজার সামনে দাঁড়াই আমাকে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ডাক দিসে। আমি তাকাতেই বলল, পড়ার বই খোলা রেখে কোন দিকে তাকাই হাসতেছিস?
– কই, আব্বু?
– আমি তোরে ভালো করে চিনি। কার পাল্লায় পড়ছিস?
– তুমিও আম্মুর কথা বিশ্বাস করলা? কোন পাগলে আমার সাথে প্রেম করবো?
আব্বা আমার কাছে এসে সুন্দর করে উপদেশ দিয়ে গেলেন যে বই খোলা থাকলে শয়তানে পড়বো। অতএব পড়ায় মন দাও। আমি মনে মনে কইলাম, যে পড়া, শয়তানও বলব, থাক, তোর পড়া তুই পড়। আমার অন্য কাজ আছে। এটা বলে সেও পালাইব। ভেবেই ফিক করে হেসে দিলাম। আব্বা চলে যাচ্ছিলেন। হাসি শুনে আমার দিকে ফিরে বললেন, আবার হাসিস ক্যান?
– আব্বা, ভাবতেসি।
– কি?
– কালকে কয়টা রসগোল্লা তোমার পেটে গেসে।
এই কথাতেই আব্বা চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে বললেন, এই, তোর আম্মুকে বলিস না। আসলে দেখে আর লোভ সামলাতে পারি নাই।
– আমি বুঝি, চিন্তা কোরো না, আমার দিক থেকে এই কথা লিক হবে না।
কথায় বলে না যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। হঠাৎ কোথায় থেকে আম্মা এসে হাজির। আমার কথার শেষ অংশ শুনেই বললেন, কি লুকাইতেসো বাপে ঝিয়ে মিলা। আব্বা কিছু বলার আগেই বললাম, কালকে কয়টা রসগোল্লা খাইসে সেই সংখ্যাটা বলতে মানা করতেসিলো। আমিও বলসি আমার থেকে এই কথা লিক হবে না। আব্বা সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হাঁড়ি হাটে ভেঙে গেসে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার খেয়েছো!? তোমার না ডায়াবেটিস। ব্যাস শুরু আম্মার ভাষণ। আমিও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল আর শিখতে লাগলাম। ভবিষ্যতে ক্রাশকে এভাবে বলতে হবে না!? ভেবে এবার আটাশটা দাঁত বের করে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি দেইখা আব্বা আম্মা ঝগড়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকাই রইল। যেন আমি তাদের মেয়ে না কোনো আজব চিড়িয়া চলে আসছে আমাদের ঘরে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমার হাসি বন্ধ হইয়া গেল। আমি পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
.
.
.
.
দিন দিন তার প্রতি দুর্বল হইতে লাগলাম। ক্রাশের প্রতি আমার হূদয় ক্রাশিত হইতে লাগিল। আমিও হাল ছাড়ার পাত্রী নই। আমি যখন তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ খুঁজতেসি তখন সুযোগ নিজেই আমার কাছে এসে কইল, ছোঁয়া, তোর দুঃখে দুঃখিত হইয়া নিজেই চলে আসলাম তোর কাছে। একদিন আন্টি আমাদের পিঠা দিতে আসলেন। আমি তো পিঠার সেই লেভেলের ফ্যান। আমাকে কেউ সারাদিন পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করলে ওগুলো শেষ না করা অবধি আমার দুই পা দরজার দিকে নড়ে না। আমাকে যদি বলে তোকে পিঠাওয়ালার কাছে বিয়া দি দিমু তাইলে হাসতে হাসতে রাজি। তবে সেটা আগের কথা। এখন আমার জামাই আছে, মানে হবু জামাই আছে। এখন পিঠাওয়ালাকে বিয়া করা আমার জন্য জায়েজ নাই। যাই হোক, আন্টি মাত্র পিরিচটা রাখতেই আমি পিঠার সুগন্ধে মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে বসার রুমে চলে এলাম। গিয়ে দেখি পিঠাগুলো আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকাই আছে। কিন্তু আন্টির সামনে নিতে পারতেসি না। হবু শাশুড়ী বলে কথা। যদি দেখে ছেলের বউ রাক্ষসের মতো পিঠা গিলতেসে তাইলে আর জীবনেও ক্রাশ রে এই মুখো হতে দিবে না। আমি খালি পিঠার দিকে তাকাইতেসি আর চরকির মতো আন্টি আর আম্মার চারপাশে ঘুরতেসি। কি কপাল!!! আমার সাধের পিঠা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাই আছে আর আমিও বুভুক্ষের মতো তাকাই আছি। আম্মা আমার হাবভাব দেইখা কইল, কি রে, কিছু বলবি?
– না।
আম্মা বলল, যা তো ছোঁয়া, তরকারির লবণ দেখে আয়।
আমি মুখ কালো করে রান্নাঘরে চলে এলাম। আরেকটা বিরক্তির কাজ। আমি যতদিন লবণ দেখসি ততদিন আম্মার একটা লম্বা ভাষণ শুনতে হইসে। হায় রে ক্রাশ!!! তোমার জন্য আমার মুখ এখন মিষ্টি না করে নোনতা করতে হবে। কোথায় আরাম করে পিঠা খাইতাম তার জায়গায় তরকারির ঝোল খাইতেসি। আমি লবন দেখে নিজের রুমে চলে এলাম। আম্মা আর আন্টি গল্প করতেসে। আমার ইচ্ছা করতেসে মনের দুঃখে গান গাই। কিন্তু আন্টি কি আমার গলা সহ্য করতে পারবে? কয়েক মুহূর্ত উপরের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করলাম। তারপর ভাবলাম, আমারে পিঠা খাইতে দিতেসে না, বইসা বইসা রসের আলাপ করতেসে। এইটুকু প্যারা তো দেওয়াই যায়। মাত্র গলা পরিষ্কার করে গান গাইব, এমন সময় আমার কান ওনাদের গল্পের দিকে চলে গেল। আমি ঠিক শুনছি? আমার ক্রাশ গাজরের হালুয়ার উপর ক্রাশ? ভালো করে শুনে দেখলাম ঠিকই শুনসি। শুনে আমি কপাল চাপড়াইলাম। আমার ক্রাশের সব সময় আমার অপছন্দের জিনিসগুলাই পছন্দ কেন? আমি গাজর দুই কেন চাইর চোক্ষে দেখতে পারি না। আর সেই গাজরের হালুয়া আমার ক্রাশ খায়। এবার আমার কান্দন আইতেসে। আন্টি কথা বলে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি আম্মার ফোনে আব্বাকে ফোন করে কইলাম, আব্বু এক কেজি গাজর আনবা। আব্বা আমার কথা শুনে হার্টফেইল করল কি না বুঝলাম না। কারণ ফোনের ওপাশে নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত নাই। আমি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করতেই আব্বা বলল, তোর শরীর ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ। মনে করে আনবা কিন্তু, পারলে দুই কেজি আনিও।
তারপর আর কথা নাই। আমি তাকাই দেখলাম ফোন কেটে দিসে। আমি ভাবি কি হলো!? ফোনে তো টাকা আছে, তাহলে মনে হয় আব্বা কেটে দিসে। থাক গা। আমি চার হাত পা মেইলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গাজরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন যে ঘুমাই পড়ছিলাম টের পাই নাই। হঠাৎ তাকাই দেখি আব্বা আম্মা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাই আছে। আমি ইশারায় বললাম কি? ওনারাও ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কি? আমিও আবার জিগাই, তারাও জিগায়। এভাবে কি কি খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে উঠে বললাম, কি হইসে? আব্বা আমার কপালে হাত দিয়ে বললেন, চল ডাক্তারের কাছে।
– হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাবো কেন?
– শরীর ঠিক নাই।
আমার শরীর অথচ আমিই জানি না আমার শরীর খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুই কেজি গাজর আনসো? আব্বা আম্মা একে অপরের দিকে তাকাই আছে আর আমি তাদের দিকে। আমি ডায়নিংয়ে গিয়ে দেখলাম একটা কালো পলিথিনে কিছু গাজর উঁকি ঝুঁকি দিতেসে। আমি নাক কুঁচকে একটা মোটকা দেখে গাজর ধুয়ে নিয়ে সোফায় বসলাম। আব্বা আম্মা অবাক হয়ে আমার কান্ড কারখানা দেখতেসে। আমি গাজরে একটা কামড় দিতেই দুইজনে আঁতকে উঠল।
চলবে…